ডক্টর – হেনরি সেলসার
এমপ্লয়মেন্ট অ্যাডভাইসার যথারীতি পেশাদারি শুভেচ্ছা বিনিময় করলেন। পেশাদারি দুনিয়ায় মাথা ঠান্ডা রেখে মুখের হাসিকে চিরস্থায়ী রাখার কৌশল বেশ ভালোভাবেই জানা আছে তাঁর। তাই সহাস্য মুখে তিনি বললেন– না না… আপনার মতো লোকের কিছু করা দরকার। বিশেষত, আপনার মতো উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তিদের তো বটেই। সর্বগ্রাসী যুদ্ধ হয়েছে তো নিশ্চয়ই, তাহলেও তো আমরা অসভ্য বর্বর হয়ে যাইনি। সত্যি বলতে কী, সর্বনাশা যুদ্ধের পরে বিশেষত শিক্ষকদের চাহিদা বহুগুণ বেড়ে গেছে!
ড. মেখাম দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলে চেয়ারে হেলান দিয়ে বসলেন। একটু চুপ করে থেকে বললেন, ব্যাপারটা ঠিক তা নয়, বুঝতে একটু ভুল হচ্ছে। সাধারণত শিক্ষক বলতে যা বোঝায় আমি ঠিক তা নই। আমি যে বিষয়ে অভিজ্ঞ, লেখাপড়া করেছি, সে বিষয়ের আজ আর কোনও চাহিদাই নেই। তবে আমি জানি মানুষ জানতে চায়… ওদের ঘাড়ে চাপানো যুদ্ধোত্তর ধ্বংসস্তূপ নিয়ে ওরা কী করবে, কেমন করে বাড়ি-ঘরদোর করবে, রাজমিস্ত্রির কাজ শিখবে কোথায়? কলাকুশলী যন্ত্রবিদ পাবে কেমন করে? গুঁড়িয়ে যাওয়া শহরগুলোকে কেমন করে আবার গড়ে তুলবে?… বন্ধ হওয়া যন্ত্রের কাজ শুরু হবে কেমন করে? তেজস্ক্রিয়ায় আক্রান্ত, অসুস্থ, অশক্ত হাড়-গোড়ভাঙা মানুষদের কেমন করে চিকিৎসা করবে? বোমায় পঙ্গু জনসাধারণের কৃত্রিম অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের প্রয়োজন। কিন্তু কে বা কারা কেমন করে তৈরি করবে… দৃষ্টিশক্তিলুপ্ত মানুষ কেমন করে স্বাবলম্বী হবে… বিকলাঙ্গ বিকৃতমস্তিষ্ক মানুষের কী হবে? এই সব সমস্যারই আশু প্রতিকার ওরা জানতে চায়, শিখতে চায়। আর সে কথা তো আপনার চেয়ে বেশি কেউ জানে না।
–কিন্তু এখানে কি আপনার মতো একজন বিশেষজ্ঞের কোনও ভূমিকা নেই ডক্টর? আপনার বিষয়ের কি কোনও চাহিদা নেই? আর একবার চেষ্টা…
–এবার হেসে ফেললেন ড. মেখাম।
–চেষ্টা যে আমি করিনি তা নয়। চেষ্টা করেছিলাম… মানুষকে আগ্রহী করার সব চেষ্টাই বারে বারে বিফল হয়েছে। জানেন, গত কুড়ি বছর ধরে ছাত্রদের একটা বিষয়েই শিক্ষা দিয়ে এসেছি… মেমারি অর্থাৎ স্মরণশক্তি মানুষের এক বিশেষ সম্পদ… আর এই স্মরণশক্তিকে যথাযথ ধরে রাখার কৌশল শেখানোই হল আমার কাজ। জানেন, ছ-ছ’টা বই লিখেছি আমি… বাজারেও বেরিয়েছিল। তার মধ্যে দুটো বই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঠ্য হয়েছিল। শান্তিচুক্তি হওয়ার বছরেই আমি আট সপ্তাহের এক বিশেষ কোর্স-এর জন্যে বিজ্ঞাপন দিয়েছিলাম… কিন্তু ফল কী হল জানেন? মাত্র একটা দরখাস্ত পেলাম। অথচ এটাই হল আমার প্রফেশন… এতদিন এটাই আমার কাজ ছিল। এই নতুন পরিবেশে আমি কী করব তা বুঝে উঠতে পারছি না… যুদ্ধোত্তর বিভীষিকা আর মৃত্যুর রাজত্বে আমার আর কোনও কাজ নেই… আমি একেবারে নিঃস্ব হয়ে গেলাম। এক বুকভাঙা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে গেলেন ড. মেখাম।
মুখে কোনও কথা নেই। আপনমনে নিচের ঠোঁট কামড়ে চলেছেন এমপ্লয়মেন্ট অফিসার। এ এক রীতিমতো চ্যালেঞ্জ… যুদ্ধোত্তর পৃথিবীতে বিশেষজ্ঞদের যথাযথ পুনর্বাসন নিয়ে নানান সমস্যা দেখা দেয় ঠিকই, কিন্তু তার সমাধানও পাওয়া যায়। কিন্তু ড. মেখামকে… নিজের মনেই চিন্তার ঝড় চলছে। ড. মেখাম থাকাকালীন কোনও সমাধানই তিনি খুঁজে পেলেন না। অবশেষে হতোদ্যম ডক্টর ধীরে ধীরে চেয়ার ছেড়ে দরজা দিয়ে বাইরে বেরিয়ে গেলেন। ওঁর সামনের দিকে ঈষৎ ঝুঁকে পড়া নুজ দেহটার দিকে তাকিয়ে ব্যথায় টনটন করে উঠল বুকটা। নিজের প্রতি এক অজানা ক্রোধ জমে উঠল। কিন্তু সেই রাতেই যুদ্ধের এক মর্মন্তুদ ভয়াবহ ঘটনার স্বপ্ন দেখে ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন অ্যাডভাইসার… রাতের পর রাত একই ঘটনার পুনরাবৃত্তি। শুধু উনি নন, যুদ্ধোত্তর পৃথিবীর সকলেই নিশাতঙ্কের শিকার। অন্ধকার ঘরে বিছানায় শুয়ে রইলেন। অ্যাডভাইসার… খোলা দুই চোখে কোনও দৃষ্টি নেই… মনের গভীরে চিন্তার ঝড় উঠেছে। ড. মেখামের হতোদ্যম চেহারাটা ভেসে উঠছে বারবার। অবশেষে ভোরেই সমাধানের হদিশ পেয়ে গেলেন তিনি।
ঠিক একমাস পরে সরকারি কাগজে ফলাও করে এক বিজ্ঞাপন ছাপা হল.. হুগো মেখাম, পিএইচডি
শুরু হচ্ছে আট সপ্তাহব্যাপী এক যুগান্তকারী কোর্স। ভুলে যাবার সহজ উপায় বা কেমন করে ভুলব। সেপ্টেম্বর ৯ তারিখে নাম লেখানো শুরু।
সঙ্গে সঙ্গে আশাতীত সাড়া মিলল।