তেরো
পরদিন সকালে উঠে কল্যাণী দেখল তার টেবিলের বইখাতা লণ্ডভণ্ড হয়ে রয়েছে—কে যেন সমস্ত নেড়েচেড়ে গেছে।
মীরার কবিতার খাতার ভিতর যে ফার্ণ ও গোলাপফুলগুলো ছিল সে সব টেবিলের ইতস্তত রয়েছে—কবিতার খাতাটও খুঁজে বের করতে তার ঢের দেরী লাগল—একগাদা বইখাতার ভিতরে কোথায় যে সেটাকে কে গুঁজে রেখে দিয়েছে-Intelligent বইটা পাওয়া যাচ্ছে না।
কল্যাণী চোখ কপালে উঠল; তন্ন তন্ন করে সমস্ত টেবিল খুঁজে দেখল সে–দেরাজগুলো দেখল—একে একে বইগুলো আস্তে আস্তে তুলে তুলে সমস্ত খুঁজে দেখল আবার—সমস্ত টেবিলের বই একটার পর একটা করে সাজিয়ে রাখল—কিন্তু মিনুর সে বই কোথাও পাওয়া গেল না।
শেলফ দেখল সে–ছোড়দার টেবিল দেরাজ দেখে এল–মেজদা ও বাবার ঘরেও ঘুরে এল—কিন্তু কোথাও সে বই নেই।
বই কি হল? কে নিল? বিরক্তিতে অশান্তিতে রাগে একেবারে গুম হয়ে উঠে কল্যাণী কিশোরের ঘরের দিকে গেল—নিশ্চয় এ সব ছোড়দার কাজ!
বাবার কাছে বলে মেজদার কাছে বলে দেখাব আজ মজা বাছাধনকে আমি— থিয়েটারের সব কথা বলে দেব-স্টিমারে যে হুইস্কি খেয়েছিল সব বলে দেব বাবাকে আমি কিশোর নিজের টেবিলে বসে একটা নাটকের মতো কি যেন লিখছিল—
কল্যাণী ঢুকে পড়ে বললে—ছোড়দা
কিশোর গ্রাহ্য না করে লিখে যাচ্ছিল
কল্যাণী বললে—ছোড়দা শুনছ—
–কি
—আমার টেবিল তুমি ঘেঁটেছিলে?
—তোর টেবিল?
—হ্যাঁ
কিশোর বললে—তোর আবার টেবিল আছে নাকি?
হাত দিয়েছিলে নাকি বল ছোড়দা
কিশোর নাটক লেখায় মন দিয়ে বললে–কি দরকার তোমার টেবিল নেড়েচেড়ে আমার?
—নাড় নি?
কিশোরের কথা বলবার অবসর ছিল না, সে ঘাড় নেড়ে বললে, না, সে হাত দেয়নি।
—সত্যি বলছ ছোড়দা
কিশোর কলের মতো ঘাড় নেড়ে বললে —হ্যাঁ সত্যি বলছি—
কল্যাণী বিশ্বাস করতে পারল না—
বললে—তবে আমার বই গেল কোথায়?
কিশোরের কান এদিকে ছিল না—সে কোনও জবাব দিল না।
কল্যাণী গলা চড়িয়ে বললে—আমার বই তাহ’লে কোথায় গেল ছোড়দা? বইর কি ডানা হ’ল নাকি।
–কি হয়েছে?
—আমার বই পাচ্ছি না।
—কি বই?
—দরকারী বই।
—নাম নেই? (কি দরকারী বই?)
কল্যাণী ক্ষুব্ধ হয়ে বললে—কেন, Intelligent…
কিশোর ফ্যা ফ্যা করে হেসে উঠল
কল্যাণী বললে—নিয়েছ নাকি তুমি?
ও সব বইর কিছু বুঝিস তুই?
—খুব বুঝি
—ছাই বুঝিস
—বুঝি আর না বুঝি—তাই বলে তুমি না বলে নিয়ে যাবে কেন?
—আমি না বলে নিয়ে গেছি?
কিশোর চটে লাল
কে নিল তাহ’লে
—তা আমি কি জানি?
—নাও নি তুমি?
—ফের ট্যাটামি করবি তো বের করে দেব এখান থেকে!
কল্যাণী ঠোঁটে আঁচল গুঁজে বিক্ষুব্ধ হয়ে নিজের ঘরে চলে এল।
বইটা কোথায় গেল তাহ’লে। ছোড়দা নেয়নি; ছোড়দা-নিলে ওরকম চটে উঠত না। শেষ পর্যন্ত বলে দিত; বইটা ফিরিয়ে দিত। চটে উঠত না। ছোড়দা আর যাই করুক, কল্যাণীর সঙ্গে এরকম ধরণের ধাষ্টামো কোনও দিনও সে করে না।
কল্যাণী অনুপায় হয়ে বসে রইল।
কোথায় গেল বই? কে নিল?
বিছানাটা ঝেড়ে খুঁজল সে। বালিশের নিচে-তোষকের নিচে অনেকবার দেখল— তেতলায় গিয়ে দেখে এল—কোথাও নেই।
কল্যাণী মেজদার ঘরে একবার গেল।
প্রসাদ ল’ জার্নাল পড়ছিল—
কল্যাণী খুব ধীর শান্তস্বরে বললে—মেজদা
প্রসাদ চুরুটে একটা টান দিয়ে বললে—কি
—আমার একটা বই তুমি দেখেছ?
—তোমার বই?
—হ্যাঁ
—কি বই?
কল্যাণী একটু সঙ্কুচিত হয়ে বললে—অবিশ্যি সে বই আমার পড়া উচিত নয় —
—পড়া উচিত নয়! কি বই কল্যাণী?
—শুনলে রাগ করবে না তো?
প্রসাদ ঈষৎ হেসে বললে—কেন রাগ করবার কি আছে
কল্যাণীর ঘাড়ে সস্নেহে হাত রাখল প্রসাদ….
বললে—কি বই রে কল্যাণী?
—বাবা হয়তো পড়তে অনুমতি দিতেন না
—Intelligent……….
—ওঃ, সে আবার কার বই?
–শ’য়ের
–শ?
—বার্নার্ড শ—
—ওঃ, নাটক বুঝি! তা বেশ, শ’য়ের নাকট মন্দ না; তবে–একটু গর্জন বেশি। তোমাদের মতন মেয়েদের পক্ষে না পড়াই ভাল।
প্রসাদ মুখ বিকৃত করে বললে—লিটারেচার ফিটারেচার ধার ধারি না আমিও বই দেখিওনি কোনও দিন চোখে। তোমার কাছে ছিল বুঝি? কিনেছিলে? কে দিয়েছিল—? মিনু? মিনু কে? কলেজের মেয়ে? ওঃ; মেয়েরা বুঝি এ সব খুব পড়ে? বোঝে কি? শ একটু শক্ত নয় কি? হার্ড নাট! কি বোঝে! তুই বুঝিস? আমরা বুঝি না–বড্ড [?] সেই এক গ্রুভে ঘুরছে—ঘুরছে— ঘুরছে—মাকড়সার মত; এই রকম না? মাকড়সা–মাকড়সা—ঊর্ণনাভ– ঊর্ণনাভ! অনাদ্যন্ত পৃথিবীর ঊর্ণনাভ নয়। বিশ শতকী England-এর প্রথম ওই দশকের–। লোকটা আজ মৃত। (কে জানে আজকালকার ছেলেমেয়েরা হয়তো আমাদের চেয়ে)
প্রসাদ ল’ জার্নালে মন দিল।
কল্যাণী বললে—বইটা তাহ’লে তুমি দেখনি?
—না
—আমার টেবিলে ছিল—কাল রাতেও ঘুমোবার আগে দেখেছি—আজ ভোরে পাচ্ছি না। প্রসাদ বললে— কোথাও হয়তো অসাবধানে ফেলে রেখেছে—ভাল করে খুঁজে দেখ গিয়ে—যাও—আর বিরক্ত কোরো না।
কল্যাণী চলে গেল।
আস্তে আস্তে নিজের পড়ার ঘরের চেয়ারে এসে বসল সে। তার মনে হ’ল কাউকে সে আর অপরাধী স্থির করতে পারে না—কারুর বিরুদ্ধেই কোনোরকম নালিশ সে আর তৈরি করতে পারল না–সেরকম ভিত্তি সে কোনোদিকেই খুঁজে পেল না; দোষ তার নিজেরই; হয়তো এমন কোনো জায়গায় বইটা সে ফেলে রেখেছিল সেখান থেকে বাইরের লোক এসে নিয়ে যেতে পারে!
কোথায় সে ফেলেছিল? অনেকক্ষণ কঠিন চিন্তা করে মনে করতে চেষ্টা করল; কিন্তু মাথাটা তার তাকে একটুও সাহায্য করল না যেন। কল্যাণীর মনে হ’ল সমস্ত চিত্তবৃত্তিই যেন দিনের পর দিন তার ক্ষয় হয়ে যাচ্ছে, অবনত হয়ে পড়ছে!—মেয়েরা যে বই বোঝে সে তা বুঝল না; পড়তে পড়তে হারিয়ে ফেলল; কোথায় হারিয়ে ফেলল তাও মনে করতে পারল না।
নিজের প্রতি ধিক্কারে তার মন ভরে উঠল।
কল্যাণীর মনে হ’ল পৃথিবীতে কাকে সে তৃপ্ত করতে পারবে? তাকে নিয়ে কেউ তৃপ্ত হবে কি? কি হবে পৃথিবীতে তাকে দিয়ে?
মিনুকে একখানা বই কিনে দিতে হবে।
কিন্তু এই বইখানার পাশে পাশে মিনুর যথেষ্ট নোট ছিল—সে নোটগুলো কোথায় পাবে সে? সেগুলো খুব মূল্যবান মন্তব্য; মিনু অনেক রাত জেগে জেগে অনেক বিদ্যাবুদ্ধি খরচ করে লিখেছে; এ জন্য অনেক বইও ঘাঁটতে হয়েছে মিনুর-অনেক ভাবতে হয়েছে। এ সব কল্যাণী কি করে উদ্ধার করতে পারবে আবার?
ভাবতে ভাবতে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঘুমিয়ে পড়ল কল্যাণী।