কল্যাণী – ২০

কুড়ি

চন্দ্রমোহনের সঙ্গে কল্যাণীর বিয়ে হবার পর বছর খানেক কেটে গেছে।

কল্যাণীর সাত মাস চলছে—

জরায়ুর শিশুটি যখন তাকে তেমন বিশেষ যন্ত্রণা দিচ্ছিল না, দিনটা মন্দ লাগছিল না, স্বামী কাছে ছিল না—তখন একটু অবসর করে মাকে সে চিঠি লিখতে বসল :

এই এক বছরের মধ্যে তিন চারখানা চিঠি মাত্র তোমাকে লিখেছি মা। বাবাকে এক খানাও লিখতে পারিনি।

বাবার দুইখানা চিঠি আমি ঠিক সময়েই পেয়েছিলাম, কিন্তু সেগুলোর কোনো উত্তর দিয়ে উঠতে পারি না। বাবা কি রাগ করেছেন?

তোমরা তো জানতেই পেরেছ মা যে সাত আট কোটি টাকার কিছু ব্যবসা নয়— ব্যবসাই নয়; ব্যাংকে ওঁর পনের হাজার টাকা আছে মাত্র। তারি সুদে আমাদের চলে। উনি অনেক সময় বলেন, ব্যবসা না করলে এ টাকা বাড়বে কি করে? ব্যবসা করতে চান। কিন্তু আমি জানি—ব্যবসাবুদ্ধি ওঁর একেবারেই নেই। চার দিক থেকে লোকেরা এসে ওঁকে প্রায়ই ফুসলায়—উনি বিচলিত হয়ে যান। আমি এ রকম করে শক্ত করে চেপে না থাকলে এ ক’টি টাকা অনেক আগেই মারা যেত। তখন আমরা দাঁড়াতাম কোথায়, সেই পনেরো হাজার টাকার মধ্যেও সাত হাজার টাকা বাবার দেওয়া—আমার বিয়ের সময় যা যৌতুক দেওয়া হয়েছিল সেই টাকা।

মোট পোনেরো হাজার টাকা আমাদের সম্বল—বিয়ের আগে ওঁর আট হাজার টাকা ছিল মাত্র—কিন্তু ভুল খাতা দেখিয়ে ভাওতা দিয়ে বাবাকে ও মেজদাকে উনি প্রতারিত করেছেন বলে বাবা আজো ওঁর ওপর মর্মে মর্মে চটে আছেন—চিঠিতে লোকের মুখে ক্রমাগত ওঁকে গাল পাড়েন। তুমি তো তা কর না মা। তুমি জান মেয়ে মানুষের স্বামী ছাড়া কি আর থাকতে পারে। তুমি বাবাকে বলে দিও তিনি যেন ওঁকে এরকম করে আর নির্যাতন করতে না যান— তাতে আমার বড় বেশি আঘাত লাগে। আমাকেও যা চিঠি লিখেছেন তাও ওঁকে গাল পেড়ে—আমাকে না জেনে না বুঝে জলে ফেলে দিয়েছেন এই সব কথা লিখেছেন। এই জন্য আমার এত খারাপ লেগেছে যে বাবার চিঠির উত্তরও দেইনি।

বাবাকে বোলো তুমি যে আমাকে জলে ফেলে দেওয়া হয়নি—আমার স্বামীর কাছেই আমাকে রাখা হয়েছে।

এ সব কথার মর্ম বাবা হয়তো ভালোবাসবেন না—আমার স্বামী তার এমন বিষদৃষ্টিতে কিন্তু তুমি তো বুঝবে

এর আগে আমরা বালিগঞ্জের দিকে একটা বাড়িতে ছিলাম: ভাড়া লাগত না। ওঁর দাদার বাড়ি। দু’টো কোঠা আমাদের জন্য আলাদা করে দেওয়া হয়েছিল। বেশ খোলামেলা ছিল—সামনে একটা মস্ত বড় মাঠ; সেখানে ছেলেরা ফুটবল, হকি, ডাণ্ডাগুলি—আরো কত কি খেলত। আমি অনেক সময় জানালার গরাদ ধরে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখতাম।

বেশ মজা লাগত আমার—ছোট ছোট ছেলেমেয়েদের খেলা দেখতে। ছোড়দার সঙ্গে— আর ঐ ভূষণ আর আকুশির সঙ্গে ছেলেবেলায় আমিও তো কত খেলেছি!

ভূষণ কোথায় মা এখন? বিয়ে হয়ে গেছে? কোথায় হ’ল? আকুশি কোথায়?

বালিগঞ্জের বাড়িতে বেশ আলো হাওয়া আসত। খুব শান্তি ছিল। বিশেষ কোনো কাজ ছিল না। একটা ঠিকা ঝি ছিল। সেই সব করে দিত। ওঁর দাদাদের সঙ্গে এক সঙ্গে খেতাম।

সারাদিন সেলাই করতাম—আর মাঝে মাঝে উনি আমার সঙ্গে তাস খেলতে চাইতেন। দু’জনে মিলে খেলতাম—বেশ মজা লাগত।

ওঁর দাদার একটা এস্রাজ ছিল–সন্ধ্যার সময় সেটা বাজাতাম। এস্রাজ বাজাতে জানি না আমি অবিশ্যি। উনিও জানেন না। কিন্তু ঐ এক রকম হত।

কিন্তু সে বাড়িটা আমাদের ছেড়ে দিতে হয়েছে। ওঁর দাদা বললেন যে তাঁর নিজের লোকজন আসবে। শ্যামবাজারের দিকে বাড়ি ভাড়া করতে হয়েছে আমাদের; গোটা বাড়ি অবিশ্য নয়—দু’টো ঘর ভাড়া করেছি—একটা রান্নাঘর আছে; রান্নাঘরটা এক তলায়—ঘর দু’টো দোতলায়—এই সময় ওঠানামা করতে হয—এই যা কষ্ট—এখন আমার সাত মাস। উনি বলেন একটা রাঁধুনি রেখে দি—কিন্তু তাতে বড় পয়সা খরচ; এখন আমাদের সম্পূর্ণ সুদের টাকায়ই চালাতে হচ্ছে শুধু; পঁচাত্তর না সত্তর কত করে পান মাসে, তার থেকে বাড়ি ভাড়াই দিতে হয় পঁয়ত্রিশ—আর পঁয়ত্রিশে আমাদের চালাতে হয়। কাজেই রাঁধুনি রাখব কি করে? ঠিকা ঝিও রাখি নি। সব কাজ আমিই করি তুমি কিছু বেভো না মা—ভারী জিনিস কিছু তুলতে হয় না; দু’জন মানুষের রান্না তো মোটে—কত আর ভার হবে?

কল আছে—জলের জন্য বিশেষ কষ্ট পেতে হয় না।

ওঠানামাও বেশি করি না; সেই ভোরে নামি—একেবারে রান্না সেরে—স্নান করে ওঁকে দিয়ে আমি খেয়ে তবে গিয়ে ওপরে উঠি। বেশি হাঙ্গাম পোয়াতে হয় না।

বাসাটা গলির ভেতরে। তাই বড্ড অন্ধকার; হাওয়া তেমন খেলে না। আমাদের ঘর দু’টোর দক্ষিণ পূব বন্ধ—উত্তরের দিকে দু’টো জানালা—জানালার পাশেই কাদের বাড়ির সব প্রকাণ্ড দেয়াল—একেবারে আকাশ অব্দি চলে গিয়েছে। আকাশটাকে বড় একটা দেখতে পাওয়া যায় না—সেই যেন কেমন লাগে যেন মাঝে মাঝে

একেবারে হাঁফিয়ে উঠতে হয়। গলির ভেতর আমের খোসা, নেংটি ইঁদুর মরা, পচা বিড়াল, ভাত তরকারী উচ্ছিষ্ট, কাদের একটা গোয়াল, দু’এক জন কুষ্ঠ রোগী এইসব মিলে গন্ধ হয় বড়–কাজেই জানালার দিকে বড় একটা যাই না।

কিন্তু আমার মনে হয় পেটে ছেলে আছে বলেই বোধ হয় মনের এ রকম আঠকানে অবস্থা—শরীরটাও খারাপ লাগে। তাই না মা?

ছেলে হয়ে গেলে আবার বেশ আরাম পাব—উনিও তাই বলেন; শিগগিরই হয়ে যাবে—আর বেশি দেরী নেই; উনি বলেছেন তখন ভাড়াটে ঘোড়ার গাড়িতে করে আমাকে নিয়ে রোজ বিকেলে একটু একটু বেড়াবেন।

বড়দা কি এখনও বিলেত? তার কোনো চিঠি পাও? বড়দা কি আর দেশে ফিরবে না? কতদিন দেখিনি তাকে। যখন বিলেত চলে যায়—আমার মনে আছে আমি ঘুমুচ্ছিলাম—তুমি আমাকে জানালে। আমি দৌড়ে গিয়ে তাকে প্রণাম করলাম—মেজদা নাকি কলকাতায় এসেছিলেন? আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন না কেন? তিন চার বার কলকাতায় এসেছিলেন—অথচ একবারও এদিকে এলেন না। জানতে পেরে আমি প্রত্যেকবার কত কেঁদেছি—তোমাকে লিখেছি—কিন্তু তবুও মেজদা একবারও দেখা করতে এলেন না। ওঁর ওপর না হয় তাঁর রাগ থাকতে পারে। কিন্তু আমি তাঁর বোন—নই কি? তবে কেন তিনি আমাকে কাঁদালেন? ওরা আর আমাকে বোন বলেও মনে করে না—এই জন্য আমার এত কষ্ট হয়। মাঝে মাঝে বুক ফেটে যেতে থাকে।

কিন্তু উনি এসে ধীরে ধীরে আমাকে সান্ত্বনা দেন। তাইতে আমার একটু ভালো লাগে।

ছোড়দা মাঝে মাঝে এখানে আসে—কিন্তু ওঁকে দেখলেই নাক খিঁচে উঠে চলে যায়। এতে আমার বড় খারাপ লাগে। ছোড়দা কেন এ রকম করছে? ছোড়দাকে তুমি লিখে দিও এ রকম করে না যেন আর, সব মানুষই মানুষ, বিশেষ করে যে মানুষ ওঁর মত জীবনের কাছ থেকে এত বেদনা বিড়ম্বনা পাচ্ছে তাকে ঘৃণা না করে একটু সমবেদনা দেখালেই মানুষের কাজ হয়।

তুমি কি একবার কলকাতায় আসবে না? তোমাকে বড় দেখতে ইচ্ছা করে; বাবাকেও। কিন্তু তোমরা কেউ আস না কেন?

সন্তান না হলে আমি দেশেও যেতে পারি না। আগে আমাকে দেশে যেতে লিখেছিলে। কিন্তু তখন মেজদা কলকাতায়–অথচ আমাদের সঙ্গে দেখা করলে না, সেই জন্য যাইনি।

কিন্তু এ সব অভিমান এখন আর আমার নেই। আগে নানা জিনিসেই ঢের কষ্ট হত,—কিন্তু এখন ক্রমে ক্রমে সব যেন বুঝতে পারছি—আঘাত ক্রমে ক্রমেই কম অনুভব করি— একদিন হয়তো কোনো রকম আঘাত বোধই থাকবে না।

এই এক বছরের ভিতর আমি ঢের বড় হয়ে গেছি, মা। আসরীতে দেখলে হাসি পায়; উনিও মাঝে মাঝে আমার চেহারা দেখে হাসেন, দুঃখ করেন, কিন্তু ঠাট্টা করেন না, বকেন না। নিজেকে মাঝে মাঝে কেমন আধবয়সী বুড়োমানুষ বলে মনে হয়। কিন্তু মনটাই যে আস্তে আস্তে ঢের বয়স্ক হয়ে গেছে। বিয়ের আগের সেই ছেলেমানুষী নেই, অভিমান নেই, অহঙ্কার নেই, ডায়েরী লিখবার সাধ নেই, সিনেমা দেখার প্রবৃত্তি নেই, কি সব অদ্ভুত বই পড়তাম সে সবের কথা মনে পড়লে এখন গায়ে জ্বর আসে। মেয়েদের কাছে চিঠি লিখিনি আর—ইচ্ছে করে না। কি হবে লিখে? তাদের সঙ্গে দেখা করতেও ভয় করে। তারা দিন রাত এত সব বড় বড় কথা বলে—তাদের ভাব, ভাষা, চিন্তা ভালো করে বুঝতে হ’লে ঢের বিদ্যা বুদ্ধি চাই, কিন্তু এই সবই আমার কাছে অসার বলে মনে হয়। এ সব দিয়ে কি হবে? বিয়ের আগের সেই ভালোবাসাও নেই। স্বামী স্ত্রীর সম্পর্কটা অন্য রকম—সেবা ও শ্রদ্ধার জিনিস। উনি বলেন ভালোবাসারও জিনিস। কিন্তু আমি বুঝি না। হয়তো স্বামীরা ভালোবাসে, স্ত্রীরা শ্রদ্ধা করে। কিম্বা যে মেয়েমানুষদের চরিত্র খারাপ তারা অন্য পুরুষদের সঙ্গে ভালোবাসা করে বেড়ায়। তাই না মা?

ওঁর এক বন্ধু আছেন—ডাক্তার—বুড়োমানুষ—মিডওয়াইফারি খুব ভাল জানেন। তিনি প্রায়ই সন্ধ্যার সময় এসে এখানে চা খান; ও আমাকে দেখে যান। ক’দিন থেকে বিছানার ওপর আমাকে চিৎ করে শুইয়ে পেটের কাপড় উঠিয়ে পেট নেড়ে চেড়ে দেখছেন। কাল পেটের ওপর কান রেখে অনেকক্ষণ কি যেন শুনছিলেন। বুড়ো মানুষ না হ’লে আমার বড় লজ্জা করত।

তারপর বললেন—ছেলে হবে। পেট খুব বড় কিনা, কাজেই সন্তানও খুব বড়—কাজেই ছেলে। তা ছাড়া নড়াচড়ার রকম দেখেও উনি বুঝেছেন যে ছেলেই হবে।….

ছেলেই হ’ল—

যেই দেখে সেই বলে ‘একি, এ যে আর এক চন্দ্রমোহন এল—’

ঠিক তেম্নি মেনি বাঁদরের মত মুখ, হলদে রং, চোখ পিটপিট করছে—ভুরু দু’টো রোঁয়ায় ভরা—মুখের ভিতর কেমন একটা নির্মম ধাপ্পাবাজির ইসারা—তারপর কেমন একটা নিঃসহায়তা

কিন্তু কল্যাণীর চোখে এ সব কিছুই ধরা পড়ে না। সুস্থ সন্তানকে মাই খাইয়ে নিজের বুকের ভিতর জড়িয়ে এমন ভালো লাগে তার। এম্নি করে মাস আষ্টেক কেটে গেল— ছেলের দাদা দিদিমা কেউ তারে দেখতে এল না; কল্যাণীরও দেশে যাওয়া হ’ল না। চিঠিও সে আর পায় না কারুর—লেখেও না কাউকে।

একদিন দুপুরবেলা চন্দ্রমোহন দেখল যে কল্যাণী ঘুমুচ্ছে—সমস্ত শরীরের জামা কাপড় সবই প্রায় খোলা—ছেলেটিকে মাই দিতে দিতে কি এক রকম আদরে ও পিপাসায় নিজের শরীরের সাথে ছেলের শরীর একেবারে মিশিয়ে ফেলেছে যেন সে–মিশ্রণ ছাড়া পৃথিবীতে আর কিছুই যেন চায় না কল্যাণী—জিনিসটাকে সোজাসুজি বুঝতে পারল না চন্দ্রমোহন। উদ্ভট ভাবে ভাবলে— এই ছেলেটা তো সে নিজেই—দিকবালিকারা মাথা নেড়ে নেড়ে বললে—তুমিই তো!

এই স্বর্গসম্ভবা কল্যাণীর মত মেয়ের জীবনেরও এক বিরাট উচ্ছৃঙ্খলতা—উপহাস, নোংরামি, অধঃপতন, ও নিজের মনের এক অপরিসীম লালসার রসে মন তার উত্তেজিত হয়ে উঠল।

কিন্তু সম্প্রতি উপায় নেই—রাত্রে হবে।

কল্যাণী আবার আট মাস—আর এক চন্দ্রমোহন আসছে।

(গভীর পরাক্রমের সঙ্গে আপাতত নিজেকে সংযত করে নিয়ে চন্দ্রমোহন বেরিয়ে গেল।)

জুলাই ১৯৩২, কলকাতা

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *