আশ্রয় – ৭

সাত

ক্রস অ্যারো র‍্যাঞ্চ হাউসের টিলার পাশে একটা অ্যারোয়োতে এসে জিস্টারের লাগাম টানল এরিখ। সময় প্রায় মধ্যরাত। চারদিকে সুনসান নীরবতা। উপত্যকা বেয়ে-আসা শোকাবহ নিঃশ্বাসের মত নৈশ বাতাসে কটনউড পাতার মর্মরধ্বনি ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

ম্লান চাঁদের আলোয় অ্যারোয়ো থেকে র‍্যাঞ্চ হাউসের পুরোটাই দেখা যাচ্ছে। এরিখ বাঙ্ক হাউসের দিকে তাকাল। আলো জ্বলছে ভেতরে, জানালা দিয়ে ছটা বেরিয়ে আসছে। জিস্টারের পিঠ থেকে নামল ও, ওটার ঘাড়ে মৃদু চাপড় দিয়ে শান্ত থাকার নির্দেশ দিল, তারপর ধীরে-সুস্থে টিলা বেয়ে উঠে গেল নিঃশব্দে।

ওপরে উঠে চারদিক সতর্কভাবে পর্যবেক্ষণ করে নিল ও। হল চ্যাপম্যানের লোকজনদের এখানে এসে ঘাপটি মেরে বসে থাকার আশঙ্কাকে সে বাদ দিচ্ছে না। করালের দিকে হেঁটে গেল ও সন্তর্পণে, একটু দূরে দাঁড়িয়ে নতুন কোন ঘোড়া বাঁধা আছে কিনা দেখল, তারপর ছায়া-অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে নিঃশব্দে বাঙ্ক হাউসের পেছনে গিয়ে দাঁড়াল।

কাঠের বেড়ার ফাঁক দিয়ে ভেতরে দৃষ্টি দিল ও। গাস আর চ্যানি দু’জনেই জেগে আছে। চ্যানি টেবিলে তাস ছড়িয়ে একা একা খেলছে; গাস শুয়ে আছে বাঙ্কে, পাইপ টানছে।

চ্যানির হাতে তাসের মৃদু খসখস শব্দ ছাড়া আর কিছু শোনা গেল না কিছুক্ষণ। তারপর চ্যানি কথা বলে উঠল। ‘আগামীকাল ভোরে উঠে প্রথম কাজ হলো গরুগুলো পাইনস ভ্যালিতে নিয়ে যাওয়া। তুমি ওখানে ওগুলোর দায়িত্বে থাকবে, গাস।’

গাস জবাব দিল, ‘এখানেও মনে হয় আমাদের কারও থাকা উচিত ছিল গরুর সাথে।’

‘ধ্যাৎ, এখানে কেউ ঝামেলা পাকাতে আসবে না। আমি আছি, ওরা এটা জানে।’

‘তা ঠিক,’ গাস একমত হলো। ‘তাহলে আগামীকাল তুমি কী কাজ করবে?’

‘কিছু লোক যোগাড়ের চেষ্টা করব,’ চ্যানি জানাল। ‘চ্যাপম্যানকে এবার মাশুল গুনতে বাধ্য করব, যদি লাগতে আসে ও আমার সঙ্গে।’

মাথা দোলাল গাস। ‘তা বটে। ওয়েনকে নিয়ে ওরা কী করবে জানো?’

‘জানার দরকার আছে?’ অর্ধেক তাসের ওপর বাকি অর্ধেক তাস দিয়ে বাড়ি লাগাল চ্যানি। ‘কোন ফালতু ভ্যাগাবন্ডের ব্যাপারে মাথা ঘামাবার সময় কোথায় আমার?’

চ্যাপম্যানদের ঘাঁটিয়েছে ও। মনে হচ্ছে রকস্প্রিঙে নিয়ে যাবার ঝামেলা পোহানোর চাইতে পথেই ওকে মেরে ফেলার কথা ভাববে ওরা। সহজ কাজ। চ্যাপম্যানদের ওপরে কথা বলার কেউ নেই এখানে। এরিখ পালাতে গিয়ে গুলি খেয়েছে বললেই হজম করে নেবে সবাই কথাটা।’

‘তাতে আমাদের কী?’

‘লোক হিসেবে খারাপ ছিল না ওয়েন। মিথ্যে কথা বলে ওকে ফাঁসিয়ে দিয়ে খারাপ লাগছে আমার।’

ঠাস করে টেবিলের ওপর তাস ফেলল চ্যানি বিয়ারি। ‘দেখো, গাস, তুমি জানো, ও আমাকে ঘাঁটিয়েছে। আমি চ্যানি বিয়ারি। এ-অঞ্চলের সবচে’ বড়লোক হতে চাই। এ-র‍্যাঞ্চটাই আমাকে সে-সুবিধা এনে দেবে। ওয়েন্ডি একা মেয়েমানুষ। আমার মত শক্ত সমর্থ অথচ সুদর্শন লোককে সে পছন্দ না-করেই পারে না। ওয়েনকে না সরিয়ে উপায় ছিল না আমার।’

মাথার নিচে দু’হাত রেখে চিৎ হয়ে শুলো গাস, সিলিঙের দিকে তাকাল। ‘তাও ঠিক। তবে এটাও ঠিক যে, শত্রুও পাবে তুমি, সুযোগের সাথে। চ্যাপম্যান র‍্যাঞ্চ চায়, বাটলার ওয়েন্ডিকে। আর এরিখ যদি পালিয়ে যেতে পারে ওদের হাত থেকে, তাহলে সেও ছুটে আসবে তোমাকে গেঁথে ফেলার জন্যে।’

থুতু ফেলল চ্যানি। ‘ভাল কিছু লোক রাখব আমি, বন্দুকে চালু। বাটলারকে নিয়ে ভাবার কিছু নেই, আর ওয়েনের সাহস হবে না আমার মোকাবেলা করার।’

‘এ-ব্যাপারে ফুটো পয়সাও বাজি ধরব না আমি তোমার পক্ষে।’

‘তুমি যেন ওর পক্ষে কথা বলছ!’

‘হ্যাঁ।’ গাস উঠে বসল। ‘বলছি। ওয়েন ভাল লোক। আর ও নিজে না জানলেও আমি জানি যে, এই মেয়ে ওকে পছন্দ করে।’

চ্যানির সুন্দর মুখ রাগে কালো হয়ে গেল। খিস্তি করল সে, ‘গোল্লায় যাও তুমি, বুড়ো! আর কোনদিন আমার কাছে এসব বলবে না।’

‘তুমি কখনও সত্যের মুখোমুখি হতে চাও না, চ্যানি।’ গাস বিষণ্ন স্বরে বলল। ‘তোমার ধারণা তুমি পশ্চিমের সবচে’ সেরা ঘোড়সওয়ার, সবচে’ চালু বন্দুকবাজ, এবং মেয়েদের দৃষ্টি আকর্ষণেও সবচে’ পটু।’

উঠে কোমরে হাত রেখে দাঁড়াল চ্যানি। ‘তোমার কী বিশ্বাস? ধারণাটা ভুল?’

ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করল গাস। ‘মাথা গরম না করে আমার কথা বুঝতে চেষ্টা করো, চ্যানি। আমি শুধু তোমাকে সতর্ক করে দেবার চেষ্টা করছি।’

ভেংচি কাটল চ্যানি বিয়ারি। ‘হাহ্! এখন আমি কী বলছি শোনো। তুমি আমার পরামর্শ অনুযায়ীই তো ওকে ফাঁসিয়েছ, না কি?’

গাস উত্তপ্ত কণ্ঠে বলল, ‘ঠিক তাই। আমি ওকে গুলি করতে দেখিনি।’

চ্যানি হাসল। ‘সম্ভবত তুমি এখন রকস্প্রিং গিয়ে বলতে চাইবে যে, ওয়েন নির্দোষ! ঠিক আছে, যেতে পারো। আমি কিছুই বলব না তোমাকে।’

গাস অন্যদিকে তাকাল। ‘তুমি আমাকে ভুল বুঝছ, চ্যানি। তুমি জানো, আমি কেবল তোমাকে ঝামেলা থেকে মুক্ত রাখতে চাই।’

চ্যানি ঝুঁকল গাসের দিকে। ‘অবশ্যই চাইবে, গাস। তোমার সম্বন্ধে কী জানি আমি, সেটা ভুলে না গেলে না চেয়ে পারবে না তুমি।’

শোবার জন্যে তৈরি হলো সে। গায়ের শার্ট আর গানবেল্ট খুলে ঝুলিয়ে রাখল নিজের বাঙ্কের মাথার দিকের দেয়ালে, আলো নিভিয়ে শুয়ে পড়ল। গাস পাইপ ধরিয়েছে আবার। প্রতিটি টানের সাথে পাইপের আগুনের আঁচে স্পষ্ট হয়ে উঠছে ওর চিন্তাক্লিষ্ট মুখ। এরিখ এখনও বুঝতে পারছে না গাস ওর বিরুদ্ধে মিথ্যে সাক্ষ্য কেন দিয়েছিল।

বাঙ্কহাউসের কোনার দিকে গেল এরিখ। ধূমপানের নেশা চাগিয়ে উঠেছে তারও। ইচ্ছেটাকে নির্মমভাবে দমন করতে হলো। সিগারেটের আগুন কারও চোখে পড়ে গেলে সমস্যা হবে। যে-উদ্দেশ্যে ও এখানে এসেছে, সেটা পূর্ণ হবে না। অন্ধকারে একটা কাঠের খালি বাক্স পেয়ে ওটার ওপর বসল ও। অপেক্ষা করতে লাগল। চ্যানি বিয়ারি আর গাস ল্যামেল ঘুমিয়ে পড়ুক।

.

এরিখ যখন উঠে দাঁড়াল, তখন চাঁদ ডোবার আর বেশি দেরি নেই। পা থেকে বুট খুলে ফেলল ও, বিড়ালের মত নিঃশব্দে বাঙ্কহাউসের কাছে পৌঁছে গেল। বাঙ্কহাউসের জানালাগুলো খোলা। এরিখ ওর নিজের বাঙ্কের কাছাকাছি জানালাটার সামনে এসে দাঁড়াল। নিঃশ্বাস বন্ধ করে কান পাতল ও। অঘোরে ঘুমুচ্ছে কাউবয় দু’জন। তাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ নেই।

জানালার সাথে লাগোয়া নিজের বাঙ্কের পাশে দেয়ালে-গাঁথা একটা পেরেকে স্পেন্সারটা ঝুলিয়ে রেখেছিল এরিখ। আস্তে আস্তে জানালা দিয়ে হাত বাড়াল ও ভেতরে। দেয়াল হাতড়ে তার হাত গুলির বেল্ট আর স্পেন্সারের ছোঁয়া পেল। সাবধানে খসিয়ে নিল ওগুলো পেরেক থেকে, বের করে আনল। এখন একটা সিক্সগান দরকার। ওরটা শেরিফ চ্যাপম্যান গ্রেফতারের সময় বাজেয়াপ্ত করেছিল।

বাঙ্কহাউস থেকে বেরিয়ে এসে লিভিং রুমে ঢোকার সিদ্ধান্ত নিল এরিখ। লিভিং রূমের দরজা বন্ধ, কিন্তু গরাদবিহীন জানালাগুলো খোলা। এরিখ জানে লিভিংরুমের দেয়ালে কিছু অস্ত্র আছে ঝোলানো। স্পেন্সারটাকে একটা ঝোপমতন জায়গায় লুকিয়ে রেখে লিভিংরুমের জানালা গলে ভেতরে ঢুকল ও।

এ-ঘর থেকে ওয়েন্ডির শোবার ঘরের মাঝখানের দরজা খোলা। এরিখ দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়াল। নিঃসাড়ে ঘুমুচ্ছে মেয়েটি। জানালা দিয়ে মোলায়েম চাঁদের আলোর সামান্য ছটা এসে পড়েছে ওর ঘুমন্ত শরীরের ওপর। ওর মধুরঙা খোলা চুল রূপোলি আলো পড়ে চকচক করছে। চঞ্চল হয়ে উঠল এরিখ। ওয়েন্ডির পাশে বসে ওকে ছুঁয়ে দেবার দুরন্ত ইচ্ছে জাগল ওর ভেতরে। কিন্তু পরক্ষণেই ইচ্ছেটাকে সংযত করল ও। এরকম বেয়াড়া ইচ্ছে জাগার কোনও মানে হয় না।

নিজের কাজে মন দিল ও। দুটো ক্যাপ অ্যান্ড বল, একটা কনভার্টেড রেমিংটন আর এক জোড়া স্টার তুলে নিল দেয়াল থেকে। দেরাজ খুলে কিছু কার্তুজ নিয়ে আরেকবার ওয়েন্ডির দিকে তাকাল। বুঝতে পারছে এরিখ, ও দুর্বল হয়ে পড়েছে। কিন্তু মেয়েটা তো ওকে ভুল বুঝেছে!

আচমকা বিদ্রোহী হয়ে উঠতে চাইল ওর মন। ইচ্ছে হলো ওয়েন্ডিকে ডেকে তুলে সব কথা খুলে বলে। কিন্তু আচমকা ঘুম ভেঙে ভয় পেয়ে মেয়েটা হৈ-চৈ শুরু করলে বিপদ হতে পারে। তাছাড়া…এরিখ সিদ্ধান্ত নিল, এখন নয়, ক্রস অ্যারোয় ফিরে এসে ওর ভুল ভাঙাবার আগে তার নিজের আরও কিছু কাজ আছে করার। নিঃশ্বাস ফেলল এরিখ, তারপর জানালা গলে বেরিয়ে এল।

.

পাইনস ভ্যালিতে কুটিরটির সামনে এসে ঘোড়া থামাল এরিখ। ঘোড়া থেকে নেমে কুটিরের ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালাল। জন আর জ্যাকের ব্যবহৃত কম্বল, রান্নার পাত্র এবং পানির ক্যান্টিনটা নিল ও। আরেকটু খুঁজতেই কিছু খাবারও মিলল। জিনিসগুলো বাইরে এনে এক জায়গায় জড় করে জিস্টারকে নিয়ে ক্যান্টিন হাতে জলাশয়ে গেল ও। ক্যান্টিনে পানি ভরে নিয়ে জিস্টারকেও পানি খাওয়াল। তারপর জিস্টারের পিঠে মালপত্র তুলে নিয়ে ভ্যালি থেকে বেরিয়ে দক্ষিণে ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের পথ ধরল। ওই হারানো ট্রেইলটির রহস্য এখনও টানছে ওকে। ওর বিশ্বাস, যদি ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নই হয় গরুচোরদের ব্যবহৃত পথ, তাহলে তারা আবার ব্যবহার করবে পথটা অতএব তাদের খোঁজ পেতে হলে ওখানে কোথাও লুকিয়ে থেকে ওটার ওপর নজর রাখা ছাড়া আর কোনও পথ নেই।

ধ্বংসাবশেষের কাছে এসে ঘোড়া থেকে নামল এরিখ। জিস্টারকে হাঁটিয়ে একদম ভেতরে নিয়ে গেল। ওটাকে দাঁড় করিয়ে চারদিকের জরাজীর্ণ ছোট ছোট ঘরগুলো থেকে মোটামুটি অক্ষত একটা ঘর বাছাই করল। তারপর ঘরটার সামনের সরুপথ ধরে হেঁটে গিয়ে ভেতরে ঢুকে আলো জ্বালল। ধুলো-বালির প্রাচুর্য সত্ত্বেও ঘরখানি মোটামুটি পরিষ্কার। বেরিয়ে এসে জিস্টারকে একটা ছোট ঝোপের সাথে বেঁধে রেখে মালপত্র নিয়ে ঘরে ঢুকল আবার। ধুলো-বালি ঝেড়ে কম্বল বিছিয়ে শুয়ে পড়ল। ক্লান্তিতে ওর শরীর অবসন্ন হয়ে গেছে, শোবার সঙ্গে সঙ্গেই ঘুমিয়ে পড়ল।

ঘরের ‘T’ আকৃতির দরজা-পথে আলো পাঠিয়ে ভোরের সূর্য ঘুম ভাঙাল ওর। উঠে কম্বল গুটিয়ে বুট পরে নিল ও। বেরিয়ে এসে উপত্যকার দিকে তাকাল। পরিষ্কার রোদে উদ্ভাসিত উপত্যকা, মেঘহীন উন্মুক্ত আকাশ, প্রায় স্থির হয়ে ওখানে ভাসছে একটা চিল অলস ভঙ্গিতে। চারদিকে একটা শান্ত সমাহিত ভাব। ভাল লাগল ওর।

ঘরে ঢুকে ঠাণ্ডা খাবার দিয়ে ব্রেকফাস্ট সারল এরিখ। তারপর কোমরে পানির ক্যান্টিন ঝুলিয়ে স্পেন্সার হাতে বেরিয়ে এল।

.

হাঁটতে হাঁটতে রুইন্স ক্যানিয়নের প্রবেশ পথে চলে এল এরিখ। ওখানেই দেখতে পেল ও জিনিসটা। গোবর। একটা মেসকিট গাছের ডাল ভেঙে নিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল ও। নেড়ে চেড়ে দেখল ওটাকে। শুকিয়ে চড়চড়ে হয়ে গেছে। তাড়িয়ে নেবার পথে পাল থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া কোনও গরুর গোবর হবে এটা, ও অনুমান করল।

উঠে সোজা হয়ে দাঁড়াল এরিখ। হাঁটতে শুরু করল ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে দক্ষিণে। এবড়োখেবড়ো পাথুরে ভূমিতে হাঁটতে গিয়ে জিস্টারের অভাব অনুভব করল। কিন্তু সম্ভাব্য শত্রুর চোখে ধুলো দিয়ে গা ঢাকা দেয়ার সুবিধার দিকটা চিন্তা করে অভাববোধটাকে ভুলতে দেরি হলো না ওর।

দুপুরের দিকে এক জায়গায় পৌঁছে থামল ও। মাথার ওপর আগুন ছড়াচ্ছে জ্বলন্ত সূর্য। রোদে লাল হয়ে উঠেছে ওর মুখ। চারদিকে চাইল সে। নীরব, নিস্তব্ধ। মানুষ অথবা গরুর কোনও চিহ্ন দেখা যাচ্ছে না।

যেদিক থেকে এসেছিল, ঘুরে সেদিকে হাঁটতে শুরু করল এরিখ। ওর দু’পাশে ক্যানিয়নের খাড়া দেয়াল; অন্যমনস্কভাবে দেয়ালের দিকে তাকাতেই ফাটলটা নজরে পড়ল ওর। আসার সময় লক্ষ্য করেনি ফাটলটা। এগিয়ে গেল সে ওটার দিকে। একটা পরিকল্পনা খেলেছে মাথায়।

ঘণ্টাখানেক লেগে গেল ওর ফাটল বেয়ে উঠতে। ওপরে উঠে একটা পাথুরে ঢিবির ছায়ায় বসল এরিখ। গরমে, ঘামে আর পরিশ্রমে হাঁফাতে হাঁফাতে ক্যান্টিন থেকে পানি খেলো। তারপর সিগারেট ধরাল।

ধূমপান করতে করতে চারদিকে চোখ বুলাল সে। পুবদিকে উঁচু-নিচু পাথুরে টিলায় পরিপূর্ণ বিস্তীর্ণ অঞ্চল; এখানে-ওখানে ঝোপঝাড়ের আধিপত্য। দূরে তাকাতেই একটা সরু ধোঁয়ার রেখা দেখতে পেল ও, বাতাসে পাক খেয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে চারদিকে। এরিখ নিশ্চিত হলো, ওর অনুমান মিথ্যে নয়। এ অঞ্চলেই কোথাও লুকোনো আছে চোরাই গরুগুলো। খুঁজলে অবশ্যই ওদের হদিশ পাওয়া যাবে। তবে শুধু একজনের পক্ষে কাজটা কঠিন হবে।

সিগারেটের শেষাংশটা বুটের তলায় পিষে উঠে দাঁড়াল এরিখ। ঝোপঝাড় আর লতাপাতা সরিয়ে পাথুরে পথে হাঁটতে শুরু করল। ঘামছে ও, দর দর বেগে ঘাম ঝরছে গা থেকে, জামা-কাপড় ভিজে জবজবে হয়ে গেছে। ও যখন রুইন্স ক্যানিয়নের কাছাকাছি এসে পৌঁছল, তখন গলা শুকিয়ে কাঠ। থামল ও। ক্যান্টিন থেকে পানি খেলো এক ঢোক, সিগারেট ধরাল আবার, তারপর নজর বুলাল চারদিকে।

সূর্যের আলোতে ঝিক করে উঠল একটা কিছু, ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের দিকে। এরিখ সতর্ক হলো, নিজের ফিল্ডগ্লাসটা চোখে লাগাল ও। হ্যাটের সাহায্যে আড়াল করল গ্লাসটাকে সূর্য থেকে, যাতে আলো প্রতিফলিত হতে না-পারে। ক্যানিয়নের পাথুরে মেঝেয় একজন অশ্বারোহীকে দেখা গেল। নিঃসঙ্গ। হাতে ধাতব একটা কিছু, এখনও মাঝে-মধ্যে প্রতিফলিত হচ্ছে। বিড়বিড় করে খিস্তি আওড়াল এরিখ। চিনেছে ও লোকটাকে। এবড়োখেবড়ো পাথুরে মুখ। টিকাউ। ব্লাড হাউন্ডের মত গন্ধ শুঁকেই যেন দোআঁশলাটা ওকে ট্রেইল করেছে। কিছু দূর গিয়ে ঘোড়া থেকে নামল টিকাউ। ঝুঁকে মাটিতে কিছু একটা দেখতে লাগল।

মাটি শুঁকছে বেজন্মাটা! গাল বকল এরিখ, নিজের স্পেন্সারটার দিকে চাইল। খাটো মোটা অস্ত্রটার রেঞ্জের বাইরে লোকটা। নইলে পেছনে ঘুর ঘুর করার মজাটা টের পাইয়ে দেয়া যেত।

ঘুরে সোজা হয়ে দাঁড়াল দোআঁশলা। ধীরে-সুস্থে ঘোড়ায় চড়ে বড় একটা পাথরের আড়ালে অদৃশ্য হয়ে গেল।

এরিখ অপেক্ষা করল। টিকাউ একটা প্রেতকেও ট্রেইল করতে পারে, চ্যাপম্যানের মন্তব্য মনে পড়ল ওর। পাথরের আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে লোকটা কী করবে, আন্দাজ করার চেষ্টা করল। একটা ব্যাপার নিশ্চিত যে, ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের পাথুরে জমিতে ও কোন ট্র্যাক রেখে যায়নি।

অনেকক্ষণ অপেক্ষা করেও টিকাউকে বেরোতে দেখা গেল না। আচমকা এরিখের শিরদাঁড়া বেয়ে ঠাণ্ডা স্রোত নামল। লোকটার পরিকল্পনা আঁচ করতে পেরেছে ও। টিকাউ সম্ভবত, যেভাবেই হোক, এখানে এরিখের উপস্থিতি সম্বন্ধে নিঃসন্দেহ হয়েছে এবং সে জন্যে নিচে কোথাও গা ঢাকা দিয়ে ওত পেতে থাকবে অ্যামবুশ করার জন্যে। অথবা চ্যাপম্যানের ধারণানুয়ায়ী প্রেতকে ট্রেইল করার অলৌকিক শক্তিবলে যদি ও এরিখকেও ট্রেইল করতে পারে স্রেফ পাথর শুঁকে, তাহলে রুইন্স ক্যানিয়নে ঢুকেছে—এবং ওখানেই অপেক্ষা করছে এরিখের জন্যে।

চোখ থেকে ফিল্ডগ্লাস নামাল ও, খাপে ঢোকাল ওটা, তারপর উঠে ঘুরপথে এগুলো রুইন্স ক্যানিয়নের দিকে। সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলেছে এরিখ; টিকাউ যদি ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের কোথাও ওত পেতে থাকে, তাহলে ওকে হতাশ হতে হবে। ক্যানিয়নের ঢালের ওপর দিয়ে হেঁটে গিয়েই ও রুইন্স ক্যানিয়নে নামবে। খুঁজলে ওদিক দিয়ে নামার জন্যে একটা পথ পাওয়া যাবে নিশ্চয়।

ঘণ্টা খানেক হাঁটার পর এরিখ রুইন্স ক্যানিয়নে পৌছল। একটা ভাঙাচোরা ধারে থামল ও, ঝোপঝাড়ের আড়াল হতে নিচের দিকে নজর দিল। শান্ত উপত্যকা। অস্বাভাবিক কিছু চোখে পড়ল না। টিকাউর চিহ্নও নেই।

নামার পথ খুঁজল এরিখ। খাড়া ক্যানিয়নের দেয়াল। প্রথমে প্রায় আশাই ছেড়ে দিল। এরকম খাড়া দেয়াল বেয়ে নামা, মানুষ দূরের কথা, সরীসৃপেরও অসাধ্য। আরও কিছুক্ষণ খুঁজতেই এক জায়গায় মোটামুটি ঢালু মনে হলো ওয়ালটাকে। ওখান দিয়ে নামার সিদ্ধান্ত নিল ও।

প্রায় আধঘণ্টা লাগল ঢাল বেয়ে নামতে। নেমে ক্লান্তিতে অবশ হয়ে যাওয়া শরীরটাকে বিশ্রাম দেবার জন্যে বসল ও কিছুক্ষণ। চোখ বুলাল আবার উপত্যকায়। দেয়ালের ছায়া পড়তে শুরু করেছে উপত্যকা সমতলে সন্ধে হতে বেশি দেরি নেই।

খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিয়ে উঠে দাঁড়াল ও, ঝোপের আড়ালে হাঁটতে লাগল আস্তানার দিকে; কাছাকাছি এসে থামল আবার। ঝোপ থেকে গলা বাড়িয়ে সন্তর্পণে পর্যবেক্ষণ করল চারদিক। বেরিয়ে এসে ফাঁকা জায়গায় দাঁড়াল।

একটু দূরে একটা মেস্কিট গাছের গোড়ায় চোখ পড়ল ওর। এগোল সেদিকে। কাঁচা গোবর। মাটিতে ঘোড়ার পায়ের ছাপ স্পষ্ট হয়ে আছে। টিকাউ তাহলে রুইন্স ক্যানিয়নে ঢুকেছিল!

আস্তানার দিকে এগোল এরিখ। একটু পরে জিস্টারকে দেখতে পেল। যেখানে বাঁধা ছিল, ওখানেই দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা। চুপচাপ। নিশ্চিন্ত হলো এরিখ। ওর সাড়া পেয়ে কান খাড়া করল জিস্টার, ডেকে উঠল অভ্যর্থনার সুরে। এরিখ কাছে গিয়ে আশ্বস্ত করল ঘোড়াটাকে, টুপি খুলে ক্যান্টিন থেকে পানি ঢেলে খাওয়াল; তারপর নিজের ঘরে ঢুকল।

খেতে বসল ও। খেতে খেতে পরিস্থিতি বিচার করল ঠাণ্ডা মাথায়। টিকাউ যে তার খোঁজেই এখানে ঢোকেনি, এ-ব্যাপারে ও এখন নিশ্চিত জিস্টারের এত কাছাকাছি পৌঁছেও ওটাকে দেখতে না পাওয়ার মানে হলো, ও ঘোড়াটাকে দেখার আশাও করেনি। অতএব অন্য কোন উদ্দেশ্য আছে দোআঁশলার।

কী সেটা? ভ্রূ কুঁচকাল এরিখ। সেটা জানতে হলে আপাতত চুপচাপ অপেক্ষা করতে হবে।

খাওয়া শেষ করে এরিখ ধূমপান করল। তারপর শুয়ে পড়ল কম্বল বিছিয়ে। আজ রাতে রকস্প্রিং যাবে ও। ওখান থেকে খাবার আর খবর দুটোই নিয়ে আসতে হবে। রকস্প্রিং এখন ওর জন্যে বিপজ্জনক, শেরিফ টের পেলে ছিঁড়ে খেতে আসবে। তবু ঝুঁকি নিতে হবে ওকে। উপায় নেই।

.

ঘণ্টা দুয়েক পর জাগল এরিখ ঘুম থেকে। রকস্প্রিং যাবার জন্যে তৈরি হয়ে বেরিয়ে এসে জিস্টারের কাছে দাঁড়াল ও। রাতের উপত্যকা জুড়ে ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। জিস্টারের পিঠে চড়তে গিয়ে হঠাৎ কান খাড়া করল ও। চারদিক থেকে রাতের নিজস্ব শব্দ ভেসে আসছে। ও চেনে এসব শব্দ। তবু এমন একটা অস্পষ্ট আওয়াজ ওর কানে এসে পৌঁছেছে, যেটা রাতের স্বাভাবিক শব্দের সাথে মেলে না।

শব্দটা আবার শোনার জন্যে কান খাড়া করে রইল এরিখ। কিন্তু আর শোনা গেল না। আপনমনে কাঁধ ঝাঁকাল ও। তারপর জিস্টারের পিঠে চড়ে চলতে লাগল সামনের দিকে।

ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে উত্তর দিকে খাঁড়ির পাড়ে পৌঁছল ও। জিস্টারকে খাঁড়িতে নামিয়ে পানি খাইয়ে নিল, তারপর খাঁড়ির পাড় ধরে রকস্প্রিঙের দিকে যাত্রা করল আবার। পুবাকাশে চাঁদের ক্ষীণাভাস দেখা দিয়েছে। স্বল্পালোকে আলোকিত হয়ে উঠেছে রকস্প্রিঙের রাস্তা। শহরের কাছাকাছি পৌঁছতে পৌঁছতে চাঁদ আকাশের অনেকখানি ওপরে উঠে এল। থামল এরিখ। রাস্তা থেকে খানিকটা দূরে একটা ঝোপের ভেতর জিস্টারকে বাঁধল, তারপর খাঁড়ির ভেতর দিয়ে শহরের দিকে এগোল।

শহরের বরাবর এসে খাঁড়ি থেকে উঠে এল এরিখ। অন্ধকার গলিপথ ধরে ক্র্যামারের দোকানের কাছে এসে উঁকি দিয়ে রাস্তার এমাথা থেকে ওমাথায় চোখ বুলাল। লোকজনের চলাচল নেই রাস্তায়, দোকানপাট সব প্রায় বন্ধ হয়ে গেছে। ওয়েস্টার্ন মূন সেলুন থেকে মাঝে-মধ্যে ভেসে আসা মাতালের হুল্লোড় ছাড়া আর কোথাও মানুষের সাড়া-শব্দ নেই।

ক্র্যামারের দোকানের সামনের দরজা বন্ধ। তবে আলোর আভাস দেখতে পেয়ে আশ্বস্ত হলো ও। ক্র্যামার জেগে আছে এখনও।

সাবধানে রাস্তা পেরিয়ে জেনারেল স্টোরটার পেছনে চলে এল এরিখ। জানালা দিয়ে উঁকি দিল দোকানের ভেতরে। ক্র্যামার একমনে হিসেব দেখছে। এরিখ চাপাস্বরে ডাকল, ‘ক্র্যামার!’

চমকে উঠে মুখ তুলল ক্র্যামার। ‘কে?’

‘আমি। এরিখ ওয়েন। দরজা খোলো।’

বিড়বিড় করে গাল বকল বুড়ো, দরজা খুলে সরে দাঁড়াল। এরিখ ভেতরে ঢুকে পড়ল। জেমস দরজা লকআপ করে জানালার শাটার নামিয়ে দিল দ্রুত।

‘গর্দভ নাকি তুমি!’ মৃদু স্বরে বকুনি লাগাল ও। ‘চারদিক চষে বেড়াচ্ছে হল আর তার চেলারা তোমার খোঁজে।’

এরিখ বসল, মৃদু হেসে বলল, ‘এখানে খোঁজার কথা ভাববে না।’

একটা বোতল নামিয়ে নিয়ে গ্লাসে মদ ঢালল জেমস। ‘তা ভাববে না।’ একটা গ্লাস এগিয়ে দিল ও এরিখের দিকে। ‘কিন্তু কপাল খারাপ হলে—যাক গে, যাচ্ছ কোথায় এখন?’

‘কোথাও না,’ গ্লাসে চুমুক দিল এরিখ। ‘আমি আশেপাশেই আছি, জেমস।

‘তুমি ফেঁসে গেছ, বাছা। ডগ লেইকার শত্রু হিসেবে একাই একশো। তার ওপর চ্যাপম্যানদের লেজে পা দিয়েছ ওদের একটা লোককে গুলি করে।’

‘আমি করিনি গুলি ‘

‘আমি ওরকমই শুনেছি।’

দোকানদারকে সব খুলে বলল এরিখ। মাথা দোলাল বুড়ো। ‘বিয়ারি শহরে এসেছিল আজ। পিস্তলবাজ ভাড়া করবে, বলে বেড়িয়েছে সবাইকে আমি রেঞ্জ ওয়ারের আশঙ্কা প্রকাশ করাতে আমার মুখের ওপর হেসেছে বেজন্মাটা!’

‘বিয়ারি গোলমেলে লোক,’ এরিখ মন্তব্য করল।

‘গোলমেলে নয় শুধু, উদ্ধতও। সারাক্ষণ মুখিয়ে আছে গোলমালের আশায়। এরিখ,’ উদ্বিগ্ন দেখাল ক্র্যামারকে, ‘ওয়েন্ডির জন্যে ভয় হচ্ছে আমার।’

এরিখ খালি গ্লাস বাড়িয়ে দিল দোকানদারের দিকে। ‘বিয়ারির আশা পূর্ণ হবে, জেমস। আর ওয়েন্ডি শক্ত মেয়ে। ক্ষতির সম্ভাবনা দেখলে বাঘিনীর মত রুখে দাঁড়াবে ও।’

গ্লাস নামিয়ে রেখে মুখ মুছল জেমস। ‘টোকার মারা গেছে, এরিখ।’

‘টোকার?’

‘মোট টোকার। যাকে তুমিই গুলি করেছিলে বলে জানে সবাই।’

তলপেটে শীতল অনুভূতি টের পেল এরিখ। তাহলে আর কী? একটা মার্ডার ওয়ারেন্ট জারি হতে যাচ্ছে আমার বিরুদ্ধে, এই তো?’

‘ঠিক তাই।’ ক্র্যামার ঝুঁকল এরিখের দিকে। হাড্ডিসার একটা হাত রাখল ওর হাঁটুতে। ‘এরিখ, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনও সুযোগই পাবে না তুমি। ডব্লিউ বারের লোকেরা তোমাকে ফুঁ দিয়ে উড়িয়ে দেবে। পালাও, এবার।’

এক হাতে ক্র্যামারের হাতটা সরিয়ে দিল এরিখ। শূন্য গ্লাসটি অন্যহাতে টেবিলে রাখল। ‘আমি পালাব না।’

‘তাহলে তোমাকে মরতে হবে, পেছন থেকে গুলি খেয়ে কিংবা ডেভিডের মত ফাঁসিতে ঝুলে।’

‘দুটোর একটাও পছন্দ নয় আমার।’

ওর চোখে তাকাল দোকানদার। ‘কেন থাকছ তুমি, ওয়েন?’

এরিখ সিগারেট ধরাল। ‘চ্যাপম্যানরা ওয়েন্ডি ক্লে’কে ভাগিয়ে দিক এখান থেকে, তা আমি চাই না। তাছাড়া, বিয়ারির সঙ্গেও আমার বোঝাপড়া রয়েছে। মোট টোকারকে ও-ই গুলি করেছিল, আমি নিষেধ করা সত্ত্বেও। অথচ এখন ও আর গাস ল্যামেল মিলে দোষ চাপিয়েছে আমার ঘাড়ে, যাতে আমি ক্রস অ্যারো র‍্যাঞ্চ থেকে দূর হই এবং চ্যাপম্যানের হাতে গ্রেফতার হই। বিয়ারির পরিকল্পনা কি, আমি জানি। ওর উদ্দেশ্য ক্রস অ্যারো র‍্যাঞ্চটা হাতিয়ে নেয়া। আমি তা হতে দেব না, জেমস।’

চেয়ারে হেলান দিয়ে চুপচাপ ওর কথা শুনে গেল জেমস। সিগার জ্বালাল এরপর। ‘তোমাকে বিশ্বাস করা উচিত বলে মনে হচ্ছে। কেন, তা জানি না। তবে লেইকারকে যে ধোলাই দিয়েছ, এজন্যে আমি খুশি। অনেকদিন থেকেই এটা ওর পাওনা ছিল। এরিখ, একটা কথা জেনে নিতে পারো। লেইকারের বিরুদ্ধে তুমি একা নও। এখানকার শান্তিপ্রিয় লোকেরা তোমার পক্ষে থাকবে। আরেকটা কথা—এবং সেটাই মুখ্য।’

‘কি কথা?’ এরিখ জানতে চাইল।

ক্র্যামার উঠল। দরজা খুলে বেরোল সে। ফিরে এসে দরজা আটকাল আবার। চেয়ার টেনে এরিখের কাছাকাছি গিয়ে বসল। চাপাস্বরে বলতে শুরু করল, ‘ছোট-বড় কয়েকটা র‍্যাঞ্চের মালিক রাসলিঙের বিরুদ্ধে জোট বেঁধেছে। এ জন্যে একজন স্টক ডিটেকটিভ ভাড়া করেছি আমরা।’

‘তোমরা?’

‘কয়েকটি ছোটখাট র‍্যাঞ্চে আমার টাকা খাটছে। এছাড়া গরু চুরির উপদ্রবে রকস্প্রিঙের ব্যবসা-বাণিজ্যও মার খাচ্ছে ভীষণ। আমার খদ্দেরদের মধ্যে ছোট র‍্যাঞ্চের মালিক আছে অনেক। তারা এখন ব্যবসা গুটিয়ে ফেলার কথা ভাবছে। ওরকম হলে আমার ব্যবসাও লাটে উঠবে। খদ্দের হারাব আমি। সে যা-ই হোক, আমাদের একজন লোক আছে জর্জ চ্যাপম্যানের র‍্যাঞ্চে।’

‘কে সে?’

‘তুমি চেনো ওকে। জো রীভস।’

‘জো রীভস!’

‘ভাল লোক,’ হাসল দোকানদার, ‘পিঙ্কারটনের হয়ে প্রচুর কাজ করেছে।’

‘ওয়াইওমিং আর কলোরাডো

রাইটা ভাল। এরিখ নিজের গ্লাস ভর্তি করে নিল। ‘কিছু বের করতে পেরেছে, জো?’

‘তেমন কিছু না। জর্জ চ্যাপম্যান যদি রাসলিঙে মদদ যুগিয়ে থাকেও, কোনও ভাবে সেটা প্রমাণ করা যাবে না।’

‘আর কে থাকতে পারে এর পেছনে?’ এরিখ স্বগতোক্তি করল।

‘সেটাই যদি জানতাম!’ হাত ওল্টালো জেমস ক্র্যামার হতাশার ভঙ্গিতে। ‘শুধু জানি, গরু হারাচ্ছি আমরা। এ পর্যন্ত পাঁচশো থেকে এক হাজারের মধ্যে হবে সর্বমোট।’

‘কোথায় থাকতে পারে ওগুলো?’

‘আমাদেরও সে-প্রশ্ন। এখান থেকে কয়েকমাইলের মধ্যে ওগুলোর কোন ট্র্যাক খুঁজে পাওয়া যায়নি। এতেই বোঝা যায়, ওগুলো এ অঞ্চলেই লুকানো আছে কোথাও।’

‘ঠিক আছে,’ সিদ্ধান্ত জানাল এরিখ। ‘আমিও আছি।’

সিগারের ধোঁয়া ছাড়ল ক্র্যামার। ‘তুমি আমাদের এসোসিয়েশনের হয়ে কাজ করবে?’

‘না। স্বাধীনভাবে কাজ করতে পছন্দ করি আমি।’

‘একা তুমি আর কতটা করতে পারবে, এরিখ? বরং আমাদের সাথে কাজ করলে সম্ভাব্য সব রকম সাহায্য পাবে তুমি।

এরিখ শ্রাগ করল। ‘তাহলে আলোচনায় আসা যাক। আমার কাজ কি হবে?’

‘নিজের সুবিধেমতন জায়গায় লুকিয়ে থাকবে। খোঁজখবর রাখবে। কিছু জানতে পেলেই আমাদের জানাবে।’

‘রীভস কি করবে?’

‘ওকে আমি জানাব তোমার কথা।

‘কতটা বিশ্বাস করা যায় ওকে?’

‘পুরোপুরি।’

‘ও কি এখনও ডব্লিউ বারে কাজ করছে?’

‘হ্যাঁ।’

ক্র্যামারকে নিজের জন্যে গ্লাস পূর্ণ করতে দেখল এরিখ। ‘অদ্ভুত!’

‘কোনটা?’ গ্লাসে চুমুক দিল দোকানদার।

‘ডব্লিউ বার রাসলিঙে আছে কি নেই—এটা বের করতে না পারাটা।’

‘চ্যাপম্যান চতুর, এরিখ। দারুণ চতুর।’

এরিখ উঠে দাঁড়াল। ‘আমি এখন যাব।’

‘তোমাকে কোথায় পাওয়া যাবে যোগাযোগ করার জন্যে?’

‘ব্রিজের নিচে, পশ্চিম পাশে, যেখানে ভ্যালি আর ক্রীক রোড মিলেছে। কোনও খবর থাকলে ওখানে রেখে দিলে আমি পাব। নাম-ধাম উল্লেখ কোরো না যেন।’

ক্র্যামার হাসল। কালকের ছেলে পেয়েছ আমাকে?’

স্টারটা বের করল এরিখ। এটার জন্যে কিছু কার্তুজ, স্পেন্সারের জন্যেও। এছাড়া বেকন, ময়দা, টিনের খাবার, শুকনো মাংস, তামাক, কফি আর লবণ চাই। ভাল রশি হবে তোমার কাছে?’

‘সব হবে।’

‘চমৎকার! একজন মানুষের ভার সইতে পারে এমন দেড়শো ফুট রশি চাই।’

অন্ধকারে হাতড়ে হাতড়ে থলে পূর্ণ করল ক্র্যামার। কাজশেষে এরিখের সামনে এনে রাখল মালপত্রে ঠাসা থলেটা। এক বোতল রাই বের করল সে। ‘রাতে ঠাণ্ডায় জমে যাবার হাত থেকে বাঁচার জন্যে এটা।’ হাসল বুড়ো দোকানদার।

এরিখও হাসল। ‘বিলটা তৈরি করো।’

লম্বা একটা হাত বাড়িয়ে এরিখের কাঁধে রাখল দোকানদার। ‘দাম দিতে হবে না।’

চোখে চোখে চাইল এরিখ, তারপর বলল, ‘ধন্যবাদ। এবার যাই।’

আলো নেভাল ক্র্যামার। সাবধানে থেকো। ভারি বিপজ্জনক কাজ এটা।’

অন্ধকারে হাসল এরিখ। ‘তবে নতুন নয়, এই যা। জেমস, আমি সিক্সথ টেক্সাসে একজন স্কাউট ছিলাম।

থলে তুলে নিল এরিখ, অন্ধকারে পা বাড়াল বাইরে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *