চৌদ্দ
বেলা এগারোটার সয় ঘুমের থেকে জেগে উঠে স্নান করতে গেল। আজকাল পঙ্কজবাবু চন্দ্রমোহনের খাতিরে দোতলায় একটা গোল টেবিলের চারদিকে সমস্ত পরিবারকে নিয়ে খেতে বসেন—
এ পদ্ধতিটা চন্দ্ৰমোহন শিখিয়েছে; প্রসাদ বলেছে ‘মন্দ কি?’ পঙ্কজবাবুরও বোধ হ’ল এ বেশ। এক গুণময়ী ছাড়া সকলেই দু’বেলা টেবিলে বসে খায়।
স্নান শেষ করে কল্যাণী এসে দেখল টেবিলে জায়গা তৈরি। ভিজে চুলে—একটুও না নিংড়ে—সিঁথিপাটি কিছুই না করে কল্যাণী খেতে বসল এসে।
চন্দ্রমোহন তাকিয়ে দেখল—এমন বিষণ্ণ মুখ এ মেয়েটির আজ!
সমস্ত মাথার থেকে অনবরত টপটপ করে জল পড়ে ব্লাউজ শাড়ি সব ভিজে একাকার হয়ে যাচ্ছিল কল্যাণীর।
কিন্তু এক চন্দ্রমোহন ছাড়া সেদিকে আর কারুর লক্ষ্য ছিল না। পৃথিবীর কোনও কিছু-ে কই কল্যাণী আজ আর তার গ্রাহ্যের মধ্যে আনছিল না—একধারে বসে চোখ নত করে খেয়ে আস্তে আস্তে উঠে সে চলে গেল। নিজের ঘরে আরসীর সামনে গিয়ে ধীরে ধীরে চুল আঁচড়ে বেণী বেঁধে নিজের পড়ার টেবিলের পাশে এসে বসল সে।
চেয়ারে বসে ভাবল “মিনুকে একখানা চিঠি লিখবে’ সমস্ত কথা খুলে লিখবে সে; না জানি মিনু কি ভাববে?
ভাবতে গিয়ে কল্যাণী বড় মর্মাহত হয়ে উঠল।
মীরার কবিতার খাতা ঠিক আছে; চিতুর অ্যালিস ইন ওয়ান্ডারল্যান্ডও; সুপ্রভা যে বই দিয়েছে সেখানাও রয়েছে। ভাল করে দেখে নিল সব কল্যাণী। যে শুকনো গোলাপ ও ফার্নগুলো এদিক সেদিক ছড়িয়ে পড়ে ছিল মীরার খাতার ভিতর ধীরে ধীরে যত্ন করে গুছিয়ে রেখে দিল সব সে।
টেবিলটাই সকাল থেকে গুছিয়ে ছিল—
আরও একটু পরিপাটি করে গুছিয়ে সাজিয়ে ফেলল এখন। কল্যাণী ভাবল, দরকারী জিনিসগুলো এর পর থেকে ডেস্কের ভিতর চাবি বন্ধ করে রেখে দেবে।
যেমন ভাবা তেমন কাজ।
মেয়েদের বইখাতাগুলো এখনই ডেস্কের ভিতর রেখে দিল সে। রেখে দিতে দিতে ডেস্কের মধ্যে নিজে চিঠিপত্রগুলো নেড়েচেড়ে দেখল—মনে হ’ল কে যেন এ সবও ঘেঁটেছে—দু’চারখানা চিঠিকে খসিয়েছে বলে মনে হল।
কিন্তু চিঠির তো কোনও তালিকা নেই তার কাছে—অনেক চিঠিই তো তার কাছে আসে—নিজের অবহেলায়ও চিঠি হারায় সে ঢের—অনেকগুলো রেখেও দেয় ডেস্কের ভিতর; এগুলোর ভিতর থেকে কেউ যদি আবার কিছু সরিয়ে নেয় বুঝে ওঠা বড় দুষ্কর কল্যাণীর পক্ষে।
চোখ তার ব্যথা করছিল।
চোখ মাথা—এ সব আর খাটতে চায় না যেন।
কল্যাণীর মনে হ’ল চিঠি যদি কেউ নিয়ে থাকেনিক্ সে; যা খুশি করুক গে; করবার নেই, বলবার নেই।
নিজের ডায়েরীটা বের করল সে।
মিনু তাকে ডায়েরী লিখতে শিখিয়েছে। এক বছর ধরে দিনের পর দিন লিখে আসছে কল্যাণী
—একটা মস্ত বড় মরোক্কো চামড়ায় বাঁধানো খাতায় তারিখের পর তারিখ কত কি ঘটনা—কত কি দুষ্টুমি–ফুর্তি—মন্তব্য—মাঝে মাঝে এক আধটু ভালোবাসার কথা— মেয়েদের সঙ্গে, দু’একটা ছেলের সঙ্গেও অবিশ্যি।
কল্যাণীর মুখ আরক্তিম হয়ে উঠল।
দু’একটা আধ-ফোটা গোপন ভালোবাসার কথা মনে পড়ে গেল তার—ভাবতে লাগল—ডায়েরীটা টেবিলে রেখে—ডায়েরীর ওপর মাথা গুঁজে অনেকক্ষণ ধরে ভাবল সে সে সব ছেলেরা আজ কোথায়? ছোড়দার সঙ্গে বোর্ডিংয়ে এসেছিল একটি একদিন; মামাবাবুর বাসায় আর একটির সঙ্গে দেখা হয়েছিল; এই শালিখবাড়িতেও আর একজন রয়েছে—অবিনাশদা।
কিন্তু এ ভালোবাসাগুলো জমেনি—জমতে পারেনি তেমন; এদের সঙ্গে দেখা হয় কত কম। এত কম! বিধাতা এদের।
কে জানে অবিনাশদা এখন শালিখবাড়িতেও আছে কি না?
আছে হয়তো; পূজোর ছুটিতে এসেছে নিশ্চয়।
অবিনাশদার সঙ্গে এক দিন দেখা করতে যাবে সে–ছোড়দাকে সঙ্গে নিয়ে যাবে। তারপর ছোড়দাকে দেবে বিদায় দিয়ে। তারপর কথাবার্তার পর অবিনাশদা কল্যাণীকে তার বাসায় পৌছে দেবে। ডায়েরীতে অবিনাশের কথা মাঝে মাঝে অল্পস্বল্প লিখে রেখেছে কল্যাণী। মিনু দেখতে চেয়েছিল—কিছুতেই দেখায়নি; নিজের ভালোবাসার কথাগুলো কাউকেই সে দেখায়নি।
কিন্তু এ হয়তো ভালোবাসাও নয়।
কে জানে ভালোবাসা কি না?
যাই হোক না হোক, সেই কলকাতার ছেলে দু’টির চেয়েও অবিনাশকে তার নিকটতর মনে হয়। হয় না কি?
ডায়েরীতে অনেক কথা লিখবে আজ কল্যাণী।
ধীরে ধীরে ডায়েরীটা খুলল সে। কিন্তু খুলতেই সে স্তম্ভিত হয়ে গেল।
কল্যাণীর মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ল যেন; এ কি ডায়েরীর মাঝখানের ক’টা পাতা (এমন করে) কাটা কেন? কে কেটে নিল? এ কি ভীষণ!
কল্যাণী সমস্ত চোখে অন্ধকার দেখতে লাগল যেন। ঘরের দরজা জানালা আটকে নিস্তব্ধ হয়ে বসে রইল সে। কি সে করবে? কি সে করতে পারে! এ ডায়েরীর কথা কাকে সে বলবে? ছি, ছি, ছি, ছি——
এ করে কি লাভ হ’ল তার?
তারপর বিতর্ক আর নয়। বালিশে মুখ গুঁজে নিঃসহায় শিশুর মতো প্রাণ ঢেলে কাঁদতে লাগল কল্যাণী।
বেলা তিনটের সময় ধীরে ধীরে চোখ মুছে আবার কিশোরের কাছে গেল সে। কিশোর তখনও লিখছিল—তার সেই নাটক।
কল্যাণী গিয়ে বললে—ছোড়দা—
গলা তার এত শান্ত—এত নরম—এত ব্যথিত যে কিশোর অত্যন্ত সমবেদনার সঙ্গে কল্যাণীর দিকে তাকিয়ে বললে–কি রে!
কল্যাণী বললে—ছোড়দা, কাউকে বলবে না একটা কথা।
কিশোর বললে—কেন বলব? আমার কাছে যা গোপন রাখতে চাও সে কথা তুমি আমি ছাড়া আর কেউ জানবে না কল্যাণী।
কল্যাণী আশ্বাস পেয়ে বললে–ছোড়দা, সেই বইটে আমি কোথাও পেলাম না–হয়তো আমিই এমন জায়গায় রেখেছিলাম যে সেখান থেকে কেউ নিয়ে গেছে; তা হতে পারে।
কল্যাণী থামল
কিশোর বললে—আচ্ছা আমি খুঁজে দেখব
—জান ছোড়দা, আমি ডায়েরী লিখি—
—ডায়েরী লিখিস?
—হ্যাঁ
—কৈ, আমি তো জানি না—
—কাউকে আমি বলিনি
কিশোর সমবেদনার খোরাক জুগিয়ে বললে—তা সত্যি, ঢেঁড়া পিটোবার জিনিস তো এ সব নয়; নিজের মনের যে সব কথা নিজেকে ছাড়া আর নিজের সখীদের ছাড়া আর কাউকে বলা চলে না তাই দিয়েই মানুষের ডায়েরী—মেয়েদের অন্তত।
আমিও অনেক সময় ভাবি ডায়েরী লিখব—কিন্তু মেয়েরা ছাড়া ও লিখতে পারে না। তাই নাটক লিখছি—
কিশোরের কথার ভিতর, তার গলায়, কোথাও কোনো উপহাসের সুর নেই; কল্যাণীকে কিশোর এমন সমর্থন করল, কল্যাণী এমন ভরসা পেল।
সে বললে–ছোড়দা, ডেস্কের ভিতর আমি আমার ডায়েরী রেখে দিয়েছিলাম—কাল রাতে লিখে রেখে দিয়েছি—ঠিকঠাক কোথাও কোনও গলতি নেই। আজ দুপুরে আবার ডেস্কের থেকে বার করে দেখি মাঝখানের দশ পনেরো পাতা কেটে কেটে নিয়েছে
কিশোর অবাক হয়ে বললে—বলিস কি!
—সত্যি কেটে নিয়েছে ছোড়দা
—কেটে নিয়েছে মানে
—কাঁচি দিয়ে কেউ কেটে নিলে যে রকম—তাই
কিশোর স্তম্ভিত হয়ে বললে—তা কি করে হয়!
—হয়েছে তো
—ইঁদুরে কাটেনি তো?
—তুমি দেখে যাও এসে ছোড়দা মানুষ আর কেউ কেটেছে কি না—
কিশোর কল্যাণীর সঙ্গে গেল—
ডায়েরীটা টেবিলের ওপরেই ছিল
কল্যাণী বললে—এই দেখ—
কিশোর ভ্রুকুটি করে দেখল কাঁচি বা ব্লেড দিয়ে কেটে নিলে যে রকম হয় ঠিক তাই। মানুষের হাতে কাটা—বেশ নিপুণভাবেও বটে।
বললে—এ কি অন্যায়!
কল্যাণী বললে—বিশেষ করে এই পাতাগুলো নিয়ে গেছে কেটে
কিশোর বললে—ওগুলোতে কি ছিল?
—যাই থাক না কেন?
কিশোর বললে—তোর ডেস্কের ভিতর ছিল?
—হ্যাঁ
—মজা ছোড়দা?
—জঘন্য
কল্যাণী বললে—কি করা যাবে?
কিশোর একটু ভেবে বললে—যে নিয়েছে তাকে কিছুতেই ধরতে পারা যাবে না।
কেন?
—কাকে তুমি সন্দেহ করবে?
কল্যাণী অত্যন্ত কঠিনভাবে ভেবেও কাউকে সন্দেহ করতে পারল না।
কিশোর বিমুগ্ধ হয়ে দেখছিল সুন্দর পরিষ্কার হাতে প্রায় আড়াইশো তিনশো পৃষ্ঠা ভরে কল্যাণী কত কি লিখেছে!
কিশোর বললে—পড়ব কল্যাণী?
—পড়।
দু’এক পাতা উল্টে কিশোর বললে—থাক্।
ডায়েরীটা বন্ধ করে রেখে দিল কিশোর।
উঠে দাঁড়াল।
কল্যাণী বললে কোথায় যাচ্ছ?
—লিখতে।
—আমার কি ব্যবস্থা হ’ল?
কিশোর চোখ মুখ হাত রগড়ে একটা হাই তুলে বললে—কিছু তো আমি ভেবে বের করতে পারছি না। যখন কাটছিল তখন যদি ধরা যেত তাহলে প্যাদানো যেত—কড়িকাঠের সঙ্গে লটকে দিতাম—কিন্তু এখন করতে পারা যাবে না কিছু। কাকে সন্দেহ কর তুমি।
কিশোর এক পা দু’পা করে হাঁটতে লাগল—
কল্যাণী বললে—তা’হলে আমাকে চোখ বুজে এ অত্যাচার সহ্য করতে হবে?
—কেউ যদি বলে তুমি নিজে কেটেছ—?
কল্যাণী সে কথা অগ্রাহ্য করে বললে—তাহ’লে তোমরাও এ বাড়ির কেউই আমার কোনো উপায় করে দিতে পারবে না।
কিশোর বললে—এখন থেকে চাবি বন্ধ করে রেখে দিস
—কিন্তু সম্প্রতি যা সর্বনাশ হয়েছে তা মুখ বুজে সহ্য করতে হবে।
—detective লাগাতে পারিস। বাংলাদেশে তা পাবি কোথা? এ দেশে কচুর শেকড় আর ঘেঁটুফুল ছাড়া কিছু পাওয়া যায় না। করবি কি
কিশোর চলে গেল
কল্যাণী কাঁদতে লাগল।
ডায়েরীর এক একটা পাতা ছিঁড়তে ছিঁড়তে সে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে বলতে লাগল; এত বড় অন্যায়ের কেউ কোনও প্রতিকার করতে পারবে না, এ কেন হবে?
জীবন বিধাতা বললেন; এ ডায়েরীটা তুমি ছিঁড়ো না কল্যাণী, এতে আমার ব্যথা লাগে!
কিন্তু তবুও পাতার পর পাতা ছিঁড়ে ছড়িয়ে ফেলতে লাগল মেয়েটি।