পনেরো
সন্ধ্যার সময় আজো সকলে হরিচরণ চাটুয্যের হাবেলীতে যাত্রা দেখতে চলে গেল— পঙ্কজবাবু পর্যন্ত।
কল্যাণীও ভেবেছিল সে যাবে।
কিন্তু বিকেলের ডাকে মিনু ও মীরার বেশ বড় দু’খানা চিঠি এল।
কল্যাণী তক্ষুণি জবাব লিখতে বসল। চিঠিতে একবার হাত দিলে না শেষ করে ওঠে না সে। লিখতে লিখতে সন্ধ্যা হয়ে গেল—ওরা গেল চলে।
ওসমানকে চিঠি পোস্ট করতে দিয়ে কল্যাণী তেতলার বারান্দায় একটু পায়চারি করতে গেল—হাতে সুপ্রভার বইখানা! দি রেড লিলি।
বারান্দায় পা দিয়ে দেখল চন্দ্রমোহন একটা সোফার ওপর বসে আছে।
এ লোকটার কথা সারারাত ভুলে ছিল কল্যাণী; পৃথিবীতে যে এ মানুষটি আছে তাও মনে ছিল না।
একে দেখেই সে পিছিয়ে শটকে যাচ্ছিল—কিন্তু চন্দ্রমোহনের হাতের বইটার দিকে তাকিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে রইল কল্যাণী—
চন্দ্ৰমোহন বললে—ওঃ আপনি।
একটু কেশে বললে—আপনিও বুঝি যাত্রা দেখতে ভালোবাসেন না? বেশ বেশ।
চন্দ্রমোহন তার হাতের বইটা ধীরে ধীরে বন্ধ করলে——
বললে—ওঃ বসেছেন। বেশ বেশ। আমিও ভাবছিলাম বই না পড়ে কথাবার্তা বললেই বেশ লাগবে।
চন্দ্রমোহন কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে বললে—আমি কোনোদিন স্বপ্নেও ভাবিনি যে বাঙালির ঘরে এ রকম রূপ থাকতে পারে; কিন্তু থাকে বাঙালির ঘরেই। শিল্পীরা এ জন্যেই বাঙালি মেয়ে বিয়ে করবার জন্য পাগল।
কল্যাণী বললে–আপনার হাতে ওটা কি রই?
—এটা?
— হ্যাঁ
—এই বইটা–
চন্দ্রমোহন বইটার শিরোনামের দিকে তাকিয়ে ধীরে ধীরে—এটা হচ্ছে An intelligent………
কোথায় পেলেন এ বইটা?
—এই সোফার ওপরেই ছিল।
—বই সোফার ওপরে?
—হ্যাঁ
—ঠিক মনে আছে আপনার?
চন্দ্রমোহন বললে— বাঃ।
কল্যাণী বললে—কখন পেলেন?
—এই তো এক্ষুণি এসে
এই এসে পেলেন?
হ্যাঁ, কে যেন ফেলে গিয়েছিল, আপনি হয়তো?
কল্যাণী নিস্তব্ধ হয়ে চন্দ্রমোহনের দিকে তাকাল—
চন্দ্ৰমোহন বললে—এ এক রকম বই, না আছে মাথা, না আছে মুণ্ডু; না আছে কোনো মনে। এ সব বই মানুষের পড়া উচিত নয় —
কল্যাণী বললে—সোফার ওপর এ বই কে এনে রাখল? আমার যদ্দুর মনে পড়ে আমি তো সঙ্গে করেই নিয়ে গিয়েছিলাম; কাল রাতে ঘুমোবার আগেও টেবিলে বসে পড়েছি বইখানা—সকালে দেখি কোথাও নেই—
চন্দ্ৰমোহন বললে–আপনি হয়তো ভুলে গিয়েছিলেন—এইখানেই রেখে গিয়েছিলেন— এ রকম ভুল হয় মাঝে মাঝে—আমাদের সকলেরই হয়—
কল্যাণী বললে—এ বারান্দাও তো আমি পঁচিশবার করে দেখে গেছি—সোফায়ই যদি থাকবে তাহ’লে আমার চোখে পড়ল না কেন?
চন্দ্ৰমোহন বললে—পড়েনি তো।
একটু পরে বললে—একটা সামান্য বই কোথায় ছিল না ছিল এ নিয়ে মানুষের বক্তব্য বেশিক্ষণ চলতে পারে না।
কল্যাণী ঠোঁট কামড়ে চুপ করে রইল।
চন্দ্রমোহন বললে–আসল কথা হচ্ছে এ বই আমাদের পড়া উচিত নয়–
কল্যাণী বললে—নাই বা পড়লেন।
—না, পড়ব না আমি।
—দিন বইটা।
চন্দ্রমোহন কল্যাণীকে বইটা ফিরিয়ে দিয়ে বললে— আপনার বেশ ভালো লাগে?
কল্যাণী কোনো জবাব দিল না।
চন্দ্ৰমোহন বললে— আমি ব্যবসায়ী হয়েও প্রেমিক হয়েছি, প্রেমিক হয়েও মাস্টার হতে পেরেছি—বলে সে একটু হাসল।
পরে বললে—এখন একটু মাস্টারী করা দরকার—প্রেম না হয় আর এক সময় হবে।
কল্যাণী উঠে দাঁড়াল।
চন্দ্ৰমোহন বললে—শুনুন
—কিছু শুনবার নেই—
কল্যাণী চলে যাচ্ছিল—
চন্দ্ৰমোহন বললে—কথা আছে শুনুন—আপনার বাবা—
কল্যাণী এক নিমেষের জন্য দাঁড়াল—বাবার কথা এ আবার কি বলতে চায়?
চন্দ্রমোহন বললে–আপনার বাবা আর আমি কাল আপনার কাছে গিয়েছিলাম—
—আমার বাবা?
—হ্যাঁ আপনার বাবা আর আমি
—আমার কাছে গিয়েছিলেন বাবা!
—হ্যাঁ
—কখন?
—কাল রাতে।
—কোথায়?
—আপনার ঘরে
কল্যাণী বিস্মিত হয়ে বললে রাতে আমার ঘরে—কখন?
একটা সোফার ওপর বসল সে।
চন্দ্রমোহন বললে—তখন আপনি ঘুমুচ্ছিলেন—
কল্যাণী স্তম্ভিত হয়ে বললে—বাবা তখন আমার ঘরে ঢুকেছিলেন আপনাকে সঙ্গে করে?
—হ্যাঁ
কল্যাণী আড়ষ্ট হয়ে চন্দ্রমোহনের দিকে তাকিয়ে রইল।
চন্দ্রমোহন বললে—বিশ্বেস হয় না বুঝি?
কল্যাণী রুদ্ধ নিঃশ্বাসে চন্দ্রমোহনের দিকে চেয়ে রইল।
চন্দ্ৰমোহন বললে—একটা দরকারী কথার প্রসঙ্গে গিয়েছিলাম —
সে কথা কল্যাণীর কানে গেল না, অত্যন্ত ব্যথিত হয়ে সে বললে—আমার বাবা আপনাকে নিয়ে গিয়েছিলেন?
–হুঁ
চন্দ্ৰমোহন বললে–আপনার টেবিল নেড়ে চেড়ে দেখলেন আপনার বাবা।
—আমার বাবা? কল্যাণীর শরীর মন নিঃশ্বাস ফেলতে চাইছে না যেন আর।
—হ্যাঁ, এই বইটেও তিনি নিয়ে এলেন
—এই বইটে?
— হ্যাঁ
—নিজের ঘরে গিয়ে পড়েছিলেনও বুঝি—পড়ে তার অত্যন্ত খারাপ লাগল— যাত্রা শুনতে যাবার সময় এই সোফার ওপর ফেলে গেলেন—আমাকে পড়তে বললেন। আমারও ভালো লাগেনি—আপনার টেবিলের সব বইগুলি তিনি দেখেছেন— বড্ড দুঃখিত হয়েছেন তাতে——
কল্যাণী হঠাৎ চেঁচিয়ে উঠে বললে—আমি বিশ্বাস করি না। মিথ্যা কথা সব।
চন্দ্ৰমোহন বললে—আস্তে।
কল্যাণী তেমনি চীৎকার করে উঠে বললে—কক্ষণও না—
চন্দ্ৰমোহন বললে—ছি
কল্যাণী বললে—না—না-না—আমার বাবা কিছুতেই নয়—মেজদা হতে পারে—ছোড়দা হতে পারে—মা হতে পারে—বাবা নয়—বলুন বাবা যাননি—বলুন—বলুন আপনি–
চন্দ্ৰমোহন বললে—যদি গিয়ে থাকেন, আপনার মঙ্গলের জন্য গিয়েছেন; তাতে খারাপ তো কিছু হয়নি।
কল্যাণী আড়ষ্ট হয়ে বললে—আমার মঙ্গলের জন্য?
—বাবা মা মঙ্গল ছাড়া আর কি চান?
—আমার ডায়েরী—
—আপনার ডায়েরীটাও দেখেছেন তিনি।
—বাবা?
—হ্যাঁ—কয়েক পাতা কেটেও রেখেছেন
কল্যাণীর সমস্ত শরীর কাঁপতে লাগল। যেন প্রবল প্রচণ্ড মেরুর শীত এসে ঘিরে ধরেছে তাকে।
চন্দ্ৰমোহন তাকিয়ে তাকিয়ে মেয়েটির আপাদমস্তক দেখতে লাগল—দেখতে লাগল শুধু—
এই মেয়েটির কোনো মঙ্গল কোনো কল্যাণ কোনো ভবিষ্যতের চিন্তা তার মনের ত্রিসীমায়ও ছিল না—এর অভূতপূর্ব রূপও মুহূর্তের জন্য অর্থহীন হয়ে গেল চন্দ্রমোহনের কাছে—মন তার কেমন দুরন্ত গভীর ক্ষুধায় ভরে উঠল। হা, বিধাতা, কেমন একটা গভীর ক্ষুধায়!
কিন্তু প্রবল পরাক্রমের সঙ্গে নিজেকে সংযত করে নিলে সে।
বললে—কল্যাণী তুমি কষ্ট পাচ্ছ—কেন এত কষ্ট পাও? আমি তোমাকে আমার প্রাণ দিয়ে ভালোবাসি কল্যাণী।
নিজের সোফাটা এগিয়ে আনল চন্দ্ৰমোহন
কল্যাণী আরক্ত চোখ মেলে হাত ইসারা করে চন্দ্রমোহনকে সরে যেতে বললে।
চন্দ্ৰমোহন নিতান্ত দ্বিধাহীন নিঃস্পৃহভাবে সরে গিয়ে আগের জায়গায় বসল আবার।
তারপর ধীরে ধীরে উঠে সেখান থেকে সে চলে গেল; নইলে তার ক্ষুধাকে সে রাতে কিছুতেই সে জয় করতে পারত না।