কিউব রহস্য – নেলসন বন্ড

কিউব রহস্য – নেলসন বন্ড

উত্তেজনায় অধীর উন্মুখ জনতা। প্রশস্ত রাজপথ… একধারে প্রকাণ্ড স্টেজ। রাজপথ থেকে স্টেজ পর্যন্ত সুদৃশ্য ঘোড়ানো সিঁড়ি। রাজপথ ছাড়িয়ে জনতার ভিড় চারপাশের বিস্তৃত মাঠের ওপরে এসে গেছে। রীতিমতো ঠেলাঠেলি শুরু হয়ে গেছে। সারা দুনিয়ার সব জুথিল আজ এখানে সমবেত হয়েছে। আরও আসছে কাতারে কাতারে… যতদূর দৃষ্টি যায় কালো কালো মাথা গিজগিজ করছে। এরপরেও যাদের শহরে বাড়ি আছে সেখানেও আত্মীয়স্বজনের ভিড়… আজকের অত্যাশ্চর্য ঘটনা সকলেই প্রত্যক্ষ করতে চায়… সকলেই জনে জনে মেনাভিসারের সামনে বসে… কখন খবর হবে?

রহস্যময় কিউবটা এখন উন্মুক্ত। দৈত্যাকৃতি শ্বেতপাথরের মসৃণ খণ্ডগুলো সূর্যালোকে জ্বলজ্বল করছে। বন্ধ করার কী সুন্দর যান্ত্রিক কৌশল… মসৃণ চকচকে দেওয়ালগুলো কয়েকশো ফুট ঊর্ধ্বে উঠে গেছে। সবচেয়ে দীর্ঘ জুথিলদের চেয়ে অনেক অনেক দীর্ঘ.. কিউবের তলদেশ বিশালাকৃতি… কম-সে-কম কয়েকশো জুথিলদের বাসগৃহ ধরে যাবে। মাত্র কয়েকঘণ্টা পূর্বেই কিউবের ঢাকনি খোলা সম্ভব হয়েছে। সামান্য চাপেই মসৃণ ঢাকনিটি খুব ধীরে ধীরে সরে যায়… কিউবের অভ্যন্তরভাগ মিশমিশে কালো গহ্বরের মতো হাঁ করে থাকে।

ইতোমধ্যে একদল দুঃসাহসী অভিযাত্রীদল অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে কিউবের অভ্যন্তরে নেমে গেছে। সরেজমিন পর্যবেক্ষণ করে আসার পর জনসমক্ষে ওদের অভিজ্ঞতার কথা জানাবে… সেই রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতা শোনার জন্যেই জুথিলরা রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করছে।

জীবিত বা মৃত কেউ জানে না কিউবের ইতিহাস। কোন অনাদিকাল থেকে যে পড়ে আছে, কেন কীসের জন্যে, সে-ও আজ অনুমানসাপেক্ষ। জুথিলদের সবচেয়ে প্রাচীন নথিপত্রে কিউবের অস্তিত্বের কথা বলা আছে। ব্যস এইটুকু মাত্র… আর কিছু নেই। সব দেখেশুনে প্রাচীনযুগের জুথিলদের অনুমান যে, কিউবের সৃষ্টিরহস্য অলৌকিক রহস্যে ভরা… স্বর্গ থেকে নেমে এসেছিল একদিন। আরও বড় কথা বর্তমান পৃথিবীর বাসিন্দাদের সাধ্য কী এই বিশাল বিরাটকায় কিউব তৈরি করে? তাহলে খোদ ভগবানই এর সৃষ্টিকর্তা!

অধীর আগ্রহে সকলেই মেনাভিসারের ডায়ালটা স্টেজের মেন্টাল মনিটরের সঙ্গে যোগ করে দিল। এই মনিটরের মাধ্যমেই অভিযাত্রীদল তাদের প্রথম মেন্টাল ইমেজ জনসমক্ষে ছড়িয়ে দেবে। ইমেজের সঙ্গে সঙ্গে টেলিপ্যাথির মাধ্যমে জুথিল-জনতা অভিযাত্রীদের রোমাঞ্চকর অভিজ্ঞতার অংশীদার হবেন।

হঠাৎ মেনাভিসারের রিফ্লেকটার স্ক্রিন হালকা সবুজ আভায় জ্বলজ্বল করে উঠল। দর্শকরা উত্তেজনায় হিসহিস্ করতে লাগল। অভিযাত্রীদল নিরাপদে ফিরে এসেছে। জুথিল বিজ্ঞানীদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ টুল এবার ঘোরানো সিঁড়ি বেয়ে ডায়াসে উঠে এলেন। চওড়া প্রশস্ত কপাল চিন্তাম্বিত। ওঁর পেছনে অভিযাত্রীরাও পিলপিল করে ওপরে উঠে এল।

একেবারে ইমেজ প্রোজেক্টিং ইউনিটের সামনে এসে দাঁড়ালেন টুল। টুল আর অভিযাত্রীদলের বিজয়ীর হাবভাব মুহূর্তের মধ্যে লক্ষ লক্ষ জুথিলদের মেনাভিসারে ফুটে উঠল। সমস্বরে আনন্দে সকলে লাফিয়ে উঠল… মেন্টাল কনট্যাক্ট দৃঢ় হবার সঙ্গে সঙ্গে ছবিটাও ধীরে ধীরে জীবন্ত হয়ে উঠল।

প্রতিটি জুথিলের চোখের সামনে ভেসে উঠল কিউবের অভ্যন্তরের অন্ধকার গহ্বর… পরক্ষণেই উজ্জ্বল টর্চের আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে গেল। ধাপে ধাপে শ্বেতপাথরের সিঁড়িগুলো অন্ধকারের বুকে উধাও। পাথরের গায়ে জোড়ার চিহ্ন নেই… লম্বা করিডোরের উঁচু ছাদ… পায়ের তলায় শতাব্দীর ধুলো আর মাকড়সার জাল। বাতাসেও প্রাগৈতিহাসিক যুগের বুক। চাপা বাসি গন্ধ। কত সহস্র বছরের বন্ধ বাতাস আজ মুক্তি পেল। টর্চের আলো এবার ঘরের শিলিং দেখার চেষ্টা করল। কিন্তু ছাদ কোথায়…অন্ধকারের বুকে থই পেল না আলোকশিখা।

উত্তেজনায় টানটান হয়ে উঠেছে জনসাধারণ। করিডোর ক্রমেই প্রশস্ত হয়ে বিরাট এক হলঘরে মিশে গেল। হলঘরের দৈর্ঘ্য-প্রস্থ-উচ্চতা এতই বিশাল যে, অভিযাত্রীদলকে সেখানে অতি নগণ্য বোধ হল। টেলিপ্যাথির মাধ্যমে প্রতিটি দর্শক যেন নিজেকে প্রত্যক্ষ করল… তারপর টুলের সঙ্গে সঙ্গে ওরাও নিজেদের পা সামনে বাড়িয়ে দিল… তারপর একটু থেমে টর্চটা চারপাশে ঘোরাল… সঙ্গে সঙ্গে সকলের দৃষ্টির সামনে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য ভেসে উঠল… সারি সারি অজস্র প্রকাণ্ড সব ড্রয়ার… দেওয়ালের গায়ে লাগানো। প্রতিটি ড্রয়ারে বিশাল ব্রোঞ্জপ্লেট-এর ওপরে দুর্বোধ্য চিত্রলিপি। বন্ধ ড্রয়ারের অভ্যন্তরে কী আছে কিছুই বোঝা গেল না… ড্রয়ার খোলার কৌশলও কারোর জানা নেই।

মেনাভিসারের ছবি কাঁপতে শুরু করল। ধীরে ধীরে অস্পষ্ট হয়ে এল। মেন্টাল কনট্যাক্ট ক্ষীণ হয়ে সমষ্টিগত ছবি বন্ধ হয়ে গেল। এবার দর্শকবৃন্দের সঙ্গে সরাসরি টেলিপ্যাথির কাজ শুরু হল। সবুজ আভায় মেনাভিসার উজ্জ্বল হয়ে উঠল।

“এতক্ষণ আপনারা নিজেরাই রহস্যময় বস্তুর অভ্যন্তর দেখলেন। রহস্য উদঘাটনের যাবতীয় চেষ্টা এ যাবৎ ব্যর্থ হয়েছে। প্রকাণ্ড প্রকাণ্ড বন্ধ ড্রয়ারে কী আছে আমরা জানি না। মনে হয় বহুদিন আগের লুপ্ত কোনও জাতির মহাফেজখানা বা আর্কাইভ। এই ড্রয়ার রহস্য উদঘাটনের জন্যে বহু সময় পরিশ্রম আর উন্নত বৈজ্ঞানিক কারিগরী বিদ্যার সাহায্যের প্রয়োজন। একথা অনস্বীকার্য যে, অতি জটিল প্রক্রিয়ায় প্রস্তুত এই ড্রয়ার আমাদের বর্তমান বিজ্ঞানকে হার মানিয়ে দিয়েছে। যদি কোনও জীবন্ত প্রাণীর দ্বারা এই বিশাল ড্রয়ার তৈরি হয়ে থাকে তা হলে সেই সব প্রাণীদের আকৃতি কী প্রকাণ্ড হবে সেটাও নিশ্চয় আপনারা অনুমান করতে পারছেন। আমাদের তুলনায় অজানা জীবদের পর্বতের মতো এবং প্রকাণ্ড ড্রয়ার নির্মাণের প্রয়োজনও আমাদের বুদ্ধির বাইরে। তবে হ্যাঁ, রহস্যময় কিউবের মধ্যে থেকে একটি বস্তু আমরা নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছি। সেটাও আপনাদের সামনে নিয়ে এসেছি। বস্তুটা যে কোনও এক ধরনের যন্ত্র, সে বিষয়ে আমরা একমত। কারণ এই রকম যন্ত্র, যদিও এর চেয়ে অনেক ছোট, আমরা হামেশাই ব্যবহার করে থাকি।

টুল এবার দুই সহকারীকে ইঙ্গিত করল। সঙ্গে সঙ্গে এক প্রকাণ্ড গোলাকৃতি পাথরের চাকতি অনেকে ঠেলে ঠেলে ডায়াসের ওপরে তুলল। চাকতিটা আবার অজানা কোনও তন্তুজাতীয় পদার্থে তৈরি চতুষ্কোণ একটি বাক্সের মধ্যে বসানো। বাক্সের সঙ্গে লাগানো প্রকাণ্ড এক স্থিতিস্থাপক hawser…।

বাক্সের সঙ্গে লাগানো এক মস্ত লম্বা কেবল সটান নেমে গেছে কিউবের অভ্যন্তরে। মনে হয় রহস্য উদঘাটনের এটা এক চাবিকাঠি। কিন্তু আমরা এর কোনও হদিশ পাচ্ছি না। আমাদের ইঞ্জিনিয়ারদের খুব সন্তর্পণে পাথরের চাকতিটা খুলে ফেলতে বলেছি। সময় এখানে কোনও সমস্যা নয়। চাকতিটা নিরেট শক্ত… কথা বলতে বলতে hawser-এর ওপরে উঠে দাঁড়াল টুল।

পুশবাটনের ওপরে উঠে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে যুগযুগান্ত ধরে নিষ্ক্রিয় শক্তির আধার থেকে বিদ্যুৎপ্রবাহ শুরু হয়ে গেল। কিউবের অন্ধকার গহ্বর থেকে বিদ্যুৎ নিয়ন্ত্রিত রেকর্ডার সচল হয়ে উঠল। মানুষের কণ্ঠস্বর ভেসে এল।

–পঞ্চাশৎ শতাব্দীর মানবজাতিকে আমাদের অভিনন্দন। আমরা আপনাদের পূর্বপুরুষ পঞ্চবিংশ শতাব্দীর মানুষ। মানবতার দোহাই, আমরা আপনাদের সাহায্য প্রার্থী।

এই যে আমি কথা বলছি… এই সময়ে আমাদের সৌরজগত প্রকাণ্ড এক ক্লোরিন গ্যাসের মেঘের মধ্যে নিমজ্জিত হতে চলেছে… আমাদের হিসাবমতো কয়েকশো বছরেও সৌরমণ্ডল ক্লোরিনমেঘ থেকে মুক্তি পাবে না। সমস্ত মানব জাতির ধ্বংস অবধারিত। বিশেষভাবে নির্মিত এইসব ভল্টের ড্রয়ারের মধ্যে মরণ ঘুমে শায়িত আছেন পৃথিবীর দশহাজার শ্রেষ্ঠ জ্ঞানীগুণী বিজ্ঞানী। এককথায় বলা যায় পৃথিবীর জীবন্ত জ্ঞানভাণ্ডার। এঁদের ঘুম ভাঙবে পঞ্চাশৎ শতাব্দীতে। হার্মিটিকালি সীল করা এই ড্রয়ারগুলিসমেত ভল্টের স্বয়ংক্রিয় দরজা কেবলমাত্র পঞ্চাশৎ শতাব্দীতেই উন্মুক্ত হবে। আমাদের হিসাবমতো সৌরজগতের মহা বিপর্যয় এই সময়ের মধ্যে দূর হয়ে যাবে। ক্লোরিন গ্যাসের মেঘের আবরণ থেকে মুক্তি পাবে সৌরজগৎ।

পূর্বনির্ধারিত সময়মতো পঞ্চাশৎ শতাব্দীর প্রথম দিন। ভল্টের দরজা আপনাদের জন্য উন্মুক্ত হল। এখন মানুষ যদি বেঁচে থাকে এবং বাতাস যদি শ্বাসপ্রশ্বাসের উপযুক্ত হয়, তাহলে প্রথম ড্রয়ারের পাশে ইলেক্ট্রি সুইচটা টিপে দিন। মরণ-ঘুম থেকে আমরা জেগে উঠব।

যদি পৃথিবীর বুকে কোনও মানুষ না থাকে বা কোনও মানুষ যদি আমাদের আবেদনে কর্ণপাত না করে… তাহলে হে পৃথিবী বিদায়… বিদায় সৌরমণ্ডল। মরণ ঘুমে আচ্ছন্ন আমরা মৃত্যুর কোলে চিরবিশ্রাম নেব। বিদায় পৃথিবী… চিরদিনের জন্যে বিদায়।

…সলিড… মনে হল যেন একটু বসে গেল। প্রতিটি জুথিলবাসী মনে মনে টুলের কথা বুঝতে পারল।

টুল বলে চলল– জুথিলের নাগরিকবৃন্দ… আপনাদের মতো আমরা এই রহস্য উদঘাটনে দিশাহারা। কিন্তু আপনাদের বলে রাখছি, এই রহস্য-মোচনে সত্য উদঘাটনের জন্যে বিজ্ঞান পরিষদের প্রতিটি বিজ্ঞানী যথাসাধ্য চেষ্টা করবেন। আপনারা এবার যে-যার কাজে ফিরে যান।

মেনাভিসারের সবুজ আভা ধীরে ধীরে মিলিয়ে গেল। জুথিলের নাগরিকবৃন্দ যে যার কাজে ফিরে গেল। নাগরিকবৃন্দের অধিকাংশ শ্রমিক… দিন আনে দিন খায়। রাজপথ ধরে নাগরিকদের ফেরা শুরু হল। যাবার সময়ে সকলেই সকলের গুঁড়রূপী অ্যান্টেনা স্পর্শ করে ভাবের আদান প্রদান করল… অভূতপূর্ব রহস্যে রোমাঞ্চিত হয়ে উঠল।

পঞ্চবিংশ শতাব্দীর মানুষের কণ্ঠস্বর কোনও জীবিত প্রাণীর কর্ণকুহরে প্রবেশ করল না। কারণ পঞ্চাশৎ শতাব্দীর পৃথিবীর শাসনভার যাদের ওপরে ছিল তারা হল পিপীলিকা… পিপীলিকারা শুনতে পায় না।