ছয়
পরের কটা দিন এরিখ বলতে গেলে ঘোড়ার পিঠেই কাটাল। র্যাঞ্চের চারপাশে ঘুরে ফিরে জায়গাটাকে জরিপ করল ও। ভাল, সম্ভাবনাপূর্ণ অঞ্চল, প্রচুর ঘেসো জমি, পানির অভাব নেই। যে কেউই আন্তরিকভাবে চাইলে এটা থেকে সোনা ফলিয়ে নিতে পারবে। বুড়ো ক্লে অভিজ্ঞ লোক ছিল, জায়গা চিনতে ভুল করেনি; চ্যাপম্যানও পাকা লোক, সন্দেহ নেই। গ্রাস করার জন্যে উপযুক্ত জায়গাই বাছাই করেছে সে।
এর মধ্যে ওয়েন্ডির সাথে ওর আর বিশেষ কথাবার্তা হয়নি। ওই দিন রাতে ওকে চুমু খেয়েছিল এরিখ। ওয়েন্ডি বাধা দেয়নি, তবে সাড়াও যে দেয়নি, এরিখ তা বুঝতে পেরেছে। মেয়েটা সম্ভবত আড়ষ্টবোধ করছে কিছুটা, অনুমান করল ও। এই কদিনের মধ্যে খাবার টেবিলে টুকটাক কথাবার্তা ছাড়া তাদের মধ্যে আর কোনও আলাপ-আলোচনা হয়নি
গাস আর চ্যানির যেদিন গরু নিয়ে দক্ষিণ থেকে ফেরার কথা, সেদিন বেলা কিছুটা বাড়ার পর এরিখ ঘোড়া নিয়ে খাঁড়ির কাছে গিয়ে উপস্থিত হলো। গাস আর চ্যানি ঠিক সময়েই এসে পৌঁছেছে। এরিখ গিয়ে ওদের গরুগুলোকে পানি খাওয়াতে দেখল। গরুগুলো কিছু সংকরসহ বেশিরভাগ হেয়ারফোর্ড, বাকি অল্প কয়েকটা দুরহাম।
গাস অভ্যর্থনা জানাল ওকে, বিক্রয়-রসিদ বের করে দেখাল, ‘কোন ঝামেলা হয়নি। নেট হলওয়ে ভাল লোক। বেছে বেছে সেরাগুলোই আনতে দিয়েছে।’
‘ওয়েন্ডি কেমন আছে?’ চোখ নাচাল চ্যানি
‘খুব ভাল।’ হুল ফোটাবার লোভ সামলাতে পারল না এরিখ। ‘কেবল দুশ্চিন্তা করছিল গরুগুলো তোমরা ঠিকঠাকমত নিয়ে আসতে পারো কিনা।
‘উঁহু,’ পাল্টা হুল ফোটাবার চেষ্টা করল চ্যানি, ‘মনে হচ্ছে, ও আমার অদর্শনেই উতলা হয়েছিল, ওয়েন।’
‘মোটেই না। তোমার অনুমান শক্তি এতই কম যে, প্রায় নেই বললেই চলে,’ হাসল এরিখ।
জ্বলে উঠল চ্যানি বিয়ারি। গাসের দিকে তাকাল সে। গাসও হাসল।
‘বাদ দাও,’ কাজের কথা পাড়ল গাস। ‘তারচে’ বরং গরুগুলো নিয়ে যাই।’
ওরা গরুগুলোকে উত্তরে উপত্যকার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে চলল। উপত্যকায় প্রবেশ-পথের কাছাকাছি পৌঁছতেই ওদিক থেকে জনাছয়েক অশ্বারোহীর একটা দলকে বেরিয়ে আসতে দেখা গেল। ঘোড়ার পেটে স্পার দাবিয়ে গরুর পালের সামনে চলে গেল এরিখ। অশ্বারোহীদের একজনকে চিনতে পেরেছে ও। ডগ লেইকার। নেতৃত্ব দিচ্ছে অশ্বারোহীদের।
কাছাকাছি হতেই লাগাম টেনে ঘোড়া থামাল লেইকার। হাসল এরিখের দিকে চেয়ে, এমনভাবে, যেন ওদের মধ্যে কখনও কিছু ঘটেনি। এরিখ লক্ষ করল, ওর মুখ থেকে মারের দাগ এখনও মিলিয়ে যায়নি।
‘তোমাদের সাথে কিছু গরু দেখছি?’ হাসিমুখে বলল লেইকার।
‘স্বীকার করছি, তুমি অন্ধ নও।
অন্য লোকদের দিকে চাইল এরিখ। ওদের একজন জো রীভস, বাকি চারজন অপরিচিত। শক্ত সমর্থ কঠোর মনে হচ্ছে লোকগুলোকে। জো রীভস খানিকটা দূরে একপাশে থামিয়েছে ওর ঘোড়া।
এর মধ্যে গাস চলে এসেছে এরিখের পাশে। ডগ লেইকার সিগারেট রোল করল। ‘বাটার বলগুলো, চোখ নাচিয়ে গরুর পালের দিকে ইঙ্গিত করল ও, ‘কোথায় পেয়েছ?’
‘নেট হলওয়ের কাছ থেকে কিনেছি,’ জবাব দিল গাস। এরিখের দিকে ফিরল ও, ‘চলো যাই।’
ডগ ওর লোকদের দিকে তাকাল, ‘আমরা আবারও চেকিঙে বেরিয়েছি, এরিখ।’ সিগারেট ধরিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল ও, ‘কয়েকদিন আগে মি. চ্যাপম্যানের বিশ-তিরিশটা গরু হারিয়েছে। ওগুলো খুঁজছি আমরা। কিছু মনে কোরো না, সম্ভবত এখানেও আমাদের খুঁজে দেখা উচিত।
গরুর পালের দিকে একটা হাত বাড়িয়ে দিল এরিখ। ‘এগুলোর গায়ে নেট হলওয়ের ব্র্যান্ড দেখতে পাবে। তাছাড়া, কাঁচা কাজ করেনি গাস। নেটের কাছ থেকে বিক্রির রসিদও নিয়ে এসেছে।’
‘তাই নাকি? ঠিক আছে।’ নিজের লোকদের দিকে চাইল ও। ‘তবু- এডি, জো, ম্যানিউ! এমনিই একটু চোখ বুলিয়ে নাও। এসেছি যখন।’ এরিখের দিকে ফিরল সে, ‘কি বলো?’
চ্যানি বিয়ারি পেছনে ছিল এতক্ষণ। ঘোড়া ছুটিয়ে এবার সামনে চলে এল। ডগ লেইকারের হুকুম তামিল করতে যাওয়া লোকগুলোর দিকে চাইল এক নজর, তারপর কর্তৃত্বের সুরে প্রশ্ন করল, ‘কি হচ্ছে এসব?’
‘কিছুই না,’ ডগ সহজ কণ্ঠে জবাব দিল। ‘এমনিই রুটিন চেক। কে ও এরিখ?’
‘চ্যানি বিয়ারি।’
‘তুমি ওদের দিচ্ছ চেক করতে?’ এরিখকে জিজ্ঞেস করল বিয়ারি।
‘ক্ষতি কি, এতেই যদি ওরা খুশি হয়?’ এরিখ নিস্পৃহ স্বরে বলল, ‘ডব্লিউ বারের লোকদের করার মত তেমন কোন কাজ নেই যখন।’
‘আমি দিচ্ছি না,’ বলেই পিস্তলের বাঁটে হাত দিল বিয়ারি। দুটো পিস্তল উঠে এল ওর দু’হাতে। ডগের দিকে তাক করে হুকুম করল, ‘ওদেরকে নিজের জায়গায় ফিরে যেতে বলো, বাঁটকুল মিয়া। আমার হাত কাঁপছে, রাগে। গুলি ছুটে যেতে পারে যে কোন মুহূর্তে। তাড়াতাড়ি বলো।’
শীতলচোখে ওর দিকে চাইল ডগ। তারপর এরিখের দিকে ফিরল। ‘তোমরা তাহলে পিস্তলবাজ ভাড়া করেছ?’
‘মিস ক্লে ওদের কাজ করার জন্যে রেখেছে,’ এরিখ জবাব দিল। চ্যানির দিকে চাইল ও, ‘পিস্তল নামাও, চ্যানি।’
চ্যানি ভেংচি কেটে থুতু ফেলল। ‘তুমি ভয়ে লেজ গুটিয়ে ফেলেছ। আমিই ব্যবস্থা নিচ্ছি তাই।
লেইকার সামান্য নড়ে হাত তুলে নিজের লোকদের নিরস্ত করল। চ্যানির দিকে তাকাল সে। ‘ওয়েন ভয় পায়নি, মিস্টার। কিন্তু তোমাকে হঠাৎ পিস্তল বের করতে বলল কে?’
‘কেউ বলেনি। আমার ইচ্ছেতেই চলি আমি,’ দাঁত বের করে হাসল ও। হুকুম পালিত হয়েছে দেখে খুশি। ‘কেউ যেতে পারবে না গরুর কাছে।
‘ত্যাদোড় লোক, না? বেশ,’ নিজের লোকদের দিকে ফিরল লেইকার, ‘চলো তোমরা। আরেক সময় এ-ব্যাপারে কথা হবে।’
‘আরেক সময় কেন? সাহস থাকলে এখনি বের করো পিস্তল!’ আস্ফালন করল বিয়ারি।
‘আমি পিস্তলবাজ নই,’ পিছিয়ে গেল ডগ।
গরুগুলো তত্ত্বাবধানের অভাবে পাল থেকে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়তে শুরু করেছে। গাস ওগুলোকে সামলানোর জন্যে পেছনে চলে গেল। ডগ ঘোড়া ঘুরাল। নিজের লোকদের নিয়ে চলে যেতে শুরু করল ও। গজ পঞ্চাশেক যেতেই ওদের একজন আচমকা ঘোড়া ঘুরিয়ে গুলি করল। মিস করল সে। বিয়ারি দ্রুত নড়ে উঠল। পিস্তল বের করে গুলি করতে গেল ও। এরিখ ওকে থামানোর জন্যে নিজের মাথার হ্যাট খুলে নিয়ে ওর পিস্তলে আঘাত হানল।
ততক্ষণে ট্রিগার টিপে দিয়েছে চ্যানি বিয়ারি। এরিখের হ্যাটের আঘাত বুলেটকে লক্ষ্যভ্রষ্ট করল। গজ দশেক দূরে মাটিতে বিধল গুলি। ধূলি উড়ল ওখান থেকে। বিয়ারি খিস্তি করল। এরিখের দিকে ফিরল সে। এরিখের হাতে পিস্তল।
‘তুমি আবার নাক গলালে কেন?’ খেঁকিয়ে উঠল বিয়ারি।
এরিখ শ্রাগ করল। ‘এমনিতে যথেষ্ট ঝামেলায় আছি আমরা,’ মাথা গরম ছেলেটাকে বোঝাবার প্রয়াস পেল ও। তুমি বেন থম্পসনের ভূমিকায় নামলে ওটা বাড়বে বৈ কমবে না।’
ডগ তার দলবলসহ কিছুটা দূরে চলে গেছে। চ্যানি সেদিকে তাকাল। ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল সে, ছুটতে ছুটতে গুলি করল। তারপর লাগাম টেনে ঘোড়ার গতি রোধ করল।
ডগের দলের একজন চিৎকার করে উঠল। নিজের কাঁধ খামচে ধরেছে লোকটা। ডগ থামল না, হাত নেড়ে নিজের লোকদের তাড়া দিয়ে দ্বিগুণ বেগে ঘোড়া ছোটাল।
ঘোড়া ঘুরিয়ে এরিখের পাশে চলে এল চ্যানি বিয়ারি। রাগে মুখ বিকৃত হয়ে আছে ওর। পিস্তল উঁচিয়ে ও এরিখকে শাসাল, ‘ফের যদি তুমি ওরকম কিছু করো, তোমাকে খুন করব আমি।’
গাস ঘোড়া ছুটিয়ে ওদের মাঝখানে চলে এল। ‘তোমার হয়েছেটা কি, চ্যানি। ঠিকই করেছে ও। এ মুহূর্তে বন্দুকবাজির চেয়ে আমাদের জন্যে জরুরী গরুগুলোকে ছড়িয়ে পড়তে না দেয়া।
চ্যানি পাত্তা দিল না বুড়োকে। একদৃষ্টে তাকিয়ে এরিখের প্রতিক্রিয়া লক্ষ করছে ও। এরিখ নির্বিকার। অপেক্ষা করল চ্যানি, তারপর পিস্তল খাপে ঢোকাল। ‘স্টা বুয়েনো।’ মৃদু কণ্ঠে বলে গরু সামলাতে চলে গেল সে।
খুব বাড়াবাড়ি করছে ও, গাস,’ এরিখ শান্তস্বরে মন্তব্য করল।
সিগারেট রোল করল গাস। ‘গরুর জন্যে যাবার পর থেকে শুধু মেয়েটার কথাই বলছে। ভেবে বসে আছে যেন মিস ওয়েন্ডিকে রক্ষা করার সব দায়িত্ব তারই।
‘ওদের একজন মারাত্মক চোট পেয়েছে মনে হচ্ছে। এটা ঝামেলা ডেকে আনবে,’ এরিখ শুকনো স্বরে বলল।
‘বাদ দাও,’ কাঁধ ঝাঁকাল গাস, ‘চলো, গরুগুলো নিয়ে যাই।’
‘ওগুলো র্যাঞ্চ হাউসের কাছাকাছি নিয়ে রাখব। আরও লোক যোগাড় করার আগে পাইনস ভ্যালিতে রাখা ঠিক হবে না।’
‘মাত্তর পঞ্চাশটা গরু!’ হাসল গাস।
‘এ-ই অনেক। এরিখ হাসল না। ‘তুমি একবার গরুচোরদের দেখিয়ে দাও গরুগুলো তোমার আছে, ওগুলো রক্ষণাবেক্ষণের শক্তিও তোমার আছে। পরবর্তীতে তুমি যদি গরুর স্টক আরও বাড়িয়ে দাও, তাহলে তার সাথে তোমার শক্তিও যে বেড়েছে, এটা আপনা থেকেই বুঝে নেবে ওরা।’
‘মনে হয়,’ সায় দিল গাস, ‘তোমার কথাই ঠিক।’
.
এরিখের অপেক্ষায় ছিল ওয়েন্ডি। এরিখ লিভিং রুমে গিয়ে ওর সাথে দেখা করল। হাসল সে। ‘গরুগুলো র্যাঞ্চ হাউসের কাছে নিয়ে এসেছি, ম্যাম। পাইনস ভ্যালিতে রাখা ঠিক হবে না এখন। আরও কিছু লোক রাখা উচিত এবার আমাদের।’
‘কেন?’ ওয়েন্ডিও হাসল, ‘ঠিক আছে, না হয় একজন রাঁধুনি রাখা যাবে।’
‘না,’ মাথা নাড়ল এরিখ। ‘রাঁধুনির দরকার হবে না। আমাদের যা আছে, তার দেখাশোনার জন্যে আমরাই যথেষ্ট। তবে চুরি ঠেকাতে হলে আরও লোকের দরকার হবে।’
‘না, এরিখ। লোক বাড়লে শুধু খুনোখুনিই বাড়বে। আমি বরং আগের মত হলেও খুশি।’
‘তোমার যেটা ইচ্ছা,’ এরিখ বলল নিচু স্বরে।
‘কোন ঝামেলা হয়েছিল আনতে?’
এরিখ ইতস্তত করল। ‘লেইকারের সঙ্গে দেখা হয়েছিল পথে। পাঁচজন লোকসহ আমাদের পাশ কাটিয়ে গেছে,’ পুরো ঘটনা বলল না ও।
‘সত্যি কোনও ঝামেলা হয়নি তো?’ ওয়েন্ডির গলায় উদ্বেগ
‘মোটেই না।’
ওয়েন্ডি চুপ থাকল কিছুক্ষণ। একসময় এরিখের পাশে এসে দাঁড়াল। ‘তুমি অনেক করেছ, এরিখ,’ কোমল স্বরে বলল ও।
এরিখ ওকে কাছে টানল। ওদিনের মত জড়তা নেই আজ ওয়েন্ডির মধ্যে। ওর ঠোঁটে চুমু খেলো এরিখ। আস্তে করে নিজেকে মুক্ত করে নিল ওয়েন্ডি। এরিখ জানালার দিকে চাইল। কেউ একজন খুব দ্রুত সরে গেল ওখান থেকে। কপালে ভাঁজ পড়ল ওর
ওয়েন্ডির দিকে ফিরল এরিখ। নতমুখে দাঁড়িয়ে আছে মেয়েটি। তৃপ্তির হাসি ওর ঠোঁটে।
তুমি একদম চিন্তা কোরো না, ওয়েন্ডি,’ আশ্বাস দিল এরিখ মেয়েটিকে। ক্রস অ্যারোকে আমরা দাঁড় করাবই।’
‘বাবা বেঁচে থাকলে,’ বিষণ্ন মুখে বলল ওয়েন্ডি, ‘তোমাকে ঠিকই কাজে লাগাতে পারত। বেচারী সারা জীবন একাকী লড়ে গেল।’
‘হত্যাকারীকে একদিন না একদিন খুঁজে বের করবই আমরা।’
এগিয়ে এসে নিজে থেকে এবার চুমু খেলো ওয়েন্ডি। ‘জানি, এরিখ। আমি জানি।’ সরে গেল আবার।
নিজের ঠোঁটে আলতো করে আঙুল বুলাল এরিখ। ‘বাটলারের খবর কি? এসেছিল আর?’
‘না, ওয়েন্ডি হাসল, মনে হয়, আমার মুখ আর দেখবে না বলে পণ করে ফেলেছে।’
‘ফেলুক। ওকে ছাড়াও চলবে তোমার।’
বারান্দা পেরিয়ে উঠানে নামল এরিখ, বাঙ্কহাউসের বারান্দায় গিয়ে উঠল। চ্যানিকে দেখল ও, বসে বসে নিজের অস্ত্রের পরিচর্যা করছে। এরিখের সাড়া পেয়ে চোখ তুলল, পলকের জন্যে স্থির দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে, তারপর চোখ নামিয়ে নিজের কাজে মন দিল আবার। এরিখের যা বোঝার, সে-জন্যে ওইটুকুই যথেষ্ট। বিয়ারির চোখে নগ্ন ঘৃণা আর তীব্র বিদ্বেষ ছাড়া আর কিছু নেই।
সন্ধে হলো। উপত্যকার রাস্তায় হঠাৎ ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনল এরিখ। দ্রুত পায়ে উঠান পেরিয়ে বাইরে বেড়ার কাছে এগোল ও। কোমরে আটকানো কোল্টের খাপে হাত বুলিয়ে নিল একবার। চ্যানি রান্নাঘরে। ডিনারের পর ওয়েন্ডিকে ধোয়া মোছায় সাহায্য করছে।
ছয়জন লোক গেটের কাছে এসে ঘোড়া থামাল। সবার সামনে শেরিফ চ্যাপম্যান; নেতৃত্ব দিচ্ছে। হাঁসফাঁস করে ঘোড়া থেকে নামল মোটা লোকটা, এগিয়ে আসতে আসতে ঘাড় ফিরিয়ে একবার নিজের লোকদের দেখে নিল। সন্দেহমুক্ত হলো, ওরা আছে পেছনে।
ডগকে দেখল এরিখ। ঘোলাটে চোখ দুটো মেলে ওর দিকে চেয়ে আছে বাঁটকুল। একজন লম্বা, পাতলা লোক কুঁজো হয়ে বসে আছে একটা ধূসর রোয়ানের পিঠে। লোকটার এক হাত গলার সাথে বাঁধা। দুপুরে বিয়ারির গুলিতে আহত লোকটাই, অনুমান করল এরিখ।
‘শেরিফ হল চ্যাপম্যান! কি খেদমত করতে পারি তোমার?’ ব্যঙ্গ মেশানো কণ্ঠে প্রশ্ন করল এরিখ।
ওর কথায় কান দিল না শেরিফ। মোটা থ্যাবড়া বুড়ো আঙুলটা উচিয়ে আহত লোকটার দিকে নির্দেশ করল সে, ‘তুমি, অথবা তোমাদের কেউ একজন ডব্লিউ বারের এই লোকটাকে বিনা উস্কানিতে গুলি করে আহত করেছ। মারাও যেতে পারত ও। আমি অপরাধীকে ধরে নিয়ে যেতে এসেছি।’
ডগ এগিয়ে এল। তথ্য যোগাল সে, ‘ওটা ওয়েন, শেরিফ। আমি ওকে গুলি করতে দেখেছি।
‘তুমি একটা জঘন্য মিথ্যুক, লেইকার!’ এরিখ প্রতিবাদ করল।
চ্যাপম্যান বাড়ির ভেতরে তাকাল। ‘কে কে আছে ওখানে?’
‘মিস ক্লে আর চ্যানি বিয়ারি নামের নতুন একজন কাজের লোক।’
‘গরুর সাথে কে আছে?’
‘গাস ল্যামেল।’
‘ডাকো ওদের, আদেশ দিল শেরিফ। ‘দাঁড়াও, তুমি না। নিজের লোকদের একজনের দিকে ফিরল, ‘জো, তুমি যাও। ল্যামেলকে নিয়ে এসো।’
ওয়েন্ডি আর চ্যানি ততক্ষণে বেরিয়ে এসেছে ভেতর থেকে। এরিখের পেছনে দাঁড়াল ওরা। ওয়েন্ডিকে উদ্বিগ্ন দেখাচ্ছে, চুপচাপ দেখছে ও সবাইকে। একটু পরেই গাস এল, একা।
‘আমার লোক কই?’ শেরিফ জানতে চাইল।
‘গরুর কাছে রেখে এসেছি।’ জবাব দিল গাস। এরিখের দিকে চাইল। ‘ব্যাপার কি?’
চ্যাপম্যান গলা খাঁকারি দিল সবার মনোযোগ আকর্ষণ করার ভঙ্গিতে। ‘এখন বলো।’ আহত লোকটাকে দেখাল সে। ওকে কে গুলি করেছে?’
‘আমি তো আগেই বলেছি যে, ওয়েন… শুরু করল ডগ।
গাস ওকে বাধা দিল। ‘ওরাই আগে গুলি করেছে, শেরিফ।’
‘কাকে?’ প্রশ্ন করল শেরিফ।
‘আমাদের কারও গায়ে গুলি লাগেনি। গাস একটু থামল। তবে ওদের দিক থেকেই প্রথম গুলির শব্দ আসতে শুনেছি।’
‘গুলি কে করেছে দেখোনি?’
‘না। আমি তখন গরু সামলাচ্ছিলাম।’
বিয়ারির দিকে তাকাল শেরিফ। ‘তুমি কি দেখেছ?’
‘ওরা গুলি করাতে আমিও পিস্তল বের করতে যাচ্ছিলাম। ও,’ এরিখের দিকে ইঙ্গিত করল বিয়ারি। ‘আমাকে থামায়। ওরা চলে যেতে থাকে। হঠাৎ ও নিজেই ওদের তাড়া করে পেছন থেকে গুলি চালায়। ওতেই— ‘
‘মিথ্যে কথা বলছে ও,’ এরিখ আবারও প্রতিবাদ জানাল।
‘ও সত্যি কথাই বলেছে, শেরিফ, ডগ মাথা নাড়ল। ‘ওয়েনই আমাদের দিকে গুলি ছুঁড়েছিল।’
এরিখ বুঝতে পারল ফেঁসে গেছে। ঠাণ্ডা একটা ভয়ের অনুভূতি গ্রাস করল ওকে। ওয়েন্ডির দিকে চেয়ে দেখল, মেয়েটি অবাক হয়ে ওকেই দেখছে। হতাশা বোধ করল এরিখ। গাসের দিকে ফিরল সে, ‘কি দেখেছ তুমিই বলো, গাস।’
গাস মাথা নিচু করল। শীর্ণহাতে নিজের চোয়াল ঘষল। ‘এরিখ, আমি ঠিক নিশ্চিত নই যদিও, তবু আমার মনে পড়ছে, তুমি- মানে তোমার হাতেই যেন একটা পিস্তল ছিল— ধোঁয়া বেরোচ্ছিল ওটার মুখ দিয়ে।’
শেরিফ চ্যাপম্যান বিজয়ীর দৃষ্টিতে তাকাল এরিখের দিকে। এগিয়ে এল সে। তাহলে ওয়েন, এই ব্যাপার? তোমাকে আমাদের সাথে যেতে হবে। ওয়ারেন্ট আছে আমার কাছে।
প্রকাণ্ড একটা হাত বাড়াল শেরিফ, ‘তোমার পিস্তল জমা দাও, প্রথমে।’ এরিখ পিস্তল বের করে দিল। চ্যানির দিকে চাইল ও। ‘তোমার সাথে বোঝাপড়া হবে, অপেক্ষা কোরো। সত্যি কথা বলার পুরস্কার থেকে, কথা দিচ্ছি, বঞ্চিত হবে না তুমি।’
চ্যানি অবাক হবার ভান করল, ‘আমি শুধু যা দেখেছি, তা-ই বললাম। গাসও তাই বলেছে।’
গাসের দিকে চাইল এরিখ, ‘কেন সত্যি কথা বললে না, ল্যামেল? কার ভয়ে?’
গাস ল্যামেল সরে দাঁড়াল একটু। ‘যা জানি, তা-ই বলেছি আমি।’ এরিখের দিকে তাকাল না সে।
‘ওর ঘোড়াটা নিয়ে এসো, গাস,’ শেরিফ অনুরোধ জানাল।
ওয়েন্ডি এগিয়ে এল এরিখের কাছে। ‘তুমি আমার কাছে মিথ্যে বলেছ, ওয়েন। তুমি খুনোখুনিকে ঘৃণা করো বলেছিলে।
এরিখ কোমল কণ্ঠে বলল, ‘আমি গুলি করিনি, ওয়েন্ডি। আমি বরং—’ ওয়েন্ডি ঘুরে দাঁড়াল, ধীরে ধীরে ঘরের দিকে পা বাড়াল ও। গাস এরিখের ঘোড়া নিয়ে এল করাল থেকে।
‘চলো,’ চ্যাপম্যান আদেশ দিল।
ঘোড়ায় চড়ল এরিখ। উপত্যকা বেয়ে নামতে লাগল ওরা সবাই। জো এসে যোগ দিল একটু পরেই। এরিখের পেছনে দু’জন অশ্বারোহী, বাকিরা সামনে। আহত লোকটার মাথা নুয়ে পড়েছে যন্ত্রণায়। এক হাতে কাঁধের ক্ষত চেপে ধরে কোনমতে বসে আছে ও ঘোড়ার পিঠে। এরিখ ভেবে পেল না লোকটার চিকিৎসার ব্যবস্থা না-করে তাকে এতদূর পর্যন্ত টানা হেঁচড়ার কি দরকার ছিল। এ অন্ধকার রাতে বন্ধুর পথে রকস্প্রিং পৌছতে পৌঁছতেই মনে হয় ওর জান বেরিয়ে যাবে।
দক্ষিণ দিকে এগিয়ে চলল ওরা। এরিখের মাথায় ঝড়ের বেগে চিন্তা চলছে। এরা ওকে ভয়ঙ্কর লোক হিসেবেই জানে। ওদের এ-ভীতিবোধটাকে নিজের কাজে লাগাতে হবে। কেন যেন ওর মনে হলো, বিচার করার জন্যে এ-জীবনে ওকে রকস্প্রিঙে নিয়ে যাবার সম্ভাবনা নেই। পথে গুলি করে মেরে ফেলে শহরে গিয়ে রটিয়ে দেয়া হবে যে, আসামী পালাবার চেষ্টা করায় তাকে ওরা গুলি করতে বাধ্য হয়েছে। এটা অবিশ্বাস করবে না কেউ।
‘লে ডেল ফুয়েগো।’ অভিজ্ঞতা থেকে স্মরণ করল এরিখ। এটা একটা মেক্সিকান পদ্ধতি। সীমান্তের ওদিকে যথেষ্ট দেখেছে ও। প্রথমে পালিয়ে যাবার সুযোগ দাও এবং পালাবার সময় গুলি করো।
নীরবে, দ্রুত এগিয়ে চলল ওরা। এরিখ পালাবার কোন সুযোগ পাচ্ছে না। প্রতি মুহূর্তেই ওর আশঙ্কা হতে লাগল, এই বুঝি ওর ধারণা সত্যি বলে প্রমাণিত হয়। এক সময় ওরা রকস্প্রিঙের রাস্তায় গিয়ে পড়ল। এরিখের সন্ধানী চোখ সুযোগটা দেখতে পেল মুহূর্তেই।
ক্রীকের এক পাড় ধরে রকস্প্রিঙের রাস্তা; অপর পাড়টা ঘন ঝোপঝাড়বেষ্টিত জঙ্গল। অন্ধকার; পুরাকাশে চাঁদের ক্ষীণাভাস জেগেছে মাত্র। এই সময় চ্যাপম্যান ডাকল লেইকারকে। লেইকার ঘোড়ার পেটে স্পার দাবিয়ে শেরিফের পাশে চলে গেল। বারকয়েক এরিখকে দেখে নিয়ে নিচু স্বরে আলাপ জুড়ল ওরা। হৃৎপিণ্ডের গতি বেড়ে গেল এরিখের। ওর অনুমান তাহলে সত্যি হতে চলল!
জিনের ওপর নড়েচড়ে বসল এরিখ। লক্ষ করল, ওর পেছনের লোকটা সিগারেট রোল করছে মনোযোগের সাথে। নির্দয়ভাবে স্পারের গুঁতো লাগাল ও জিস্টারের পেটে, ডাকাতে হুঙ্কার ছাড়ল আচমকা। পেছনের লোকটার হাত থেকে সিগারেট পড়ে গেল। বিড়বিড় করে গালাগাল দিতে দিতে চমকে ওঠা ঘোড়াটাকে সামলাতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল লোকটা। ওরা সচকিত হয়ে গুলি করার আগেই জিস্টার ক্রীকের পানিতে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটা গুলি এরিখের হ্যাটের ব্রীম ছুঁয়ে উড়ে গেল। প্রাণপণে সাঁতার কেটে ক্রীকের ওপারে গিয়ে উঠল জিস্টার। অন্ধকারে পেছন থেকে আগুনের হলকার সাথে শব্দ শোনা গেল কয়েকবার। এরিখের সামনে ঝোপঝাড়ে বিদ্ধ হলো বুলেটগুলো। পেছন থেকে শেরিফ চ্যাপম্যানের কর্কশ গলা শোনা গেল। ‘ওর পেছনে ছোটো!’
ঝোপঝাড় ভেঙে এগোতে লাগল জিস্টার। খোঁচা খাওয়ার হাত থেকে বাঁচার জন্যে এক হাতে মুখ ঢেকে ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল এরিখ জিস্টার একটা ঢালুমতন জায়গা বেয়ে নিচে নামল। এরিখের মাথার ওপর দিয়ে শিস কেটে গেল কয়েকটা বুলেট।
পেছনে ঝরনার পানিতে আওয়াজ শোনা গেল। আরেকটা ঢালে গিয়ে উঠল এরিখ। এক মুহূর্তের জন্যে একদম খোলা জায়গায় গিয়ে পড়ল জিস্টার। পেছনে গুলির শব্দ শোনা গেল। এরিখের বুটের হীলে ছোবল বসাল একটা বুলেট।
খোলা জায়গাটা একটা তৃণভূমি। ওটা পেরিয়ে পেছনে ফিরল এরিখ। চারজন লোক তৃণভূমির ওপারে এসে পৌঁছেছে। আরেক ঝাঁক গুলি ছুটে এল পেছন থেকে। জিস্টার ততক্ষণে একটা ট্রেইলে গিয়ে পড়েছে, পেছনের লোকগুলোর দৃষ্টি থেকে অদৃশ্য হয়ে গেল ও।
ধাওয়াকারীদের ঘোড়ার খুরের শব্দ এগিয়ে আসতে শুনল এরিখ। একটা খাড়া ঢাল পেয়ে ওটা বেয়ে উঠে গেল ও, তারপর বিপজ্জনক ভঙ্গিতে পিছলে ওপাশে নামল। শুকনো খটখটে পাথুরে জমি। কিছুদূর গিয়ে বামে তাকিয়ে অন্ধকারে আবছাভাবে একটা ক্যানিয়নের মুখ দেখে ঘোড়া ছোটাল ওদিকে। মনে মনে প্রার্থনা করল, বক্স ক্যানিয়ন যেন না হয়।
ক্যানিয়নের বাইরে ওদের হৈ-চৈ শোনা গেল। একটু পরেই ক্যানিয়নের পাশ দিয়ে ছুটন্ত ঘোড়ার শব্দ মিলিয়ে গেল। অপেক্ষা করল এরিখ, তারপর ঝোপঝাড় মাড়িয়ে ঘোড়া ছোটাল দক্ষিণে। প্রায় আধঘণ্টা পর থামল এক জায়গায়। কান পাতল, কোন সাড়াশব্দ নেই পেছনে। চাঁদ উঠেছে আরও পরিষ্কার হয়ে; চারদিকে কবরের নীরবতা। দক্ষিণে গেল ও, থেমে নিঃশ্বাস ফেলল। আজ থেকে ও একজন আউট-ল। অথচ অস্ত্র বলতে এ মুহূর্তে ওর কাছে একটা পিস্তল পর্যন্ত নেই। হল চ্যাপম্যান পেছনে লেগে থাকবে জোঁকের মত। ওকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আগ পর্যন্ত শান্তি পাবে না সে। এদিকে চ্যানি বিয়ারি নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করবে এরিখের জায়গায়। এ জন্যেই সুযোগ পেয়ে ওকে ফাঁসিয়েছে ছোকরা। সবচে’ খারাপ কথা, ওর ভালবাসার নারীর মনে ঢুকে গেছে সন্দেহের বীজ। ঈর্ষাতুর ওই ছোকরা দারুণ মওকা পেয়েছে। এরিখ নিজের ভেতরে গোয়ার্তুমির আভাস পেলো। ও একজন আউট-লয়ে পরিণত হয়েছে। যা করার, এখন থেকে একাই করতে হবে ওকে।