কল্যাণী – ২

দুই

চৌধুরী মশাই সন্ধ্যা-আহ্নিক করেন না বটে, কিন্তু জীবনের প্রতি কাজে—প্রতি তুচ্ছাতিতুচ্ছ কাজেও পদে পদে বিধাতাকে মানেন তিনি। ভালো করলেও এ বিধাতাই করেছেন, অমঙ্গল করলেও এ বিধাতারই না জানি কি নিগূঢ় ইঙ্গিত—এমনি তার বিশ্বাস— অত্যন্ত স্পষ্ট—কেমন সরল—কি যে আন্তরিক—গভীর বিশ্বাস তার। (লোকটি) জানেন শোনেন অনেক; উনিশ শো এক সালে প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে চৌধুরী বি-এ পাস করেছিলেন। সেই থেকে পড়াশুনার ঢের চর্চা নানা দিক দিয়ে করে এসেছেন। বাড়িতে মস্ত বড় একটা লাইব্রেরী আছে—আজো নতুন নতুন মোটাসোটা বই ঢের আসে কলকাতার দোকানপাট থেকে–বিলেতের ফার্মগুলোর থেকে অব্দি; নানারকম দেশী বিলিতী নিবিড় ম্যাগাজিন আসে সব। এত চিন্তা যুক্তি গবেষণার আবহাওয়া মানুষের শ্রদ্ধা বিশ্বাসের তাল খসিয়ে উড়িয়ে ফেলে—কিন্তু তবুও চৌধুরী আজো কোনো কথা কাজ বা ব্যবহারের ধাপ্পাবাজি ভোজবাজি গোঁজামিলের ভিতরে নেই,—মানুষের মনের অতি উৎসুক চিন্তা ও প্রশ্ন যেন বারবধূদের মত (নয় কি?)—সে সবের হাত থেকে তাঁর ধর্মকে রক্ষা করেন তিনি, ‘ন্যায়কে রক্ষা করেন, নিজের বিধাতাকে রক্ষা করেন।

যেন কখনো কোনো ব্যভিচার না হয়—অবিচার না হয় যেন—মঙ্গলময় ভগবান জীবনের পদে পদে প্রতিফলিত হয়ে চলেন যেন—চৌধুরী মশাই খুব খাঁটি আগ্রহে নিজের মনকে অনেক সময়ই এই সব কথা বলেন।

কল্যাণী কলকাতার থেকে এসেছে; ছোট ছেলে কিশোরও এসেছে। একদিন বিকেলবেলা প্রসাদ কোর্টের থেকে ফিরে বারান্দার ইজি চেয়ারে বসে চুরুট টানছিল।

বাবা এসে আরেকটা ইজি চেয়ারে বসলেন।

প্রসাদ চুরুটটা ফেলে দিতে যাচ্ছিল।

চৌধুরী বললেন—তা খাও; আমিও তো খাই। লাড্স আমাদের দু’জনেরই ভাল আছে।

হাসলেন।

নিজেও চুরুট বের করলেন।

প্রসাদও টানতে লাগল।

চৌধুরী বললেন—এ বার কাজের কথা।

প্রসাদ বাবার দিকে তাকাল।

‘তোমার দাদাকে আর টাকা পাঠাব না ঠিক করেছি।’

প্রসাদ চুপ করে রইল; সে তো বরাবরই বাবাকে বলে এসেছে দাদাকে টাকা পাঠান মানে জমিদারি আস্তে আস্তে গুটিয়ে ফেলা; প্রজারা খাজনা দিতে চায় না, গভর্নমেন্টকে রেভিনিউ দিতে হচ্ছে, সম্পত্তি ভেঙে খেতে হচ্ছে—ওকালতী করতে বাধ্য হতে হচ্ছে— অনেক কিছুই দাদার গুখুরির জন্য।

পঙ্কজবাবু বললেন—অন্যায় হবে প্ৰসাদ

প্রসাদ বললে—একেবারেই ওকে একটা পয়সাও আর কোনোদিন তুলে দেবে না এইটে আগে ঠিক করতে পার যদি—(তারপর কথা।

পঙ্কজবাবু একটু স্থির থেকে বললেন–কি করে আর দেই?

প্রসাদ বললে—স্টেটে টাকা নেই বলে?

—না, তা নয়।

—তবে কি বাবা?

—টাকা এখনও—টাকা বিজলীকে পাঠাবার ক্ষমতা এখনও দু-চার বছর বেশ আছে

আমার—কিন্তু —

পঙ্কজবাবু থামলেন—

প্রসাদ বললে—তা হ’লে দু’চার বছর আরো পাঠাও।

—তা পাঠাব না।

প্রসাদ একটু হেসে বললে—ওর চিঠি পেলে তোমার মন খুব উসখুস করে না বাবা? কোনো কল্পিত সঙ্কল্পই টেকে না আর তোমার। দাদা খুব চমৎকার চিঠি লিখতে পারে।

—ওর চিঠি এবার আর পড়বও না আমি—কেবল পাঠালে ছিঁড়ে ফেলে দেব।

প্রসাদ ঘাড় হেঁট করে চুরুটটার দিকে তাকাচ্ছিল।

পঙ্কজবাবু বললেন—এইই ঠিক হবে।

তাঁকে খুব দূর মনে হ’ল।

প্রসাদকে বললে—তোমার মাকে বলিনি।

—কি দরকার বলবার?

—মিছেমিছি কেন আর

—অন্যায় হবে না?

—কিসে বাবা?

—এই যে তোমার মার কাছে গোপন করলাম—অন্য কাউকে বলিনি—অন্যায়? Not sending money — অন্যায়?

প্রসাদ চুরুটের মুখের থেকে ছাই ঝেড়ে ফেলে কিছুক্ষণ ক্লান্ত হয়ে বসে রইল। পরে বললে—আমাদের খেতে হবে তো?

—তাই তো।

কিশোরকে দেখতে হবে, কল্যাণীর কথা ভাববার রয়েছে—

পঙ্কজবাবু বললেন—না, না, অন্যায় হবে না কিছু। কত ছেলে মরে যায় মা’রা সহ্য করে না?

বললেন—আমি তো মনে করি বিজলী মরে গেছে—তোমার মাও সেরকম ভাবতে পারবেন না?

প্রসাদ বললে—না যদি পারেন তিনিও মরে যাবেন-—

পঙ্কজবাবু বিস্মিত হয়ে প্রসাদের দিকে তাকালেন।

প্রসাদ বললে—কিন্তু তিনি মরবেন না। কে কার জন্য মরে?

দু’জনেই খানিকক্ষণ চুপ করে রইল—

প্রসাদ বললে—কিন্তু মা যেন এ সবের একটুও আঁচ না পায়,—তা হলে খুঁচিয়ে শেষ পর্যন্ত তোমাকে দিয়ে টাকা পাঠিয়ে ছাড়বে

পঙ্কজবাবু বললেন—তা বটে—

প্রসাদ বললে—ঘোঁট আর কোরো না কিছু—টাকাটা বন্ধ করে দিয়ে—

গুণময়ী এক মুহূর্তের জন্য এসে দাঁড়ালেন—শাড়ীতে হলুদ লঙ্কার চ্যাপসা, হাত পা গায়ে মশলার গন্ধ মাছের মিষ্টি আঁশটে গন্ধ—একেবারে রান্নাঘরের থেকে ছুটে এসেছেন— প্রসাদের দিকে তাকিয়ে গুণময়ী বললেন—একেবারে তিনটে রুইমাছ ভেট পাঠিয়েছে।

–কারা মা!

ঘোষালরা।

স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন—এক একটা রুই যেন এক একটা সোমথ মানুষের বাচ্চা—এমন তরতাজা মাছ—আহা কাটতেও কষ্ট হয়—

পঙ্কজবাবু বললেন—তা হ’লে কাট কেন

—আহা, এক দিন ভালো করে মাছের কালিয়া হল না। যাই—আমি না রাঁধলে আবার ঐ বামুনের রান্না খেতে পারবি প্রসাদ

প্রসাদ মাথা নেড়ে বললে—তা পারব না আমি

গুণময়ী বললেন—আহা, বিজলীও পারত না-—

প্রসাদ ফু ফু করে হেসে বললে—আজ খ্রিস্টানের রান্না খাচ্ছে–

গুণময়ী হতাশ হয়ে বললেন—সে কি রকম রান্না রে?

—সে কি রান্না। সব সেদ্ধ—শালগম সেদ্ধ—মুলো সেদ্ধ—বিট সেদ্ধ—স্যালাড— আধসেদ্ধ মাছ—আঁশটে।

গুণময়ী একটা খোঁচা খেয়ে অন্ধকারের মধ্যে অন্তর্হিত হয়ে গেলেন।

পঙ্কজবাবু খানিকক্ষণ চুপ করে রইলেন—

পরে বললেন—মেম বিয়ে করেছে দেশে আসতে চায় না, মা বাবা ভাই বোন কারুর কাছে একখানা চিঠি অব্দি না—আমার কাছে শুধু সেই টাকাকড়ির চিঠিগুলো ছাড়া—এ কেমন?

প্রসাদ বললে—কেমন অস্বাভাবিক যেন।

আমাদের এস্ট্রেট তো খুব বড় নয়—নানা দিক দিয়েই জড়িয়ে গেছে—তার ওপর নবাবের হালে এই আট বছর ওকে টাকা পাঠালাম—ও যা পেত তার চেয়ে ঢের বেশি ওকে দেওয়া হয়ে গেছে—

পঙ্কজবাবু থামলেন —

তারপর বললেন—কাজেই দ্বিধার কিছু নেই যদি আমি—

প্রসাদের দিকে তাকিয়ে বললেন—না প্ৰসাদ?

কিন্তু মন যেন পঙ্কজবাবুর সায় পাচ্ছে না—কোথায় যেন কেমন কি খোঁচ থেকে যায়—

মনের এই সঙ্কোচ বাঁধাকে পেড়ে ফেলবার চেষ্টা করে বললেন—টাকা পাঠাইলে বা হবে কি—কোনো ভালো কাজে তো নয়—থিয়েটার রেসে ওড়াবে। তা ছাড়া, নিজে সে ঢের বড় হয়েছে এখন; নিজের ঘাড়ের দায়িত্ব এখন ভালো করে বোঝা উচিত তার। নিজের রোজগার করা উচিত তার। না করতে পারে—আসুক এখানে—আমরা দেখব সব। নাহলে এক পয়সাও পাঠাব না।

(পরদিন পঙ্কজবাবু প্রসাদকে বললেন—সব বুঝিয়ে সুঝিয়ে বিজলীকে আর এক খানা চিঠি লিখলাম এই। না যদি শোনে, আর টাকা পাঠাব না। এ বার দেড় হাজার পাঠালাম—.. আধাআধি কমিয়ে দিয়েছি—

কিন্তু কয়েক দিন পরে আরো দেড় হাজার পাঠিয়ে দিলেন তিনি।)

পর দিন সকাল বেলা প্রসাদ ছাড়া আর সকলেই ছিল তেতলার পুব দিকের বারান্দায়।

কল্যাণী বললে—বাবা, ন্যাওতার মাঠ কেন বলে? ন্যাওতা মানে কি?

—কী জানি।

কিশোর বললে—শব্দটা কি আরবী না ফারসী না ইংরেজি—

পঙ্কজবাবু বললেন—জানি না।

কল্যাণী বললে—কোনো ডিকশনারিতে এর মানে পাবে না ছোড়দা—

—তবে ন্যাওতার মাঠের মানে কি?

—সত্যি, ন্যাওতার মাঠ ওটাকে বলে কেন?

—কি অদ্ভুত শব্দ

—কোনো মানে নেই কি বিশ্ৰী

পঙ্কজবাবু অবিশ্যি মানেটা জানতেন—(অন্তত) যে প্রবাদ অনেক দিন থেকে এ মাঠের সম্পর্কে এ অঞ্চলে প্রচলিত হয়ে এসেছে তার সমস্তটুকুই জানতেন তিনি। কিন্তু সে সব কাহিনী বলতে গেলে পূর্বপুরুষদের দু’একটা গ্লানি বেরিয়ে পড়ে—কাজেই বললেন না কিছু।

কল্যাণী বললে—ভিলুন্দির জঙ্গলই বা কি?

—তাই তো—

—আমি অনেক দিন ভেবেছি—কোনো মানে বের করতে পারিনি

—আমিও না-—

কিশোর বললে—ভিলুন্দি বলে আবার একটা শব্দ আছে না কি কোথাও?

কল্যাণী বললে—ছাই আছে।

একটু পরেঃ কোন ডিকশনারিতে পাবে না তুমি ছোড়দা

কল্যাণী বললে—কত সুন্দর সুন্দর নাম দিতে পারত না ছোড়দা? তা না ভিলুন্দির জঙ্গল—

পঙ্কজবাবু বললেন— আচ্ছা বেশ।

বললেন—ও নাম আমার কাছে ঢের সুন্দর শোনায়।

এই জঙ্গলের সম্পর্কেও অনেক দিন থেকে একটা কাহিনী চলে আসছে; কিন্তু নানা কারণে সেই গল্পটাও এদের কাছে আজ তিনি পাড়তে পারলেন না।

কল্যাণী বললে মোটের ওপর এ জায়গাটা আমার ভালো লাগে না—

পঙ্কজবাবুর হাত থেকে খবরের কাগজ আস্তে আস্তে তাঁর কোলের ওপর পড়ে গেল— কল্যাণীর দিকে স্থিরভাবে তাকিয়ে তিনি বললেন—ভালো লাগে না নাকি? এ জায়গাটা তোমার ভালো লাগে না কল্যাণী?

—নাঃ!—

—কেন?

কল্যাণী বললে—বড্ড পাড়াগাঁর মত—

কিশোর বললে—হ্যাঁ, একটা ডিস্ট্রিক্ট টাউন–জজ ম্যাজিস্ট্রেট পুলিশের হেড কোয়ার্টার ওমনি পাড়াগাঁ বলে দিলেই হল আর কি!

কল্যাণী বললে—তা হোক গে——

গুণময়ী বললেন—তা ছাড়া মেয়ে আমার এই কলকাতা থেকে নেমেছে, আহা, একটু একলাটি লাগবেই তো!

পঙ্কজবাবু বললেন—আমাদের এ দিকটা আবার একেবারে শহরের এক প্রান্তে কি না—

কল্যাণী বললে—কি কেবল দিনরাত ঘুঘু ডাকে-আমার ভালো লাগে না—

কিশোর হেসে উঠল—

বললে—সেই হরিণ মারার রাইফেলটা নিয়ে এক বার বেরুতে হবে—জান মা, আমি লিলুয়াতে গিয়ে প্রায়ই পাখি মারি—ঘুঘু, লালশিরে, স্নাইপ, বুনোমুরগি, বালিহাঁস—হাত বেশ পেকে গেছে এখন—

কিশোরের কথায় কেউ কান দিচ্ছিল না

গুণময়ী বললেন—তুমি কেন দিনরাত ঘুঘুর ডাক শুনতে যাও কল্যাণী-—

—বাঃ মার যেমন কথা ঘুঘু ডাকবে, আমি শুনব না?

কিশোর বললে—তুমি বুঝি শোন না মা?

পঙ্কজবাবু বললেন—কৈ, আমার তো ঘুঘুর ডাক খারাপ লাগে না।

গুণময়ী বললেন—আমারও না।

কিশোর বললেন—তা তোমরা গেঁয়ো বলে।

পঙ্কজবাবু বললেন— বাস্তবিক

কল্যাণী বললে—এমন টেনে টেনে ডাকে; সারাদিন-সারা দুপুর—শুনতে শুনতে আমার কিচ্ছু ভালো লাগে না আর–তার ওপর ক্যারম বোর্ড নেই; তার খেলব কাদের নিয়ে—কেউ নেই—সে রকম কোনো লোকজন নেই, একটু সিনেমা দেখতে পারা যায় না, থিয়েটার নেই, গান নেই—সব সময়ই ঘরদোর এমন থম থম করছে।

কিশোর হো হো করে হেসে উঠল—

পঙ্কজবাবু বললে—তুমি তাহ’লে ক্যারম খেলতেও শিখেছ—?

কল্যাণী বললে—কবে শিখেছি!

বোর্ডিঙে গিয়ে?

—বাঃ, এখানেই তো—

—এখানে?

—বাঃ, ছোড়দার একটা বোর্ড ছিল—

পঙ্কজবাবু বললেন—ওঃ–

বললেন—বিলিয়ার্ডস খেলতে জান কল্যাণী?

—না।

—কলকাতায় খুব বায়োস্কোপ দেখতে?

—হ্যাঁ।

—কার সঙ্গে যেতে?

—কল্যাণী একটু ফাঁপরে পড়ল—

বললে—মেয়েদের সঙ্গেই যেতাম

—তা যেতে দেয়

—6731—

দেয়—

পঙ্কজবাবু বললেন-আর থিয়েটার?

থিয়েটারেও সে গিয়েছে বটে ঢের—ছোড়দা আর তার বন্ধুদের সঙ্গে—কিন্তু সে সব কথা চেপে গেল কল্যাণী।

বললে—না, থিয়েটারে আমি যাই নি বাবা।

—কোনো দিনও না?

—না।

—তবে যে বলছিলে?

কল্যাণী বললে—বললামই তো যাইনি–

—কেন যাওনি

—তোমার অনুমতি না নিয়ে যাওয়া উচিত নয় কি না—তাই—

পঙ্কজবাবু বললেন—এবার আমি যদি অনুমতি দেই তাহ’লে যাবে?

কল্যাণী দু’এক মুহূর্ত চুপ থেকে বললে—আমি আরো বড় না হ’লে তুমি কি অনুমতি দেবে বাবা?

পঙ্কজবাবু একটু থেমে বললেন–হয়তো আমি কোনোদিনই তোমাকে অনুমতি দেব না—থিয়েটার দেখতে।

কল্যাণী একটু বিস্মিত হল, আঘাত পেল, কিন্তু মুহূর্তের মধ্যেই সে সব মুছে গেল তার; বাবা থিয়েটার দেখতে বারণ করলে বিশেষ কিছু আসে যায় না, টিকিট কাটবার পয়সা থাকলেই হয়—জীবনের এমন এক রকমের সত্যকে তার ভাইদের সঙ্গে সেও অধিগত করেছে। অধিগত করতে গিয়ে পঙ্কজবাবুর ছেলেমেয়েদের মধ্যে কল্যাণীকেই সবচেয়ে বেশি বেগ পেতে হয়েছে—অধিগত ক’রেও তারই সবচেয়ে কম শান্তি। কিন্তু তবুও সংস্কারহীন গণ্ডীহীন সুবিধাবাদের জীবনকেও সেও আয়ত্ত করেছে—

পঙ্কজবাবু বললেন—তোমার বাপ মা ভাইদের মধ্যে এসেও যে তোমার ভালো লাগে না—একটা ক্যারাম বোর্ড তাস বায়োস্কোপ গল্প গুজব গান কলকাতার সব আনুষাঙ্গিক না হলে তোমার যে চলে না এমনতর মনের ভাবটাকে তোমার পরিত্যাগ করতে হবে। এখানেই তোমার মন বসাতে হবে। তোমার জন্য একটা ক্যারাম বোর্ড কিনে দেব না আমি, তাসও খেলতে পারবে না, এখানে একটা বায়োস্কোপ হল হয়েছে সেখানেও যেতে দেব না তোমাকে আমি—কিন্তু —

কল্যাণী কাঁদছিল—

পঙ্কজবাবু বললেন—কিন্তু তোমার মা যেমন এই বাড়িতে বসে ঢের পরিতৃপ্তি পাচ্ছেন সে রকম একটা তৃপ্তি ধীরে ধীরে বোধ করা তোমার পক্ষেও সম্ভব হবে।

কল্যাণী চোখের জল মুছতে লাগল—

পঙ্কজবাবু বললেন—এখানে কোনো অশান্তি নেই তো—ভালো লাগবে না কেন তোমার?

বললেন—শালিখবাড়ি তোমার ভালো লাগে না—তোমার বাপ-মা ভাইদের ভিতরে এসেও তোমার ভালো লাগে না—এমন কথাও তুমি বলেছিলে।

কল্যাণীর আবার কান্না এল, কিন্তু জোর করে নিজেকে নিরস্ত করে রাখল সে।

পঙ্কজবাবু বললেন—তুমি এদ্দিন চাল যা শিখেছ ভুল শিখেছ—

সকলেই অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। পঙ্কজবাবু আবার বললেন—সব ভুল শিখেছ—

কল্যাণীর মনে হল তার বাবাই ভুল শিখেছেন—কত বড় বড় লোক থিয়েটার দেখে, বায়োস্কোপ দেখে, নাচ গান মজলিসে ফুর্তি করে, এ রকম একটা পাড়াগায় এলে পাঁচ মিনিটের মধ্যে তাদের প্রাণ হাঁফিয়ে ওঠে—তাদের কি ভুল শিক্ষা? কক্ষণো না। তার বাবাই যেন কেমন কঠিন ধরণের মানুষ–

কিশোরের মনে হ’ল কল্যাণী তো ঠিকই বলেছিল, এ জায়গা আবার ভালো লাগে কার? কোনো ভুল করেনি–তার বাবার শিক্ষাই অসম্পূর্ণ।

গুণময়ী ভাবছিলেন, আহা, মেয়েটাকে মিছেমিছে কাঁদাচ্ছেন কেন।

পঙ্কজবাবু বললেন—শুধু কলেজে পড়লেই হয় না, ডিগ্রি নিলেই হয় না—বই তো আমিও ঢের পড়েছি—

থামলেন।

বললেন—মস্ত বড় একটা লাইব্রেরী রয়েছে আমার—

বললেন—অনেক বড় বড় লেখকদের অনেক বই আছে। তারা নাকি চিন্তাশীল— মনীষী—ঋষি—কত কি। কিন্তু যত অদ্ভুত কথা তারা বলেছে সেই সব যদি মানতাম তা হলে একটা মস্ত বড় ব্যভিচারী জমিদার হতাম আমি আজ—অনাচারকেও ধর্ম মনে করতাম। কিন্তু সে সব ভুল।

অনেকক্ষণ বসে শিক্ষার ব্যাখ্যা করলেন তিনি, ছেলেমেয়েদের শেখালেন ধর্ম কি, নীতি কি, ধর্ম নীতি চরিত্র ছাড়া যে কোনো শিক্ষা হতে পারে না বললেন তা, বিধাতা যে কি রকম মঙ্গলময় কত মঙ্গলময় খুলে বললেন।

আগাগোড়া সমস্ত কথার মধ্যেই এর ঢের আন্তরিকতা—আগ্রহ ছিল। কিন্তু এর একটা কথাও গ্রাহ্য করল না ছেলেমেয়েরা, গ্রাহ্য করল না।—

তাদের মনে হ’ল বাবার চেয়ে জীবনটাকে তারা ঢের বেশি বোঝে। কল্যাণীর মনে হল বাবার মনে কষ্ট না দিয়েও তো থিয়েটার দেখা যায়—বাবা না জানলেই হ’ল; কলকাতায় যেমন সে বরাবর চলে এসেছে তেমনিই চলবে। বাবার উপদেশ শুনবার পর নিজের রকমটাকে কোনো দিক দিয়ে কোনোভাবে বদলাবার কোনো তাগিদ বোধ করল না কল্যাণী। জীবনটাকে সে নিজের রুচি অনুসারে চালাবে—বাবা হয়তো একটু আধটু কষ্ট পাবেন; কিন্তু প্রায়ই তো জানবেন না তিনি। কল্যাণীর লুকোচুরির সম্বন্ধে পঙ্কজবাবু যাতে কোনো দিনও কিছু না জানতে পারেন মনে মনে তারি নানা রকম দুঃসাধ্য উপায় বাৎলাচ্ছিল মেয়েটি। মন তার হয়রান হয়ে উঠেছিল। এক সময় মনে হল; বাবা তো চিরকাল বেঁচেও থাকবেন না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *