আশ্রয় – ১৪

চোদ্দ

বার্ডস ক্যানিয়ন থেকে হালকা ফুরফুরে মন নিয়ে হাইড-আউট ক্যানিয়নে এসে পৌঁছল এরিখ।

অন্ধকার। চাঁদ নেই আকাশে। মৃদু ঠাণ্ডা হাওয়া বইছে থেকে থেকে। অন্ধকারে ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে পথ করে নিয়ে ক্যাম্পের দিকে এগোল জিস্টার। এরিখ নাক কুঁচকাল। বাতাসে ধোঁয়ার গন্ধ। গাস আর ওয়েন্ডি জমিয়ে গল্প করছে সম্ভবত আগুনের পাশে বসে। হাসল ও। ওয়েন্ডি তাহলে খুব একটা ভেঙে পড়েনি। পরিবেশের সাথে মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছে নিজেকে।

আরও খানিকটা এগিয়ে গেল জিস্টার। এরিখ এখন ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে আগুনের শিখা দেখতে পাচ্ছে মাঝে-মধ্যে। ওদের কথাবার্তা শোনার আশায় কানখাড়া করল ও।

কাছে এসে আচমকা ঘোড়া থামিয়ে নামল ও ওটার পিঠ থেকে। অস্বস্তি বোধ করছে। গাস কিংবা ওয়েন্ডির গলার আওয়াজ শোনা যায়নি এখনও। বড় বেশি নীরব মনে হচ্ছে ক্যাম্পটাকে। এটা অস্বাভাবিক। গাস আর ওয়েন্ডি নিশ্চয় মুখে কুলুপ এঁটে বসে থাকবে না। ও ক্যাম্পের যতটা কাছে এসেছে, সেখান থেকে অবশ্যই ওদের গলার আওয়াজ শুনতে পাবার কথা।

জিস্টারকে দাঁড় করিয়ে রেখে ঝোপের পাশে একটা পাথরের আড়ালে চলে গেল ও। বসল উবু হয়ে। ওখান থেকে ক্যাম্পের সামনের দিকটা দেখা যাচ্ছে। আগুনের পাশে কেউ বসে নেই। ক্যাম্পের ভেতরে নজর দিল ও। ভেতরে আবছা অন্ধকার। দৃষ্টিকে তীক্ষ্ণ করল এরিখ। কেউ আছে বলে মনে হচ্ছে না। আচমকা জোর বাতাস পেয়ে অগ্নিশিখা উজ্জ্বল হলো কিছুটা। ক্যাম্পের ভেতরটা পরিষ্কার দেখা গেল এবার। কেউ নেই। খালি।

এরিখ উঠে দাঁড়াল। নাম ধরে ডাকল গাস আর ওয়েন্ডিকে। জবাব পেল না।

কাছে কোথাও একটা শব্দ হলো। পাথর গড়িয়ে পড়ার শব্দ। সচকিত হলো এরিখ। একটানে স্টারটা বের করে নিল খাপ থেকে, ঝাঁপিয়ে পড়ল একদিকে।

অগ্নিশিখার সাথে গুলির আওয়াজ হলো। এরিখের মাথার এক ফুট ওপর দিয়ে ছুটে গিয়ে বুলেট বিদ্ধ হলো একটা গাছে। গড়িয়ে সরে গেল এরিখ জায়গা থেকে। পরপর দুটো গুলি পাঠাল অগ্নিশিখা যেদিকে জ্বলে উঠেছিল সেদিক লক্ষ্য করে। সাথে সাথেই একটা লোকের খিস্তি শোনা গেল। গলার স্বরে বোঝা গেল একাধারে বিস্মিত ও অসন্তুষ্ট হয়েছে স্বরের মালিক। ওকে সান্ত্বনা দেবার জন্যেই সম্ভবত ক্যাম্পের পেছন থেকে আরেকটা পিস্তল গর্জে উঠল মুখ দিয়ে আগুনের হলকা ছড়িয়ে। এরিখ গড়ান দিল, তারপর উবু হয়ে পরপর তিনটে গুলি পাঠাল ক্যাম্পের পেছনে। তিন নম্বর বুলেটটা ফল দিল; ক্যাম্পের পেছনে আত্মগোপনকারী আততায়ী কর্কশ স্বরে আর্তনাদ করে উঠল। ঝোপঝাড় মাড়িয়ে দুদ্দাড় করে তার সরে যাবার শব্দ শোনা গেল। এরিখ ছয় নম্বর গুলিটাও পাঠিয়ে দিল লোকটার পেছনে।

ক্রল করল ও। জায়গা বদল করে পাহাড়ের গোড়ার দিকে সরে গিয়ে একটা পাথরের পাশে থামল। দ্রুতহাতে স্টারটা রিলোড করে নিয়ে গলা বাড়িয়ে সামনে তাকাল।

কিছুক্ষণ কেটে গেল চুপচাপ। অধৈর্য হলো না এরিখ। শত্রু এখনও চলে যায়নি, নিশ্চিত ও।

পাথরে বুটের ঘষার শব্দ শুনে ক্যানিয়নের মাঝখানে দৃষ্টিকে নিবদ্ধ করল ও। একটা ঘোড়া ডেকে উঠল চি-হি শব্দে। ব্যস্ত হলো না এরিখ। একটু পরেই একটা অবয়ব স্পষ্ট হয়ে উঠল ওর চোখে। কেউ একজন ক্যাম্পের দিকে যাচ্ছে। আগুনের কাছাকাছি হতেই এরিখ চিনতে পারল লোকটাকে। রস ম্যাস্টন। গুলি করল ও। ম্যাস্টন চমকে উঠে খিস্তি করল। পলকে ঘোড়া ফিরিয়ে নিল সে যেদিক থেকে এসেছে সেদিকে। জোরে স্পার দাবাল। ক্যানিয়নের প্রবেশ-মুখের দিকে ছুট লাগাল ভীত-সন্ত্রস্ত পিন্টোটা। এরিখ উঠে দাঁড়াল। গুলি করল ধাবমান লোকটাকে। লক্ষ্যভ্রষ্ট হলো না গুলি। ম্যাস্টন ঘোড়ার পিঠে নড়ে উঠল, দু’বাহু এক সঙ্গে ওপর দিকে তুলল, তারপর গড়িয়ে পড়ল একদিকে। ওর পিন্টো থামল না। ঝোপঝাড় ভেঙে পালাল গুলিবিদ্ধ মনিবকে ফেলে রেখে। পরক্ষণেই নীরব হয়ে গেল ক্যানিয়ন।

কমপক্ষে দু’জনকে ঘায়েল করা গেছে, অনুমান করল এরিখ। অপেক্ষা করল সে আরও কিছুক্ষণ, এরপর উঠে ক্যাম্পের কাছে চলে এল। একটা ঝোপের পাশে এক লোক চিৎ হয়ে পড়ে আছে। এরিখ ম্যাচ জ্বালল। মুখ দেখল লোকটার। গুজম্যান। ক্রস অ্যারোর কাউহ্যান্ড।

হঠাৎ কানখাড়া করল ও। ওর নাম ধরে ডাকছে কেউ একজন। পাঁই করে ঘুরল সে একপাক, লুকিয়ে পড়ল ঝোপের ভেতর। আবার শুনতে পেল ও ডাকটা। ‘এরিখ।’

বেরিয়ে এল ও ঝোপ থেকে। গাস ল্যামেলের গলা ওটা। গলার স্বর লক্ষ করে যেতেই একটা ঝোপের পাশে পড়ে থাকতে দেখতে পেল ও বুড়োকে। উবু হয়ে পড়ে আছে। দু’হাত পিছমোড়া করে বাঁধা। এরিখ কোমর থেকে ছুরি বের করে ওকে বন্ধনমুক্ত করল। উঠে ফুঁপিয়ে শ্বাস টানল বুড়ো গাস।

এরিখ ম্যাচ জ্বালল। ম্যাচের আলোয় গাসের ক্ষতবিক্ষত মুখটা দেখে চমকে উঠল ও। অত্যাচার চলেছে গাসের ওপর। অস্ফুটে গাল বকল ও, তারপর জানতে চাইল, ‘ওয়েন্ডি কোথায়?’

‘পালিয়েছে,’ গাস জানাল। ‘চ্যানি আর টম গেছে ওকে ধরার জন্যে।’

বুড়োর হাত ধরে ওকে ক্যাম্পে নিয়ে গেল এরিখ। আগুনের পাশে বসে শুকনো কাঠ গুঁজে দিল, তারপর বাইরে অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে শিস। একটু পরেই ঝোপঝাড়ের মধ্য দিয়ে জিস্টারের ছুটে আসার শব্দ শোন গেল।

‘ঘণ্টাখানেক আগে এসেছিল ওরা,’ মুখ থেকে রক্ত মুছতে মুছতে বলল গাস। ‘এসেই তোমার খোঁজ করে বিয়ারি। আমি ভয় পাচ্ছিলাম তুমি সে সময় এসে পড়ো কি না। বিয়ারি টমকে হুকুম দেয় আমাকে বাঁধার জন্যে। টম আমাকে বেঁধে মারধর করতে থাকে। ওয়েন্ডি না-পালালে বিয়ারি অপেক্ষা করত তোমার জন্যে।’

ওর মাথায় হাত বুলাল এরিখ। ওর ক্ষত-বিক্ষত মুখের দিকে তাকিয়ে গাল বকল তিক্ত স্বরে। ‘বাস্টার্ডস!’

‘বাদ দাও,’ মাথা ঝাঁকিয়ে এরিখের হাত সরিয়ে দিল গাস। ‘ওকে আমি খুন করব এজন্যে।

‘কেমন বোধ করছ এখন?’

থুতু ফেলল গাস। ‘অত সহজে কাবু হই না আমি। ওর মত ভোঁদড়কে শায়েস্তা করার ক্ষমতা আমার এখনও আছে।’ উত্তেজিত হয়ে উঠল ও।

‘শান্ত হও, গাস,’ এরিখ মৃদুস্বরে বলল।

নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ ফিরে পেল গাস, তাকাল এরিখের দিকে। ‘তুমি কজনকে খতম করেছ?’

‘দু’জন।’

‘বুয়েনো!’ হাসল বুড়ো বিকৃত মুখে। ‘তোমাকে খতম করার জন্যেই চ্যানি ওদের রেখে গিয়েছিল।’

এরিখ জিস্টারের কাছে গেল। ‘বিয়ারির খোঁজে যাচ্ছি আমি।’

‘আমাকে ছাড়া?’ উঠে দাঁড়াল গাস। ‘আমিও যাব।’

‘না,’ মাথা নাড়ল এরিখ। ‘তুমি এখানে থাকো। হয়তো কোন সূত্র পেয়েও যেতে পারো। আমার বিশ্বাস, দু’একদিনের মধ্যেই রাসলারদের খোঁজ পেয়ে যাব আমরা।’

নিবৃত্ত হলো গাস। ‘কিন্তু,’ বলল সে, ‘ওয়েন্ডির কী হবে?’

‘বিয়ারির খোঁজ পেলে ওকেও পাওয়া যাবে। তুমি নিশ্চিন্ত থাকতে

পারো, ওয়েন্ডির কোন ক্ষতি করতে পারবে না ও।’

‘টমকে আমার জন্যে রেখে দিয়ো। ও আমার।’

‘ঠিক আছে।’ হাসল এরিখ। ‘যদি কিছু বেঁচে যায়, তুমিই পাবে। কথা দিচ্ছি।’

হঠাৎ কানখাড়া করল গাস। ‘শোনো!’

এরিখও খেয়াল করেছে ততক্ষণে। ‘গরু!’

ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের দিক থেকে পাওয়া যাচ্ছে আওয়াজটা। একসাথে অনেকগুলো গরুর খুরের আওয়াজ।

লাফ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ল এরিখ। ঘোড়া ছোটাল অন্ধকার ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে। গাস তাড়াতাড়ি বালি ছিটাল আগুনে।

.

ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের মুখে আসতেই ধুলোর গন্ধ পেয়ে নাক কুঁচকাল এরিখ। গরুর পাল ক্যানিয়নের দক্ষিণে চলে গেছে প্রায়, তাদের দ্রুত ধাবমান খুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে এখনও। জিস্টারের পেটে স্পার দাবিয়ে ক্যানিয়নে প্রবেশ করল ও। ক্যানিয়নের ভেতরে ধূলির ঝড় বইছে; থামল না এরিখ, সমানে ঘোড়া হাঁকাল দক্ষিণে।

হঠাৎ সামনের অন্ধকার ফুঁড়ে ভূতের মত নিঃশব্দে দু’জন অশ্বারোহীকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। পরক্ষণেই একটা রাইফেল গর্জে উঠল আলোর ঝলকানিসহ। এরিখ জিস্টারের পেটে হাঁটুর গুঁতো লাগাল। এক পাশে সরে গিয়ে একটা ঝোপের ভেতর গা ঢাকা দিল ঘোড়াটা। আরও ক’টা গুলির শব্দ শোনা গেল। একটু পরেই দুই অশ্বারোহী অন্ধকারে মিলিয়ে গেল আবার ভূতের মতই।

গরুর পাল দৌড়াচ্ছে এখনও, খুরের শব্দ শোনা যাচ্ছে ওদের। ইতোমধ্যে ক্যানিয়নের ভেতরের অন্ধকার কিছুটা ফিকে হয়ে উঠতে শুরু করেছে। ক্যানিয়নের দেয়ালের ওপর দিয়ে চাঁদ উঁকি দিচ্ছে। এরিখ বেরিয়ে এল ঝোপ হতে। সামনের দিকে এগোবার নির্দেশ দিল ও জিস্টারকে।

প্রায় আধ মাইল নির্বিঘ্নে এগোল ও, তারপর আবার বাধা দেয়া হলো। আবছা অন্ধকার থেকে পর পর কয়েকটা গুলি ছুটে এল ওর দিকে। ঘোড়ার পিঠ থেকে ঝাঁপ দিয়ে মাটিতে পড়ে আত্মরক্ষা করল ও। ওর আশেপাশে পাথরে গুলি বিদ্ধ হবার শব্দ শোনা গেল।

কিছুক্ষণ চুপচাপ পড়ে থেকে সামনের বাধাদানকারীদের পক্ষ থেকে আর কোন সাড়া না পেয়ে আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়াল এরিখ। ওর নড়াচড়ার আভাস পেয়ে প্রায় সাথে সাথেই ওর কাছে চলে এল জিস্টার। এরিখ মৃদুস্বরে কথা বলল ঘোড়ার সাথে।

প্রায় আধ ঘণ্টা চুপচাপ অপেক্ষা করে আবার সামনে এগোল ও। ক্যানিয়নের অভ্যন্তরে ধূলির কমতি নেই এখনও। চাঁদের ম্লান আলোয় উড়ন্ত ধূলিকে হালকা কুয়াশার মত দেখাচ্ছে। ঠোঁট চাটতেই জিভে ধূলির স্বাদ পেল এরিখ। কটু গন্ধে ওর নাক কুঁচকে গেছে। কিছুদূর যাওয়ার পর জিস্টারের পিঠ থেকে নেমে পড়ল ও। ঘোড়াটাকে এক জায়গায় দাঁড় করিয়ে রেখে পায়ে হেঁটে চলল।

হাঁটতে হাঁটতে রুইন্স ক্যানিয়নের সামনে চলে এল এরিখ। গরুর খুরের শব্দ এখনও মিলিয়ে যায়নি পুরোপুরি। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ওদের পায়ের ক্ষীণ শব্দ শুনল ও। ধীরে ধীরে এক সময় মিলিয়ে গেল শব্দ। পুরোপুরি নীরবতা নেমে এল ক্যানিয়ন জুড়ে।

চাঁদ আরও ওঠার পর রুইন্স ক্যানিয়নে ঢুকল ও। ধূলির স্তর ভাসছে এখনও বাতাসে। এগিয়ে গেল ও ক্যানিয়নের আরও ভেতরে। এক জায়গায় দাঁড়িয়ে চারদিকে নজর বুলাল পর্যবেক্ষণের ভঙ্গিতে। গরুর কোন চিহ্নই দেখা গেল না কোথাও।

টুপিটা পেছনে ঠেলে দিয়ে এক হাতে চোয়াল ঘষতে ঘষতে মাথা নাড়ল এরিখ আপনমনে। গাসের কথাগুলো ভাবছে ও। ওর সন্দেহই যেন সত্য। ভোজবাজির মত মিলিয়ে গেছে গরুগুলো। ভৌতিক ব্যাপারই বটে। ধীরে ধীরে ফিরতি পথ ধরল ও। বিরক্তিবোধ করছে মনে মনে।

ক্যাম্পে ফিরে এসে গাসকে পেল না এরিখ। গাসের ঘোড়াটাও নেই। ক্যাম্পে বসে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিল ও, গাসের জন্যে অপেক্ষা করল। তারপর বেরিয়ে পড়ল আবার। ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের উত্তরাংশে চলে এল। চাঁদের আলোয় চারদিক মোটামুটি পরিষ্কার। এরিখ তিনজন ঘোড়সওয়ারকে দেখল। চট্ করে একটা ঝোপের আড়ালে চলে গেল ও। তিন ঘোড়সওয়ার কাছে এগিয়ে এল। কথা বলছে তারা নিজেদের মধ্যে।

একজনের উত্তেজিত গলা শুনল এরিখ। ‘কোথাও যায়নি। আমি বলছি, ওগুলো এখানেই আছে কোথাও।’

গোল্ড বার্জারের গলা, চিনতে পারল এরিখ। স্পেন্সারটা হাতে নিয়ে ডাকল ওকে, ‘গোল্ড।’

বার্জারের হাতে পিস্তল চলে এল সাথে সাথে। ‘কে?’ গলা উঁচিয়ে হাঁক দিল সে।

‘ওয়েন,’ এরিখ সাড়া দিল। বেরিয়ে এল ঝোপের আড়াল থেকে।

পিস্তল খাপে ঢোকাল বার্জার। ‘ধ্যাৎ! ভয় পাইয়ে দিয়েছিলে তুমি আমাদের। এরা…’ সঙ্গীদের দিকে তাকাল ও, ‘সাইফ ও’হারা আর গ্রেস গুন্থার।’

নড করল এরিখ ওদের উদ্দেশে। দক্ষিণ দিকে আঙুল উঁচিয়ে বলল, ‘ওগুলো রুইন্স ক্যানিয়নে ঢুকেছে, তারপর নিঃশব্দে মিলিয়ে গেছে ভূতের মত। আমিও গিয়েছিলাম পিছু পিছু, ওদের রাইফেলের মুখে টিকতে পারিনি। ফিরে আসতে বাধ্য হয়েছি।’

‘উঁহু!’ সন্দেহের ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল গুন্থার। রুইন্সে নয়। ওটা একটা বক্স ক্যানিয়ন। ওদিক দিয়ে বেরোবার পথ নেই।’

‘সেটা আমিও জানি,’ এরিখ খেঁকিয়ে উঠল প্রায়। ‘কিন্তু ওগুলো রুইন্সেই ঢুকেছে এবং ওখান থেকেই হাওয়া হয়ে গেছে।’

থুতু ফেলল বার্জার। ‘সেই পুরানো প্যাচাল!’ তিক্তস্বরে বলল ও। কি করব আমরা এখন?’

‘তোমাদের লোকজন কোথায়?’ এরিখ জানতে চাইল।

‘দক্ষিণে ক্যাম্প করেছে ওরা, দু’দিন আগে থেকে,’ জানাল বার্জার।

‘সাবাস!’ হাসল এরিখ। ‘আমি না-আসা পর্যন্ত এদিকে থাকো। আর যদি রুইন্সের দিকে যাও, চোখ-কান খোলা রেখো।’

‘তুমি যাবে না আমাদের সাথে?’

‘যাব। তার আগে এদিকে একটা কাজ আছে আমার। জরুরী। এটা সেরে নিই আগে। ভাল কথা, গাসকে দেখেছ তোমরা?’

‘ক্রীকের কাছে দেখা হয়েছিল। রকস্প্রিং যাচ্ছে বলল,’ জবাব দিল বার্জার।

ঘোড়ায় চড়ল এরিখ। ‘দেখা হবে আবার,’ বলল সে, তারপর স্পার দাবাল জিস্টারের পেটে।

প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে রকস্প্রিং রোডে গাসের দেখা পেল এরিখ। ওকে দেখে হাসল বুড়ো একগাল। শহর থেকে আসছি। ভাল খবর। বিয়ারি নাগাল পায়নি ওয়েন্ডির। তার আগেই ক্র্যামারের কাছে চলে গেছে ও।’

‘বিয়ারি কোথায়?’

‘দেখা হয়নি আমার সাথে।’

‘ঠিক আছে।’ ঘোড়া ফেরাল এরিখ। ‘ওয়েন্ডি যখন নিরাপদে আছে, তখন আমরা বার্জারের সাহায্যে যেতে পারি আপাতত। বিয়ারির ব্যবস্থা পরে করলেও চলবে।’

রুইন্স ক্যানিয়ন থেকে আধ মাইল উত্তরে গোল্ড বার্জার আর তার দুই সঙ্গীর দেখা পেল ওরা।

‘এরকম আর দেখিনি!’ এরিখকে বলল বার্জার অভিযোগের সুরে। না গরু, না গরুর পায়ের ছাপ, দুটোই হাওয়া!’

এরিখ মাথা দোলাল সায় দেবার ভঙ্গিতে; কোন মন্তব্য করল না।

‘এখন কি করা উচিত আমাদের?’ রেগেমেগে জানতে চাইল বিভ্রান্ত র‍্যাঞ্চ মালিক।

এরিখ ক্যানিয়নের পশ্চিম দিকের দেয়ালে তাকাল। চাঁদের আলো পড়েছে দেয়ালে। ওদিকে আরেকটা ক্যানিয়ন আছে।’

‘তুমি জানো?’

‘জেনেছি,’ এরিখ জবাব দিল। বার্জারের দিকে ফিরল ও। ‘তোমরা এখানেই থাকো। আমি আর গাস যাচ্ছি ওখানে খোঁজ করার জন্যে।

‘কিন্তু ওখানে গরু ঢোকানোর পথ কোথায়?’

‘আছে। কোনদিক দিয়ে তা জানি না। তবে তুমি নিশ্চিত থাকতে পারো যে, রুইন্স থেকে গরুগুলো উড়াল দেয় না, মাটি বেয়েই যায়।’

‘তাহলে রুইন্সে গিয়ে খোঁজ করলেই হয়,’ বলল বার্জারের সঙ্গী ও’হারা। ‘গরু তো ওখান দিয়ে যায়, তোমার কথামত। পথ থাকলে ওখান দিয়েই থাকা উচিত।’

‘পথ ওখান দিয়েই আছে,’ এরিখ চাইল ওর দিকে। ‘আমরা খুঁজে পাচ্ছি না, এই যা। কিন্তু ওখান দিয়ে পথ খুঁজতে গেলে বিপদে পড়ার সম্ভাবনাও আছে। ফাঁদ পেতে বসে থাকবে ওরা আমাদের জন্যে।

ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করল ও হারা। কিছু একটা বলতে গেল ও এরিখের কথার প্রতিবাদে, এরিখ বাধা দিল ওকে হাত উঠিয়ে, তার চেয়ে আমি কী বলি শোনো। তোমরা ক্যানিয়নের মুখেই থাকো। কড়া নজর রাখো ক্যানিয়ন থেকে কেউ বেরিয়ে আসে কি না। এলে আটকাও। গাস আর আমি যাচ্ছি ওদিকের ক্যানিয়নটা খুঁজে দেখার জন্যে। আমার মনে হয়, চিড়িয়া ওখানেই মিলবে।’

বার্জার জানতে চাইল, ‘ঢুকবে কোনদিক দিয়ে?’

‘জানি না। তবে জেনে নেব,’ জবাব দিল এরিখ।

উঁচু, খাড়া দেয়ালটার দিকে চাইল গাস। শিস দিল ঠোঁট গোল করে। ‘বাপস! এটা বেয়ে উঠতে হবে?’ কাঁধ ঝাঁকাল ও অনিশ্চিত ভঙ্গিতে। ‘কি জানি! হয়তো পেরেও যেতে পারি শেষ পর্যন্ত।’

হাইড-আউট ক্যানিয়নে চলে এল ওরা দু’জন। এরিখ ক্যাম্প থেকে রশি বের করল। এদিকের দেয়ালে চাঁদের আলো পড়েনি। অন্ধকার। এ- অবস্থায় খাড়া দেয়াল বেয়ে উঠতে যাওয়াটা বিপজ্জনক, ভাবল ও। কিন্তু এছাড়া উপায় নেই। সেদিনের মত যতটুকু সম্ভব হাতড়ে হাতড়ে পায়ে হেঁটে উঠল ও গাসসহ। তারপর ওপরের বের হয়ে থাকা পাথরটার অবস্থান অনুমান করে রশির মাথা ছুঁড়ে দিল গেরো বেঁধে।

আটবারের বার পাথরের মাথায় আটকে গেল রশির গেরো। স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল এরিখ সশব্দে। পাঁচ-ছয়বার হ্যাঁচকা টান মেরে এবং দু- তিনবার ঝুলে পড়ে নিঃসন্দেহ হলো ও। আটকেছে রশি শক্ত হয়ে। গাসকে অপেক্ষা করতে বলে সাবধানে উঠতে শুরু করল ও রশি বেয়ে। শেষমেষ উঠে বসল পাথরটার ওপর।

এবার গাসের পালা। এরিখ ওকে উৎসাহ যোগানোর চেষ্টা করল, কিন্তু ওকে অবাক করে দিয়ে বিড়ালের মত নিঃশব্দে ক্ষিপ্রগতিতে উঠে এল বুড়ো। এরিখ সরে গিয়ে ম্যাচের আলো জ্বেলে ওকে সাহায্য করল পাথরে চড়ে বসতে।

উঠে বসল গাস। নিঃশ্বাস ফেলল সশব্দে। ‘উরেব্বাপ, মরে গেছি!’

বাকি পথটুকু হেঁটে উঠল ওরা। উজ্জ্বল চন্দ্রালোকিত মেসা। হাঁটা শুরু করল দ্রুতবেগে। এক সময় মেসার শেষ প্রান্তে এসে দাঁড়াল দু’জন।

নিচে ক্যানিয়নের দিকে তাকাল ওরা। আলো-আঁধারিতে ভূতুড়ে দেখাচ্ছে জায়গাটাকে; রহস্যময়ও। একটা পাথরের সাথে রশির একমাথা শক্ত গেরো দিয়ে বাঁধল এরিখ। তারপর ছুঁড়ে দিল অন্য মাথা নিচের দিকে।

‘নিচে নামবে?’ প্রশ্ন করল গাস। ওর গলায় সন্দেহ।

এরিখ মাথা দুলিয়ে সম্মতি জানাল।

‘তাহলে আমাকেও দেখছি নামতে হবে।’

এরিখ হাসল। হাতে থুতু ছিটিয়ে ভিজিয়ে নিল ও। তারপর রশি বেয়ে নামতে লাগল নিচের দিকে। প্রায় অর্ধেক নামার পর দেয়াল থেকে ঠেলে বেরোনো কার্নিসের মত জায়গা পেয়ে পা রাখল ওটায়। নেমে আসতে লাগল গাসও। একটু পরেই এরিখের পাশে এসে দাঁড়াল।

আবার ঝুলে পড়ল এরিখ রশি ধরে। যত নামছে, তত অন্ধকার হয়ে উঠছে জায়গাটা গাছগাছড়ার ছায়ায়। সাবধানে নামছে ও যাতে দেয়াল থেকে বেরিয়ে থাকা আলগা কোন পাথরে ধাক্কা খেতে না হয়। এক সময় নিরাপদে নেমে গেল ক্যানিয়নের মেঝেয়। রশি টেনে গাসকে ইঙ্গিত পাঠাল ও নেমে আসার জন্যে। মিনিট তিন-চারেক লাগল গাসের নামতে। এরিখের পাশে দাঁড়িয়ে হাঁফাতে লাগল গাস। শ্বাস টানছে সশব্দে।

এরিখ বসল একটা পাথরের ওপর। চারদিকে চোখ বুলাল। চাঁদের আলো আর ছায়া মিলে অপরূপ দেখাচ্ছে পুরো ক্যানিয়নটাকে। নৈশ বাতাসে ঝোপঝাড়ের পাতা দুলছে। মৃদু শির শির শব্দে মুখর চারদিক।

হঠাৎ উঠে দাঁড়াল গাস। ‘শোনো। এরিখের কাঁধে আঙুল ছোঁয়াল সে। ক্যানিয়নের অন্ধকার অংশের কোথাও একটা গরুর ডাক শোনা গেল। উঠে দাঁড়াল এরিখও। কান পাতল। সাড়া-শব্দ নেই আর।

দেয়ালের কোল ঘেঁষে পশ্চিমে হাঁটা শুরু করল ওরা। ওদিক থেকেই এসেছে মনে হয়েছে শব্দটা। মাঝে-মধ্যে বাতাসে ভেসে আসা আরেকটা শব্দ শুনছে ওরা। কুল কুল করে দ্রুত জল গড়ানোর শব্দ। কাছাকাছি কোথাও ঝরনা আছে, অনুমান করল এরিখ।

মাইলখানেক চলার পর হঠাৎ ঘোঁৎ করে উঠল গাস। দাঁড়িয়ে গেল। আঙুল উঁচিয়ে এরিখের দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। ‘দেখো।’

খাঁড়িটা দেখতে পেল এরিখ। খাঁড়ি ছাড়িয়ে আরও খানিকটা দূরে বিরাট একটা খোলা মাঠের মত জায়গা, গরু চরছে তাতে।

‘কম পক্ষে পাঁচ থেকে ছয়শোর মত গরু হবে ওখানে,’ বলল এরিখ। গাসের দিকে তাকাল। ‘শেষ পর্যন্ত তাহলে পেয়ে গেলাম! কি বলো? নিশ্চয় ভূতদের গরু কিংবা গরুদের ভূত বলে ভাবছ না তুমি?’

‘কোনটাই ভাবছি না,’ বলল গাস উত্তেজিত স্বরে। ‘কিন্তু এখন কী কর্তব্য?’

এরিখ ওর কাঁধে হাত রাখল। মৃদুস্বরে বলল, ‘ওদিকে দেখো।’

একটা আলোর আভাস দেখা যাচ্ছে, গরুগুলো যেখানে চরছে তার খানিকটা পশ্চিমে।

‘কী ওটা?’

‘আলো। মনে হয় চিমনির মুখ দিয়ে বেরোচ্ছে।’ হাঁটা শুরু করল এরিখ। ‘কেউ আগুন জ্বালিয়েছে ওখানে।

আরেকটু এগোতেই মানুষের গলার আওয়াজ শোনা গেল। গান গাইছে কেউ। ঘোড়ায় চড়ে গরুর পালের পাশে টহল দিচ্ছে।

লুকিয়ে পড়ল ওরা একটা ঝোপের আড়ালে। পা টিপে টিপে একটা প্রশস্ত পাথরের ওপর গিয়ে উঠল। ওখান থেকে উঁকি মারতেই চাঁদের আলোয় একটা ঘর দেখতে পেল। পাহাড়ের ঢালের ওপর পাথরের তৈরি ঘরটা। ঘরের পাশে খাঁড়ি কিছুটা গভীর হয়ে জলাশয়ের আকার ধারণ করেছে।

ঘরের সামনে হিচিং রেইল, চারটে ঘোড়া বাঁধা তাতে। সশব্দে দরজা খুলে কেউ একজন বেরোল ঘর থেকে। ছায়া থেকে চাঁদের আলোয় এসে দাঁড়াল লোকটা। একটু পরেই ওর গলা শোনা গেল। ‘আমি রুইন্স থেকে ঘুরে আসব ভাবছি।’

দরজার সামনে এসে দাঁড়াল আরেকজন। ‘উঁহুঁ। এক্ষুণি নয়, প্রথম জনকে পরামর্শ দিল ও। ‘গেলে হয়তো দেখবে জর্জ ক্ষ্যাপা মোষের মত ঘুরছে ওখানে। ওর চোখে পড়ে গেলে ওখানে তোমার উপস্থিতির কোন কারণ খুঁজে পাবে না ও। তুমিও দেখাতে পারবে না। অতএব ঘাটে এসে তরী ডোবাতে যেয়ো না এখন।’

জবাবে অস্ফুটস্বরে কিছু বলল প্রথম জন। বোঝা গেল না দূর থেকে। আটকে রাখা দম ছাড়ল এরিখ। শুনতে পেয়েছ?’

‘ক্রাইস্ট!’ আঁতকে উঠল বুড়ো গাস। ‘ডগ লেইকার আর হল চ্যাপম্যান! ভাবা যায়?’

‘শুধু ওরা দু’জন? উঁহু,’ মাথা নাড়ল এরিখ, ‘আরও আছে। ওদের দু’জনের বুদ্ধিতে কুলোত না এই কাজ। যাহোক,’ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল ও, ‘জর্জ চ্যাপম্যানকে সন্দেহ করার কিছুই নেই আর।’

‘হ্যাঁ। কিন্তু এরপর কি করব আমরা? চলে যাব এখন? পরে লোকজন নিয়ে এসে…’

থামিয়ে দিল এরিখ গাসকে। না। যা করার এখনই করতে হবে। ওদের কাজ মনে হচ্ছে শেষ পর্যায়ে এসে গেছে। গরুগুলো সরিয়ে নেবার মতলব ভাঁজছে ওরা। হয়তো আজ রাত থেকেই শুরু করবে সরানোর কাজ।

‘ওখানে আরও লোক থাকার সম্ভাবনা আছে?’ প্রশ্ন করল গাস।

‘দেখতে হবে।‘

এরিখ গরুর পালের দিকে তাকাল। টহলরত লোকটা পুবদিকে যাচ্ছে এখন। ‘তুমি ওকে অনুসরণ করার চেষ্টা করো,’ ইশারায় লোকটাকে দেখিয়ে বলল ও। ‘আমি ঘরটায় উঁকি মারতে যাচ্ছি।’

‘ঠিক আছে,’ সম্মতি জানাল গাস ঘাড় নেড়ে

ঝোপঝাড়ের আড়ালে গা ঢাকা দিয়ে ইঞ্চি-ইঞ্চি করে সামনে এগোল এরিখ। ঘরটার পেছনে গিয়ে পৌছতে যথেষ্ট সময় লাগল। মাঝে-মধ্যে ভেসে আসা ওদের টুকরো-টাকরো কথাবার্তার আওয়াজ শুনল ও কান পেতে। একটা ব্যাপারে নিশ্চিত হলো। সতর্ক নয় ওরা মোটেও। কোন রকম ঝামেলা আশা করছে না।

‘ডগ লেইকার তাহলে চ্যাপম্যানকেও বোকা বানিয়েছে!’ ভাবল ও। ‘কিন্তু অবাক কাণ্ড! জর্জ চ্যাপম্যানের ছোট ভাই রকস্প্রিং শহরের শেরিফ হল চ্যাপম্যান ভাইয়ের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করছে? অথচ জর্জের দয়ায় ও শেরিফ; এই এলাকার সবচেয়ে সম্মানিত মানুষ হিসেবে পরিচিত।

স্পেন্সারটা শক্তহাতে ধরল এরিখ। ঘরের পেছনে চলে এসেছে ও। দেয়ালসংলগ্ন একটা পাথরে পা রেখে দাঁড়াল। উঁকি দিল ঈষৎ খোলা জানালা দিয়ে ঘরের ভেতর। হল আর ডগকে দেখতে পেল ও। ওর দিকে পিঠ রেখে আলাপ করছে ওরা নিজেদের মধ্যে। ঘরের ভেতর দু’তিনটে কক্ষ। বার্ট আর ডগ যেটায় কথা বলছে, সেটায় ছাড়া অন্য একটা কক্ষেও আলো জ্বলছে।

‘ক্যানিয়নের ভেতর আমাদের অনুসরণ করেছিল কে, বুঝতে পেরেছ?’

‘না,’ ডগ জবাব দিল। ‘অন্ধকার ছিল খুব। তবে বেশিদূর আসতে পারেনি। বাক প্রেসি গুলি করে ভাগিয়েছে ব্যাটাকে।

‘ব্যাপারটা পছন্দ হচ্ছে না আমার,’ ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করল হল। ‘ওই ব্যাটা এরিখ কি না কে জানে! ও তো এদিকেই ঘোরাঘুরি করছে। তুমি কি নিশ্চিত যে, আমাদের গরু ঢোকানোর পথটা ও দেখে ফেলেনি?’

‘নিশ্চয়ই দেখতে পায়নি!’ প্রায় চেঁচিয়ে উঠল লেইকার। ‘দেখতে পেলে এতক্ষণে লোকজন নিয়ে এসে হামলা করত।’

‘সবচে’ ভাল হত ওকে মেরে ফেলতে পারলে, পাশের কক্ষ থেকে আরেকটা গলা শোনা গেল। ওখান থেকেই আলোচনায় অংশ নিচ্ছে গলার মালিক। আর এরিখকে খতম করার জন্যে ডগ দু’বার গিয়েছে ওকসহ, লোকজন নিয়ে। কিছুই করতে পারেনি, ওককে হারানো ছাড়া।

এরিখ চমকে উঠল রীতিমত। খুব পরিচিত গলা। কিন্তু এই মুহূর্তে চিনতে পারছে না লোকটাকে।

‘অত ঘাবড়াবার কী আছে রাইলটন?’ ডগ লেইকার আশ্বাস দিল গলার মালিককে। ‘দু’বারই নেহাত কপালগুণে বেঁচে গিয়েছে ওয়েন। ওকে নিয়ে উদ্বিগ্ন হবার দরকার নেই। ওর ব্যবস্থা চ্যানি বিয়ারিই করবে। দেখে নিয়ো তুমি।’

‘প্রচুর গরু জমেছে আমাদের। দিন দুয়েক চুপচাপ থেকে পশ্চিমে চালান করে দেব আমরা। কোন অসুবিধে হবে না। ওদিকের ঝামেলা মেটার পর ওয়েনের খবর নেয়া যাবে আবার। থামল ও একটু। যোগ করল আরেকটা নাম, ‘জর্জেরও। অবশ্য যদি হল সেটা সত্যিই চায়।

হল চ্যাপম্যান হাসল আড়ষ্টভঙ্গিতে। কাজটা তোমাদের কাউকেই সারতে হবে।’

‘নিশ্চয়ই।’ হাসল ডগও, শব্দ করে। ‘হাজার হোক মায়ের পেটের ভাই। কি বলো?’

রাইলটন! রাইল…রাইলটন! এই নামটাই, তাহলে বলতে চেয়েছিল জ্যাক মারা যাবার আগে? লোকটাকে দেখার চেষ্টা করল এরিখ জানালা দিয়ে আরেকটু ঝুঁকে। পারল না। রাইলটন বেরিয়ে আসেনি নিজের কক্ষ ছেড়ে।

হঠাৎ পা ফসকাল এরিখ। কয়েকটা মরচে ধরা টিনের ক্যান পড়েছিল পাথরটার পাশে। ওগুলোর সাথে পা লেগে গিয়ে জোরে শব্দ হলো। শরীরের ভার সামলাতে গিয়ে হাত থেকে স্পেন্সারটা খসে পড়ল ওর। দেয়ালের সাথে বাড়ি খেয়ে দূরে ছিটকে পড়ল অস্ত্রটা।

ওটা কুড়িয়ে নেবার সময় পেল না ও। ঘরের ভেতর থেকে বেরিয়ে এল লোকগুলো। দুদ্দাড় করে ছুটে আসতে শুরু করল। স্পেন্সারটা কুড়িয়ে নিতে গেলে ধরা পড়ে যাবে এখন ওদের হাতে। অগত্যা ওটার মায়া ত্যাগ করেই দৌড় লাগাল এরিখ। ঢুকে গেল ঝোপের ভেতর।

ঘরের পেছনে চলে এল লোকগুলো। ‘কে ওখানে?’ নার্ভাসভঙ্গিতে কর্কশ স্বরে জানতে চাইল হল চ্যাপম্যান।

এরিখের স্পেন্সারটা দেখতে পেল ডগ। ‘এটা কী?’ অস্ত্রটা তুলে নিল ও।

‘রাইফেল!’ ওর দিকে ঝুঁকল শেরিফ। ‘আমাদের লোকদের কারও হবে।’ হাঁফাচ্ছে লোকটা। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে যে, ভয় পেয়েছে ও।

‘না।’ চ্যাপম্যানের কথায় পাত্তা দিল না লেইকার। ‘আমাদের লোকদের কারও কাছে স্পেন্সার নেই। এটা মনে হয় ওই বেজন্মা ওয়েনটার। ওর একটা স্পেন্সার আছে। জানি আমি।’

ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করল শেরিফ। ‘আমার মনে হচ্ছে আজ রাতে গণ্ডগোল হবে এখানে। লক্ষণে তাই বলছে,’ গজগজ করছে ও।

‘বাদ দাও। চলো গরুর কাছে যাই।’

ঘোড়ায় চড়ল ওরা। এরিখ ওদের ঢাল বেয়ে নেমে যেতে দেখল। ডগের হাতেই শোভা পাচ্ছে ওর স্পেন্সারটা। তৃতীয় লোকটাকে চিনতে পারার আগেই একটা ঝোপের আড়ালে চলে গেল ওরা।

ঝোপ থেকে বেরিয়ে এল এরিখ সাবধানে। ঘরের ভেতরটা এখন ফাঁকা। ভেতরে ঢুকল ও। ফায়ারপ্লেসে গনগন করছে আগুন। হঠাৎ বাইরে গরুর পালের কাছে গুলির শব্দ হলো। দ্রুত বেরিয়ে এল ও ঘর থেকে। দৌড়ে ঝরনার কাছে চলে গেল। জলাশয়ের পাড়ে দাঁড়িয়ে পুবদিকে তাকাল সে। হাঁটতে শুরু করল আবার। রাইফেলের আওয়াজ হতে লাগল থেমে থেমে। দৌড়াতে শুরু করল এরিখ। গাসকে দেখে ফেলেছে ওরা।

ঝোপের ভেতর কিছু একটা নড়ে উঠতেই চোখের পলকে ডবল অ্যাকশন স্টারটা বের করে নিল ও খাপ থেকে। গাসকে দৌড়ে আসতে দেখা গেল, ডান হাতে বাম বাহু চেপে ধরেছে ও। এরিখের সামনে এসে থামল বুড়ো। ‘ধরা পড়ে গেছিলাম আরেকটু হলেই। পালিয়ে এসেছি। রাইফেলটা পড়ে গেছে এক জায়গায়। কুড়িয়ে নেবার সময় পাইনি। খুঁজছে ওরা আমাকে।’ এক নাগাড়ে বলে গেল বুড়ো ফিস ফিস করে।

‘আমার স্পেন্সারটাও খোয়া গেছে, বলল এরিখ। কি আর করা! দাঁড়াও এখানে চুপচাপ।

আঁতিপাতি করে খুঁজছে লোকগুলো ঝোপঝাড়ের ভেতর। এরিখ ওদিকে দেখতে দেখতে প্রশ্ন করল গাসকে, ‘কি বুঝলে? পথটা খুঁজে পাওয়া যাবে?’

‘পেয়েছি মনে হচ্ছে। একটা উঁচুমতন জায়গা, গুহার মত ঢুকে গেছে পাহাড়ের ভেতর। একজনকে অনুসরণ করে গিয়ে দেখেছি। ব্যাটা ঢুকে গেছে ওখান দিয়ে, বেরিয়ে আসতে দেখিনি। আমার মনে হয়,’ থেমে শ্বাস টানল গাস, ‘রুইন্স ক্যানিয়নে গিয়ে শেষ হয়েছে ওটা।’

‘বুঝলাম। কিন্তু রুইন্স ক্যানিয়নের কোনদিক দিয়ে?’

‘তা জানি না।’ মাথা নাড়ল গাস।

গরুর কাছ থেকে সরে এসে অশ্বারোহীরা এখন ঝোপ ঝাড়ে তন্ন তন্ন করে খুঁজতে শুরু করেছে। প্রত্যেকের হাতেই উদ্যত রাইফেল।

গাস সেদিকে তাকিয়ে বলল, ‘এবার পালাই চলো।’ হাত ঘুরিয়ে পেছনে পাহাড়ের একটা জায়গা দেখাল, ‘ওখান দিয়েই ঢুকেছে লোকটা। আমরাও যেতে পারব নিশ্চয়ই।’

এরিখ তাকাল ওদিকে। ক্যানিয়ন থেকে একটা ঢাল উঠে গেছে ওপরের দিকে। ঢালের ওপর পাহাড়ের কিছু অংশ অন্ধকার। বিক্ষিপ্ত কিছু গাছপালা জন্মেছে ওখানে। দূর থেকে গাছের ছায়ায় জমকালো দেখাচ্ছে জায়গাটাকে।

গরুর পালের দিকে তাকাল ও আবার। গুলির শব্দে কিছুটা ছড়িয়ে- ছিটিয়ে পড়েছে পালটা। অস্থির হয়ে উঠেছে।

অনুসন্ধানকারীরা কথা বলছে নিজেদের মধ্যে একে অপরকে ডাকাডাকি করে। উপদ্রবটা পছন্দ হচ্ছে না ওদের। নিজেদের কাজ প্রায় গুটিয়ে এনেছে ওরা, শেষ মুহূর্তে বিঘ্ন ঘটার আশঙ্কায় মাথা গরম হয়ে উঠেছে।

বেশিক্ষণ লুকিয়ে থাকা যাবে না, জানে এরিখ। এক সময় না একসময় ধরা পড়ে যাবে ওরা। কিন্তু গাসের প্রস্তাবেও রাজি হলো না ও।

‘না,’ বলল সে। ‘তুমি বরং লুকিয়ে পড়ো কোথাও। খবরদার, গুলি করতে যাবে না কিন্তু; অন্তত তোমার গায়ের ওপর এসে পড়ার আগে।’ সতর্ক করে দিল ও বুড়োকে।

‘তুমি কি করবে?’ জানতে চাইল বুড়ো।

‘নরক গুলজার করব,’ মৃদু হাসল এরিখ। হাঁটা শুরু করল ও পশ্চিম দিকে।

গরুর পালের পাশ ঘেঁষে ঝোপঝাড়ের ভেতর দিয়ে ওদের পেছনে চলে এল ও। এদিকের ঘাস শুকনো। ঝন ঝন শব্দ করছে ওর বুটের নিচে দুমড়ে গিয়ে। উবু হয়ে বসল এরিখ একটা শুকনো ঝোপের পাশে। মুখ উঁচু করে আরেকবার দেখে নিল গরুগুলোর অবস্থান। অনুসন্ধানকারীরা পুবদিকে সরে গেছে।

পশ্চিম থেকে বাতাস বইছে। ঠাণ্ডা। শুকনো ঘাস ছিড়ে নিল ও কয়েক মুঠো। রাখল ঝোপের পাশে। তারপর ম্যাচ জ্বালিয়ে আগুন ধরিয়ে দিল তাতে।

জ্বলে উঠল আগুন। পশ্চিমা বাতাসের ছোঁয়ায় এগোল সামনের দিকে 1 শুকনো ঝোপটার নাগাল পেতেই দাউ দাউ করে উঠল। দেখতে না-দেখতেই ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে।

‘ওটা আবার কী?’ চেঁচিয়ে উঠল অনুসন্ধানকারীদের একজন।

আগুনের কাছ থেকে দূরে সরে গেল এরিখ। আচমকা গলার রগ ফুলিয়ে চেঁচিয়ে উঠল। বুনো চিৎকার। সঙ্গে সঙ্গে স্টার থেকে গুলি ছুঁড়ল পরপর কয়েকবার। প্রতিধ্বনিত হলো গুলির শব্দ চারদিকের পাহাড়ের সাথে ধাক্কা খেয়ে।

সামনে চাইল এরিখ। আগুন এখন দেয়ালের মত দাঁড়িয়ে গেছে ওপরের দিকে। এগিয়ে চলেছে প্রচণ্ড আওয়াজের সাথে লাফিয়ে লাফিয়ে। গরুর পালের মধ্যে হুলস্থুল পড়ে গেছে। চিৎকার, গুলির শব্দ আর পটাপট আওয়াজের সাথে আগুনের লেলিহান শিখা দেখে হকচকিয়ে গেছে জন্তুগুলো পুরোপুরি। পুবদিকে এগোচ্ছে ওরা আস্তে আস্তে।

আচমকা যেন মাথা খারাপ হয়ে গেল ওগুলোর। লেজ তুলে মাথা নিচু করে দৌড় লাগাল সামনের দিকে। দ্রুত হাতে স্টারটা রিলোড করে নিল এরিখ। পরপর ছয়টা গুলি পাঠিয়ে দিল গরুগুলোর পেছনে।

যেন বিস্ফোরিত হলো পাঁচ-ছয়শো গরু। কঠিন মাটির ওপর বজ্রপাতের শব্দ তুলল ওদের শক্ত খুর। ঝোড়ো গতিতে ছুটল পুবদিকে।

‘স্ট্যা-ম-পি-ড!’ ভয়ার্ত গলায় হাহাকারের মত শোনাল অশ্বারোহীদের একজনের চিৎকার। পাঁচ থেকে ছয়শো গরু বিরাট এলাকা জুড়ে ঝড়ের গতিতে ছুটেছে ওদের দিকে। কাছে চলে গেছে প্রায়। হতচকিত ঘোড়ার পেটে উন্মত্তের মত স্পার দাবাল ওরা, গরুগুলো এসে পড়ার আগে ওদের গতিপথ থেকে সরে যাবার জন্যে। কিন্তু গরুর পাল ততক্ষণে তাদের কাছে চলে গেছে। পাশ কাটাবার আশা ত্যাগ করে সামনের পাহাড়ের দিকে ছুটল অশ্বারোহীরা। হঠাৎ আছাড় খেয়ে পড়ল একটা ভয়ার্ত ঘোড়া। সাথে সাথেই পিঠ থেকে ছিটকে পড়ল আতঙ্কিত আরোহী। উঠে দাঁড়াবার চেষ্টা করল, তার আগেই গরুগুলো ওর ওপর গিয়ে পড়ল। ওদের খুরের আওয়াজ আর ক্রুদ্ধ গর্জনের নিচে চাপা পড়ে গেল লোকটার অন্তিম আর্তনাদ।

বাকিরা ততক্ষণে আরেকটু সামনে এগিয়ে গেছে। পাহাড়ের একটা অন্ধকার অংশের দিকে ছুটছে ওরা। একটা পাথুরে ঢালের ওপর অংশটা। এরিখ লক্ষ করল, গাস তাকে ওটার কথাই বলেছিল কিছুক্ষণ আগে।

গরুগুলোও ছুটেছে ওটা লক্ষ্য করে। হঠাৎ তিন অশ্বারোহীর একজন মত পাল্টাল। প্রায় গায়ের ওপর এসে পড়া গরুগুলোর সামনে থেকে সরে যাবার আশায় ডান দিকে মোড় নিতে গেল সে। প্রাণভয়ে ভীত ওর ঘোড়াটা টাল সামলাতে পারল না আচমকা লাগামে টান পড়ায়। দড়াম করে আছড়ে পড়ল মাটিতে। পর মুহূর্তেই আরোহীসহ চাপা পড়ল গরুর পায়ের নিচে।

ততক্ষণে ঢালের কাছে পৌঁছে গেল বাকি দু’জন। হাঁচড়েপাঁচড়ে উঠতে চাইল ওরা ঢাল বেয়ে। আলগা পাথরে ফসকে গেল ওদের ঘোড়ার পা। আরও একজন ছিটকে পড়ল ঘোড়া থেকে। পাথরে হোঁচট খেয়েছে ওর ঘোড়া। অন্যজন প্রায় শেষ মুহূর্তেই ঝাঁপ দিল ঘোড়ার পিঠ থেকে পাহাড়ের গায়ে ঠেলে বেরোনো একটা পাথর লক্ষ্য করে। ধরে ফেলল পাথরটা।

ইতোমধ্যে গরুগুলোও এসে উঠেছে ঢালের ওপর। দু’হাতে পাথরটা আঁকড়ে

ধরে পা তুলে ফেলল পলাতক। কোনমতে চড়ে বসল, তারপর ওপর থেকে নেমে আসা একটা গাছের ডাল ধরে অদৃশ্য হয়ে গেল পাতার আড়ালে।

পিস্তলে গুলি ভরল এরিখ। এতক্ষণ ধরে যে ভয়াবহ তাণ্ডব প্রত্যক্ষ করেছে, তাতে নিজেই অসুস্থ বোধ করছে এখন। আগুন, ধোঁয়া এবং ধুলো- বালিতে ভরে গেছে ক্যানিয়নের ঠাণ্ডা বাতাস। দম বন্ধ হয়ে এল ওর। কাশতে লাগল খক খক করে দু’হাতে বুক চেপে ধরে। অথচ, জানে ও, এ ছাড়া উপায়ও ছিল না আর। নইলে রাসলারদের হাতে ওরা নিজেরাই মরত। ওদের একজন ছাড়া আর কেউই এখন বেঁচে নেই। নেহাত কপালগুণে বেঁচে গেছে লোকটা এই ভয়ঙ্কর মৃত্যুর কবল থেকে।

গাসকে খুঁজে বের করল ও। কুটিরের কাছাকাছি একটা পাথরের ওপর বসে আছে বুড়ো স্তব্ধ হয়ে। এরিখকে দেখেই ককিয়ে উঠল ভাঙা গলায়, ‘গড! এরিখ, সত্যিই তুমি নরক গুলজার করে দিয়েছ!’

ওকে নিয়ে কেবিনে ঢুকল এরিখ। ‘বসো এখানে,’ বলল সে। ‘আমি ওই গুহায় ঢুকব। ওদের একজন পালিয়েছে। খুঁজে বের করতে হবে ওকে।’

মাথা দোলাল গাস। আস্তে আস্তে ধাতস্ত হয়ে উঠছে। ‘গরুগুলো গায়েব হয়ে গেল কোথায় আবার?’

‘ওগুলোকেও খুঁজব,’ বলল এরিখ। গাসের বামবাহু পরীক্ষা করল ও। সামান্য ক্ষত। ভয়ের কিছু নেই।’ বেরিয়ে পড়ল ও। লম্বা লম্বা পা ফেলে এগিয়ে চলল পাহাড়ের সেই অন্ধকার অংশটার দিকে

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *