কল্যাণী – ১৯

ঊনিশ

সেই রাত্রেই–

লক্ষ্মীপূজোর অশেষ জ্যোৎস্নার মধ্যে লাল রাস্তার পর কাঁকরের আরো লাল রাস্তার বাঁক ঘুরে ঘুরে বগি গাড়িটা নিঃশব্দে চলছিল—যেন এ চলার সীমা শেষ নেই। কিন্তু তবুও খুব তাড়াতাড়িই যেন পঙ্কজবাবুর গাড়ি বারান্দায় এসে ঝট করে গাড়িটা থেমে গেল। ঘোড়াটা খট খট করে খানিকটা লাফিয়ে উঠল—পাগলামি করল—চাবুক খেল—তারপর সব চুপ।

কল্যাণী হঠাৎ চমকে উঠে বুঝতে পারল যে বাসায় এসে পৌঁছেছে—

ছোড়দার পিছনে পিছনে তেতলা অব্দি গেল কল্যাণী—

কোথাও কেউ নেই।

কল্যাণী বললে—কোথায় গেছে সব ছোড়দা–

–কে জানে কোথায়?

দোতলায় নেমে সিদে খাবার ঘরের দিকে চলে গেল কিশোর; কল্যাণীও দোতলায় নামল—খেতে গেল না আর। হলের একটা চেয়ারের ওপর চুপ করে বসে ছিল—কিশোরের গলার আওয়াজ রান্নাঘরে ক্রমাগত খন খন করছে—কাকে যেন ধমকে ধমকে সে ভূতঝাড়া করে দিচ্ছে—

কিশোর অবিশ্রাম বকে চলছিল-কিন্তু ছোড়দার গলার অস্তিত্ব ক্রমে ক্রমে লোপ পেয়ে এল যেন কল্যাণীর কাছে।

কে কিছুই দেখছিল না–বুঝছিল না।

কিশোর খেয়ে এসে কল্যাণীকে অগ্রাহ্য করে ঘুমোতে চলে গেল।

ওসমান এসে বললে—দিদিমণি

কল্যাণী নড়ে উঠল।

ওসমান বললে—কত্তারা বোধ হয় কেউ আজ রাতে ফিরবেন না

—কোথায় গেছে?

যাত্রা না পাঁচালী শুনতে হরিবাবুর হাবেলীতে–

কল্যাণী বললে—কে কে গেছেন?

—ছোটবাবু আর আপনি ছাড়া সবাই

—মাও!

—হ্যাঁ।

—আচ্ছা তুমি যাও।

—খাবেন না?

কল্যাণী বললে—কে?

—চন্দ্ৰমোহনবাবু—আপনি—

–তিনি কোথায়?

—বাগানে বেড়াচ্ছেন—

—খান নি?

—না

—তাঁর ডেকে খেতে দাও গিয়ে

—এই টেবিলেই দেব?

—দাও

—ডেকে আনি?

—খাবার ঠিক হয়েছে?

— হ্যাঁ

—আন ডেকে

—ওসমান চলে গেল।

কল্যাণী ভাবছিল—সে তেতলায় চলে যাবে—কিম্বা নিজের ঘরে যাবে ঘুমুতে; কিন্তু বসেই রইল সে—মস্ত বড় গোল ডিনার টেবিলটার পাশে একটা চেয়ারে খাবারের জন্য ও চন্দ্রমোহনের জন্য স্তব্ধ হয়ে প্রতীক্ষ করছে যেন সে। কল্যাণীর মনে হচ্ছিল, এ কেমন! কিন্তু এমনই তো হ’ল। জিনিসটাকে খুব বেশি অঘটন বলেও মনে হচ্ছিল না তার।

চন্দ্রমোহন এল।

কল্যাণী বললে—বসুন।

বলেই শিউরে উঠল। নিজের প্রতি বিরূপ কাতর ব্যথিত চোখ দু’টোকে নীলাম্বরীতে ঢেকে তেতলার দিকে ছুটে যাবার ইচ্ছে করল তার। কিম্বা এই মেঝের ইঁট চুণ কাঠের ভিতর মিশে যেতে ইচ্ছা করছিল তার—কেউ কোনো দিন খুঁজে পাবে না তাকে আর।

কিন্তু তবুও সময়বিধাতা তাকে বসিয়েই তো রাখলেন।

চন্দ্রমোহনের ভাত এল; কল্যাণীরও

কল্যাণী বললে—ওসমান

—হুজুর

—এখন না, আমি পরে খাব।

ওসমান থালা তুলে নিয়ে গেল—

চন্দ্রমোহন অত্যন্ত মর্মপীড়িতের মত বললে—কেন? পরে কেন?

কল্যাণী বললে আপনি খান।

—আপনি কেন খাবেন না?

—খাব তো; পরে

—আমার সামনে খেতে খারাপ লাগে

কল্যাণী বললে—আপনার ভাত ঠাণ্ডা হয়ে যাচ্ছে

—আমি খাচ্ছি

একটু হেসে বললে—আপনি না খেলেও আমি খাচ্ছি—কাউকে কষ্ট দেবার ইচ্ছে আমার নেই।

চন্দ্রমোহনবাবুর কখন কি লাগে ওসমান তদারক করে যাচ্ছিল; কল্যাণী তাকিয়ে দেখছিল মাঝে মাঝে—নিপুণ খানসামার মত এসে বুঝে শুনে দরদ দিয়ে লোকটাকে খাওয়াছে। মাথাটা একটু কাৎ করে জানালার ভিতর দিয়ে জ্যোৎস্নার দিকে তাকিয়ে রইল কল্যাণী।

খাওয়া হয়ে গেলে ওসমান টেবিল পরিষ্কার করে নিয়ে গেল—কল্যাণীর মনে হ’ল এখন সে চলে যেতে পারে।

চন্দ্রমোহন মুখ ধুয়ে গামছায় মুখ মুছে টেবিল সাফ শেষ আগেই দাঁড়িয়েছে এসে।

ওসমান চলে যাওয়ার পর চন্দ্রমোহন বললে—আমি কাল পশু তক এখান থেকে চলে যাব—

কল্যাণী মাখা হেঁট করে বসেছিল—

চন্দ্রমোহন বললে আপনার বাবার মত পেয়েছি—আমারও কলকাতায় ঢের কাজ আছে ভাই—

কল্যাণীর বুকের ভিতর ঢিব ঢিব করছিল। অস্ফুট স্বরে বললে বাবার মত? কিসের মত?

চন্দ্ৰমোহন বললে—তা তো আপনি জানেনই—

কল্যাণী বললে—আপনার কাছে একটা অনুরোধ

চন্দ্রমোহন হাসি মুখে তাকাল

কল্যাণী বললে—-আপনি যদি মানুষ হন বাবাকে আর বিরক্ত করবেন না—আমাদেরও না

চন্দ্রমোহন ধীরে ধীরে একটা চেয়ার টেনে বসে পড়ে অত্যন্ত করুণ হয়ে বললে— আপনার বাবাকে কি আমি বিরক্ত করেছি?

কল্যাণী একটু চুপ থেকে বললে—না হয় সেধেই বাবা আপনাকে ভালো বেসেছেন—কিন্তু–

চন্দ্রমোহন তাড়াতাড়ি বাধা দিয়ে বললে—কিন্তু আর কেন কল্যাণী

কল্যাণীর আপাদমস্তক জ্বলে উঠল। কিন্তু পরক্ষণেই এমন কান্না এল তার—অতি কষ্টে কান্না চেপে চন্দ্ৰমোহনকে বললে—কি চান আপনি?

চন্দ্রমোহন অত্যন্ত কাতর হয়ে বললে—তুমি দয়াময়ী; তোমার মতন দয়া আর কারুর নেই। আমি প্রথম দিন দেখেই বুঝেছি—শেষ পর্যন্ত তোমার জন্য যেন আমার মৃত্যু না হয়–

কল্যাণী ঠোঁটে আঁচল গুঁজে কঠিন আড়ষ্ট হয়ে বসে রইল—নড়বার চড়বারও শক্তি ছিল না তার।

চন্দ্রমোহন একটু এগিয়ে এসে কল্যাণীর হাত ধরে বললে—তুমি আমাকে ভালোবাস— বল, তুমি আমাকে ভালোবাস—

কল্যাণী হাত খসিয়ে দিয়ে বললে—না, ছাড়ুন—

—বল, আমাকে ভালোবাস তুমি কল্যাণী—বল ভালোবাস—

কল্যাণী চোখের জলে একাকার হয়ে বললে—না—না—না—কোনো দিনও না—কোনো দিনও আপনাকে আমি ভালোবাসি নি—আপনি সরুন—আমাকে যেতে দিন—যেতে দিন—

চন্দ্ৰমোহন বললে—আমি এখনও জানি তুমি আমাকে ভালোবাস–

কল্যাণী অবোধের মত কাঁদতে কাঁদতে বললে—কে বলেছে সে কথা আপনাকে–আপনি ভুল করেছেন—ভুল করেছেন—ভুল করেছেন—

কল্যাণী চীৎকার করে উঠে বললে—আপনাকে দেখলে ভয় করে—আপনাকে দেখলে ঘেন্না করে আমার —

বলতে বলতে কল্যাণী শোবার ঘরের দিকে ছুটে যেতে লাগল—নিষ্কৃতি নাই—নিষ্কৃতি নাই—একটা ব্যাধের জাল যেন কল্যাণীকে ক্রমে ক্রমে ঘিরে ফেলছে—

চন্দ্রমোহন মেঝের ওপর শুয়ে পড়ে কল্যাণীর পা দু’টো জড়িয়ে ধরে বললে—আমাকে মেরে ফেল—আমাকে মেরে ফেল কল্যাণী।

সমস্ত শরীর চন্দ্রমোহনের যেন কেমন নিষ্পেষিত পাখির মত—মাছের মত কল্যাণীর পায়ের নিচে লুটিয়ে লুটিয়ে ছটফট করতে লাগল। সে কি কাতরতা—মানুষ কোনোদিন এত কাতর—এমন অনাথ শিশুর চেয়েও ভয়াবহ অথবতার পরিক্রমে বোকা মেয়েমানুষকে স্তম্ভিত করতে পারে—কল্পনাও করতে পারেনি কোনো দিন কল্যাণী।

ধীরে ধীরে কান্না থেমে গেল তার। কান্না থামতেই নিজেকে সে ধিক্কার দিতে লাগল; সে বোকা মেয়েলোক ছাড়া আর কি? নইলে এই মানুষটার কাছে এমন করে সে ঠকে যায়!

বিচলিত হয়ে মেঝের ওপর বসে পড়ে চন্দ্রমোহনের দিকে তাকাল কল্যাণী—এই লোকটার অঙ্গপ্রত্যঙ্গের বীভৎসতাও নয় আজ আর—আজকের আকাশ মাঠ জ্যোৎস্না পৃথিবীর কি একটা নিগূঢ় কাতরতা ও নিষ্ফলতার প্রতীক ব্যবসায়ী—না সত্যিই প্রতীক এই চন্দ্ৰমোহন।

কল্যাণী বললে—উঠুন।

কোনো সাড়া দিল না চন্দ্ৰমোহন।

কল্যাণী বললে—উঠুন উঠুন—বলেছিলাম ঘেন্না করি, ভয় করি—কিন্তু এখন আর করি না সে সব কিছু—

চন্দ্রমোহন মেঝের ওপর মাথা উপুড় রেখেই বললে–বল ভালোবাস—

কল্যাণী আঁচলে চোখ মুছতে মুছতে বিড়বিড় করে কি বললে, চন্দ্রমোহন ছাড়া কেউ আর তা শুনতে পেল না—

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *