ওঁ – মার্টিন গার্ডনার

ওঁ – মার্টিন গার্ডনার

আকাশগঙ্গার এক প্রান্তে খুব সন্তর্পণে উঁকি মারলেন ওঁ। ঊর্ধ্বনেত্রের দৃষ্টিকে কেন্দ্রীভূত করলেন দূরের আণবিক মেঘরাশির ওপরে। পৃথিবীর উপরিভাগ থেকে ক্রমেই উঠে আসছে ছত্রাক মেঘপুঞ্জ… সমগ্র ধরিত্রীকে আবৃত করে। ঊর্ধ্বনেত্র বেয়ে ফোঁটায় ফোঁটায় অশ্রু ঝরে পড়ল আকাশগঙ্গার নিচে।

লেগনাস আর মানব এই দুটিরই স্রষ্টা ওঁ। তবে লেগনাসের তুলনায় মানব সামান্য নিকৃষ্ট। মানবজাতির স্ত্রী পুরুষদের ওঁ নিজের অনুকরণে সৃষ্টি করেছিলেন। সৃষ্টিই করেছিলেন, কিন্তু মানসিক উৎকর্ষসাধন করা আর হয়ে ওঠেনি। এর ফলশ্রুতি-স্বরূপ মানবজাতি বিশ্বাসের তুলনায় অধিকমাত্রায় যুক্তিআশ্রয়ী হয়ে ওঠে… পরস্পরের প্রতি যুক্তিআশ্রয়ী বিভেদ গড়ে ওঠে। মানবসভ্যতার ইতিহাস কেবলই এই সীমাহীন বৈষম্য আর বিভেদের ইতিহাস।

ওঁ-এর কিছুই অজ্ঞাত নয় কোনও একদিন আণবিক মেঘ অপসারিত হবে, দুর্ধর্ষ জীবাণুর আক্রমণও একসময়ে স্তিমিত হয়ে আসবে… পুনরায় ধরাপৃষ্ঠে মানবজাতির অভ্যুদয় হবে। বিধ্বংসী যুদ্ধের অবসাদের শেষে আবার ওরা ঘৃণা আর ভালোবাসার খেলায় উন্মত্ত হয়ে উঠবে… গড়ে উঠবে নতুন সব শহর… নতুন স্বপ্নের জোয়ার আসবে… ভালোবাসা আর ঘৃণার দ্বৈত সংঘাতে হবে নয়া বিশ্বযুদ্ধে নব রূপায়ন। সৃষ্টি-ধ্বংসজন্ম মৃত্যুর দ্বৈত লীলা চলবে মহাকালের অন্তিম মুহূর্ত পর্যন্ত।

মানবের নৈতিক অসম্পূর্ণতার এই সৃষ্টিগত ত্রুটি ওঁকে বিচলিত করে তোলে। অজান্তে একটি দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসে। বাঁ পায়ের বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠের অগ্রভাগ দিয়ে পৃথিবীর পৃষ্ঠদেশ স্পর্শ করেন ওঁ।

তৎক্ষণাৎ ধরিত্রীর বুকে মহাপ্রলয়ের দুন্দুভি বেজে ওঠে। ঘন ঘন বজ্র বিদ্যুতের ঘোর নিনাদে মুহূর্মুহূ কেঁপে ওঠে পৃথিবী। দুরন্ত বেগে বাতাস বয়ে চলে… পর্বতমালা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। সাগরের জলরাশি তটরেখা ছাপিয়ে ওপরে উঠে আসে। প্রবল জলোচ্ছ্বাসে মহাদেশ সব তলিয়ে যায়। আবার একদিন জলপূর্ণ পৃথিবীর বুকে স্বস্তি নেমে আসে ধীরে ধীরে… সাগরের জলরাশি সাগর-গহ্বরে ফিরে যায়। প্রাণহীন ধরিত্রী সূর্যবন্দনায় মগ্ন হয়ে পড়ে।

বিশ্বনিখিল জুড়ে অজস্র গ্রহ অজস্র সূর্যের চারপাশে নীরবে আবর্তনরত। প্রতি গ্রহেই ওঁ প্রাণ সৃষ্টির প্রয়াস চালিয়েছেন… গ্রহে গ্রহে জীবনের বিকাশ ঘটুক এইটুকুই শুধু ওঁ-এর কামনা। কিন্তু প্রতি গ্রহেই সীমাহীন তিক্ততা আর অন্তর্কলহ ক্লান্ত করে তুলেছে ওঁকে। একের পর এক ওঁ-এর পদস্পর্শে গ্রহগুলোর মৃত্যু হয়েছে… জ্বলন্ত সূর্যরশ্মির নির্মম আলোকে চির-উদ্ভাসিত হয়ে উঠেছে নিষ্প্রাণ গ্রহগুলি।

রত্নখচিত ঘড়ির মতো জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ড। অগুন্তি সূর্যশোভিত বিশ্বনিখিল নীরবে আপন কাজে রত। নিষ্প্রাণ গ্রহগুলোর দিকে দৃষ্টি পড়ামাত্র ওঁ অব্যক্ত যন্ত্রণায় ছটফট করে ওঠেন। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দীর্ঘনিশ্বাস আছড়ে পড়ে মহাবিশ্বের বুকে জ্বলন্ত নক্ষত্র সূর্যের ওপরে। মুহূর্তে নিভে যায় জ্বলন্ত অগ্নিপিণ্ডগুলো… মৃত সূর্যগুলো নিখিল বিশ্বচরাচরে মসীময় দানবের মতো আবর্তনশীল। অতলান্ত অন্ধকারে আচ্ছন্ন বিশ্বচরাচর।

ওঁ-এর দরবারে অনেকেই হেসে উঠল। দরবারও অন্ধকারে তলিয়ে গেল। অবশ্য বেশ কিছুজনের মুখের হাসি এটা নয়। একে একে সূর্যের মৃত্যু দুঃখজনক হলেও ওঁ নিরুপায়। সূর্যমৃত্যুর অবিচারে বিশ্বব্যাপী বাদানুবাদ শুরু হল… লেগনাসরাও বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়ল। যথাসময়ে বাদানুবাদের উত্তেজক ধ্বনিসমূহ বিশ্বচরাচরে ব্যাপ্ত হয়ে ওঁ-এর নিম্ন কর্ণকুহরে প্রবেশ করল।

ওঁ ঘুরে দাঁড়ালেন। অগ্নিকঠোর নেত্রে লেগনাসের পানে দৃষ্টিপাত করলেন। বজ্র-গম্ভীর তাঁর মুখমণ্ডল দর্শন করে সীমাহীন আতঙ্কে সকলে কুঁকড়ে উঠল… ডানাগুলো সব শিথিল হয়ে দেহের দু’পাশে ঝুলে পড়ল। খুব সন্তর্পণে ওদের ওপরে ফুঙ্কার দিলেন। নিঃসঙ্গ ওঁ শূন্য করিডোরে পায়চারি শুরু করলেন। মুহূর্মুহূ স্বীয় কর্মের ব্যর্থতায় সমস্ত মুখমণ্ডল ক্রোধে রক্তবর্ণ ধারণ করল… এবং অসীম শূন্যতায় বিষাদমলিন হয়ে উঠল ওঁ-এর হৃদকমল। অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে দ্বৈত সত্তার জাগরণ হল। সে বলে উঠল, তুমি মূর্খের মতো কাজ করেছ… অনন্তকাল সীমাহীন… তুমি তোমার নিজ শক্তির অপব্যবহার করছ।

স্বীয় আত্মার দ্বিচারিতায় ওঁ ভয়ঙ্কর ক্ষুব্ধ হয়ে উঠলেন। নিজের অভ্যন্তরেই অসীম চাঞ্চল্য আর অপরিপূর্ণতায় অশান্ত হয়ে উঠল ওঁ-এর অন্তর।… নিজের সম্বন্ধে সন্দিহান হয়ে উঠলেন। সীমাহীন অন্ধকার কালসমুদ্রের উদ্দেশে মধ্যবর্তী হাত প্রসারিত করে দিলেন। মসীময় বিশ্বচরাচরের মাঝে ওঁ চিহ্ন এঁকে দিলেন।

অসীম দূরত্বে সেই হাতের পরিধি বিস্তৃত হয়ে চলল… অনন্ত কালসমুদ্র শান্ত হয়ে। এল… কালসমুদ্রের মাঝে জেগে রইল ওঁ চিহ্ন।

এবার নিখিল বিশ্বচরাচরে পরিপূর্ণ শান্তি নেমে এল… শূন্যতা বুকে নিয়ে বাউল বাতাস নিঃশব্দে বইতে শুরু করল… নিবাত নিষ্কম্প প্রদীপশিখার মতো আপন মহিমায় ভাস্বর হয়ে রইল ওঁ। ভাবী সৃষ্টিলীলার স্বপ্নে বিভোর।