1 of 2

ধ্বংসযজ্ঞ – ৩৩

তেত্রিশ

রেলিঙের কাছে ছুটে এসেছে লামিয়া। বিস্ফারিত চোখে তাকিয়ে রইল আলোড়িত পানির দিকে, কয়েক সেকেণ্ড আগেও ওখানে ভাসছিল রানার সাবমারসিবল।

‘না!’ ভাঙা গলায় চেঁচাল ও। ‘না-আ-আ!’

পিছিয়ে এসে ডেকের ওপর হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল ও। নিঃশব্দে কাঁদতে শুরু করেছে। থেকে থেকে কেঁপে উঠছে কাঁধদুটো।

বাঁকা চোখে ওর দিকে তাকাল কর্টেজ। বিদ্রূপের সুরে বলল, ‘বড়ই হৃদয়-বিদারক দৃশ্য।’

হেঁটে লামিয়ার কাছে এল সে। এক হাঁটু গেড়ে নিচু হলো ওর সামনে। হাত দিয়ে চিবুক ধরে উঁচু করল মুখটা, যতক্ষণ না চোখাচোখি হয় দু’জনের।

‘কষ্ট পেয়ো না, লক্ষ্মী,’ বলল সে। ‘তোমাকে নিয়ে চমৎকার সব প্ল্যান আছে আমার। আশা করি উপভোগ করবে।’

তীব্র ঘৃণায় বিকৃত হয়ে গেল লামিয়ার মুখ। থুতু ছুঁড়ল ও। ঝট্ করে মাথা সরিয়ে নিল কর্টেজ, পুরোপুরি বাঁচতে পারল না, মুখের একপাশে এসে পড়ল থুতুটা। উঠে দাঁড়াল, রুমাল বের করে মুছল মুখ।

‘মেয়েগুলো সব এক রকম, থুতু দেয়া ছাড়া আর কিছু জানে না,’ বিরক্ত গলায় বলল সে। তারপর একটা লাথি মারল লামিয়ার বুকে। চিৎ হয়ে পড়ল ও। সেদিকে আর তাকাল না কর্টেজ। পাইলটহাউসের দিকে ফিরে নির্দেশ দিল, ‘ইঞ্জিন চালু করো।’

কয়েক মুহূর্ত পরেই গর্জে উঠল শক্তিশালী ইঞ্জিন। চলতে শুরু করল ইয়ট।

রুফাস এগিয়ে এল কর্টেজের দিকে। চেহারায় মেঘ, জমেছে। মার্সেনারি দলের সদস্য নয় সে, প্রেসিডেন্ট আকুম্বার খাস লোক। কর্টেজের ওপর নজর রাখার জন্যে পাঠানো হয়েছে তাকে।

‘আপনার সঙ্গে কথা আছে,’ কাছে এসে বলল সে।

‘কী কথা?’ নিরাসক্ত গলায় বলল কর্টেজ।

‘হ্যাণ্ডকাফের চাবিটা দিয়ে এলেন কেন? ওরা যদি বেঁচে যায়?’

নিঃশব্দে হাসল কর্টেজ। ‘বেঁচে গেলে তো ভালই হয়, তাতে ব্যাপারটা আরও উপভোগ্য হয়ে উঠবে,’ বলল সে। ‘তবে অযথাই চিন্তা করছ। বাঁচতে পারবে না ওরা… মানে, দু’জনেই বেঁচে যাবে, তা অসম্ভব।’

‘একজনকেই বা বাঁচার সুযোগ দিচ্ছেন কেন?’

‘কারণ মৃত্যুই একমাত্র শাস্তি নয়, রুফাস। মানুষকে বাঁচিয়ে রেখেও মৃত্যুর চেয়ে কঠিন শাস্তি দেয়া যায়।’ কর্টেজের গলায় দার্শনিকের সুর। আত্মতৃপ্তিতে ভুগছে রানাকে শাস্তিটা দিতে পেরে। একদিন রানাও তাকে একইভাবে ভুগিয়েছিল। ‘যাক গে, তোমার ছোট মাথায় এসব বড় বড় কথা ঢুকবে না। যাও, নিজের কাজে যাও।’

ঘুরে চলে যেতে উদ্যত হলো সে, খপ্ করে তার হাত আঁকড়ে ধরল রুফাস। ‘কাজটা ঠিক করেননি। আমি প্রেসিডেন্ট আকুম্বাকে এ-ঘটনা জানাব। নিশ্চিত থাকুন, তিনি মোটেই খুশি হবেন না এতে।’

শীতল চোখে তার দিকে তাকাল কর্টেজ। ‘কাজটা আমি কাউকে খুশি করার জন্যে করিনি।’

‘তা হলে কেন করলেন? এর পেছনে আমি কোনও খুঁজে পাচ্ছি না।’

‘আমার প্রতিটা কাজের পেছনেই যুক্তি থাকে… কারণ থাকে,’ বলল কর্টেজ। ‘দেখতে চাও? এই দেখো, সবার সামনে উদাহরণ সৃষ্টির জন্যে আমি কী করি।’

চোখের পলকে কোমর থেকে একটা পিস্তল তুলে আনল সে। রুফাসের কপালে ঠেকিয়ে টিপে দিল ট্রিগার। কোনও আওয়াজ করল না আফ্রিকান লোকটা, একটুও কাঁপল না, স্রেফ বিস্ফারিত হয়ে গেল চোখের দৃষ্টি। টলমল পায়ে কয়েক কদম পিছিয়ে গেল সে, রেলিঙে গিয়ে ঠেকল, এখনও প্রাণ বেরিয়ে যায়নি। আবার গুলি করল কর্টেজ। বুকে লাগল বুলেট, সেই ধাক্কায় নিচু রেলিঙের ওপর দিয়ে উল্টোদিকে ডিগবাজি খেল দেহটা। পড়ে গেল পানিতে।

ইয়ট এগিয়ে গেলে দেখা গেল লাশটা—পরনে লাইফজ্যাকেট থাকায় ঢেউয়ের মাঝে ডুবছে-ভাসছে। কপাল আর বুকের ক্ষত থেকে বেরিয়ে আসা রক্ত মিশছে পানিতে।

পিস্তলটা কোমরে গুঁজে সঙ্গীদের দিকে ফিরল কর্টেজ। গলা চড়িয়ে বলল, ‘আমার নেতৃত্ব নিয়ে আর কারও কোন প্রশ্ন থাকলে স্বচ্ছন্দে এগিয়ে আসতে পারো।’

বলা বাহুল্য, তাকে চ্যালেঞ্জ করতে এল না কেউ। ইয়টের পাইলটকে হুকুম দিল সে, ‘স্পিড বাড়াও।’

ইঞ্জিনের গর্জন বেড়ে গেল। দুরন্ত বেগে ছুটতে শুরু করল ইয়ট। ওটাকে অনুসরণ করছে পাওয়ারবোটদুটো। পেছনে রেখে আসছে সাদা ফেনার রেখা।

.

ত্রিশ ফুট তলিয়ে গেছে হ্যামারহেড, নামছে ক্রমাগত। কানের ওপর বাড়ছে পানির চাপ, হারিয়ে যাচ্ছে সূর্যের আলো। এ-অবস্থায় স্বাভাবিকভাবে যা জাগে… মানে, আতঙ্ক আর উন্মাদনা… সেসব দমিয়ে মাথা ঠাণ্ডা রাখার চেষ্টা করছে রানা। চেষ্টা করছে একটা প্ল্যান গুছিয়ে নেবার।

চোখে গগলস্ না থাকায় ঘোলাটে দেখাচ্ছে চারপাশে, পানির রঙ হয়ে উঠেছে হলদেটে সবুজ। রানা বুঝল, হ্যামারহেডের বাতিগুলো এখনও জ্বলছে। রাইফেলের গুলিতে অচল হয়ে যায়নি ইলেকট্রিক্যাল সিস্টেম। মুরল্যাণ্ডকেও সাধুবাদ জানাতে হয়-ক্যানোপি খোলা থাকায় লোনা পানি হামলা করেছে কন্ট্রোল প্যানেলে, তা-ও কিছু হয়নি। পুরো সিস্টেমটা পানি-নিরোধীভাবে বানিয়েছে ও।

নিজেদের পজিশনের ব্যাপারে মোটামুটি ধারণা আছে রানার… আন্দাজটা যদি ঠিক হয়, একশো বিশ ফুট নিচে রয়েছে সাগরের মেঝে। ওখানে পৌঁছুনোর পর শুরু হবে ওর কাজ। সফল হবার সম্ভাবনা খুব বেশি নয়, অনেক কিছুই থাকতে হবে নিজেদের অনুকূলে, এমনকী হ্যামারহেড কীভাবে ল্যাণ্ড করবে, সেটাও।

চোখ জ্বালাপোড়া করছে লোনা পানিতে, তাও চোখের পাতা মুদল না রানা। তীক্ষ্ণদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে নিচে। তলদেশে আছড়ে পড়ার দশ সেকেণ্ড আগে আলোকিত হয়ে উঠল কাদা আর পাথরে ভরা জমিন। প্রত্যাশার চেয়ে দ্রুত উঠে আসছে ওগুলো। শরীর শক্ত করে ফেলল ও।

সজোরে সাগরের তলায় আছড়ে পড়ল সাবমারসিবল। প্রচণ্ড ঝাঁকিতে শরীরের সব হাড়গোড় নড়ে যাবার দশা। কিন্তু এক মুহূর্ত দেরি করল না রানা। হাত এখনও লিফট বারে আটকানো, দোল খেয়ে শরীরের বাকি অংশ বের করে আনল ককপিটের বাইরে, পা রাখল মাটিতে। আড়চোখে লক্ষ করল, ওর দেখাদেখি মুরল্যাণ্ডও একই কাজ করছে।

বাঁচার একটাই উপায় রয়েছে ওদের সামনে–একটা এয়ার পকেট চাই। সেজন্যে উল্টে ফেলতে হবে হ্যামারহেডকে। ককপিটের খাঁজটা তখন একটা উল্টানো বালতির মত কাজ করবে, এয়ার সিলিণ্ডার থেকে বাতাস ছেড়ে ভরতে হবে সে-খাঁজ, তৈরি করতে হবে প্রত্যাশিত এয়ার পকেট।

সাবমারসিবলটাকে উল্টানোই সমস্যা। পেছনদিকটায় রয়েছে সমস্ত যন্ত্রপাতি—ইঞ্জিন, ইমপেলার, বাতাসের সিলিণ্ডার, ইত্যাদি। এক পাশ থেকে উল্টাতে চাইলে ওগুলো- সহ উল্টাতে হয়। কাজটা কঠিন। সহজ উপায় হলো, পেছনদিকটাকে মাটিতে রেখে নাকটা তুলে ফেলা… উল্টো ডিগবাজি দেয়া। দু’পাশ থেকে ধরতে পারলে সেটা সহজেই করে ফেলা যেত, কিন্তু লিফট বারে আটকা পড়ায় একপাশ থেকে ঠেলতে হবে ওদেরকে।

তা-ই সই, ভাবল রানা। কোনোমতে খাড়া করে ফেলতে পারলে বাকিটা ওজনের টানেই সেরে ফেলা যাবে। মুরল্যাণ্ডকে ইশারা দিয়ে টানতে শুরু করল নাকটা। সময় নেই একেবারে, দম ফুরিয়ে আসছে দু’জনেরই। মাটিতে পা সেঁধিয়ে দিয়ে সর্বশক্তিতে টানতে থাকল ওরা।

আস্তে আস্তে উঁচু হলো নাকটা, সাবমারসিবলের গোটা কাঠামো খাড়া হলো লেজের ওপর ভর দিয়ে। এবার তলায় হাত দিয়ে একটা ধাক্কা দিল রানা ও মুরল্যাণ্ড। উল্টে গেল হ্যামারহেড, তবে পুরোপুরি নয়। পেছনদিকে যে একটা বড় পাথর আছে, তা খেয়াল করেনি ওরা। সেটার ওপরে গিয়ে পড়ল নাকটা। তবে যতটুকু উল্টেছে, ততটুকুই সই। তাড়াতাড়ি উল্টানো ককপিটের ভেতরে শরীর ঢুকিয়ে দিল দু’জনে।

এয়ার রিলিজ ভালভে হাত পৌঁছচ্ছে না, পা ব্যবহার করল রানা। জুতোর ডগা দিয়ে গুঁতো দিল কন্ট্রোল প্যানেলে। এবার আতঙ্কিত হলো রানা, পারছে না ভালভটা খুলে দিতে। উল্টোপাল্টা সুইচে পড়ছে চাপ। বাতিগুলো নিভে গেল হঠাৎ, গাঢ় অন্ধকারে ছেয়ে গেল চারপাশ। আরেক গুঁতো দিতেই জ্বলে উঠল ফের।

প্রতিটা মুভমেন্টে দুর্বল হয়ে আসছে রানার দেহ, মাথা কাজ করতে চাইছে না। ফুসফুসে অসহ্য জ্বলুনি। নিঃশ্বাস আর আটকে রাখতে পারছে না। ইচ্ছে করছে হাঁ করে টেনে নেয় পানি, মিটিয়ে দেয় সব জ্বালা-যন্ত্রণা। স্রেফ বেঁচে থাকার তীব্র আকুতি সচল রেখেছে ওকে।

এতকিছুর পরেও সব চেষ্টা ব্যর্থ হলো। চোখের সামনে নামতে শুরু করল একটা কালো পর্দা। কিন্তু তখুনি পানিতে বুদের আলোড়ন দেখতে পেল ও। প্রথমে সব ঝাপসা দেখাল, তারপর লক্ষ করল, মাথার ওপরে তৈরি হচ্ছে একটা এয়ার পকেট। খুব বড় নয়, এক ফুটের মত। তবে কে ওসব নিয়ে মাথা ঘামায়। বকের মত গলা বাড়িয়ে দিল ও, মাথা ঢুকিয়ে দিল বাতাসের ছোট্ট আশ্রয়টায়। বুকে আটকে রাখা কার্বন ডায়োক্সাইড ছাড়ল, কেশে উঠল সঙ্গে সঙ্গে। নাকে- মুখে ঢুকে গেল লোনা পানি। তারপরেও অদ্ভুত এক স্বস্তি অনুভব করছে।

সুস্থির হয়ে ঘাড় ফেরাল রানা। দেখতে পেল মুরল্যাণ্ডের হাসিমাখা মুখ।

‘ক্…কীভাবে….’

প্রশ্নটা ওকে শেষ করতে দিল না মুরল্যাণ্ড। শরীর বাঁকিয়ে একটা পা তুলে আনল। জুতো-মোজা কিচ্ছু নেই, কোন্ ফাঁকে যেন খুলে ফেলেছে।

‘সহজ একটা কাজ,’ বলল সে। ‘বাথটাবে শুয়ে শুয়ে পা দিয়ে কল বন্ধ করোনি কখনও?’

‘জুতো খোলার কথা মাথায় আসেনি,’ স্বীকার করল রানা। ‘ঠিকমত চিন্তা করতে পারছিলাম না কিছু।’

‘নিশ্চয়ই বাতাসের ঘাটতি দেখা দিয়েছিল,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘পানিতে ডুব দেবার আগে আধ-পাগল খুনির সঙ্গে অযথা বাতচিত করতে গেলে এ-ই হয়।’

হাসল রানা। কথাটা অবশ্য ভুল বলেনি মুরল্যাণ্ড। কর্টেজের সঙ্গে কথা না বলে বেশি বেশি করে দম নেয়া উচিত ছিল ওর।

‘কখনও ভাবিনি তোমার ওই গরিলার মত পাদুটো আমার জীবন বাঁচাবে,’ বলল ও। ‘দারুণ দেখালে!’

‘অপমান করলে, না প্রশংসা করলে, ঠিক বুঝতে পারছি না,’ গোমড়ামুখে বলল মুরল্যাণ্ড। তারপর সিরিয়াস হলো। ‘সবগুলো ভেণ্ট খুলে দিয়েছি। ককপিট থেকে পানি সরাবার জন্যে কাজ করছে হ্যামারহেডের সিস্টেম। কিছুক্ষণ টিকতে পারব, সন্দেহ নেই, তবে খুব বেশি সময় নয়। বিশ মিনিটের মধ্যে খালি হয়ে যাবে এয়ার সিলিণ্ডার।’

মাথা ঝাঁকিয়ে চারপাশে নজর বোলাল রানা। বাঁকা হয়ে আছে হ্যামারহেড, এয়ার পকেটে ও আর মুরল্যাণ্ড মোটামুটি সহজে ঘাড়-মাথা ঢোকাতে পারলেও হাত রয়ে গেছে বাইরে—লিফট বারের সঙ্গে হাতকড়া বাঁধা

হাতকড়া বাঁধা অবস্থায়। ওপরদিকে, ককপিটের একটা কোনা দিয়ে বুদ তুলে বেরুচ্ছে বাতাস। বড় করে একটা শ্বাস নিয়ে ডুব দিল ও, মাথাটা নিয়ে গেল ককপিটের বাইরে। হলদে-সবুজ আলোয় দেখতে পেল সাবমারসিবলের গায়ে বিঁধে থাকা ছুরিটা, সুতো দিয়ে প্যাচানো হ্যাণ্ডকাফের চাবিটা এখনও আটকে আছে ওটার হাতলে।

মুক্তির এমন একটা উপায় কেন ওদেরকে উপহার দিয়েছে কর্টেজ, জানে না রানা। হয়তো এটা তার একটা খেলা, কিংবা অন্য কিছুও হতে পারে। তবে সেসব নিয়ে পরোয়া করছে না ও। হাতের নাগালে নেই ছুরিটা, ওটাকে ধরার কায়দা একটাই। মুরল্যাণ্ডের মত পা থেকে জুতো খুলে ফেলল ও, মোজাও। এরপর পা-টা বাড়িয়ে দিল ছুরির দিকে।

প্রথম চেষ্টায় পৌঁছুল না পা। ককপিটে ফিরে শ্বাস নিল ও, এরপর দ্বিতীয় প্রচেষ্টার জন্যে ডুব দিল আবার। পুরো শরীর প্রসারিত করে ছুঁড়ল পা। এবার স্পর্শ পেল ছুরিটার। পায়ের আঙুল বোলাল ওটার গায়ে। সুতোটা ছুরির হাতল থেকে ঢিলে হয়ে ভাসছে, আঙুলে পেঁচিয়ে ফেলল ওটা। তারপর অন্য পা দিয়ে লাথি মারল ছুরিতে। এক লাথিতে কাজ হলো না, দ্বিতীয়… তৃতীয় লাথি খেয়ে খোল থেকে আলগা হলো ছুরি, খসে পড়ল নিচে। পায়ের আঙুল বাঁকা করে ফেলল রানা, সুতোটাও যেন ছুরির সঙ্গে পড়ে না যায়।

কয়েক মুহূর্ত পর ককপিটের বাতাসে মাথা ঢোকাল ও। ঘন ঘন শ্বাস ফেলছে। মুরল্যাণ্ডের জিজ্ঞাসু দৃষ্টির জবাবে ভাঁজ করে এক পা তুলে আনল ওপরে—আঙুলের ফাঁকে ঝুলছে সুতোয় বাঁধা চাবি।

‘চমৎকার!’ প্রশংসার সুরে বলল মুরল্যাণ্ড। ‘গরিলার পায়ের কাজ তো এবার তুমি দেখালে!’

‘ধন্যবাদ,’ বলল রানা। ‘তবে এই পা দিয়ে আমরা কেউই হ্যাণ্ডকাফের তালা খুলতে পারব না।’

‘তোমার ওপর আমার আস্থা আছে, দোস্ত।’

মাথা ঝাঁকাল রানা। শ্বাস নিয়ে আবার বেরিয়ে গেল ককপিট থেকে। বাইরে পৌঁছে কসরত শুরু করল শরীরের—কোমর ঘুরিয়ে, হাঁটু মুড়ে পায়ের পাতা নিয়ে আসতে চাইছে হাতের কাছে। একটু সময় লাগল, তবে সফল হলো শেষ পর্যন্ত। পায়ের আঙুল থেকে সুতোয় বাঁধা চাবিটা নিয়ে নিল হাতে, এরপর মাথা ঢুকিয়ে দিল এয়ার পকেটে। ফোঁস ফোঁস করে শ্বাস ফেলছে।

‘পেরেছ ছুটতে?’ জানতে চাইল মুরল্যাণ্ড।

‘এখনও না,’ হাঁপাতে হাঁপাতে বলল রানা। ‘জাদুকরদের মত পানির তলায় তালা খুলতে অভ্যস্ত নই কিনা। একটু ধৈর্য ধরো।’

ককপিটের ভেতর থেকে হাতদুটো দেখতে পাচ্ছে না রানা। আঙুল দিয়ে হাতড়ে খুঁজে বের করল হ্যাণ্ডকাফের চাবির ফুটোটা। ওখানে চাবি ঢোকানোর সময় খুব সতর্ক রইল, হাত থেকে চাবিটা পড়ে গেলেই সর্বনাশ! খাঁজের ভেতর জিনিসটা বসে যাবার পরেও ঢিল দিল না পেশিতে। খুব সাবধানে ঘোরাল চাবি।

পানির নিচে বলে কোনও শব্দ শোনা গেল না, তবে আচমকা রানা টের পেল, বাম হাতের কবজি থেকে আঁটসাঁট ভাবটা দূর হয়ে গেছে। খুলে গেছে হ্যাণ্ডকাফ! তাড়াতাড়ি হাতটা মুক্ত করল ও। ডান হাতে এখনও আটকে আছে হ্যাণ্ডকাফের অন্যপাশের কড়াটা, তবে টান দিতেই জিনিসটা পিছলে চলে গেল লিফট বারের তলা দিয়ে।

‘পেরেছি!’ মুক্ত দুই হাত পানি থেকে তুলে আনল রানা। অনাবিল হাসিতে ভরে উঠেছে মুখ।

‘আমি মুগ্ধ,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘পরের জাদুটা কী?’

‘সান্তা মারিয়ায় ওদের বক্সিং প্রতিযোগীকে পৌঁছে দেব।’

‘আবার ওই দৈত্যটার মুখোমুখি হবার জন্যে?’ কপট আতঙ্ক দেখাল মুরল্যাণ্ড। ‘তারচেয়ে এখানে মরে যাওয়াই বোধহয় ভাল।’

হেসে ফেলল রানা। চাবি দিয়ে ডান হাত থেকেও খুলে ফেলল হ্যাণ্ডকাফ। তারপর বেরিয়ে গেল ককপিট থেকে। তাড়া অনুভব করছে। পানির তাপমাত্রা ষাট ডিগ্রির বেশি নয়, দ্রুত কাজ না সারলে হাইপোথারমিয়ায় আক্রান্ত হবে ওরা। মুরল্যাণ্ডের হ্যাণ্ডকাফটা ধরে ফুটোতে ঢুকিয়ে দিল চাবি। পরমুহূর্তে থমকে গেল। ঘুরছে না চাবিটা। বের করে আবার ঢোকাল। লাভ হলো না। চাবিটা খুলে ফিরে এল এয়ার পকেটে।

‘আমি এখনও বন্দি,’ ওকে বলল মুরল্যাণ্ড।

‘জানি,’ রানা বলল। চাবিটা চোখের সামনে তুলে ভাল করে দেখছে। ‘একটু সময় দাও আমাকে।’

শ্বাস নিয়ে ফের ডুব দিল ও। একে একে দু’হাতের কড়াতেই ঢোকাল চাবি। হা-হতোস্মি, এক চুল ঘুরল না চাবিটা। আর তখুনি কর্টেজের কথা মনে পড়ল রানার। অর্ধেক পুরস্কারের কথা বলছিল সে… তখন হেঁয়ালির মত লেগেছিল কথাটা, এখন তার অর্থ পরিষ্কার।

দু’জন বন্দি, দুটো হ্যাণ্ডকাফ, কিন্তু চাবি একটা। অর্ধেক পুরস্কারই বটে।

সত্যটা উপলব্ধি করে তেতো ঠেকল রানার মুখের ভেতরটা। নিষ্ঠুর একটা খেলা খেলছে কর্টেজ। প্রায় অসম্ভব একটা পরিস্থিতিতে রানাকে বাঁচার একটা ক্ষীণ সুযোগ দিচ্ছে… কিন্তু সেটা এমনই এক সুযোগ, যা কোনোদিন রানার পক্ষে নেয়া সম্ভব নয়। মানসচোখে লোকটার চেহারা দেখতে পেল ও, হাসছে ওর দিকে তাকিয়ে। পুরাণের এক অপদেবতা যেন সে—রানাকে উপহার দিচ্ছে জীবন, কিন্তু সে-উপহার গ্রহণ করতে চাইলে পরিত্যাগ করতে হবে প্রিয় বন্ধুকে, তাকে সঁপে দিতে হবে মৃত্যুর মুখে। যা-ই করুক রানা, শেষ পর্যন্ত জিত তারই হচ্ছে। মুরল্যাণ্ডকে যদি ফেলে যায় রানা, কোনোদিন ক্ষমা করতে পারবে না নিজেকে; যতদিন বাঁচবে, জ্বলবে অসহ্য যন্ত্রণায়। এর চেয়ে বড় শাস্তি আর কী হতে পারে? আর যদি না যায়…

গা ঝাড়া দিয়ে চিন্তাটা দূর করল রানা। না, এত সহজে হার মানতে রাজি নয় ও। দম ফুরিয়ে আসছে, তাই ফিরে গেল মুরল্যাণ্ডের পাশে।

‘কী করতে হবে, তা নিয়ে বোধহয় তোমার সন্দেহ আছে,’ স্বভাবসুলভ ভঙ্গিতে বলল মুরল্যাণ্ড। ‘আমার হাতদুটো খুলে দেবার কথা তোমার।’

‘একটা সমস্যা দেখা দিয়েছে,’ শান্ত গলায় বলল রানা। ‘চাবিটা কাজ করছে না।’

অর্থটা বোঝার জন্যে এক মুহূর্ত নিল মুরল্যাণ্ড। এরপরেই দুষ্টুমিমাখা ভাবটা দূর হয়ে গেল তার চেহারা থেকে। নিচু গলায় বলল, ‘আমারই ভুল। আমাকে হ্যাণ্ডকাফ পরানোর সময় ওরা যে অন্য একটা চাবি ব্যবহার করছিল, সেটা খেয়াল ছিল না।’

চাবিটা বুকপকেটে ঢুকিয়ে রাখল রানা। এরপর তল্লাশি চালাল ককপিটে। হ্যাণ্ডকাফটা ভাঙার মত কিছু পাওয়া যায় কি না দেখছে। এক জোড়া স্ক্রু-ড্রাইভার, এক সেট অ্যালেন রেঞ্চ, আর টুকিটাকি কিছু জিনিস পেল। সবই ছোট্ট সাবমারসিবলে আঁটানোর জন্যে ছোট করে তৈরি।

‘একটাও কাজের না,’ হতাশ গলায় বলল রানা। ‘চাড় দেবার মত বড় কিছু আছে?’

‘উঁহুঁ।’ মাথা নাড়ল মুরল্যাণ্ড।

‘লিফট বারটা? কোনোভাবে ওটা খুলে ফেলা যায় না?’

‘সাবমারসিবলের সবচেয়ে শক্ত অংশ ওটা, একেবারে ফ্রেমের সঙ্গে ঝালাই করে লাগানো। সবকিছু ভাঙলেও ওটা ভাঙা সম্ভব না।’

অপলকে বন্ধর দিকে তাকিয়ে রইল রানা।

‘আমাকে তুমি এখান থেকে নিতে পারছ না, রানা,’ গম্ভীর গলায় বলল মুরল্যাণ্ড।

‘আমি মানি না,’ গোঁয়ারের মত বলল রানা। ‘একটা না একটা উপায় আছেই।’ কাঁপছে ও-শুধু উত্তেজনায় নয়, ঠাণ্ডাটা হামলা চালাচ্ছে অস্থিমজ্জায়।

‘এখানে কাজে লাগাবার মত কিছুই নেই,’ বলল মুরল্যাণ্ড। ‘চলে যাও তুমি। এখানে বসে থেকে আমার সঙ্গে ডুবে মরার কোনও মানে হয় না।’

‘যাতে ভূত হয়ে পরে আমাকে জ্বালাতন করতে পারো তুমি?’ ঠাট্টার সুরে বলল রানা, পরিবেশটা হালকা করতে চাইছে। ‘না, ধন্যবাদ।’

‘আমি সিরিয়াস, রানা। চলে যাও। ওপরে কোনও বোট বা হেলিকপ্টার পেয়ে যেতে পারো। নেপচুন হয়তো আমাদের মেসেজটা রিসিভ করেছে।’

অতটা আশাবাদী হতে পারছে না রানা। তা ছাড়া মেসেজ পেলেই বা কী? লোহা কাটার সরঞ্জাম নিয়ে তো আর আসবে না কেউ। সেসব জোগাড় করে, নিচে নেমে মুরল্যাণ্ডকে উদ্ধার করতে অনেক সময় প্রয়োজন। অতক্ষণ টিকবে না ও। বাতাস ফুরিয়ে যাবে, ঠাণ্ডায় জমে যাবে।

না, যা করার করতে হবে ওকেই। কী প্রয়োজন, সেটা বুঝতে পারছে—করাত, কিংবা ব্লো-টর্চ… যাতে লিফট বার বা হ্যাণ্ডকাফটা কেটে ফেলা যায়। কিন্তু কোথায় পাবে ওসব? ভাবতে ভাবতে হঠাৎ বিদ্যুচ্চমকের মত একটা চিন্তা এল মাথায়। হ্যাণ্ডকাফের শেকল কাটার জন্যে পুরোদস্তুর ব্লো– টর্চের প্রয়োজন নেই আসলে; যথেষ্ট তাপ সৃষ্টি করতে পারে, এমন কিছু পেলেই চলে। মনে পড়ল, গতকাল লামিয়াকে উদ্ধার করার সময় কনস্টেলেশন বিমানটার ভেতরে একটা সবুজ রঙের সিলিণ্ডার দেখেছিল ও। সবুজ সিলিণ্ডার মানে বিশুদ্ধ অক্সিজেন, জানা আছে ওর। এ-ও জানে, বিশুদ্ধ অক্সিজেন পোড়ালে উজ্জ্বল আলো আর প্রচণ্ড তাপের সৃষ্টি হয়। ঠিকমত ব্যবহার করা গেলে ওই অক্সিজেন দিয়েই কাটিং টর্চ বানানো সম্ভব।

হাত চালাল রানা। ককপিটের একটা ছোট্ট খোপ থেকে বের করে আনল ইমার্জেন্সি সাপ্লাই। দুটো ডাইভার’স্ মাস্ক, দু’জোড়া ফিন, আর ছোট্ট দুটো এয়ার ট্যাঙ্ক আছে ওতে। ট্যাঙ্কদুটোয় বিশুদ্ধ অক্সিজেন ভরা থাকলে এখুনি কাজ হয়ে যেত। তবে কপাল খারাপ, ডাইভ দেবার জন্যে সাধারণ বাতাস ভরা হয়েছে ওতে— একুশ ভাগ অক্সিজেন আর আটাত্তর ভাগ নাইট্রোজেন, সঙ্গে অন্যান্য গ্যাস। এ-বাতাস পানির নিচে জ্বলবে না, তবে রানা যে-কাজে ব্যবহার করতে চায় তাতে সাহায্য করবে অনায়াসে।

খোপের ভেতর আরও কিছু জিনিস পাওয়া গেল। এক প্যাকেট ফ্লেয়ার, একটা ইমার্জেন্সি লোকেশন ট্রান্সমিটার বা ইএলটি, আর ভাঁজ করা একটা প্লাস্টিকের র‍্যাফট—দু’জন যাত্রী চড়ার উপযোগী। শেষ পর্যন্ত যদি ওরা সারফেসে পৌঁছুতে পারে, ওগুলোর সবক’টাই কাজে লাগবে।

একটা এয়ারট্যাঙ্ক মুরল্যাণ্ডের হাতে বেঁধে দিল রানা, রেগুলেটরটা সেট করে দিল মুখের পাশে। বলল, ‘ককপিটের বাতাস শেষ হয়ে গেলে এটা ব্যবহার কোরো।’

মাথা ঝাঁকাল মুরল্যাণ্ড। ‘ওপরে যাচ্ছ তুমি?’

দু’পায়ে ফিন লাগাচ্ছে রানা। ‘না হে। আমি হার্ডওয়্যারের দোকানে যাচ্ছি তোমার জন্যে একটা কাটিং টর্চ আনতে।

ভুরু কোঁচকাল মুরল্যাণ্ড। ‘তোমার মাথা-টাথা খারাপ হয়ে গেল নাকি?’

‘সে তো অনেক আগেই হয়েছে। তাই বলে পাগল হয়ে যাইনি।’

নিজের এয়ারট্যাঙ্কটাও হাতে বাঁধল রানা। চোখের ওপর টেনে দিল মাস্ক। ভালভ খুলে রেগুলেটরটা গুঁজল মুখে। ‘তুমি সিরিয়াস?’ নিশ্চিত হতে চাইল মুরল্যাণ্ড।

মাথা ঝাঁকাল রানা।

‘সেক্ষেত্রে আশা করছি বেশি দূরে যেতে হবে না তোমাকে।’

রানাও মনে মনে তা-ই প্রার্থনা করছে। কোথায় ডুবেছে ওরা, তা মোটামুটি জানে। এখান থেকে বিমানটার দূরত্ব খুব বেশি হবার কথা নয়। কিন্তু ধারণাটা ভুল হলেই মুশকিল।

ইশারায় মুরল্যাণ্ডের কাছ থেকে বিদায় নিল ও, তারপর ডুব দিয়ে বেরিয়ে গেল ককপিট থেকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *