কে ভালো – রে রাসেল

কে ভালো – রে রাসেল

ঠিক যেন ঊর্বশী… লাবণ্যময়ী যৌবনশ্রীমণ্ডিত অপূর্ব রূপসী। অবশ্য রূপসী না হলেও ঠি কোনও ক্ষতিবৃদ্ধি হত না। আসল ব্যাপার হল ঊর্বশী এক রমণী। এমন রমণী তো অনেক অনেক থাকতে পারে কিন্তু এই উর্বশী হল পৃথিবীর একমাত্র এবং শেষতম রমণী।

সতরাং পৃথিবীর একমাত্র আশাপ্রদীপকে ঘিরে তো পতঙ্গের ভিড় হবেই। রমণী জয়ের আশায় যুদ্ধ অমূলক নয়। পাণিপ্রার্থীর সংখ্যাও দু’জন মাত্র… কারণ এই দু’জনই পৃথিবীর সর্বশেষ দুই পুরুষ মানুষ। গোধূলিবেলায় কনে-দেখা ম্লান আলোয় দুই যুদ্ধোদ্যত পুরুষ… মরি কিংবা মারি… নারীরত্ব লাভের এছাড়া দ্বিতীয় পন্থা নেই। ধ্বংসপ্রাপ্ত পৃথিবীর ধূলিধূসরিত ইট-পাথর-সিমেন্ট-বালির ইডেনে কে হবে আদম এই প্রশ্নের মীমাংসা হয়ে যাবে।

–-ছিঃ, অস্ত্র ফেলে দাও. সমস্ত পৃথিবী আজ মৃত… আর মৃত্যুর প্রয়োজন নেই… এসো যুক্তি দিয়ে বিচার করি… বুদ্ধি দিয়ে প্রমাণ হোক… দুজনের মধ্যে কে বেশি যোগ্য পুরুষ! শান্ত কণ্ঠে বলে উঠল রমণী।

খঞ্জ এবং বিরলকেশ পুরুষ বলে উঠল– তাহলে বলি শোনো। আমার নাম জন… আমিই শ্রেষ্ঠ পুরুষ। অবশ্য এটা সত্যি যে, আমি শিশু নই… আমার দৃষ্টিশক্তিও ক্ষীণ হয়ে এসেছে… এক কানে আমি শুনতে পাই না… সর্দিকাশি আমার নিত্যসঙ্গী আর দাঁতগুলোও বাঁধানো… আমার জিনগুলো তেজস্ক্রিয়ায় কতটা ক্ষতিগ্রস্ত তা-ও সঠিক বলতে পারব না। তবে আমি শিক্ষিত, শিল্পকলায় পারদর্শী, আর আমার বয়সের কারণে আমার অভিজ্ঞতাও বেশি।

–বাঃ, বড় সুন্দর বলেছ জন। এবার তোমার কথা বল যুবক। মধুর কণ্ঠে রমণী বলে ওঠে।

একটু নড়েচড়ে দাঁড়ায় যুবক। দীর্ঘদেহী সুদর্শন।

–আমার নাম নাইন… আমি একেবারেই ওর মতো মানুষ নই। আমার পুরো নাম হল ৯৪৬৩৭.০০৫২৮… আমি অ্যান্ড্রয়েড… কিন্তু ওর তুলনায় আমিই শ্রেষ্ঠ পুরুষ।

হো হো করে হেসে ফেলে জন। শ্রেষ্ঠ পুরুষ! প্লাস্টিকের হাড়… রাসায়নিক রক্ত আর কৃত্রিম মাংসের সমষ্টি? তাই তো শুনেই হাসি পায়!

কোন যুক্তির ওপরে নির্ভর করে নিজেকে শ্রেষ্ঠ পুরুষ বলে দাবি করছ নাইন? মধুর হেসে রমণী প্রশ্ন করে।

গলা পরিষ্কার করে নিয়ে নাইন বলে তাহলে তো প্রথম থেকে শুরু করতে হয়… তবে রোস্ট আর অ্যান্ড্রয়েডদের ইতিহাস বলে বিরক্ত করতে চাই না।

–না না নাইন… ওসব তো জানা কথা… বাধা দেয় জন।

–বেশ, তবে আপনারা দু’জনেই জানেন যে, গত কয়েক শতাব্দীর অনলস প্রচেষ্টায় অ্যান্ড্রয়েড উৎপাদনের প্রভূত উন্নতি হয়েছে এবং…

–হা হা… সে তো সকলেই জানে। টেলিভিশন ক্যামেরার বদলে আমাদের চোখের মতো চোখ… না না… চোখ নয়… ছোট চোখের মতো টেলিক্যামেরা কাজ করে… দুই কাঁধ নাচিয়ে অবজ্ঞার সুরে বলে জন।

–না না… আরও উন্নতি হয়ে… আমাদের মতো ওদের চুল আর নখ বেড়ে ওঠে। যোগ করে রমণী।

–থামলেন কেন? বলুন… আমাদের মতোই বর্জ্যপদার্থ নিষ্ক্রমণের ব্যবস্থা আছে… আপনার সামনে এমন কথা বলার জন্যে খুবই লজ্জিত সুন্দরী… লজ্জিত ভঙ্গিতে ক্ষমা চেয়ে নেয় জন।

–না না… লজ্জার কী আছে… হাসির কোনও ফারাক নেই… অশ্রুও তো একই রকম… তাই না নাইন?

মৃদু হেসে রমণীকে সমর্থন করে নাইন… যথার্থ বলেছেন আপনি। উৎকর্ষ-বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে আমরাও অনেক বেশি মানুষ হয়ে উঠেছি.. তফাত নিশ্চয় কিছু আছে, কারণ মানুষের দেহ আর মস্তিষ্কের হুবহু নকল করা সম্ভব হয়নি… তবে অনেকাংশেই মানুষের চেয়ে আমরা উন্নত, যেমন ধরুন না… আপনাদের দাঁত পড়ে যায়… দাঁত বাঁধায়… নাক। বেঁকে যায়… চামড়া কুঁচকে যায়… চুল পেকে যায়… স্তন শিথিল হয়ে পড়ে… কর্মক্ষমতা হ্রাস পায়… তেজস্ক্রিয়তায় বিকলাঙ্গ হয়… অমানুষ হয়ে ওঠে। কিন্তু অ্যান্ড্রয়েডের ক্ষেত্রে এসবের কোনও প্রশ্নই ওঠে না… সেদিক দিয়ে বিচার করলে আমরা আরও বেশি মানুষ। হয়ে উঠছি।

–খুব ভালো বক্তৃতা হল, মস্ত বড় বড় হাই তুলে বলল জন।

–আসল কথা হল জন… আপনার বয়স হচ্ছে, বার্ধক্য আসছে… শরীরও অশক্ত হয়ে পড়বে… কিন্তু আমার শরীর কমপক্ষে আরও একশো বছর টিকবে… একটু যত্ন নিলে অনেক বছর। গায়ের জোরও আমার বেশি… শুধু কি তাই… চোখের দৃষ্টি আপনার থেকে অনেক ভালো… দু’কানও আমার ভালো.. এমনকি… না আর বাড়িয়ে লাভ নেই। নতুন পৃথিবী গড়ার সময়ে এই সমস্ত গুণের প্রয়োজন… তাই সব দিক থেকে বিবেচনা করলে আমিই যোগ্যতর পুরুষ। দুই হাত দু’পাশে প্রসারিত করে কাঁধ ঝাঁকিয়ে বলল নাইন।

–কিন্তু একটা বিষয়ে ভুলে যাচ্ছেন? জনের কণ্ঠে শ্লেষের আভাস।

প্রথম দিকে– না না… আমার কোনও ভুল হয়নি। আমরা অ্যান্ড্রয়েড… ল্যাবরেটরিতে অনেক পরীক্ষার পর একের পরে এক অংশ জুড়ে জুড়ে আমাদের সৃষ্টি করা হয়… এটা খুবই ব্যয়সাধ্য সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই। কিন্তু আজকের চিত্র সম্পূর্ণ ভিন্ন। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিবিদ্যায় অশেষ উন্নতির ফলে একদিকে যেমন আমাদের সৃষ্টির ব্যয় অনেক কমেছে, অন্যদিকে আমাদের এখন এমনভাবে তৈরি করা হচ্ছে যার ফলে আমরাই নতুন অ্যান্ড্রয়েড-এর জন্ম দিতে পারি। বস্তুতপক্ষে কোনও কোনও ল্যাবরেটরিতে আমাদের নিয়ে আরও অনেক গবেষণা হয়েছে… অবশ্য সেটা খুবই গোপনীয়– তার ফলে আমরা এখন প্রায় মানুষের সমকক্ষ… এমনকি মানুষকে আমরা বিয়েও করতে পারি!

থুঃ থুঃ করে একরাশ থুতু ফেলল জন… তারপর আমতা আমতা করে বলল- ছিঃ ছিঃ, রীতিমতো লজ্জাজনক ব্যাপার… মেশিনের সঙ্গে রক্তমাংসের বিয়ে? আগে তো কোনওদিন শুনিনি এমন কথা… কী বলতে চাইছেন পরিষ্কার করে বলুন তো? যৌনমিলন? সন্তান হবে? অ্যান্ড্রয়েড আর মানুষের মিলনে? শুধু অসম্ভব নয়… মিথ্যে, ডাহা ধাপ্পাবাজি।

–মিথ্যে নয়! এখন আর অসম্ভব বলে কিছু নেই… আমি যা বলছি একেবারে ধ্রুব সত্য। দৃঢ়প্রত্যয়ের সঙ্গে কথাগুলো বলল নাইন।

দুই প্রতিযোগীর মাঝে ঊর্বশী যেন কোনও প্রতিযোগিতার মূল্যবান প্রাইজ… বিলোল কটাক্ষে পেশিবহুল নাইনের দিকে ঘুরে দাঁড়াল সে। খুক খুক করে কাশতে শুরু করল জন… সর্দির প্রকোপ বেশ বেড়েছে… কাশতে কাশতে কথা বলার চেষ্টা করার সঙ্গে সঙ্গে হাতের ইশারায় থামতে বলল ঊর্বশী।

-–দেখুন সবদিক দিয়ে বিচার করে দেখলাম মাইনের কথাই ঠিক… ও-ই যোগ্যতর পুরুষ। আপনার জন্যে আমার দুঃখ হচ্ছে, কিন্তু কোনও উপায় নেই জন।

দীর্ঘনিঃশ্বাস ফেলল জন… কোনও কথা বলল না… কাশতে কাশতে ভাঙা বাড়ির আড়ালে চলে গেল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে একটা গুলির আওয়াজ হল– সঙ্গে সঙ্গে ধপাস করে পতনের শব্দ শোনা গেল।

-–বেচারা! জনের জন্যে দুঃখ হচ্ছে! ঊর্বশীর কণ্ঠে ব্যথার আভাস।

-–সত্যি… বেচারা জন! কিন্তু এই নিয়েই তো জীবন। উর্বশীর হাত ধরে ধ্বংসপ্রাপ্ত হোটেলের আধভাঙা ঘরের দিকে পা বাড়াল নাইন। ওটাই হবে ওদের বাসর ঘর।

–কী জানো… মনে মনে আমার ভয় হয়েছিল… জনের শিক্ষা আছে… অনেক বিষয়ে দক্ষতা আছে আর আছে ওর বুদ্ধি… এই সমস্ত বিচারে জনই এক নম্বর হবে ভেবেছিলাম।

–হ্যাঁ… প্রায় জিতে ফেলেছিল।

এবার আপনাকে খুলে বলি। আমি মিথ্যে বলেছি। নিজেকে অ্যান্ড্রয়েড বলে ছোট্ট একটা গুল মেরেছিলাম… এখন আর বলতে বাধা নেই…আমার নাম নাইন নয়… বিল আমার নাম… আর আমি একশোভাগই মানুষ।

–ঠিক এটাই ভেবেছিলাম! ধ্বংসস্তূপের আড়াল থেকে বাইরে বেরিয়ে এল জন। মুখে জেতার আনন্দ।

–শুধু মিথ্যে কথা নয়… নির্বুদ্ধিতার পরিচয় দিয়েছেন। বোকা না হলে গুলির শব্দ শুনেই ভেবে নিলেন আত্মহত্যা করেছি। এবার ঊর্বশীর দিকে ফিরে বলল–কী হল সুন্দরী এমন এক মিথ্যেবাদীকেই জীবনসঙ্গী হিসেবে বেছে নেবেন? যে লোকের নীতির বালাই নেই! রক্তমাংসের শরীর হলে কী হয়, মনটা ওর বিষিয়ে গেছে! এমন জঘন্য লোকই যোগ্যতর?

বিব্রত বোধ করল ঊর্বশী। একটু সামলে নিয়ে বলে উঠল– আপনার কথা ঠিক। ভবিষ্যৎ জাতির পিতা হবে এমন একজন যার আত্মসম্মানবোধ থাকবে… বুদ্ধিমান হবে… আর নীতিজ্ঞান হবে প্রখর।

এবার জন বিলের দিকে এগিয়ে গেল। বলল, জুরি আর বিচারক না থাকলেও আমি সম্পূর্ণ দায়িত্ব নিয়ে রায় দিচ্ছি… আপনি ভাবী মানবজাতিকে দুর্নীতির আশ্রয় নিয়ে কলঙ্কের বোঝা চাপিয়ে দেবার চেষ্টা করেছিলেন। আপনার অপরাধের শাস্তি হল মৃত্যু।

বিলের কপাল লক্ষ্য করে গুলি চালাল জন। ঘর বাঁধার স্বপ্ন নিয়ে ধুলোয় লুটিয়ে পড়ল বিলের প্রাণহীন দেহ।

–এবার সুন্দরী.. আমাদের মাঝখানে আর কোনও বাধা নেই… নতুন জাতির ভাবী জননী আপনাকে আমি আমার ধর্মপত্নী হিসাবে গ্রহণ করলাম। সলজ্জ ভঙ্গিতে ঊর্বশীও জনের পাশে এসে দাঁড়াল।

-–এখন আর স্বীকার করতে কোনও বাধা নেই যে, সত্যি বলতে গেলে আমি যুবকও নই আর সুন্দর তো নই-ই। তাহলেও আমাকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করে তোমার লাভই হবে।

-–আচ্ছা আপনি কি অ্যান্ড্রয়েড? দুম করে প্রশ্ন করে উঠল ঊর্বশী।

–বিলের সব যুক্তি কিন্তু অকাট্য ছিল। মানুষ আর অ্যান্ড্রয়েডের তুলনামূলক বিচার একেবারেই যথার্থ। তা সত্ত্বেও আমি অনেক বাজে কথা বলেছিলাম। তার কারণ কী ছিল জানো? কারণ আর কিছুই নয়… আমি তোমাকে হারাতে চাইনি। যাই হোক… এখন আর আলোচনা করে কোনও লাভ নেই… অ্যান্ড্রয়েড বা মানুষ যাই হই না কেন… যা হবার তা তো হয়েই গেছে… মন থেকে মুছে ফেল সব। তবে হ্যাঁ, আমি যে সম্পূর্ণ যোগ্যতর মানুষ সে বিষয়ে কোনও সন্দেহ নেই… কী বলো সুন্দরী?

মৃদু হেসে উর্বশী জনের হাত ধরে বলল, বাঃ, কী সুন্দর কথা বল তুমি। আসলে কী জানো, আমার কাছে মানুষ আর অ্যান্ড্রয়েড দুইই সমান। একটু থেমে সলজ্জ ভঙ্গিতে জনের ঠোঁটে চুম্বন এঁকে দিয়ে বলল।

–আমি নিজেই যে অ্যান্ড্রয়েড!