কল্যাণী – ৮

আট

কিন্তু এবার বাড়ির থেকে যে একটা সঙ্কল্প ও মর্যাদা সঙ্গে করে নিয়ে এসেছিল কল্যাণী বেশি দিন আর তা টিকল না।

ক্লাসের মেয়েদের সঙ্গে সে একদিন বায়োস্কোপ দেখতে গেল—

এর ভিতর কোনো অপরাধ ছিল না অবিশ্যি।

কিন্তু তবুও প্রতিজ্ঞা তো করা হয়েছিল—বাবার কাছে প্রতি চিঠিতেই কত প্রতিজ্ঞা জানিয়েছে কল্যাণী—সে কার্নিভালে আর যাবে না, লাকি সেভেন খেলবে না, সার্কাস দেখবে না, বায়োস্কোপেও যাবে না—

প্রতিজ্ঞা যখন ভাঙল বাবাকে আর লিখল না; অবহেলা ক্রমে ক্রমে আরো বেড়ে উঠল—আয়েস বাড়ল, আবার সেই আগের আরাম ফিরে এল। আটটা সাড়ে আটটার সময় ঘুম থেকে উঠে জীবনটাকে তার ভালো লাগতে লাগল।

বেশ চলেছে।

আর একদিন বায়োস্কোপ দেখতে গেল সে; হাফ টাইমের সময় আইসক্রিম খেলে ছবি কিনলে–মেয়েরা সোডা ফাউন্টেন থেকে ঘুরে এল–কল্যাণীও গেল।

এই সব নির্দোষ আমোদ, কোনো গ্লানি নেই এ সবের ভিতর। কিন্তু আরাম রয়েছে। কল্যাণীর জীবন তাহ’লে আরামের দিকে মোড় নিল আবার? এক প্রসাদ ছাড়া এরা সকলেই এই রকম—অনেক কিছুই আরম্ভ করতে পারে—কিন্তু কোনো কিছুতেই শেষ সিদ্ধান্ত নিয়ে দাঁড় করাবার মত অপরিসীম আখখুটেপনার গৌরব এদের চরিত্রের মধ্যে নেই—

কিশোর একদিন কল্যাণীকে থিয়েটারে নিয়ে যেতে চাইল—

বললে—ভাদুড়ীর প্লে তুই কোনোদিন দেখিসনি কল্যাণী

—দেখিনি তো—

—তাহ’লে কি নিয়ে তুই বড়াই করবি।

কল্যাণী একটু বিস্মিত হয়ে বললে—তার মানে?

লোকে তোকে ঠাট্টা করে ধুনে দেবে যে—

—কেউ ঠাট্টা করে না

—এখন করে না; আছিস তো কতকগুলো খাজা মেয়ের মধ্যে। কিন্তু যখন বড় হবি— বিয়ে করবি—সোসাইটিতে ফিরবি—তখন চোখের মাথা খেয়ে বড্ড লজ্জা পেতে হবে তোর

কল্যাণী এ লজ্জাকে এখনও হৃদয়ঙ্গম করতে পারছিল না। থিয়েটারে যাবার তার একটুও ইচ্ছা ছিল না।

কিশোর বললে—এবার আমাদের বাঙালিদের স্টেজটা ভালো হয়েছে—

স্টেজের জন্য বিশেষ কোনো আকর্ষণ ছিল না কল্যাণীর—সে চোখ নামিয়ে নখ খুঁটতে লাগল।

কিশোর গম্ভীর হয়ে উঠল।

বললে—কল্যাণী, ও রকম অবহেলা কোরো না।

কল্যাণী ছোড়দার দিকে তাকাল—

কিশোর বললে—শুধু তো নাচ গান দেখতে যাওয়া নয়—ফুর্তি তামাসা নয় শুধু। আর্ট আলাদা জিনিস।

আর্টের সম্বন্ধে কল্যাণীর বিশেষ কোনো ধারণা ছিল না। আর্ট তাকে কোনো দিন বড় বেশি উৎসুক করেনি—উত্তেজিত করা তো দূরের কথা।

কিশোর বললে—না যাত্রা-ফাত্রা নয় আর, এ দত্তর মত প্লে—

কল্যাণী একটু বিস্মিত হয়ে বললে–প্লে?

–প্লে—

কিশোর বললে—যত গাজন পাঁচালী ঢপ কথকতা যাতা শালিখবাড়িতে শুনেছ— কলকাতার থিয়েটারেও সেই সবেরই কপচানি দেখেছ এদ্দিন, কিন্তু এখন একেবারে আলাদা জিনিস দেখবে।

কল্যাণীর একটু কৌতূহল হ’ল, ভাবলে : না জানি কেমন!

বললে—সত্যি ছোড়দা?

—আমার সঙ্গে এসো—দেখো—তারপর বোলো

কিশোর একটু কেশে বললে—তারপর বোলো চিরদিন মনে থাকবে কিনা

—সত্যি?

—তা যদি না থাকে তাহ’লে আর্ট হয়?

—ওঃ বুঝেছি

কিশোর বললে—কবিতা গল্প কত জায়গায় তো আর্টের পরিচয় পেয়েছ—

কল্যাণীর স্পষ্ট কিছু মনে পড়ছিল না।

কিশোর বললে—ছবিতেও

বিশেষ কোনো ছবি—কোনো ছবিই মনে পড়েছিল না কল্যাণীর।

কিশোর বললে—মানুষের মুখে কিম্বা পাথরের মূর্তিতেও

কল্যাণী গালে হাত দিয়ে ছোড়দার দিকে তাকিয়ে রইল।

কিশোর বললে—গানে বাজনায়।

একটু কেশে বললে—এবার স্টেজে দেখবে।

দু’জনে গেল—থিয়েটার দেখতে।

থিয়েটারের থেকে ফিরবার সময় কিশোর একটা ট্যাক্সি ভাড়া করলে।

ট্যাক্সিতে চেপে কল্যাণী বললে—রাত হয়ে গেছে

কিশোর বললে—বেশি না হুঁ।

–ক’টা?

—একটা দু’টো হবে।

কল্যাণী ভয় পেয়ে বললে—কি হবে তাহলে?

—কেন?

—বোর্ডিঙে যেতে পারব না তো এখন।

কিশোর হো হো করে হেসে উঠে বললে—সেই জন্য তোমার ভাবনা?

—ভাবনা নয় ছোড়দা?

—ভাবনা আবার! এই নিয়ে ভাবনা? এই সেথো জিনিস নিয়ে? বলতে বলতে কিশোর একটা স্টলের দিকে গেল।

কল্যাণীর বুকের ভিতর ঢিব ঢিব করতে লাগল।

কিশোর পান সিগারেট কিনে এনে গাড়িতে এসে বসল; বোনের চোখের ছটফটানির দিকে তাকিয়ে বললে—ছিঃ এ কি রকম?

—কি হবে ছোড়দা?

কল্যাণীর হাত ধরে কিশোর বললে—আমি আছি না?

—তুমি তো আছ—

—তবে?

—বোর্ডিঙে যেতে পারব না যে

কিশোর বললে—এই তো থিয়েটার থেকে বেরুলে, বোর্ডিঙের ভাবনা ছাড়া তোমার মাথায় আর কিছুই কি নেই?

—এত রাতে কোথায় যাব আমরা?

—বলি, এরকম চিন্তাভাবনা ছাড়া তোমার হৃদয়ের মধ্যে আর কিছুই কি নেই? কল্যাণী বললে—না

কিশোর অত্যন্ত নিরাশ হ’ল।

খানিকক্ষণ সিগারেট টেনে বললে—একটা নতুন কিছু দেখেছ—অজন্তার গুহায় ঢুকলে বা ইটালীর মাস্টারদের ছবি প্রথম দেখলে বা জার্মান মাস্টারদের মিউজিক প্রথম শুনলে বা কাউকে প্রথম ভালোবাসলে মন যেমন করে ওঠে—কেমন নাড়াচাড়া ফেরে তেমন কিছুই কি তোমার হয়নি কল্যাণী?

কল্যাণী ঘাড় নেড়ে বললে—না

তা যাই বলুক ছোড়দা কিশোরের আজকের রাতের এই পৃথিবী থেকে কল্যাণী ঢের দূরে—কিশোরকে তার এমন অস্পষ্ট অসংযত নির্মম মনে হতে লাগল—এমন হৃদয়হীন হয়ে গেছে ছোড়দা—এমন অর্থহীন

কিশোর বললে—এমন অদ্ভুত তুমি—এখন অদ্ভুত—অদ্ভুত—আজগুবির এক শেষ

কল্যাণী বললে—কোথায় চলেছ?

—যেখানে খুসি

কিশোর অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে গেছল—তার নিজের সহোদর বোনটা এমন ভীরু—এমন ভোঁদা—একটা মাংসপিণ্ড যেন—কেমন একটা আর্টের পৃথিবীর থেকে ফিরে এসে নট নিয়ে কথা নয়, নটী নিয়ে কথা নয়,গান কবিতা কুশলতা, প্রাণ, রস, আবেগ, সংযম, সীমা অনুভব, বেদনা কিছু নিয়ে নয়—এমন কি থিয়েটারের ঘট ঘট ফাইফুর্তি নিয়েও নয়—শুধু কোথায় চলেছ, কত রাত হয়েছে, বোর্ডিঙে যাব কি করে!

অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে উঠল কিশোরের মন।

কল্যাণী বললে—ট্যাক্সি চলেছে তো চলেইছে—

—বেশ করেছে—

—আর কত দূর যাবে?

কিশোর কোনো জবাব দিল না।

নীরবে সিগারেট টানতে টানতে সে তার নট-নটীদের কথা ভাবছিল—ভাবছিল এক দিন সেও হয়তো স্টেজে দাঁড়িয়ে অমন অভিনয় করবে—আরো রূপান্তর আনবে সে– আরো স্থির—আরো অবিকৃত প্রতিভা— (মুখোস একেবারে দেবে বদলে)—

কিশোর ভাবছিল—বিলেত যদি হ’ত—

কল্যাণী আতঙ্কিত হয়ে বললে—এ কি গঙ্গা নয়?

কিশোর টিটকারি দিয়ে বললে—গঙ্গাকে চেন কি তুমি? কল্যাণী?

কল্যাণী অভিমানক্ষুব্ধ ছোড়দার দিকে তাকাল —

কিশোর বললে—একটা নদী দেখেও তোমার মনের উৎকণ্ঠা ফুরোয় না? যেন আরো বাড়ে। ভালোবেসে তুমি এর দিকে তাকাতে পার না? এ কেমন?

কল্যাণী বললে—রাত যে ঢের হয়ে গেছে ছোড়দা!

—হ’লই বা। তাতে কি নদী মরুভূমি হয়ে গেল? তোমাদের মেয়েদের ঐ বড় দোষ। মনের মুদ্রাদোষ কিছুতেই ছাড়াতে পার না তোমরা। চলতি পথের থেকে এক চুল চুমরে পড়লে সবই যেন গ্লানি—ব্যথা–ভয়—কত কি? মেয়েরা জীবনটাকে তাই বোঝে না। পর পর বিস্ময় চমক ও নতুনত্ব নিয়ে যে জীবন মেয়েরা তাতে কেমন যে অশ্রদ্ধার চোখে দেখে— জীবনটাকে তোমরা অশ্রদ্ধা কর—এই নদীটাকেও তুমি আজ শ্রদ্ধা দিতে পারলে না। আমার কাছে এমন চমৎকার মনে হচ্ছে—অথচ তোমার কাছে এই গঙ্গা একটা কেঁদো জানোয়ার যদি না হয় প্রাণপণে এটা হিংসে করছ তুমি; না কল্যাণী?

কল্যাণীর মনে হ’ল ছোড়দা আজও হয়তো ঢের হুইস্কি খেয়েছে। কিন্তু কোনো রকম হুইস্কি খায়নি কিশোর আজ।

সে খুব সরল মনে কথা বলছিল—অত্যন্ত আন্তরিকতার সঙ্গে; তার বাক্যের চিত্তবৃত্তি তার সমস্ত প্রাণকে ভরে ফেলেছে যেন আজ; দিনরাত্রির মাঝখানের এমন বিস্ময়কর সময়ের গঙ্গাটাকে সে খুব হৃদয় দিয়ে উপভোগ করছিল—

শেষ রাত্রের বাতাস ভালো লাগছিল। অনেকক্ষণ নদীর দিকে তাকিয়ে রইল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *