কল্যাণী – ৬

ছয়

কলকাতায় পৌছে কল্যাণী বললে—আমি বোর্ডিঙেই যাব, তুমি ছোড়দার

–আমার হোস্টেলে

কল্যাণীকে বোর্ডিঙে রেখে কিশোর চলে গেল।

কল্যাণী স্নান করে খেয়ে দরজা বন্ধ করে বিছানায় শুয়ে শুয়ে কাঁদতে লাগল—

কিন্তু কাঁদলে কি পৃথিবীতে চলে

কল্যাণীর উঠতে হ’ল।

দু-তিন দিন হ’ল কলেজ খুলেছে—আজো দু-তিন ঘণ্টা ক্লাস হয়ে গেছে—আরো দু—এক ঘণ্টা হবে। কল্যাণী বই গুছিয়ে নিয়ে কলেজে গেল।

কলেজ থেকে ফিরে এসে বুকের ভারটা তার যেন একটু কমেছে মনে হ’ল। নিজের সীটটা ঠিকঠাক পরিষ্কার করে টেবিল গুছিয়ে বই সাজিয়ে বিছানা সাফ ক’রে তারপর কল্যাণী মেয়েদের সঙ্গে গিয়ে বারান্দায় কম্পাউন্ডে খানিকটা ঘোরাঘুরি হাসি তামাসা করে এল।

কিন্তু মন তার আজ এ সবের ভিতর একটুও নেই যেন—কেবলই শালিখবাড়ির কথা মনে পড়ছে—বাবার কথা, মার কথা; ঘুঘুর ডাককে সে ঠাট্টা করেছিল—কিন্তু আজ হাজার কান পাতলেও সে ডাক আর শোনা যাবে না এ নিষ্ফলতা যেন পাড়াগাঁর কোন্ শান্তশী পল্লীকন্যার মত ঠোঁট ফুলিয়ে ফুলিয়ে কল্যাণীকে উপহাস করতে লাগল—দু’চোখ তার বেদনার—বিরহের জলে ভরে উঠল।

রাত হয়ে গেছে।

বাবাকে সে চিঠি লিখতে বসল;

তুমি যদি তাই চাও বাবা তা’হলে আবার আমি দেশে ফিরে যেতে পারি। তোমার মনে কষ্ট দেবার আমার একটুও ইচ্ছা নেই। তুমি ভেবেছ তোমাদের চেয়েও কলকাতার ফাইফুর্তি বুঝি আমি বেশি ভালোবাসি। তা আমি ভালোবাসি না বাবা। তোমাদেরই আমি বেশি ভালোবাসি–ঢের বেশি। কলকাতার ফুর্তির কোনো মূল্য নেই আমার কাছে এখন আর। এ সব আমার আর ভালো লাগে না।

দেশে থাকতে মুখ ফুটে কিছু বলিনি বলে, বাবা, তুমি আমাকে ভুল বুঝো না। এই চিঠিতে তো আমি সব লিখছি; সব খুলে লিখলাম। এখন তুমি তোমার মেয়েকে ঠিক করে চিনতে পারবে।

স্টিমারঘাট থেকে সেই যে তুমি চলে গেলে তখন থেকেই আমার এত খারাপ লাগতে লাগল। আমি রেলিঙে ভর দিয়ে রাস্তার দিকে তাকিয়ে রইলাম। কিন্তু স্টিমারটা হঠাৎ কেমন করে যে কোন দিকে যে ঘুরে গেল ভিড়ের ভিতর তোমাকে আমি আর দেখতে পেলাম না— দেখতে দেখতে পথঘাট লোকজন কোথায় সব পড়ে রইলরইল শুধু নদী আর ছোড়দা আর আমি। তখন এমন খারাপ লাগল আমার কি বলব তোমাকে বাবা! অনেকক্ষণ রেলিঙের পাশে দাঁড়িয়ে নদীর দিকে তাকিয়ে রইলাম।

তারপর রাত হ’ল।

রোজ রাতে তোমাদের সঙ্গে কত গল্প করতাম—একসঙ্গে খেতে যেতাম—একসঙ্গে ঘুমোতাম। কিন্তু স্টিমারে শুধু একা ছোড়দা–বুঝতে পারলাম বাবা মাকে আমি কত ভালোবাসি—তাদের জায়গা আর কেউ নিতে পারে না; রাত স্টিমারে এত কষ্ট হ’ল।

প্রথম রাতে কল্যাণী এর চেয়ে বেশি কিছু আর লিখতে পারল না।

বাইরে তিরিক্ষে ঝড়বৃষ্টি

জানালা খুলে রাখলে সোঁ সোঁ করে ঠাণ্ডা বাতাস—জলের ছাঁট—কেমন একটা অভূতপূর্ব স্মৃতি ও চিন্তার কাতরতা।

জানালা বন্ধ করে দিলে সমস্ত নিস্তব্ধ–বিজন; কেমন একটা গুমোট; যেন সমস্ত কিছুর থেকেই বিচ্ছিন্ন হয়ে কল্যাণী কোন্ অজানিত অপ্রার্থিত জায়গায় পাষাণরাণী হয়ে বসেছে

চিঠির প্যাড বন্ধ করে তাড়াতাড়ি টেবিলের এক পাশে সরিয়ে দু-চারখানা বই তার ওপর চাপা দিয়ে রেখে দিল কল্যাণী।

ঝড়ের জন্য জানালাটা বন্ধ করে ফেলেছিল সে; খুলল আবার।

বাতি নিবিয়ে দিল।

ঘুমিয়ে পড়ল।

পর দিন খুব ভোরের বেলা উঠে কল্যাণী চিঠিখানা শেষ করল :

কিন্তু কলকাতায় যখন এসেছি পাস করে যাব না। মানুষকে তো ভগবান সুখের জন্যই তৈরি করেননি শুধু। তোমাদের কাছে থাকলে বেশ শান্তি পেতাম-সুখ পেতাম—কিন্তু তবুও সেটা কুঁড়েমি হ’ত; অকর্মণ্যতা হ’ত; মানুষের জীবনের কর্তব্য তাতে পালন করা হ’ত না।

আমি মেয়ে হয়ে জন্মেছি বটে, কিন্তু তবুও আমার ঢের করবার জিনিস আছে। প্রথমত আমি লিখতে চাই; পড়াশুনা করে জ্ঞান অর্জন করতে চাই। তুমি বলেছিলে ডিগ্রি নিয়ে কি হবে? হয়তো ডিগ্রির কোনো মুরোদ নেই। কিন্তু তবুও একটার পর একটা ডিগ্রির জন্য এই যে স্কুল কলেজে বছরের পর বছর পড়তে হয় এ জিনিসটা আমাদের একটা নিয়ম শেখায়, একটা শৃঙ্খলার মধ্যে নিয়ে আসে আমাদের, এই শৃঙ্খলার ভিতর দিয়ে ধীরে ধীরে আমাদের অন্য নানারকম জিনিস শিখিয়ে দেয়–যা হয়তো আমরা অন্য কোনো ভাবে আয়ত্ত করতে পারতাম না।

এই দেখ, আমি যদি কলেজ ছেড়ে দিতাম—তাহ’লে এই নিয়মের ভিতর থাকতাম না আর; তাতে হত কি জান বাবা? সহিষ্ণুতা ও চেষ্টা করবার ক্ষমতা হারিয়ে ফেলতাম মন ক্রমে ক্রমে আরাম আয়েসের দিকে চলে যেত। সে রকম মন নিয়ে শুধু শিক্ষাদীক্ষাই নয়— পৃথিবীর কোনো সার জিনিসই লাভ করতে পারতাম না আমি—পারতাম কি বাবা?

সেই জন্যই আমি সঙ্কল্প করেছি যে কলেজের এই রকম সব কঠিন আইন কানুনের ভিতর অনেকদিন থেকে থেকে আমি নিজেকে ঢালাই পিটাই করে নিয়ে সম্পূর্ণভাবে তৈরি করে নেব।

এখানকার ডিগ্রি নিয়ে তারপর আমি বিলেত যাব।

বিলেত থেকে শিখে এসে তারপর এইখানে মস্ত বড় কাজের জায়গা পাওয়া যাবে, নানারকম কাজের কল্পনা আমি ঠিক করে রেখেছি; ক্রমে ক্রমে সেই সবই আমি সফল করে তুলব।

এ না করে আমি ছাড়বই না।

এখন আর আমি দেরীতে উঠি না।

আর কোনো দিন দেরীতে উঠব না।

আজ পাঁচটার সময় উঠেছি—এখন ঘড়িতে সাড়ে পাঁচটা। বোর্ডিঙের মেয়েদের মধ্যে একজনও ওঠেনি এখন। সবাই ভোঁস ভোঁস করে ঘুমুচ্ছে। কেউ কেউ হয়তো আটটার সময় উঠবে—আমার এমন হাসি পায়।

দেরীতে উঠে কোনো ফূর্তি পাওয়া যায় না বাবা। তাতে মন খারাপ হয়—তাড়াতাড়ি করে পড়াশুনা, কলেজের তাড়াহুড়োর ভিতর শরীরও খারাপ হয়ে যায় —

আজ সকালটা এমন মিষ্টি।

টেবিলের পাশে জানালাটা খুলে চিঠি লিখছি। আকাশ নীল। লতাপাতা ক্রোটন ঝুমকো পাতাবাহারের ভিতর কত ফড়িং প্রজাপতি টুনটুনি চড়ুই; আমার জানালার পাশে (উইনডোবক্সের ওপর) সাদা লোটন পায়রাগুলো; ডান দিকে মস্ত বড় সেগুন গাছটাকে জড়িয়ে থোকা থোকা হলদে করবী।

কাল রাতে খুব বড় হয়ে গিয়েছিল, আজ ভোরটা বেশ ঠাণ্ডা–শ্বেতপাথরের মত ঠাণ্ডা আর শ্বেতপাথরের মত পরিষ্কার যেন—(এই ভোর—এই ভোরের আলো।)

আমার মনে হয় আমার চোখ বেশ ভালো হয়ে গিয়েছে।

কিন্তু তবুও এম. এন. মিত্রকে চোখ দেখাব; মেয়েরা বললে ডাক্তার অ্যাট্রোপিন দেবে তুমিও তাই বলেছিলে; অ্যাট্রোপিন দিলে আমাকে অন্ধকারে কয়েক দিন থাকতে হবে। কিন্তু চশমা তাহ’লে বেশ ভালো করে ফিট করবে। আজ ছোড়দা এলে তাকে বলব শনিবার মিঃ মিত্রের সঙ্গে অ্যাপয়েন্টমেন্ট করে আসতে। শনিবার সকালে ছোড়দার সঙ্গে মিত্রের ইনফারমারিতে যাব। শনি, রবি ও ক’দিন ছুটি আছে—বুধবারও ছুটি আছে; সোম মঙ্গল কলেজ কামাই হবে।

এখন থেকে চোখ সম্বন্ধে খুব সতর্ক হব। মেয়েরা বলে চশমা নেওয়ার পর অনেক সময় চোখ ক্রমে ক্রমে ভালোও হয়ে যায়। শুনে আমার খুব ফুর্তি বোধ হ’ল। মাকে এই কথা বোলো।

থিয়েটারে আমি কোনো দিন যাব না।

পরীক্ষা না দিয়ে বায়োস্কোপেও যাব না।

তুমি যা চাও আমি ঠিক তাই করব।

আমি তোমার লক্ষ্মী মেয়ে হব।

তোমার কল্যাণী।

চিঠিখানা এই রকম।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *