কল্যাণী – ১১

এগারো

পূজোর ছুটিতে কিশোরের সঙ্গে দেশে চলে গেল কল্যাণী। সকালবেলা শালিখবাড়িতে স্টিমার গিয়ে পৌঁছুল। কল্যাণীদের নেবার জন্য পঙ্কজবাবু গাড়ি করে স্টেশনে এসেছিলেন। বাড়িতে পৌঁছে কল্যাণী দেখল দোতলার হলে একটি অদ্ভুত মানুষ বসে রয়েছে; অদ্ভুত ঠিক নয়, অদ্ভুত বলা চলে না; কিন্তু তবুও কল্যাণীর বার বার মনে হতে লাগল কি অদ্ভুত কি অদ্ভুত এই মানুষটি

লোকটি বেঁটেও নয়—লম্বাও নয়; কুঁজো মাথার চুল পাতলা হয়ে সামনে দিয়ে বেশ বড় টাক পড়ে গেছে; মুখ হলদে—কেমন চীনেদের মত যেন; মুখের ছাঁদও একেবারে চীনেদের মত। হঠাৎ দেখে কল্যাণী আঁৎকে উঠল—এমন খারাপ লাগল তার। কিন্তু তবুও ঠিক চীনে নয় যে—বাঙালি যে তা বোঝা যায়। মুখের ওপর পাঁচ ছয়টা আঁচিলের ভিতর থেকে দাড়ির মত লম্বা লম্বা চুল বেরিয়ে পড়েছে; লোকটা সেগুলোকে কাটেও না ছাঁটেও না। একটা সুট পরে বসে আছে সে। টাই ধরে নাড়ছিল। সামনে টেবিলের ওপর একখানা খবরের কাগজ মেলা। কল্যাণীকে দেখে খবরের কাগজ থেকে চোখ তুললে সে।

আর শিগগির সে চোখ ফেরাল না।

এমন আবিষ্ট হয়ে কল্যাণীর দিকে, তাকিয়ে রইল। কল্যাণী ভয় পেল। লোকটার ওপর কেমন অশ্রদ্ধায় ঘৃণায় মনটা বিষিয়ে উঠল তার। হলের থেকে বেরিয়ে গেল সে।

দু’এক মুহূর্তের মধ্যেই এই মানুষটিকে ভুলে গেল কল্যাণী।

গুণময়ী ঘোষ লেবু দিয়ে বেলের সরবৎ করে এনে দিলেন কল্যাণীকে কল্যাণী খেতে খেতে বললে—আমি স্নান করে আসি গে

গেলাসটা সে টেবিলের ওপর রাখল

–এ কি এক চুমুক খেলি শুধু যে—সমস্তটুকু খেয়ে নে

–থাক

—কেন? ভালো লাগে না?

—লাগে বেশ

—তবে?

—আমি ভেবেছিলাম, মা, যে চা খাব—

—তা খাস্

—তুমি বেল দিলে যে?

—বেলও হবে, চাও হবে

কল্যাণী হেসে বললে—তা হয় না।

কল্যাণী গেলাসটা তুলে নিয়ে পানাটুকু ছুঁড়ে ফেলে দিতে যাচ্ছিল—

গুণময়ী বললেন—এত সাধের করা বেল—

কল্যাণী ফেলতে ফেলতে থেমে গিয়ে গেলাসটা টেবিলের ওপর রাখল—

বললে—কে খাবে?

—থাক; কেউ যদি খায়।

স্নান করে কল্যাণী তেতলার বারান্দায় গিয়ে বসল ইজি চেয়ারে। বেশ লাগছিল। পূজোর ছুটিটাই সবচেয়ে ভালো লাগে তার। বেশিদিন দেশে পড়ে থাকতে হয় না। যে ক’টা দিন থাকা যায় সেও বেশ ফুর্তিতেই থাকাই।

খানিকক্ষণ পরে।

একটা বই আনবার জন্য দোতলায় নেমে গেল কল্যাণী; হলের ভিতর দিয়ে যাবার সময় আবার সেই লোকটির সঙ্গে দেখা। এর কথা এক মুহূর্ত আগেও মনে ছিল না, কাগজের থেকে মুখ তুলে কল্যাণীর দিকে আবার সে আবিষ্টের মত তাকিয়ে রইল।

কল্যাণী অত্যন্ত বিরক্ত হয়ে ভ্রূকুটি করে লোকটিকে জানিয়ে দিয়ে গেল যে এরকম করে তাকানো তার উচিত নয়—এ নিতান্তই অসভ্যতা তার।

সে তা বুঝল কি না কে জানে!

এবারও মুহূর্তের মধ্যেই এ মানুষটির কথা কল্যাণী একেবারেই ভুলে গেল।

একটা বই বেছে নিয়ে তেতলার বারান্দায় গিয়ে ইজি চেয়ারে ঠেসে বসল সে। বইটা; বার্নাড শ’র Intelligent Woman’s Pride—

কলকাতার থেকে আসবার সময় মিনু গছিয়ে দিয়েছে। মিনুর বই।

বলেছে : পড়ে দেখিস।

সুপ্রভা দিয়েছে রেড লিলি; মীরা—তার নিজের বাংলা কবিতার খাতা; চিতু—অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ড; এর চেয়ে চমৎকার বই পৃথিবীতে আর নেই; নাকি কমিশনার সাহেব বলেছেন; কল্যাণীর হাসি পেল–হোক না ডিভিশনের কমিশনার

তাই বলেও বইয়েরও কমিশনার?

অ্যালিস অবিশ্যি পড়ে দেখবে কল্যাণী—

কিন্তু পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার বই? তা কক্ষণো হ’তে পারে না। পৃথিবীর? পৃথিবীর!

পৃথিবীর সবচেয়ে চমৎকার বই কি?

জানে না কল্যাণী।

বই সে এত কম পড়েছে!

কল্যাণীর মনে হ’ল কোনো একখানা বইকে সবচেয়ে বড়—সরচেয়ে ভাল—এ রকম বলতে পারা যায় না।

লোকে বাংলা বইগুলোকে এত অগ্রাহ্য করে কেন?

কলেজের মেয়েরাও

বাঙালিদের মধ্যে কি লেখক নেই?

তেমন ধরনের বই নেই?

বাংলা বই অনেক পড়েছে বটে কল্যাণী; মাঝে মাঝে এক একটা বইকে মনে হয়েছে— মন্দ নয়; বেশ তো! এরকম একে একে ঢের বই বেশ লাগল। কিন্তু মিনুকে সেই বইগুলোর নাম বলতেই সে এমন হেসে ফেলল—

মিনু এবার বি-এ দেবে। ঢের জানে।

মিনুর কথাই গ্রাহ্য করতে হয়।

মিনু বলে বাংলায় আবার বই আছে নাকি?

সুপ্রভাও তাই বলে।

চিতু তো বলবেই; সে বাংলা পড়তেও পারে না। ছেলেমানুষের মত বানান ভুল করে যা-তা বাংলা চিঠি লেখে।

মীরার আবাল্য এদের সঙ্গে মত মেলে না। মীরা বাংলা সাহিত্যের ঢের জানে। কল্যাণীর মনে হ’ল ছোড়দা সেদিন কলকাতায় আর্টের কথা বলছিল—থিয়েটার থেকে ফিরেও কি সব বলছিল; আস্তে আস্তে মনে হতে লাগল কল্যাণীর।

সে দিনকার সেই গঙ্গাটাকে মনে হ’ল; মীরার কবিতার খাতা Intelligent Women’s Pride-এর ভেতরেই রয়েছে। খাতাটা সে কোলের উপর উঠিয়ে রাখল।

বইটা খুলল।

কিন্তু পড়তে ইচ্ছা করছিল না।

আশ্বিনের ভোরবেলা।

বহুয়ার মাঠটা কি সবুজ; সাদা সাদা কাশে ভরে গেছে; মাছরাঙা উড়ছে, এক ঝাঁক গাঙশালিখ কিচির মিচির করছে; ক্ষীরুই গাছের ডালে একটা টুনটুনি।

সুপ্রভা বলেছিল নইনীতালে গিয়ে তার মেজদির কাছে থাকবে—মেজদির বরের কাছে; রামঃ! ওতে কি মনুষ্যত্ব থাকে? মিনু যা বলেছে তাইই ঠিক, মেয়েদের স্বামীর সঙ্গে থাকতে হয়—কিম্বা করে খেতে হয়। বাবার সঙ্গেও চিরদিন থাকবার অধিকার নেই মেয়েদের। বাবা তো চিরকাল বেঁচে থাকেন না। এইসব ভাবনা কল্যাণীর মনকে নিরুদ্দেশের মধ্যে ঘোরাচ্ছিল।

কেমন অস্বস্তি বোধ হতে লাগল তার।

গুণময়ী এক গজ মসলিনের কাপড় নিয়ে এলেন

কল্যাণী বললে—কি হবে মা এটা দিয়ে?

–এটার ওপর একটা নক্সা আঁকব

—কিসের নক্সা

—পদ্মর

কল্যাণী হেসে উঠল—

গুণময়ী বললেন—হাসলি যে, ঠাট্টা হ’ল বুঝি? পদ্মর নক্সা আমি আঁকতে পারি না?

কল্যাণী বললে—না, তা নয়, মা, আমি ভাবছিলাম এত নতুন নতুন নক্সা থাকতে সেই একঘেয়ে পদ্মর নক্সা ছাড়া আর তুমি কিছু খুঁজে পেলে না?

জুতোর শব্দ হচ্ছিল

কল্যাণী বললে—বাবা আসছেন বুঝি।

পরের মুহূর্তেই পঙ্কজবাবু আর সেই ভদ্রলোকটি এসে দু’টো সোফায় বসলেন। কিশোরও এল; ইতস্তত সোফা ছড়ানো ছিল—সেও একটায় বসল।

কল্যাণী দেখলে মা উঠলেনও না, চোখও তুললেন না, ঠায় বসে ডিজাইন বুনছেন-—একটা পদ্মর ডিজাইন।

কল্যাণীও বসে রইল।

ভদ্রলোকটি গুণময়ীর দিকে তাকিয়ে বললেন—আমি তো আপনাদের সকলকেই চিনি—কাজেই লজ্জার আর কি?

গুণময়ী একটু হেসে বললেন—হ্যাঁ, লজ্জাসঙ্কোচের আর কি?

কল্যাণীর মনে হ’ল লজ্জার যে কিছু বা কিছু নয় সে সব কথা এ মানুষটিকে জিজ্ঞেস করেছে নাকি কেউ? ভারী তো গায় পড়ে কথা বলার অভ্যাস। সে বিরক্ত হয়ে বইয়ের পাতার দিকে তাকিয়ে রইল।

ভদ্রলোকটি বললেন—কত্তা আমাকে একেবারে আপনাদের অন্দরের মধ্যে টেনে এনেছেন আমি আপনাদের ডিস্টার্ব করছি না তো—

গুণময়ী বললেন—আপনি আসাতে খুব খুসি হয়েছি—

—তার চেয়েও বেশি খুসি হয়েছি আমি—

পঙ্কজবাবু একটা চুরুট ধরিয়ে বললেন—তুমি একটা চুরুট তুলে নাও চন্দ্ৰমোহন।

এর নাম তবে চন্দ্রমোহন? কল্যাণী ঘাড় তুলে একবার তাকাল; চন্দ্রমোহন তার দিকে কেমন এক রকম করে যেন তাকিয়ে রয়েছে। কল্যাণীর কেমন যেন গ্লানি বোধ হ’ল।

কেমন কুৎসিৎ বিশ্রী চেহারা—হলদে রং চীনের মত মুখ—মুখে আঁচিল ভরা ভরা দাড়ি—এ ভদ্রলোক কোত্থেকে এলেন? কেন এলেন? তাদের পরিবারেই বা কেন? বাবার সঙ্গেই বা এত খাতির কেন? সমস্ত বাড়িটা পড়ে থাকতে কল্যাণী মধুর অবসরের জায়গায়ই বা কে আসতে বললে তাদের…ভাবতে ভাবতে কল্যাণীর সমস্ত শরীর মন যেন পীড়িত হয়ে উঠল।

সে উঠে যেত কিন্তু নড়তে চড়তেও তার যেন কেমন ঘৃণা বোধ হচ্ছিল—বইটার দিকে একমনে তাকিয়ে রইল সে।

চন্দ্রমোহন বললে—আমি চুরুট খাই না; মাপ করবেন।

পঙ্কজবাবু গুণময়ীকে বললেন—দেখেছ এমন সৎএকটা চুরুট অব্দি খায় না।

গুণময়ী একটু হাসলেন

চন্দ্রমোহন বললে—আমাকে লজ্জা দেবেন না, আপনার উদার অটুট অতুলনীয় চরিত্রের কাছে আমাকে টেনে এনে কেন কলঙ্ক বাড়ানো। চুরুট কেন, আপনি যদি মদের বোতলও হাতে ধরেন তবুও তা আপনার চরিত্রের মাধুর্য্যে যেন সুধায় রূপান্তরিত হয়ে যায়—

কল্যাণীর এমন হাসি পেল, তার মনে হ’ল ছোড়দাও নিশ্চয়ই হাসছে; কিন্তু কিশোরের মুখ গম্ভীর।

মার দিকে তাকিয়ে দেখল কল্যাণী—মাও স্থির; বাবার মুখ প্রসন্ন।

কল্যাণী অবাক হয়ে ভাবল; এ কি, চন্দ্রমোহনের ভণ্ডামি কেউ ধরতে পারছে না কেন?

চন্দ্রমোহন গুণময়ীর দিকে তাকিয়ে বললে—আপনার অনেক পুণ্যি মা, জন্মজন্মের তপস্যায় এমন শিবস্বামী কপালে আসে—

গুণময়ী ও পঙ্কজবাবু দু’জনের দিকে লক্ষ্য করেই খুব গভীর ভক্তির সঙ্গে নমস্কার করল চন্দ্ৰমোহন।

কল্যাণীর মনে হ’ল চন্দ্রমোহনের বিরুদ্ধে তার মনের ঝাল আগের মতন তেমন তীব্র নেই—লোকটা অসহ্য বটে, কিন্তু তবুও অগ্রাহ্য করতে পারা যায় একে, ক্ষমা করতে পারা যায়।

চন্দ্রমোহন বললে–আপনার আলুবখরার টক ভারী চমৎকার মা

গুণময়ী বললেন—একদিন তো শুধু রেঁধেছি

—ঐ একদিনেই কিনে নিয়েছেন—

পঙ্কজবাবু বললেন—যে ক’দিন আছে, একটু আলুবখরা দু’বেলা করলেই পার

গুণময়ী প্রীত হয়ে বললেন—আমি আগে যদি জানতাম—

চন্দ্রমোহন বললে—আমার মা পিসিমা জেঠিমা মাসীমা মামী—সবারই দুর্দান্ত রান্নার হাত—কলকাতার সব জাঁহাবাজ নেমন্তন্ন সামলান—কিন্তু টক, এমন চাটনি তো কেউ রাঁধতে পারেন না।

সকলেই নিস্তব্ধ হয়ে রইল।

চন্দ্রমোহন বললে–আপনার চিংড়ী কাটলেটই বা কি চমৎকার! কলকাতার কত রেস্টুরেন্টে আমি খেয়েছি—একদিন এক চীনে বারী খাসা রেধে দিয়েছিল—কিন্তু আপনার হাতের ভাজা খেয়ে বুঝলাম যে এদ্দিন ছিবড়ে খেয়েছি–

গুণময়ীর চোখ মুখ উৎফুল্ল হয়ে উঠল।

পঙ্কজবাবু বললেন—গিন্নী রান্না শিখেছিলেন তাঁর মার কাছে— খুব ঝাঁঝালো রাঁধুনির গুষ্টি।

চন্দ্ৰমোহন বললে— আপনি কি আঁকছেন মা?

পদ্ম

বাঃ কি চমৎকার ছুঁচের কাজ উঠে আসছে—কি গ্র্যান্ড বাঃ! এমন চেকনাই পদ্ম তো আমি কোনোদিন দেখিনি

পঙ্কজবাবু বললেন—বেশ হাত আছে—

গুণময়ী বলেন—এখনও হয়নি—

চন্দ্রমোহন বললে—এরকম আরও বুনেছেন আপনি?

—হ্যাঁ

চন্দ্ৰমোহন বললে—আপনার তো শুধু এই করাই উচিত—যে জিনিয়াস আর্টের থাকে অন্য কিছু দিয়ে খোয়ানো উচিত নয়—

কল্যাণী শিহরিত হয়ে উঠল; এ লোকটাও আর্টের কথা বলছে?

চন্দ্রমোহন পঙ্কজবাবুকে বললে—আপনাদের ড্রয়িংরুমে কার্পেট দেখলাম—চমৎকার কার্পেট—এমন কার্পেট কোথাও তো দেখিনি আমি আর—অথচ কলকাতায় বড় বড় ব্যাপারীদের সঙ্গে আমার কার্বার

সকলেই গর্ব অনুভব করতে লাগল—কি না লাগল ঠিক বুঝতে পারল না কল্যাণী। লোকটা বেশি বাড়াবাড়ি করছে না তো।

চন্দ্রমোহন বললে—আর কি জমকালো বই বাড়িখানা করেছেন—ঠিক যেন একটা পুরীর মত; কলকাতায় কত রাজামহারাজার বাড়ি দেখেও এরকম মন ওঠেনি আমার—

চন্দ্রমোহন গম্ভীর সম্ভব বিস্ময়ের সঙ্গে বাড়িখানার কড়ি বর্গা দরজা জানালা খিলান চৌকাঠের দিকে তাকাতে লাগল—

বাড়িখানার রেণুপরমাণুর দিকে তাকিয়ে চন্দ্রমোহনের সঙ্গে অন্য অন্য সকলেও খুব গৌরব বোধ করছিল হয়তো; কিম্বা আত্মসমালোচনায় নিমগ্ন হয়েছিল।

কিশোরের দিকে তাকিয়ে বললে—এই ছেলেটি আপনার খুব বড় কবি হবে—

পঙ্কজবাবু ও গুণময়ী ঈষৎ কৌতূহলে চন্দ্রমোহনের দিকে তাকাল—

চন্দ্রমোহন বললে—এমন ভাবুক চিন্তাশীল চিত্তবৃত্তি শিগগির আমি আর দেখিনি—

পঙ্কজবাবু বললেন—কি করে বুঝলে?

চন্দ্রমোহন বললে—চোখ নাক কপাল দেখলেই বুঝতে পারা যায় এর কত বড় প্রতিভা—আমি এতক্ষণ অবাক হয়ে বসে বসে দেখেছি

অবাক হয়ে বসে বসে বাস্তবিক সে দেখছিল কল্যাণীকে; কিন্তু কল্যাণী মুখও তুল্ল না— কিশোরের প্রতিভার প্রশংসার কথা শুনেও চন্দ্রমোহনের মুখ থেকে নিজের প্রশংসা শুনবার জন্য বিশেষ কোনও আগ্রহ বোধ করল না সে; কল্যাণীর মনে হ’ল এ লোকটি সব জিনিসকেই চমৎকার বলে, সাজিয়ে সাজিয়ে মনের মতন কথা বলে বাবা মার মন গলাতে চায় শুধু, কল্যাণী কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারছিল না যে তাদের ড্রয়িং রুমের কার্পেট কলকাতার সব দোকানের সব রকম কাপের্টের চেয়ে সেরা—অত্যন্ত শস্তা সাধারণ কার্পেট তাদের; মার হাতের আঁকা পদ্ম অত্যন্ত সাদাসিদে জিনিস—আলুবখরার টকও তেমনি — চিংড়ির কাটলেটও তাই—

কিন্তু চন্দ্রমোহনের হলদে রং—আর চীনেম্যানের মত মুখ—মুখ ভরা আঁচিল আর আঁচিলের দাড়ি—সেগুলো যে অত্যন্ত কুৎসিৎ সে বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।

কল্যাণী ভ্রুকুটি করে বসে রইল।

পঙ্কজবাবু বললেন—এখন কাজের কথা।

চন্দ্রমোহন অত্যন্ত বিরসভাবে বললে—কাজ আর কি? পাটের জন্য আমাদের বিস্তর ক্ষতি দিতে হয়েছে—

—কত?

—আশী লাখ টাকা

—আশী লাখ!

চন্দ্রমোহন একটু হেসে বললে—আশী লাখ আবার টাকা

বলে কল্যাণীর মুখের দিকে তাকাল। কিন্তু এ মেয়ের মুখের ভিতর কোনো পরিবর্তন নেই; সে ঘাড় গুঁজে বই-এর পাতার দিকে তাকিয়ে পড়ে যাচ্ছে

পঙ্কজবাবু বললেন—তাহ’লে অদ্বিতীয় বিড়লার ব্যবসা

—হ্যাঁ পাঁচ সাত কোটি টাকার

—পাঁচ সাত কোটি

চন্দ্রমোহন একটু বিনয়ের সঙ্গে বললে—তা হ’লই বা পাঁচ সাত কোটি! টাকাকে আপনি অত বড় করে দেখেন কেন পঙ্কজবাবু। টাকাই কি সব? তাহ’লে বেনেরাই তো পৃথিবীর সবচেয়ে বড় মহাপুরুষ হ’ত। মহাপুরুষ—মনুষ্যত্ব সে সব একেবারেই আলাদা জিনিস

এ কথাগুলো শুনতে পঙ্কজবাবুর ভালো লাগছিল—গুণময়ীরও।

কল্যাণীরও মনে হ’ল বেশ বলেছে; খনখনে গলাটাকে আগের মতন তেমন খনখনে বোধ হচ্ছে না যেন; কেমন যেন আন্তরিকতায় ভিজে উঠেছে এবার।

অনেকক্ষণ পরে এবার চন্দ্রমোহনের দিকে তাকাল কল্যাণী। দেখল চন্দ্রমোহন তার দিকেই তাকিয়ে আছে—খুব অবসন্ন মনে হচ্ছে লোকটাকে; কেমন যেন একটা নিরন্তর নিবেদন কল্যাণীর কাছে তার। চন্দ্রমোহনের ওপর আগের মত ঘৃণা নেই যেন আর কল্যাণীর—কেমন একটু দয়াবোধ হতে লাগল এ লোকটির জন্য—মনে হতে লাগল এর চেহারা তো এ নিজে তৈরি করেনি—বিধাতা দিয়েছেন; কিন্তু এর মনটা তো এ নিজে প্রস্তুত করে তুলেছে একরকম মন্দ না—

কিন্তু এ সব ভাবনা কল্যাণীর দু’এক মুহূর্তের জন্য। এ লোকটি কি—এবং কি নয় সে নিয়ে কল্যাণী আর মাথা ঘামাতে গেল না।

সেরকম চিন্তা তার ভালো লাগছিল না। মোটেই ভালো লাগছিল না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *