আশ্রয় – ৯

নয়

মাথা নিচু করে ছুটে এসে হাইড-আউটে ঢুকল জো; জানালা দিয়ে উঁকি দিল বাইরে। এরিখ পিছিয়ে দরজার কাছ থেকে ঘরের অপেক্ষাকৃত অন্ধকার অংশে সরে গেল। তিনজন লোকসহ ডগ লেইকার আর ওক টিকাউকে হাইড-আউটের কাছাকাছি চলে আসতে দেখা গেল। নেতৃত্ব দিচ্ছে লেইকার।

এক হাত তুলে নিজের লোকদের থামাল ডগ। চট করে একটা পাথুরে স্তূপের আড়ালে চলে গেল। একটু পরে ধীরে ধীরে মাথা তুলে উঁকি দিল।

‘ওয়েন!’ হেঁড়ে গলায় ডাকল ডগ। ‘বেরিয়ে আসো তোমার গর্ত থেকে। আটকে গেছ তুমি। কোন আশা নেই…’

‘তুমি এখানে আছ, ওরা জানে!’ মন্তব্য করল জো।

‘টিকাউ আগে থেকেই জানত।’ থুতু ফেলল এরিখ। ‘হপ্তাখানেক আগে ওকে এদিকে ঘুর ঘুর করতে দেখেছিলাম।’

‘আমরা তোমাকে বের করে আনবই।’ পাথরের আড়াল থেকে রাইফেল উঁচিয়ে নাড়ল ডগ। ‘আমরা পাঁচজন আর তুমি একা। কথা কানে ঢুকেছে তোমার, ওয়েন? বেরিয়ে এসো এক্ষুণি।’

‘বীর পুরুষ!’ টিপ্পনী কাটল জো ডগের হম্বিতম্বি দেখে।

‘তুমি আছ ওরা জানে না।’

‘কি করব আমরা?’ জিজ্ঞেস করল জো।

‘বেরোচ্ছি না। কি হয় দেখা যাক আগে।’

ডগের লোকেরা ঝোপের ভেতরে এদিক-সেদিক ছড়িয়ে পড়েছে। ডগ লেইকার বোল্ডারের আড়াল থেকে উঁকি দিল আবার। ‘তুমি বেরিয়ে আসবে, নাকি আমাদের আসতে হবে গুঁতিয়ে বের করার জন্যে?’ জানতে চাইল সে।

স্পেন্সারের সাইটে চোখ রাখল এরিখ। গুলি ছুঁড়ল। লেইকারের মাথার এক ফুটের ভেতর পাথরের কুচি ছড়াল বুলেট। গাল বকল ও, ডাইভ দিয়ে সরে গেল ওখান থেকে।

‘পরের বার,’ হাসল এরিখ সশব্দে, চিৎকার করে বলল, ‘তোমার কল্লায় লাগাব গুলি।

অবিরাম গুলি বৃষ্টি শুরু হলো ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে। এরিখের প্রাচীন বাসভবনটির দেয়ালে লেগে ভোঁতা শব্দ তুলল প্রতিটি বুলেট। আচমকা একটা বুলেট শিস কেটে ঢুকে পড়ল দরজা দিয়ে। পেছনের দেয়ালে লেগে ছিটকে গেল ওটা, নাচতে লাগল ঘরময়।

মেঝেয় শুয়ে পড়ল এরিখ। ওদেরকে ভাগাতে হবে, জো। নইলে বেরোতে পারবে না তুমি,’ হাসল ও। ‘তোমাকে আমার সঙ্গে দেখলে খেল খতম হয়ে যাবে তোমার।’

নিজের শার্পসটার গায়ে হাত বুলাল জো রীভস। ‘দু’একটা গুলি ছোঁড়ার সুযোগ এটাকেও দেয়া যাক। কি বলো?’

‘না। গুলি করতে যেয়ো না। তোমার ওই কামানের শব্দেই ওরা বুঝে যাবে যে, আমি একা নই।’

গুলির তোড় কিছুটা কমে এসেছে এখন। ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে মাঝে-মধ্যে দু’একটা এসে বিধছে বাইরের দেয়ালে। হঠাৎ আবার একটা গুলি এসে ঢুকল ভেতরে। দেয়ালের প্রতিবন্ধকতায় ছিটকে গিয়ে আঘাত হানল ওটা জো’র কাঁধে। গাল বকল জো নিচু স্বরে।

‘উহ্! কাঁধটা গেছে আমার!’

নিচের ঠোঁট কামড়ে ধরল এরিখ, চিন্তিত।

‘ওভাবে গুলি ছিটকালে আমাদের হাল খারাপ হয়ে যাবে।’

‘কি করা যায় তাহলে?’ কাঁধে হাত বুলোতে বুলোতে বলল জো। ‘বেরোতে তো পারব না মনে হয়।’

দক্ষিণ দিকের দেয়ালে নজর বুলাল এরিখ। ওখানে একটা দরজার চিহ্ন। এক সময় দরজাই ছিল ওটা। পরে যে কোন কারণেই হোক, অধিবাসীরা চুন, বালি আর পাথর দিয়ে বন্ধ করে দিয়েছে। বেশি পুরু নয় নতুন দেয়ালটা, মূল দেয়ালের অর্ধেকের মত হবে। জো রীভসকে নির্দেশ দিল এরিখ, ‘ওটার পলেস্তারা খসাতে শুরু করো। ওপাশের রুমে চলে যাব। তারপর ওটার দরজা দিয়ে বেরিয়ে যাব বনের ভেতর।

‘তাতে কি হবে? ক্যানিয়ন থেকে তো আর বেরোতে পারছি না। জো দ্বিমত পোষণ করল

‘সেটা পরে ভাবব। আগে তো ঘর থেকে বেরোই।’

কোমর থেকে ছুরি বের করল জো রীভস। কাজ শুরু করল। এরিখ মাঝে-মধ্যে গুলি ছুঁড়তে লাগল জঙ্গলের দিকে। কেউ একজন আর্তনাদ করে উঠল। গুলি লেগেছে, বুঝতে পারল এরিখ। কুকুরের মত কেঁউ-কেউ করছে আহত অবরোধকারী। এরিখ হাসল আপন মনে। পোড়া বারুদের গন্ধে ভারি বাতাসে হালকা ছেঁড়াখোঁড়া ধোঁয়া উড়ছে।

জো’র কাজের অগ্রগতি হয়েছে কিছুটা। শক্ত ছুরির আগায় চাড় দিয়ে একটা পাথর আলগা করে ফেলেছে ও। দু’হাতে ধরে ওটা নামিয়ে রেখে আরেকটায় ছুরি চালাল। দরজা দিয়ে মাঝে-মধ্যে গুলি এসে ঢুকছে ভেতরে, দেয়ালে লেগে ছিটকে যাচ্ছে এদিক-সেদিক। পরের পাথরটাও নামাল জো। ফিস ফিস করে এরিখকে জানাল, ‘পালিয়ে যাবার মত পথ হয়েছে।’

‘উঁকি দিয়ে দেখো আগে ওপাশে কি আছে?’

জো উঁকি দিল। ওপাশে অন্ধকার। কিছুটা চোখ সয়ে আসতেই মৃদু আর্তনাদ করে উঠল ডিটেকটিভ। বাইরে দুটো গুলি পাঠিয়ে দিল এরিখ, জো’র পাশে এসে উঁকি দিল ভেতরে। ম্যাচ জ্বালাল জো। ‘দেখো!’

চারটে কঙ্কাল পড়ে আছে মেঝের ওপর। চারপাশে ছড়ানো-ছিটানো কয়েকটা পাত্র, মাদুর, জন্তুর হাড়গোড় আর ভুট্টা-জনারের রাশি।

‘মনে হয়,’ এরিখ মন্তব্য করল, ‘প্রাচীন অধিবাসীরা ক্যানিয়ন ছেড়ে চলে যাবার আগে এখানে কবর দিয়েছিল ওদের। কঙ্কালগুলোর দিকে ইশারা করল ও।

নতুন দরজা দিয়ে শরীর গলিয়ে ওপাশের রুমে ঢুকল এরিখ। ম্যাচ জ্বালিয়ে রুমটার পুবপাশের দেয়াল চেক করল। একটা দরজার আকৃতি দেখা গেল দেয়ালে।

‘এখানে দরজা,’ নিচুস্বরে জো’কে জানাল সে। বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই। পুরোটা জঙ্গলে ঢেকে আছে।’

সামনের রুমে গেল আবার এরিখ। একজন অবরোধকারী সম্ভবত, কিছুটা দুঃসাহসী হয়ে উঠেছিল, সামনের খোলা জায়গাটা পেরোচ্ছিল সে, এরিখ গুলি চালাল। ডান কানের লতিটা হারিয়ে চেঁচাতে চেঁচাতে খিঁচে দৌড় লাগাল দুঃসাহসী, পরমুহূর্তেই অদৃশ্য হয়ে গেল ঝোপের ভেতর।

জো দ্বিতীয় কক্ষের দরজা খুলল। ঠিকই বলেছ তুমি,’ বলল ও। ‘পুরোটাই জঙ্গল।’

এরিখ ওত পেতে বসে রইল প্রথম ঘরে। একটা ঘোড়া উঠে এল নিচের খাত থেকে, হাইড-আউটের সামনের খোলা জায়গায় রাশ টেনে দাঁড় করাল ওটাকে ওটার আরোহী। মুচকি হাসল এরিখ, গুলি চালাল। পাছায় গুলি খেয়ে লাফিয়ে উঠল ঘোড়াটা, মুখ ওপরে তুলে হ্যাঁচকা টান দিল নিচের দিকে। রাশ ছুটে গেল আতঙ্কিত আরোহীর হাত থেকে। রক্তাক্ত পাছা নিয়ে খিঁচে দৌড় লাগাল আহত ঘোড়া। ডগের খিস্তি শোনা গেল পেছন থেকে, পরক্ষণেই তার ঘোড়াটাও এসে পড়ল খোলা জায়গায়। প্রথমটার অবস্থা দেখে ভড়কে-যাওয়া দ্বিতীয় ঘোড়টাও ওটার অনুবর্তী হলো। হাসল এরিখ রাইফেলে গুলি ভরতে ভরতে।

দ্বিতীয় কক্ষটাতে ঢুকল ও। জো ওটার দরজা খুলে বাইরে টেরাসে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। ‘এখান দিয়ে নামতে হলে পাখা লাগবে,’ এরিখের সাড়া পেয়ে মন্তব্য করল ও।

‘অনেক নিচে, না?’

মাথা দোলাল ডিটেকটিভ। ঝুঁকে জঙ্গলের ফাঁকে নিচের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘রশি বেয়ে নামা যাবে। আছে?’

‘দাঁড়াও, আছে।’

প্রথম কক্ষে গিয়ে ক্র্যামারের দোকান থেকে আনা রশির বান্ডিলটা নিয়ে এল এরিখ। জো হাত বাড়িয়ে রশিটা নিয়ে ওটার একমাথা বাঁধল একটা পাথরের সঙ্গে, তারপর সন্তর্পণে রশি বেয়ে নিচে নেমে গেল। এরিখ টেনে তুলল রশিটা। নিজের স্পেন্সার আর জো’র শার্পসটাকে ওটার মাথায় বেঁধে ঝুলিয়ে দিল। নিজেও নেমে গেল ধীরে-সুস্থে রশি বেয়ে। হাতের ঝাঁকুনিতে ওপর থেকে খুলে নেমে এল রশিটা।

নিজের শার্পসটা হাতে নিল জো। বনের ভেতর হামাগুড়ি দিয়ে কিছুদূর এগিয়ে গেল। একটা মেস্কিট ঝোপের পাশে থামল ও। ওপর থেকে ডগের লোকদের চিৎকার শোনা যাচ্ছে। নেমে আসছে ওরা খাতে।

‘পালিয়েছে ও!’ একজনের চড়া গলা শোনা গেল।

‘ঘরটায় খুঁজেছ ভাল করে?’ ডগের গলা।

‘দেখেছি। গাট্টি-বোঁচকা ছাড়া আর কিছু নেই।’

খাতে নেমে এসেছে ওরা সবাই। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে ওদের দেখতে পাচ্ছে এরিখ আর জো।

‘ওদের ভাগাতে হবে, এরিখ।’ রাইফেল বাগিয়ে ধরল জো।

‘আমি যে একা নই বুঝে যাবে ওরা।’

‘তাতে ওদের উৎসাহ বরং কমবে,’ জবাব দিল জো। ‘ওদেরকে খাত থেকে উঠতে দেয়া যাবে না। ঢালে উঠতে পারলে ঘিরে ফেলবে আমাদের,’ যুক্তি দেখাল ও।

‘ঠিক আছে,’ এরিখ সায় দিল। উঁকি দিল ও জঙ্গলের ফাঁকে। ডগের দল ওদের পাশাপাশি চলে এসেছে প্রায়। লোকগুলো ভড়কে গেছে, বুঝতে পারল ও। একজনের বিরুদ্ধে পাঁচজন হয়ে সহজে কাজ সারতে এসেছিল ওরা। বাধা পাওয়ার আশাই করেনি।

‘তোমার কামান দাগাতে পারো,’ অনুমতি দিল এরিখ। ‘তবে আমি গুলি করার আগে নয়, পরে।’

জো’র কাছ থেকে কিছুটা দূরে সরে গেল ও। শ’খানেক গজ দূরে খাতের মধ্যে ডগের দল। এদিক-ওদিক তাকাচ্ছে ওরা; ঢাল বেয়ে উঠে জঙ্গলে খোঁজার মতলব ভাঁজছে সম্ভবত।

পর পর চারটে গুলি পাঠাল এরিখ অনির্দিষ্টভাবে। হুড়োহুড়ি পড়ে গেল শত্রুদলের মধ্যে। একজন জঙ্গলের দিকে তাক করে রাইফেল ওঠাল, এমন সময় গুলি ছুঁড়ল জো। টলে উঠল লোকটা, হাত থেকে রাইফেল ফেলে দিল, নিজেও লুটিয়ে পড়ল ওটার পাশে।

এরিখ ডগকে টার্গেট করে ওর পায়ের কাছে গুলি পাঠাল। মাটিতে ঝাঁপ দিল লেইকার, কচ্ছপের মত বুকে হেঁটে অদৃশ্য হয়ে গেল।

টিকাউর হেনরীটা ছিটকে পড়ল ওর হাত থেকে, যেন ভূতে থাবা মেরেছে ওটায়। খিস্তি করে জায়গা থেকে সরে গেল দোআঁশলা।

‘ও একা নয়!’ চিৎকার করে নিজের লোকদের জানাল ডগ লেইকার। এরিখ আর জো অনবরত গুলি ছুঁড়তে লাগল। দ্রুত জায়গা বদল করছে ওরা।

ক্যানিয়নের দেয়ালে দেয়ালে প্রতিধ্বনিত হতে লাগল ওদের রাইফেলের শব্দ।

মনোবল হারাল চার অবরোধকারী। গুলি ছুঁড়তে ছুঁড়তে পিছু হটল ওরা; অবশেষে চম্পট দিল ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের দিকে।

এরিখের পাশে এসে বসল জো, মুখ থেকে ঘাম মুছল। যুদ্ধ বটে!’ ‘তুমিও যোদ্ধা বটে,’ খালি স্পেন্সারে গুলি ভরতে ভরতে এরিখ মন্তব্য করল। ‘কোথাকার? আর্মি অভ নর্দার্ন ভার্জিনিয়া?’

‘না।’

‘টেনেসি?’

‘উঁহুঁ। জো রীভস তার শার্পসের বাঁটে আদরের চাপড় লাগাল। ‘পটোম্যাক। বার্জেস’ ফার্স্ট রেজিমেন্ট অভ ইউ এস শার্পশূটার।’

এরিখ হাসল। তলে তলে পাক্কা চোর দেখছি তুমি!’

‘তোমার মত বেজন্মা ডাকাত নই কিন্তু, ‘ হাসল জো রীভস নিজেও।

‘সিক্সথ টেক্সাসের বিপক্ষে ছিলে তুমি!’ এরিখ অভিযোগ করল।

‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল রীভস। সিক্সথ টেক্সাসই আমার পক্ষে ছিল না।’

‘যা বলেছ,’ একমত হলো এরিখ। ক্যানিয়নের দিকে তাকাল। তুমি থাকো এখানে। বিশ্বাস নেই, নিচে কোথাও লুকিয়েও থাকতে পারে ওরা। আমি দেখে আসি আগে। তোমার ঝুঁকি নেবার দরকার নেই।’

‘আমি তাহলে ঘোড়াগুলোর অবস্থা দেখে আসি।

জঙ্গল সরিয়ে নিচে নামল এরিখ। খাতের মধ্যে হাত-পা ছড়িয়ে চিৎ হয়ে পড়ে আছে জো রীভসের গুলিতে মৃত লোকটা। বুকের কাছে প্রকাণ্ড গর্ত ওর। রক্তে ভিজে গেছে শার্ট। আরেকটু এগিয়ে চারদিকে তাকাল এরিখ। ডগ লেইকার ও তার দলের চিহ্ন নেই কোথাও।

ফিরে এল ও। ততক্ষণে জো রীভসও হাজির হয়েছে ঘোড়া নিয়ে এরিখ পরামর্শ দিল, ‘ওদের সাথে দেখা হলে মুখে কুলুপ এঁটে রাখবে, জো।’

ঘোড়ায় চড়ল জো। একটু ইতস্তত করল, বলে ফেলল অবশেষে, তুমি ভাল লোক, ওয়েন।

‘তোমার চেয়ে বেশি নই, রীভস। সোজা চলে যাও, আমি কাভারে রাখব তোমাকে।’

ক্যানিয়ন থেকে বেরিয়ে গেল ডিটেকটিভ। হাইড-আউটে গিয়ে এরিখ মালপত্র গোছাল। জিস্টারের পিঠে তুলে দিয়ে সেও যাত্রা করল ক্যানিয়নের মুখে। এখানে থাকার মেয়াদ ফুরিয়েছে ওর। ধীরে ধীরে এগোল সে জেফ ক্লীন আর প্রাচীন কঙ্কালগুলোর নীরব সঙ্গ ছেড়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *