কল্যাণী – ১৬

ষোলো

পরদিন সকাল বেলা।

পঙ্কজবাবু বললেন—হ্যাঁ গিয়েছিলাম বটে—

কল্যাণী বলল—পরশু রাতে?

হ্যাঁ—

—আমি তখন ঘুমিয়েছিলাম—

—তুমি ঘুমিয়েছিলে—

—তখন কেন গেলে বাবা?

—দরকার ছিল।

চন্দ্রমোহনবাবুকেও সঙ্গে নিয়েছিলে?

—হ্যাঁ

কল্যাণী বিহ্বল হয়ে বললে—ওকে নিলে কেন?

—কি হয়েছে তাতে।

কল্যাণী হতাশ হয়ে বললে—বাবা!

চন্দ্ৰমোহনকে আমি আমার ছেলের মত মনে করি—

—তোমার ছেলের মত!

—হ্যাঁ, বিজলীর থেকে ভালো নয় কি?

—বড়দার থেকে ভাল?

ঢের—ঢের–ঢের—ঢের ভাল।

কল্যাণী দু’এক মুহূর্ত নিঃশব্দ হয়ে রইল।

পঙ্কজবাবু নীরবে চুরুট টানতে লাগলেন—

কল্যাণী বললে—আমার টেবিলের বইগুলোও দেখেছিলে তুমি?

—হ্যাঁ; ও রকম বই কেন তুমি পড়? ওসব বই কে তোমাকে দেয়? ফরাসী ডিকাডেন্সের ভগবানহীন সংযমহীন নরমাংসের নারীমাংসের নরককুণ্ডের বই সব—কে তোমাকে দেয়? কোত্থেকে পাও?

কল্যাণী এ বিশেষণগুলোর একটিরও কোনো মানে বড় একটা বুঝল না; সুপ্রভা অবিশ্যি কয়েকখানা ফরাসী উপন্যাসের ইংরেজি অনুবাদ তাকে দিয়েছিল; কিন্ত সেগুলো কল্যাণী পড়তে পারেনি—বোঝেনি—দু’এক পাতা দু’এক পাতা পড়ে কিছুই হৃদয়ঙ্গম হয়নি তার।

সে নীরব হয়ে রইল।

আহা, বেচারী, কল্যাণী,—সাহিত্যের সঙ্গে তার কোনো সম্পর্ক নেই—আর্টের সঙ্গেও না; যাদের কিছু আছে—তারা কয়েকখানা বই দিয়েছিল তাকে; সেগুলোর সুন্দর সুন্দর মলাট রাঁধাইয়ের চমৎকার কারুকার্য দেখে নিজের টেবিলের ওপরে রেখেছিল মেয়েটি—নিতান্তই টেবিল সাজাবার জন্য। আর্টের কি বোঝে সে? সাহিত্যের কি জানে? জীবনের কি বোঝে?

জীবনের কাছে সে ঢের ঢের নিরপরাধ—পঙ্কজবাবু বা গুণময়ীও কোনোদিন ততখানি ছিলেন না।

পঙ্কজবাবু না বুঝে মেয়েটিকে অপরাধী সাজিয়ে আর্ট ও সমালোচনার থেকেও একেবারে ছিটকে গিয়ে জীবনের নানা রকম স্থূলতার কথা বলতে লাগলেন—নিজে ব্যাহত হতে লাগলেন—মেয়েটিকে মর্মান্তিক ব্যথা দিতে লাগলেন।

পঙ্কজবাবু বললেন—তোমার ডায়েরীও দেখলাম; ও সব কি লিখেছ তুমি? আমাকে ভুল বুঝিয়েছ এতদিন বসে। তারিখের পর তারিখ মিলিয়ে দেখলাম বায়োস্কোপ দেখেছ— সারকাস দেখেছ—কার্নিভালে গিয়েছ—লাকি সেভেন খেলেছ—সোডা পাউন্টেনে গিয়েছ— তুমি থিয়েটার অব্দি দেখেছ কল্যাণী ওই কিশে বাঁদরটার সঙ্গে আর বাড়িতে আমাকে চিঠি লিখেছ আমি কিচ্ছু দেখি নি—এ তোমার কি অদ্ভুত অন্যায় বল দেখি কল্যাণী।

কল্যাণী কেঁদে ফেলল।

পঙ্কজবাবু বললেন—শুধু কি তাই? মেয়েদের সঙ্গে কত কি অনাচার কর তুমি বোর্ডিঙে

পঙ্কজবাবু একটু থেমে বললেন—এই বিধাতাহীন সংসহীন নরমাংসের নারীমাংসের বইগুলো পড়ে এই রকমই তো হবে—কোন মেয়ে তোমাকে চুমো দিল তাই নিয়ে তুমি কবিতা করতে আরম্ভ করলে—চারদিককার ডিকাডেন্সের শয়তান আর্টিস্টদের মত—কি উৎকট!

কল্যাণী অতসত কিছু বুঝল না; বুঝল এইটুকু যে সে উদঘাটিত হয়ে গেছে—সে যা সহজ মনে স্বাভাবিকভাবে সৌন্দর্যের সঙ্গে করেছে—যে জিনিসকে মানুষের প্রশংসা করা উচিত বলে মনে হয়েছে তখন তার—বাবা তার ভিতর পৃথিবীর পাপ ঢুকিয়ে দিলেন; আর সে যা করেনি, যে সবের নাম শোনেনি, যা বোধ করেনি, সেই সবও বাবা তাতে আপত্তি করলেন। সে যদি পারত—তা হলে অনেক কথা বলত বাবাকে—যার পর বাবা তাকে আর অভিযুক্ত করতে পারতেন না, রাগ করতে পারতেন না তার ওপর আর। কারণ, মন তার জানে, খুব ভালো করেই জানে যে বাবা যা চান—তার নিজের মনও ঠিক তাইই চায় এবং তাইই সে করে এসেছে; যেখানে এক আধটু ব্যতিক্রম হয়েছে তা তার দোষ নয়—অপরের দোষে— অপরেরও দোষে নয়—কে জানে কার দোষে!

কার দোষ জানে না কল্যাণী। কিন্তু দোষটা মানুষের অজ্ঞানতার ও সময়ের ভবিতব্যতার।

কল্যাণী আঁচল দিয়ে চোখের জল মুছতে মুছতে ভাবছিল; বাবা কেন এ সব বুঝবেন না?

কিন্তু বুঝিয়ে বলবার ক্ষমতাও তার একটু ছিল না।

পঙ্কজবাবু বললেন—যাক

তিনি চুরুট জ্বালাতেন।

‘ওসব বই মেয়েদের ফিরিয়ে দিও।’

কল্যাণী শান্তভাবে ঘাড় নেড়ে বলল—দেব।

—আর ডায়েরীটা পুড়িয়ে ফেলো

—ছিঁড়ে ফেলেছি

—সমস্ত

—হ্যাঁ

—বেশ ভালোই হয়েছে।

পরে বললেন—আর ওরকম লিখো না।

কল্যাণী বুঝতে পারছিল না যে তার কবিতা বা আর্টই শুধু নয়—তার ভিতরের জীবন স্বপ্ন ও আরাধনা সাধনা ও সৌন্দর্যের জীবন তার দিনের পর দিন ঐ লেখার ভিতর দিয়ে ফলে উঠছিল তার। বাবাকে সে বললে আর কোনোদিনও ঐ সব লিখতে যাবে না সে।

কল্যাণী বললে—আমি বুঝতে পারিনি যে এসব লেখা খারাপ–এর ভেতর অন্যায়। কি যেন বললে তুমি বাবা বিধাতাহীন সংযমহীন নরমাংসের নারীমাংসের

পঙ্কজবাবু কল্যাণীকে থামিয়ে দিয়ে বললেন—না—না—না—তা নয়; কিন্তু ক্রমে ক্রমে সেই সব দিকে যায়।

কিছুক্ষণ ধরে নীরবে চুরুট টেনে পঙ্কজবাবু বললেন–এখন কাজের কথা কল্যাণী— কল্যাণী বাবার দিকে তাকাল—

পঙ্কজবারু বললেন—পরশু রাতে তোমার কাছে গিয়েছিলাম আমরা—আরো একটা দরকারে—

পঙ্কজবাবু চুরুটার দিকে একবার তাকালেন—খানিক্ষণ বসে।

তারপর বললেন—তুমি কি কাউকে ভালোবাসা?

কল্যাণী মুখ নত করল।

পঙ্কজবাবু বললেন—কোনো ছেলে ছেলেছোকরাকে? কলকাতায়?

কল্যাণী অধোমুখে নিরুত্তর হয়ে রইল।

—বাসনি তাহ’লে। আমিও তাই ভেবেছিলাম। সে বেশ, সে খুব ভালো কথা। কলকাতায় কলেজেটলেজে পড়ে মেয়েরা অনেক সময় অনেক নির্বোধের মত কাজ করে ফেলে—

পঙ্কজবাবু বললেন—যাক, তুমি সে সবের থেকে ত্রাণ পেয়েছ।

কল্যাণীর মনে হ’ল ভালোবাসার থেকে তাঁর মেয়ের ত্রাণ চাচ্ছেন বাবা–বেশ তাই হোক—যথেষ্ট বিরুদ্ধাচার করা হয়েছে বাবার সঙ্গে, নিজের ভালোবাসার কথা বলে বাবাকে আর সে পীড়িত করতে যাবে না; নিজের ভালোবাসা তার নিজের মনের নিস্তব্ধতার ভিতরেই থেকেই যাক–হয়তো ভালোবাসাও পাপ, অন্তত বাবা যদি ডায়েরীর মত সেটা উদঘাটিত করতে পারেন তা হলে নিশ্চয় তা পাপ হবে—বিধাতাহীন সংযমহীন নরমাংসের নারীমাংসের জিনিস হয়ে দাঁড়াবে তা; কিন্তু নিজের মনের গোপনে তা এখন পাপ নয়—ভুল নয়—ভয় নয়—পৃথিবীর নানা দিককার নিঃসঙ্গতার ভিতর কেমন একটা ক্রমায়াত দীপ্ত অবলম্বের জিনিস।

পঙ্কজবাবু বললেন—তারপর আমাদের জমিদারীর যা অবস্থা-দিন দিন দেনা বেড়ে যাচ্ছে শুধু—তোমার দাদাকে বিলেত পাঠিয়ে আমাদের খোয়ারের এক শেষ হয়েছে।

কল্যাণী বললে—বদড়ার চিঠি পেয়েছ বাবা?

মেয়ের কাছে সে সব জিনিস চাপা দিয়ে যেতে চাইলেন পঙ্কজবাবু। কিছু বললেন না।

কল্যাণী বললে—আমাদের কাছে চিঠি লিখে না কেন বড়দা?

পঙ্কজবাবু কোনো উত্তর দিলেন না।

কল্যাণী বললে—মার কাছেও লেখে না।

দু’জনেই কিছুক্ষণ চুপচাপ। আরো কিছুটা সময় নিস্তব্ধতায় কেটে গেল।

কল্যাণী বললে—বড়দা আসবে কবে? আমাকে এসে কত বড় দেখবে, না বাবা?

যখন চলে গিয়েছিল বড়দা, আমি তখন ফ্রক পরতাম—

পঙ্কজবাবু বললেন—জমিদারীর তো এই অবস্থা—এক এক সময় মনে হয় কোর্ট অব ওয়ার্ডসে তুলে দেই—

কল্যাণী চমকে উঠল।

বললে—না বাবা তা দিতে হবে না।

—বলা যায় না, কিশোরকে দিয়েও কিছু হবে না; যা এক প্রসাদ। সে যদি রাখতে পারে তা হ’লে থাকবে—না হ’লে আমার আর কিছু করবার নেই। আমার কিছু সাধ্য নেই আর

কল্যাণী অত্যন্ত কষ্ট পেয়ে বললে—আমি ছেলে হলে তোমার ঢের উপকার করতে পারতাম বাবা—

পঙ্কজবাবু বললেন—মেয়ে হয়েও কি পারা যায় না? খুব পারা যায়। করবে?

কল্যাণী খুব উৎসাহ গর্ব অনুভব করে বললে—আমি খুব পারব।

সে ভেবেছিল তাকে বুঝি আর বায়োস্কোপ দেখতে হবে না, সার্কাস থিয়েটারে যেতে হবে না, ডায়েরী লিখতে হবে না। ভালোবাসাতে হবে না; এই সব। এই সব বিরতির কাজ করতে বলবে বাবা তাকে হয়তো; করবে সে–বাবার এই সব নির্দেশ সজ্ঞানে পালন করবে।

গুণময়ী এলেন—

পঙ্কজবাবু বললেন—তোমাকে দেখে চন্দ্রমোহনের খুব ভালো লেগেছে—আমার কথা শুনছ কল্যাণী।

চুরুটে টান দিয়ে বললেন—ছেলেও খুব সৎ—ওদের পারিবার জানি আমি; ওকেও জানি।

কল্যাণীর বুকের ভিতর ঢিবঢিব করছিল।

পঙ্কজবাবু বললেন—টাকাও ঢের-আমাদের মত দু’দশটা জমিদারী কিনে ফেলতে পারে ওখানে গিয়ে তোমার সুখ হবে—সব দিক দিয়ে মঙ্গল হবে।

কল্যাণীর নিঃশ্বাস আটকে আসছিল—

সে ডুকরে কেঁদে উঠে বললে কি বল তুমি বাবা!

পঙ্কজবাবু বললেন–চন্দ্ৰমোহন তোমাকে বিয়ে করতে চায়—আমিও চাই তুমি তাকে বিয়ে কর–তোমার মাও তাই চান—তোমার মেজদারও অমত নেই।

কল্যাণী কাঁদতে কাঁদতে তর্জ্জন করে উঠে বললে—বল কি তোমরা সব? মেজদা বিয়ে করবে, না তুমি করবে? তবে যে বড় বলছ! ঐ উল্লুকটাকে বিয়ে করব আমি? আমার বাপ হয়ে তুমি এই কথা বলতে সাহস পাও? আমি সব ছেড়ে দিয়ে চলে যাব তবু ওই বাঁদরটাকে বাঁদর ছাড়া আর কিছু বলতে পারব না। বাঁদর উল্লুক কোথাকার! এত বড় কথা বলে।

আকাশ-পাতাল ভাসিয়ে অসাড় অবোধ হয়ে কাঁদতে লাগল কল্যাণী।

পঙ্কজবাবু স্থিরভাবে চুরুট টানছিলেন—

একটি চুরুট তাঁর ফুরিয়ে গেল—আর একটি তিনি নিলেন; আস্তে আস্তে জ্বালালেন।

যেমনি টানছিলেন—টেনে যেতে লাগলেন।

গুণময়ীও এতক্ষণ চুপ করে ছিলেন।

গুণময়ী বললেন—ওর যদি না ইচ্ছে করে, তবে আর মিছেমিছে এ দিয়ে কি দরকার; চন্দ্রমোহন ছেলে ভালো বটে—কিন্তু মেয়েরও তা একটা রুচি অভিরুচি থাকে—তাও তো দেখতে হয়।

পঙ্কজবাবু বললেন—আমি সব জানি, আমি সব বুঝি। কল্যাণীকে স্থির হতে দাও। নানারকম বই পড়ে সঙ্গে মিশে ওর মনের ভিতর জিলিপীর পাক আর অমৃতির প্যাচ। বয়সও কম—নিজের মনটাকে ধরতে পারছে না তাই। আমাদের কাছে থাকলে শান্ত সুস্থির হয়ে ভাবতে পারবে, নিজের মনের কথা টের পাবে—তখন বুঝবে—বুঝবে সব।

কল্যাণী ধীরে ধীরে মাথা তুলল—

পঙ্কজবাবু বললেন—চন্দ্রমোহনের সম্বন্ধে ও তো কিছু জানে না—

কল্যাণী বলল—আমি জানতে চাই না বাবা—

পর মুহূর্তেই বললে—যথেষ্ট জানি ঐ উল্লুকটার সম্বন্ধে আমি; চাটগাঁয়ের মগের মত মুখ-হলদে রং; চোখ দুটো কুত কুত করে—সমস্ত মুখে আঁচিল আর দাড়ি

বলতে বলতে কেঁদে ফেললে কল্যাণী

গুণময়ী বললেন—ছি!

—আর বোলো না মা —

—কে বলছে তোমাকে যে চন্দ্রমোহনকেই বিয়ে করতে হবে তোমার

কল্যাণী মায়ের কাছ থেকে এই সান্ত্বনাটুকু পেয়ে ধীরে ধীরে আঁচল দিয়ে চোখ মুছে একটু শান্ত হয়ে বসল।

মনটা তার এখন খানিকটা ভালো লাগছে,

গুণময়ী বললেন—তোমার বাবা তো বলেননি চন্দ্রমোহনকে তোমার বিয়ে করতে হবে; তবে একটু ভেবে দেখতে বলেছেন; তোমার ইচ্ছা যদি হয়—তা হলে তুমি করবে পাত্রটিকে আমাদের খুব ভালো মনে হয়—আমরা তোমার মঙ্গল চাই—

গুণময়ী থামলেন।

পঙ্কজবাবু কোনো কথা বলছিলেন না।

গুণময়ী বললেন—তাড়ার কিছু নেই; তোমাকে যে এখুনি করতে হবে এমন কিছু নয়। তুমি আমাদের কাছে থাক—শান্ত হয়ে ব্যাপারটা ভাব। ধা করে একটা মতলব করে বোসো না। তোমাকে বিয়ে করতে বলা হয়েছে বলে ওমনিই যে তুমি মত দিয়ে বসবে—তাও আমরা চাই না—কিম্বা চন্দ্ৰমোহনকে উল্লুক বাঁদর বলে গাল দিয়ে তাড়িয় দেবে সেটাও ঠিক কথা নয়—একটু স্থিরভাবে ভেবে দেখ কল্যাণী—

কল্যাণী বললে—মা আমি ভাবতে পারি না কিছু—এ আমি কল্পনাও করতে পারি না—

–ওই তো, ছি ছি ছেলেমানুষী করতে হয় না—গুণময়ী বললেন

পঙ্কজবাবু চুরুট টানছিলেন—

গুণময়ী বললেন–তোমার বাবা—আমি—আমার সংসারের ঢের দেখেছি; অনেক কিছু জানি শুনি—বুঝি—আমরা ভেবে যা বলি তার একটা মূল্য আছে। আমাদের নির্দেশ শুনলে তোমার ভুল হবে না। কিন্তু তবুও তোমার মতামতের স্বাধীনতা দেব আমরা। তুমি যা ভাল বোঝ তাও আমরা শুনব—

কল্যাণী বললে—আমি এই ভালো বুঝি যে চন্দ্ৰমোহনবাবুর কথা ভাবতে গেলেও আমার অন্নপ্রাশনের নাড়ীশুদ্ধ প্যাচ খেতে থাকে তার চেয়েও মৃত্যু আমার ঢের ভালো মনে হয়।

কেউ কিছু বললেন না।

কল্যাণী বললে—বাপরে, কি ভীষণ! কলকাতার থেকে এসে দেখি একটা মগের মত একটা বাঁদরের মত দোতলার ঘরে বসে আছে—একটা ছাগলের মত আমার দিকে তাকাচ্ছে—আমার সমস্ত শরীর ভয়ে ঘেন্নায় ব্যথায় কাঁটা দিয়ে উঠল—আর তাকে নিয়েই কিনা এত দূর! বাপরে, বাপরে, বাপরে, বাপরে

গুণময়ী বললেন—তুমি বড় অস্থির হয়ে ওঠো কল্যাণী—

—হব না? তোমরা ভেবে দেখেছ কি ভয়ঙ্কর কথা তোমরা বলেছ আমাকে গুণময়ী বললেন—চা খেয়েছিলি?

—না

—দুধ? ওভালটিন?

—না

—কিছু না

কল্যাণী ঘাড় নেড়ে বললে—না, আমার খেতে ইচ্ছে করে না কিছু–

গুণময়ী বললে–নে, নে, আর একটু দুধটুধ খেয়ে যা।

কল্যাণী বললে—আমার কিছু খেতে ইচ্ছে করে না মা।

গুণময়ী বললে—চল চল না খেলে বাঁচবি কি করে?

মায়ের পেছনে পেছনে বাঁচবার আয়োজন করতে অবশেষে গেল সে—এখন খানিকটা শান্ত স্থির হয়েছে তার মন—চন্দ্রমোহনকে বিদায় দিয়ে দিয়েছে একেবারে সে—পৃথিবীটা আবার আনন্দ ও উপভোগের জায়গা বলে বোধ হচ্ছে কল্যাণীর।

খুব চমৎকার বেলের পানা খেল কল্যাণী—এক বাটি ক্ষীর খেল—চার পাঁচটা চাট্টিম কলা পাউরুটি আর মাখন খেয়ে কিশোরের সঙ্গে লুডো খেলতে বসে দিনটাকে তার পৃথিবীর একটি নিত্য স্বাভাবিক দিনের মত–তার সমস্ত অতীত জীবনের সমস্ত দিনের মত অঢেল সুন্দর নৈসর্গিক মনে হতে লাগল।

কিন্তু সন্ধ্যায় অন্যরকম।

প্রসাদ আর চন্দ্রমোহন পঙ্কজবাবুর বগি গাড়িতে করে হাওয়া খেতে বেরিয়ে গেছে; কিশোরও ছিল না।

তেতলার বারান্দায় তিন জন শুধু—পঙ্কজবাবু, কল্যাণী, গুণময়ী—

পঙ্কজবাবু বললেন—সারাদিনটা কি করলে কল্যাণী?

কল্যাণী সহসা কোনও উত্তর দিতে পারছিল না।

একটু পরে বললে—ঘুমিয়েছি—পড়েছি—

—কি পড়েছ?

—কলেজের বই

পঙ্কজবাবু একটু হাসলেন; কেমন যেন উদাসীন ভ্রুক্ষেপহীন একরকম হাসি। কল্যাণীর মনে হ’ল বাবা পড়াশুনার কোনও মূল্যই দিলেন না। এইরকম করে অবজ্ঞা করে হাসলেন—

পঙ্কজবাবু বললেন—এখন মনটা একটু স্থির হয়েছে তোমার?

কল্যাণী এ প্রশ্নের কোন জবাব দিল না।

পঙ্কজবাবু বললেন—শান্তভাবে ভেবে দেখলে ব্যাপারটার ভিতর কিছু অমঙ্গল পাবে না তুমি। তোমার মার কাছে যেমন, আমার কাছে যেমন—আশা করি তোমার কাছেও তেমনি জিনিসটা কল্যাণের জিনিস বলে মনে হয়েছে—

কল্যাণী বললে—কি জিনিস?

পঙ্কজবাবু উত্তর দিতে একটু দেরী করলেন—

পকেট থেকে চুরুট বের করলেন—

চুরুট নিয়ে খেলা করলেন—

পরে চুরুট জ্বালিয়ে নিয়ে আস্তে আস্তে বললেন—চন্দ্রমোহনের সঙ্গে আজো আমার কথা হয়েছে; সে আর আপেক্ষা করতে পারে না। তাকে যা হয় একটা কথা দিতে হবে আমাদের—তা খুব তাড়াতাড়ি

কল্যাণী বললে—কথা দিয়ে দেও যে আমি তাকে কিছুতেই বিয়ে করতে পারব না।

পঙ্কজবাবু একটু হেসে বললেন—অত সহজে কি কিছু হয়–

কল্যাণী বললে—আমার তা হয়-—

একটু থেমে বললে—যদি হবার হ’ত, এত কথা বলতে হত না তো তোমাদের। ঢের আগেই হয়ে যেত। আমি কি বুঝি না তোমাদের কত হেনস্থা হচ্ছে? সে জন্য আমার খুব খারাপ লাগে, কিন্তু তবুও ওকে সরে যেতে বলা ছাড়া আর উপায় নেই। আমার সামনে ওকে বেরুতেও বারণ করে দিও তোমরা—আমি টেবিলে গিয়েও আর খাব না—

পঙ্কজবাবু ও গুণময়ী চুপ করে রইলেন—

খানিকক্ষণ নীরবে চুরুট টেনে পঙ্কজবাবু বললেন—কল্যাণী, যদি বুঝতাম তুমি বড় হয়েছ— তোমার মার মত ভাবতে শিখেছ তাহলে অন্য কথা ছিল—কিন্তু এখনও তুমি ঢের ছেলেমানুষ—

কল্যাণী ছটফট করে নেচে উঠে বললে আমি ছেলেমানুষ নই; আমি ছেলেমানুষ নই। কে বলেছে আমি ছেলেমানুষ? কেন তোমরা এমন কথা বল? ও মা, বাবা কেন আমাকে ছেলেমানুষ বলে—আমি বুড়োমানুষের মত স্থিল হয়ে ভেবে কথা বলেছি; আমার মনের ঠিক সত্য কথা বলেছি আমি। জোর করে আমাকে দিয়ে মিথ্যা বলিও না তোমরা

গুণময়ী বললেন—আঃ, কল্যাণী থামরে

স্বামীকে বললেন—আজ আর থাক।

পঙ্কজবাবু চুরুটের ছাই ধীরে ধীরে ঝেড়ে ফেলে নদীটার দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে খানিকক্ষণ চুরুট টানলেন।

তারপর মেয়ের দিকে তাকিয়ে খুব নরম সুরে : কল্যাণী, তুমি তো বায়োস্কোপ দেখতে ভালোবাস, সারকাস থিয়েটারেও যাও, তোমার ছোড়দার সঙ্গে যে দু’ একটি ছেলে মাঝে মাঝে তোমাদের বোর্ডিঙে যায়—তাদের দেখে তোমার মন একটু-আধটু চিড় খায় বৈকি–হয়তো ভাব এদের ভিতর কাউকে পছন্দ করলে জীবনের সঙ্গী করে নিলে মন্দ হয় না। একজন সঙ্গী স্বামী—তুমিও হয়তো কিছুদিন থেকে খুঁজছ—কিন্তু তবুও তোমার মনকে এখনও ভালো করে বোঝ নি তুমি। যে জিনিস এখন শরবর্তী স্বর্গ মনে হচ্ছে বাস্তবিকই তা সিদ্ধির নেশা। আমরা যে সব খুব জানি। এ সব বিষয়ে তোমার মা ও আমার অভিজ্ঞতার ওপর তুমি সম্পূর্ণ নির্ভর করতে পার। তোমার তাই করা উচিত। তাইতেই তোমার মঙ্গল। তুমি যাই বল না কেন, কল্যাণী, চন্দ্রমোহনকেই তুমি তোমার স্বামী বলে বুঝতে চেষ্টা কর। তাতে তোমার জীবন পয়মন্ত হয়ে উঠবে। আমি তোমার বাবা হয়ে—তোমার জীবনের পরম কল্যাণ কি তা খুব গভীরভাবে উপলব্ধি করেই এই কথা তোমাকে বলছি—আমাকে তুমি অবজ্ঞা কোরো না।

কল্যাণী সারারাত বিছানায় লুটিয়ে লুটিয়ে কাঁদল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *