কল্যাণী – ১০

দশ

পরদিন অন্যরকম ব্যাপার।

রাত দশটা আন্দাজ হবে; কল্যাণীর টেবিলের পাশে পাঁচ ছয় জন মেয়ে এসে জড় হয়েছে।

কল্যাণী বললে—উঃ, কী ভীষণ বৃষ্টি পড়ছে

মিনু বললে—পড়বে না, এখনো তো ভাদ্র মাস—

কমিশনারের মেয়ে চিতু বললে—তোমরা কি যে বল ভাদ্র মাস না কি মাস তাই বৃষ্টি পড়ছে—অন্য মাস হলে পড়বে না—এ আমি মানি না। মাসের সঙ্গে বৃষ্টির কি সম্পর্ক

সকলে হো হো করে হেসে উঠল।

বাস্তবিক চিতু কিছু জানে না; কেবল কাঁটা ছুরি দিয়ে খট খট করে খাওয়া আর ইংরেজি গান গাওয়া ছাড়া।

চিতু একটু দমে গেল।

বললে—তোমরা হাসলে যে

মীরা বললে—হাসব না? শ্রাবণ ভাদ্র মাসে ঝড় বাদলা হবে—এ তো সকলেই জানে

চিতু বললে—কেন তা হবে? অন্য মাসে কেন হবে না? এটা তোমাদের গ্রেজুডিস্

মিনু বললে—অন্য মাসে বড় একটা হয় তো না দেখি

—খুব হয়, নভেম্বর মাসে বৃষ্টি পড়ে না ডিসেম্বরে পড়ে না?

আবার সকলে হেসে উঠল।

চিতুর মুখ আরক্তিম হয়ে উঠল; অত্যন্ত কষ্টে নিজেকে সে সংযত করে রাখল। কিন্তু এক মুহূর্তের জন্য মোটে

চেঁচিয়ে উঠে বললে—কথায় কথায় তোমাদের giggling; গা জ্বলে যায়; ঝড়বৃষ্টি কি তোমাদের বাপের চাকর দারোয়ান যে নভেম্বরে পড়বে ডিসেম্বরে পড়বে না।

মীরা বললে—শোন চিতু

চিতু মীরার ঘাড়ে হাত রেখে বললে—বল ভাই মীরা—তুমি তবু বরং একটু truthfully কথা বলতে পারে—peacefully;

মীরা বললে—তুমি বাংলা মাসের নামগুলো জান তো চিতু

চিতু বললে—না

একটু থেমে বললে—দু’একটা জানি—এই ভাদ্র—

আর কোনো নাম তার মনে এল না।

চিতু বললে—বাংলা মাসের নাম জানতে আমি কেয়ার করি না—

মীরা মাসের নামগুলো আওড়ালে

চিতু বললে—অত আমার মনে থাকবে না

কল্যাণী বললে—লিখে নাও

চিতু বললে—বয়ে গেছে আমার

মিনু বললে—ক’টা ঋতু তা জান?

—ঋতু আবার কি?

মীরা বললে—যেমন autumn—

—ওঃ, খুব জানি–seasons—

—বাংলায়ও তেমনি রয়েছে—

চিতু বললে—ইংরেজির থেকে নকল?

মিনু বললে—দূর!

চিতুর চোখ গরম হয়ে উঠল।

মীরা বললে—বৈশাখ-জ্যৈষ্ঠ এ দু’মাস গরম, আষাঢ়-শ্রাবণ বর্ষ, ভাদ্র—আশ্বিন শরৎ

 চিতু বললে—শরৎ?

—শরৎ

মীরা বললে—কার্তিক—অঘ্রাণ হেমন্ত, পৌষ-মাঘ শীত—

—মানে, ডিসেম্বরে?

—ফাল্গুন—চোত বসন্ত; বুঝলে চিতু।

চিতু বললে—তা কি কখনো হয়? বাংলা মাসের সঙ্গে শীত বা ইয়ে বৃষ্টির কোনো সম্পর্ক নেই।

বাঙালিদের মধ্যে দু’একজন তো শুধু আই-সি-এস পাস করে ডিস্ট্রিক্ট অফিসার হতে পারে—সাহেবদের সকলেই Administrator ওদেরই সব জিনিসগুলো ঠিক; বলে black in November, নভেম্বর এলেই শীত।

সকলে অত্যন্ত হতাশ হয়ে পড়ল।

কল্যাণীর আরসীর পাশে গিয়ে মিনু বেণী বাঁধতে লাগল।

কলেজে প্রফেসরদের কথা উঠল।

মিনু চুল আঁচড়াতে আঁচড়াতে বললে—আমাদের মেয়েদের কলেজে পুরুষ প্রফেসর বড় একটা থাকে না; তাতে লেকচার খারাপ হয়ে যায়—মেয়েরা কি লেকচার দেবে? জানে কি মেয়েরা?

মীরা বললে—তুমি নিজে মেয়ে নও?

মিনু আরসীর দিকে তাকিয়ে বললে—হলামই বা

কল্যাণী বললে—মেয়েদের সম্বন্ধে তোমার এত হীন ধারণা মিনু—

মিনু বললে—কিছু জানে না মেয়েরা, যা জানে তাও ফুটিয়ে বলতে পারে না। লেকচার যা ধার করে শুধু

চিতু বললে—আমি তা মানব না–মেমসাহেবরা চমৎকার ইংরেজি পড়ান—এর চেয়ে ভালো প্রফেসর কলকাতার কোনো কলেজে তুমি পাবে না—

মিনু বললে—হ্যাঁ! বললেই হ’ল কলকাতার কোনো কলেজে পাবে না—বাইবেল মুখস্থ করলে আর প্রনানসিয়েশন জানলেই হয়ে যায় না, সাহিত্য ঢের গভীর জিনিস—

মীরা বললে—তা ঠিক—সাহিত্য—

চিতু বললে—পাকামো যত সব! সাহিত্যের মানে আমি জানি না বুঝি? তোমরা কেউ বলতে পার এখন পোয়েট লরিয়েট কে?

কেউ বলতে পারল না

চিতু বললে–বরার্ট ব্রিজেস

সুপ্রভা বললে—মেসফিল্ড

চিতু বললে—তুমি ছাই জান!

সুপ্রভা বললে সেমফিল্ড আমি জানি।

চিতু বললে—যা জান না তা নিয়ে কথা বল কেন? রবার্ট ব্রিজেস পৃথিবীর সব চেয়ে (বড়) কবি

মিনু বললে—তা হোক গিয়ে; আমরা বলছিলাম কলেজের লেকচারের কথা—তার সঙ্গে ব্রিজেসের কি সম্পর্ক?

চিতু বললে—খুব সম্পর্ক। তোমরা সাহিত্য সাহিত্য কর, সাহিত্য তোমাদের চেয়ে আমি ঢের বেশি জানি। প্রনানসিয়েশনই হচ্ছে সাহিত্যের সবচেয়ে ইম্পর্টেন্ট জিনিস। বাঙালি প্রফেসররা না জানে প্রনাউন্‌স্ করতে—না জানে গ্রামার—তারা আবার লেকচার দেবে কি?

কেউ কিছু বললে না।

মিনু বললে—হিস্ট্রির প্রফেসরটি চমৎকার পড়ান কিন্তু মীরা

—কোন জন?

—ঐ যিনি নতুন এসেছেন—মিঃ গাঙ্গুলি—

মিনু বললে—আওয়াজ গুম গুম করতে থাকে—মেমদের মত মেয়েদের মত পিন পিন করে না।

মীরা বলল—বেশ ইন্টারেস্টিং করতে পারেন।

মিনু বললে–আঃ, রোমান এম্পায়ারের কথা যা বললেন—শুনতে শুনতে গায় কাঁটা দিয়ে ওঠে—মনে হয় যেন টাইবারের পারে সেই ইটার্ণাল সিটিতে আবার চলে গেছি

চিতু হাঃ হাঃ করে করতালি দিয়ে হেসে উঠে বললে—মিনু একেবারে পিক-মি-আপ

সুপ্রভা বললে—টপিঙ

চিতু বললে—দুঃখের বিষয় আমি হিস্ট্রি নেই নি, না হ’লেও গাঙ্গুলির বাচ্ছার গ্রামার প্রনানসিয়েশন নিয়ে কড়কে দিতাম

—কি করতে

I have corked him

চিতুর কথায় কোনো কান না দিয়ে মিনু বললে—এক এক সময় মনে হয় যেন উনি একজন সেন্টুরিয়েন—প্রিফেক্ট—সিনেটর…আঃ পম্পির ওপর কি লেকচারটা দিলেন—

মীরা বললে—ভালোবেসেছিস নাকি

চিতু বললে—নিশ্চয় ওঃ ভীষণ এনামার্ড!

কল্যাণী বললে—তাহ’লে বিয়ে করলেই পার মিনু

—কাকে গাঙ্গুলিকে?

কল্যাণী বললে—হ্যাঁ, দেখতেও বেশ সুন্দর—অল্প বয়েস

মীরা বললে—বয়ে গেছে গাঙ্গুলির মিনুকে বিয়ে করতে—তার চেয়ে কল্যাণী যদি একটু বেচারাকে ভরসা দেয়।

সুপ্রভা বললে—কল্যাণীই তো আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সুন্দর

মিনু বললে–কলেজের বিউটি

মীরা বললে—গাঙ্গুলিকে বললে এক্ষুণি

কল্যাণী বললে—আমার বয়ে গেছে—

মিনু আহত হয়ে বললে — কেন?

কল্যাণী বললে—টিচার বিয়ে করব আমি? আমার আর খেয়ে দেয়ে কাজ নেই।

সকলেই কিছুক্ষণ চুপ করে রইল—এমন দেমাক কল্যাণীর পক্ষে হয়তো সাজে—খুবই সাজে বটে, তাই তো সে কেন একজন টিচারকে বিয়ে করতে যাবে?

মেয়ে কটি এই কথাই ভাবছিল—

প্রথম কথা বললে মিনু; মনটা তার কেমন একটু ক্ষুব্ধ হয়েছিল, মনে হচ্ছিল এক জন যোগ্য লোককে সেধে সেধে অপমান করা হ’ল—

মিনু বললে—আচ্ছা ভাই সুপ্রভা; তুমি তো খুব ভালো ইংরেজি জান—কলেজের প্রফেসরকে টিচার ব’লে না কি আবার?

সুপ্রভা ঘোষাল চোখের থেকে চশমা নামিয়ে আস্তে আস্তে মুছে নিচ্ছিল।

মিনু বললে— এই যে কল্যাণী বললে ‘টিচার বিয়ে করব আমি?’— একজন কলেজের প্রফেসরকে কেউ আবার টিচার ব’লে নাকি?

সুপ্রভা বললে—তা বলতে পারা যায়

মীরা বললে—টিচার তো স্কুলের—

মিনু বললে—আমিও তো তাই জানি

সুপ্রভা বললে—টিচার শব্দের নানারকম মানে হতে পারে। স্কুলের মাস্টার তো দূরের কথা কলেজের প্রফেসরের চেয়েও এই শব্দটির জায়গায় ঢের বেশি মর্যাদা-যেমন টলস্টয় একজন টিচার ছিলেন

সকলেই নীরব হয়ে রইল

চিতু বললে—টিচার বিয়ে করবে না তুমি কল্যাণী?

—আমি বলেছিই তো করব না।

—কেন্ প্রফেসরদের মধ্যে বড় বড় তো ঢের আছেন

—তা থাক গে

চিতু বললে—গভর্নমেন্ট কলেজের ইম্পিরিয়াল গ্রেডের প্রফেসর হলেও করবে না? কল্যাণী বললে—না।

চিতু বললে—আমি তো করি–

সকলে অবাক হয়ে বললে —প্রসেফর বিয়ে কর তুমি চিতু?

—আই-ই-এস হলে কেন করব না?

—ওঃ আই-ই-এস!

চিতু বললে—তবে কি? একটা প্রাইভেট কলেজের বরখুটেকে তাই বলে করছি না।

ওরা খেতে পায় নাকি? ছেলেরা ওদের মাস্টারমশায় বলে।

কল্যাণী বললে—মিনুর প্রফেসর হলেই হয়—

মীরা বললে–মন্দ কি? আমারও একজন হলেই হয়—

চিতু বললে—গাঙ্গুলির মতন?

মীরা বললে—হ্যাঁ—খু-ব।

মিনু বললে—বসে আছে।

চিতু বললে—আর সুপ্রভার?

—আমি বিয়ে করব না।

—কি করবে?

সুপ্রভা দেখতে সুন্দর ছিল; খুব স্মার্ট; পড়াশুনায়ও সকলের চেয়ে সেরা।

সুপ্রভা বললে—পাস করব। পাস করে চাকরি ফাকরি নেব না আর। মেজদির ওখানে গিয়ে কাটাব–নইনীতালে—পাইন বনের বাতাসের মধ্যে।

সকলের বিমুগ্ধ হ’ল।

চিতু বললে—তোমার মেজদির বর সেখানে থাকেন বুঝি?

—হ্যাঁ

—কি করেন?

কল্যাণী বললে—আমারও ওইরকম একটা কিছু করতে হবে।

মিনু বললে—ওতে নমুষ্যত্ব থাকে না।

কল্যাণী বললে—কেন?

মিনু বললে—হয়ে স্বামীর সঙ্গে থাকতে হয়—না হয় নিজে করে খেতে হয়—মীরা বললে—তা ঠিক

জিনিসটা কল্যাণীর মনে খুব গভীরভাবে দেগে গেল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *