কল্যাণী – ৭

সাত

চশমা বেশ ফিট করেছে—কালো টরটয়েজ শেলের ডাঁট—তেমনি রিম—বড় গোল গোল পাথর।

—কল্যাণীর রূপ যেন আরো ঢের খুলে গিয়েছে এই চশমার জন্য।

মেয়েরা তার সঙ্গে এখন আরো বেশি খাতির করতে আসে।

অনেক অদ্ভুত—অসার—আজগুবি—অনেক সেন্টিমেন্টাল—নানারকম রস লালসার কথা বলে তাকে—তাকে ব্যবহার করতে চায়, কিন্তু এবার দেশে গিয়ে কল্যাণী যে একটা গুরুত্ব পেয়ে এসেছে এখনো তা সে খোয়ায়নি।

বাবা দেড়শো টাকা করে মাসে পাঠান।

বিকেলবেলা কিশোর এল, ছোড়দার নাম স্লেটে দেখে কল্যাণী লাফাতে লাফাতে নিচে নেমে এল।

কিশোর কাশছিল।

কল্যাণী বললে—’এ কি তোমার শরীর খারাপ দেখাচ্ছে যে ছোড়দা’

‘ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়েছিল।’

—আমাকে লেখনি কেন?

—তুমি আমাদের হোস্টেলের ভিজিটিং ডাক্তার, না?

কল্যাণী একটু হেসে বললে—না, জানতাম—

—জেনে কি করতে? টাট্টু প্রিন্সিপ্যালের মত প্রার্থনা করতে, না?

—টাট্টু প্রিন্সিপ্যাল আবার কে? ওঃ তোমাদের কলেজের প্রিন্সিপ্যাল—

কল্যাণী টেনে টেনে একটু হাসল।

বললে—ছি, টাট্টু বল কেন? প্রিন্সিপ্যাল মানুষ তাকে টাটু?

–কলকাতার সকলেই ওকে টাট্টু বলে।

—তাই বলে তুমিও বলবে?

—না, আমার একটা নতুন কিছু বলা দরকার, আমি বলি গিধোর—

কল্যাণী এ প্রসঙ্গ চাপা দিতে চাইল

কিশোর বললে—গিধোরের মানে জানিস?

—না

—তবে থাক্।

কল্যাণী বললে—ইনফ্লুয়েঞ্জা তোমার খুব বেশি হয়েছিল না কি ছোড়দা

—উঃ গা হাত পা এখনও টাটাচ্ছে

—তা হ’লে সারে নি তো—

—আলবৎ সেরেছে—

—কি খাও? দু-একটা দিন ভাত না খেয়ে রুটি খেও অন্তত। দু-এক দিন শুধু ওভালটিন খেয়ে দেখলে পার না? শরীরটা একটু টানলে ভাল হয়।

—এখানে সিগারেট খেতে পারা যাবে?

—না

—কেন? কোনো মেয়ে নেই তো।

—ঐ যে মেট্রন বসে

— পাকামো সব

কিশোর বললে— আমি যাই

—বোসো না।

—বসে কি হবে?

—এরকম কর কেন? আমাকে তুমি বোনের মতই মনে কর না। যেন আমি তোমার কত পর— কি যে!

—স্টিমারের সেই হুইস্কির কথা মনে আছে?

কল্যাণী লাঞ্ছিত বোধ করল।

—বাবাকে লিখিসনি তো?

—না।

কল্যাণী একটু সন্দিগ্ধ হয়ে বললে—আর খাওনি তো?

— খেয়েছি

—কোথায়?

—ইম্পিরিয়ালে—

কল্যাণী বিরস মুখে কিশোরের দিকে তাকাল।

কিশোর বললে—বাপ রে, তোকে যে পিসিমার মত দেখাচ্ছে—

কল্যাণী চুপ করে রইল; ছোড়দার জন্য যতখানি মমতা তার আছে তার সিকির সিকি প্রভাবও এ মানুষটির ওপর তার নেই। নিজে সে কিছু করতে পারে না। কিন্তু সে সঙ্কল্প করল বাবাকে লিখবে।

কল্যাণী বললে—আবারও অপথ্য করলে?

—অপথ্য?

স্টিমারে করলে—ইম্পিরিয়ালে করলে—না জানি আরো কত জায়গায়

—ও, হুইস্কি—হ’ল তোমার অপথ্য। তুমি মার রঙে মন্দ না

—আর খাবে না বল

—পিসিমার মত মুখ করিস না।

কল্যাণী বললে—আমি বাবাকে সব লিখে দেব।

কিশোর বোনের দৃঢ় মুখের দিকে তাকিয়ে খানিকটা সন্দিগ্ধ হ’ল—

বললে—সত্যি লিখবি

—নিশ্চয়, আজকের ডাকেই আমি লিখব।

—বাবা বিশ্বাস করবে তোকে?

—আমাকে বিশ্বেস করবেন না তো কি তোমাকে করবেন?

কিশোর তা জানে।

ডেস্কের ওপর থেকে একটা চক কুড়িয়ে নিয়ে দাগ কাটতে কাটতে বললে—যাঃ, আর খাব না।

—সত্যি?

—পয়সাই বা কোথায় আর?

—না, বল খাবে না আর।

—বললামই তো—

লুকোচুরি কোরো না কিন্তু আমার সঙ্গে

কিশোর একটু অপমানিত বোধ করে ঠোঁট কামড়ে কঠিন হয়ে কল্যাণীর দিকে তাকাল

—রাগ কোরো না ছোড়দা, তোমার ভালোর জন্যই বলেছি; চকোলেট খাবে?

—না

—রাগ কোরো না লক্ষ্মীটি—

কিশোর বললে—তুমি বায়োস্কোপ দেখাও ছেড়ে দিয়েছ না কি কল্যাণী!

ছেড়ে সে দিয়েছেই তো—কিন্তু তবুও ছোড়দাকে খুশি করবার জন্য বললে—তুমি যাবে নাকি?

—আমার পয়সা নেই—তুই যদি পাঁচ টাকা দিতে পারিস তা হ’লে কাল গ্লোবে চল্‌ কল্যাণী বললে— আচ্ছা

—আর থিয়েটার?

থিয়েটার আমি দেখব না

—কোনো দিনও না?

—না

কিশোর বললে—অবিশ্যি তেমন জোর বই নেই— আর্টিস্টও নেই— বাংলায়। কিন্তু, চল্ না একদিন ইংরেজি থিয়েটার দেখে আসি।

কল্যাণী বললে—বললামই তো যাব না আর আমি

কিশোর জেরা করে বললে—কেন?

—কে আমি জানি না; আমি যাব না।

—ঈস?

—তাহ’লে আমি বায়োস্কোপেও যাব না।

কিশোর বললে—আচ্ছা না গেলি–আড়াইটা টাকা আমাকে দিয়ে দে

কল্যাণী বললে— আচ্ছা নিও

—এখুনি

কল্যাণী টাকা এনে দিল।

কিশোর বললে—এঃ, ঠিক আড়াইটেই এনেছিস যে বড় গুণে গেঁথে—

—তাই তো চেয়েছিলে—

—আচ্ছা বেশ পাঁচটাই দে।

কল্যাণী ঘাড় হেঁট করে ভাবল বাবা ছোড়দাকে যা টাকা পাঠান তার ওপরেও এরকম হাঁকাই কেন—এরকম আগে তো ছিল না—এর মানে কি?—না জানি টাকা কেমন করে রূপান্তরিত হয়ে কি হয়ে যায়

কল্যাণীর মন খোঁচা খেয়ে উঠল—

ধীরে ধীরে মুখ তুলে সে বললে—আমি আর দিতে পারব না।

পাঁচটা কেন—দশটা পঁচিশটা—অনেক কিছুই সে দিতে পারত, কিন্তু কিশোরের মুখের দিকে তাকিয়ে কল্যাণীর মন সন্দেহে ভ’রে উঠল।

কিশোর বললে—পারবি, পারবি…আর আড়াই টাকা তো মোটে—

কল্যাণী নিজের মনকে বললে—দেওয়া কি উচিত? বাবা কি দিতেন? মা? আমি দেব? কিশোর বললে—তুই গেলেও আর আড়াইটা টাকা তো লাগত। সেই টাকাটা না হয় আমাকে দিয়ে দিলি—তুই আমাকে দিয়ে দে।

কিশোর একটু কেশে বললে—এতে তোর কি ক্ষতি হবে কল্যাণী?

—থাক, আর বোলো না দাদা।

একটা দশ টাকার নোট এনে কিশোরকে সে দিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *