কল্যাণী – ৩

তিন

আষাঢ় মাস—কিন্তু ঠিক যেন কার্তিক মাসের আকাশ—এমনই নীল—এমনই পরিষ্কার–ন্যাওতার মাঠের দিকে তাকালে চোখ জুড়িয়ে যায়।

আর ভিলুন্দির জঙ্গল—এমন গাঢ় সবুজ—গাঢ় নীল—রোদের সোনার গুঁড়ি জঙ্গলটার মাথার ওপর দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত একটা জরির পাড়ের মত চলে গিয়েছে যেন—কোন্ পরীদের যেন—এমন বিচিত্র।

পঙ্কজবাবু বললেন—কল্যাণী এখনো ঘুমোচ্ছে—

মেয়ের মাথার ওপর হাত রাখলেন তিনি–

বললেন—আর ঘুমোয় না—

কল্যাণী ঘুমের গলায় বললে—বাবা আমি এখন উঠব না–

—কেন?

—আমার ঘুমোতে ভালো লাগছে

সে পাশ ফিরল।

একটা কোলবালিশ জড়িয়ে ধরে অলসতার নিবিড় আরামে মেয়ের সমস্ত দেহ ভরে উঠছে আবার পঙ্কজবাবু দাঁড়িয়ে দেখলেন—

গুণময়ী ছিলেন; বললেন—থাক্—ও ঘুমোক্।

পঙ্কজবাবু সে কথায় কোনও কান না দিয়ে আস্তে আস্তে গিয়ে পুবের দিকে জানালাটা খুলে দিলেন—চড়চড়ে রোদে কল্যাণীর চোখ মুখ মাথা পুড়ে উঠল যেন।

কল্যাণী বিছানার ওপর উঠে বসে অত্যন্ত বীতশ্রদ্ধ হয়ে বললে—বাবা, তোমার এই কাজ পঙ্কজবাবু বললেন—অনেক ঘুমিয়েছ তুমি

তিনি আরো যেন কি বলতে যাচ্ছিলেন—কল্যাণী নাক মুখ খিঁচিয়ে বললে—অনেক ঘুমিয়েছি তাতে তোমার কি বাবা।

গুণময়ী বললেন—খেঁকি হোস্‌ না

–তুমিও আমার পেছনে লেগেছ মা–

—এত দেরী করেই বা তুই উঠিস কেন?

—যটার সময় খুসি তটার সময় উঠব, তাতে তোমাদের কি?

পঙ্কজবাবু বললেন—নাও, এখন ওঠো, বিছানা ঝেড়ে ঘর গুছিয়ে একটু লক্ষ্মী মেয়ের মত হও।

কল্যাণী বললে—আমি উঠব না।

পঙ্কজবাবুর সাক্ষাতেই শুয়ে পড়ল সে।

গুণময়ী বললেন—থাক্।

কিন্তু কল্যাণী উশখুশ করে সবার চোখের দিকে তাকিয়ে নিজেই উঠে বসল আবার। উঠে বলস, চুপ করে নখ খুঁটতে খুঁটতে।

বললে—বিছানা আমি ঝাড়তে পারব না।

গুণময়ী বললেন—আমি ঝেড়ে দেব যা—

পঙ্কজবাবু বললেন—না, তোমার নিজেরই ঢের কাজ আছে—মেয়ের কাজের জন্য তোমাকে আমি আটকে রাখব না—

কল্যাণী বললে—ঝিটা আছে কি করতে? ওসমানকেই বা কিসের জন্য রাখা?

পঙ্কজবাবু বললেন—তাদের কাজ আছে—

কল্যাণী গরগর করতে করতে বিছানাটা ঝাড়ছিল–ঝেড়েঝুড়ে বিছানাটা পাট করতে করতে বললে—কাজ না হাতী! ওসমানটার আবার কাজ! মেজদার বিছানা রোজ সাফ করে পাট করে দিচ্ছে—আর আমার বেলাই সব—

গুণময়ী বললেন—তোর মেজদার সঙ্গে তার কি কথা!

—ছোড়দারও তো–

গুণময়ী বললেন—তারা তোমার চেয়ে বড়—

—তা বলছ কেন? বল যে তারা ছেলে সেই জন্যই তাদের সব দিক দিয়েই সুবিধে পঙ্কজবাবু বললেন—সে কথা সত্য নয় তো কল্যাণী

কল্যাণী বাপের দিকে তাকিয়ে ঝঙ্কার দিয়ে বলতে যাচ্ছিল ‘সত্য নয়? সত্য কি মিথ্যা

আমি জানি না তো?’ কিন্তু এমন কান্না পেল তার—বাপের সঙ্গে এই সব নিয়ে তর্ক করা এমন নিরর্থক অকিঞ্চিৎকর মনে হ’ল যে ঘাড় হেঁট করে অত্যন্ত স্তব্ধ হয়ে ঘরের কাজ করে যেতে লাগল সে।

গুণময়ী বললেন—এই তো লক্ষ্মী মেয়ে —

পঙ্কজবাবু বললেন—কিন্তু একদিন লক্ষ্মী হলে তো চলবে না—রোজই এই রকম করতে হবে।

গুণময়ী বললেন—তা রোজই হবে—

পঙ্কজবাবু বললেন—এখন আটটা বেজেছে জান কল্যাণী— কল্যাণী অধোমুখে অস্ফুট স্বরে বললে—বাজুক–

সে কথা গুণময়ী বা পঙ্কজবাবু কারুর কানেই প্রবেশ করল না।

পঙ্কজবাবু বললেন—তোমার মা সাড়ে চারটার সময় উঠেছেন—আমি উঠেছি পাঁচটার সময়—আর তুমি ঘুমোলে আটটা অব্দি—

কল্যাণী কিছু বললে না।

পঙ্কজবাবু বললেন—এমনি তো একদিন নয়, কলকাতা থেকে এসে অব্দি রোজই এইরকম অনাচার করছ তুমি—

কল্যাণী চুপ করে রইল।

পঙ্কজবাবু বললেন—বোর্ডিঙে ক’টার সময় উঠতে?

—আটটা ন’টা—শীতকালে দশটার সময়ও উঠেছি।

পঙ্কজবাবু এক আধ মুহূর্ত স্তম্ভিত থেকে বললেন—এ তারা সহ্য করে? এর জন্য কোনো প্রতিবিধান নেই তাদের? কোনো শাস্তি নেই?

কল্যাণী গর্বের সঙ্গে বললে—না।

—রোজি এমন দেরী করে উঠতে তুমি?

—হ্যাঁ

গুণময়ী বললেন—আর সব মেয়েরা?

—যে যখন খুসি উঠত।

বোর্ডিং যে এ বাড়ির চেয়ে ঢের স্বাধীনতা ও ঢের তৃপ্তির জায়গা বাপ মাকে সে কথা বুঝতে দিয়ে কল্যাণী মর্যাদা বোধ করতে লাগল, হৃদয় তার প্রসন্ন হয়ে উঠল।

পুবের দিকের জানালাটা বাবা খুলেছিলেন। কল্যাণী এবার জানালাটার কাছে গিয়ে দড়াম করে সেটা বন্ধ করে তারপর নিজের হাতে ধীরে ধীরে সেটা খুলে দিল মেলে দিল বাবার চেয়ে ঢের নিপুণতা ও দৃঢ়তার সঙ্গে।

মন তার তৃপ্ত হয়েছে।

অভিযোগের বিশেষ কিছু নেই এখন আর।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *