আশ্রয় – ১২

বারো

রুইন্স ক্যানিয়ন থেকে মাইল কয়েক উত্তরে ঘন জঙ্গলে ঢাকা একটা ব্রাঞ্চ ক্যানিয়নে গিয়ে পৌছল এরিখ আর গাস। গাস কাজের লোক। বন থেকে কাঠ কেটে নিয়ে দু’জনের বাসোপযোগী একটা ঘর বানিয়ে ফেলল ও দু’দিনের মধ্যে। এরিখ একটা বড়সড় হরিণ শিকার করল। দক্ষ হাতে ওটার চামড়া ছাড়িয়ে নিল গাস। প্রচুর মাংসের স্টক হয়ে গেল দু’জনের জন্যে। ভেজে নিল ওরা মাংসটা, নষ্ট হবে না আর। আগামী কয়েক দিন রোস্ট করা ঠাণ্ডা মাংস খেতে মন্দ লাগবে না। ঘরের পাশে সামান্য দূরে একটা অগভীর ঝরনা ওদের পানির প্রয়োজন মেটাবে।

দিনের পর দিন, রাতগুলোয় খুব ঠাণ্ডা পড়তে শুরু করল। শীত এসে গেছে। এরিখ যত দ্রুত সম্ভব এই ক্লান্তিকর খেলার অবসান ঘটাবার জন্যে ব্যস্ত হয়ে উঠল। এ রকম উন্মুক্ত পরিবেশে শীত কাটানো ক্রমশ অসম্ভব হয়ে উঠছে।

তৃতীয় দিন সন্ধেয় আগুনের ধারে বসে ওরা পাইপ ধরাল। বনের মাথায় সরু চাঁদের আভাস; ওদিক থেকে চোখ ফিরিয়ে গাস বলল, ‘শ’ শ’ গরু স্রেফ ধোঁয়ার মত হাওয়ায় মিলিয়ে যাচ্ছে। ব্যাপারটা অদ্ভুত, এরিখ। তবে তার চেয়ে অদ্ভুত হলো তোমার ব্যাপারটা। আমার বিবেচনায় এখানকার যে কারও চেয়ে সৎ লোক তুমি। আর তোমাকেই কি না বনেবাদাড়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তিন-তিনটা খুনের দায় ঘাড়ে নিয়ে। এর মধ্যে দুটো তুমি আদপেই করোনি। আর যেটা করেছ, সেটা স্রেফ আত্মরক্ষার খাতিরে।’

নিভে যাওয়া পাইপটা ধরিয়ে নিল গাস আগুন থেকে। ‘এ-জায়গার ধারাই সম্ভবত এ রকম। রাসলিঙের বিরুদ্ধে কাজ করতে গিয়ে দু’জন সৎ ও পরিশ্রমী লোককে ফাঁসিতে ঝুলতে হয়েছে। এটা আমাকে কষ্ট দিচ্ছে খুব।’

‘চ্যানিকে কতটা চেনো তুমি, গাস?’ এরিখ প্রশ্ন করল। ‘তোমার কি মনে হয় না রাসলিঙের সঙ্গে ওরও যোগসাজস থাকতে পারে? এমনও তো হতে পারে, নিজেদের গরুগুলো ওরা নিজেরাই সরিয়েছে সে-রাতে। নতুন লোকগুলো এতে ওকে সাহায্য করেছে এবং পরে সন্দেহের ঊর্ধ্বে থাকার জন্যে গরুচোরদের ধাওয়া করার নামে ব্লু বার্ডস ঘুরে এসেছে। পারে না?’

ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল গাস। ‘না, মনে হয় না। এটা বলছি না যে, অন্যত্র সে এ ধরনের কাজে জড়িত ছিল না। তবে আমার জানামতে নয়। কিন্তু এখানে সে একদম পরিষ্কার। ওর উদ্দেশ্য ভিন্ন। এখানে র‍্যাঞ্চটাই ওর টার্গেট, মেয়েটাসহ।’

সামান্য ইতস্তত করল এরিখ। তুমি ওকে ভয় পাও, গাস,’ শেষ পর্যন্ত বলে ফেলল ও। ‘কেন? কী জানে ও তোমার?’

পাইপের গোড়া দিয়ে নাক চুলকাল বুড়ো কাউবয়। ‘গত বছর বিগরক ভ্যালির ওদিকে আমি একটা কাজ করেছিলাম।’

‘কি কাজ?’

‘শুনলে নিশ্চয়ই খারাপ ভাববে আমাকে?’

‘বলে ফেলো একবার চোখ বুজে। বুড়োকে উৎসাহ যোগাল এরিখ ‘শোনার পর ভাবব কী ভাবা যায়।’

লাজুক হাসল গাস। ‘একটা পে-মাস্টার অ্যাম্বুলেন্স লুট করেছিলাম আমি।’ চোরাচোখে এরিখের দিকে চাইল ও। এরিখের মুখে কৌতুকের চিহ্ন। হাসছে সে।

‘প্রায় দশ হাজার ডলারের মামলা,’ শুরু করল বুড়ো। পাত্তা দিচ্ছে না সে আর এরিখের হাসিকে। ‘কাজটা ঝোঁকের বশেই করেছিলাম। ওই সময়ে আমার অবস্থা খুব খারাপ যাচ্ছিল, টাকা-পয়সার দিক থেকে। তাই একদিন সেলুনে বসে মদ খেতে খেতে প্ল্যানটা করেছিলাম। আসলে তখন পুরোপুরি মাতাল ছিলাম আমি। টাকাটা সহজে হাতিয়ে নিতে পারলেও পরে ট্রুপারদের তাড়া খেয়ে সীমান্তের দিকে পালাচ্ছিলাম। উদ্দেশ্য, সীমান্ত পেরিয়ে যাব। ইতোমধ্যে আহত হয়েছি ট্রুপারদের গুলিতে এবং আমার মধ্যে, যাকে বলে, বিবেকের দংশন শুরু হয়ে গেছে। এক পর্যায়ে সনোরার কাছে এক ছোট্ট শহরের মার্শালের অফিসে ঢুকে চুপি চুপি টাকাটা রেখে আসি আমি। এরপর ওখানকার ক্যান্টিনায় বিয়ারির সাথে পরিচিত হই। সীমান্ত পেরোতে যাচ্ছি এবং সে জন্যে আমার সাহায্যের দরকার জানতে পেরে ও নিজেই সাহায্যের প্রস্তাব দেয়।

নিভন্ত অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে এক নাগাড়ে কথাগুলো বলে গেল গাস। থামল ও।

‘এরপর?’

কাঁধ ঝাঁকাল বুড়ো। ‘সে-রাতে আবার মদ খেয়ে মাতাল হয়ে প্রচুর বক বক করলাম। মাতাল না হয়ে উপায়ও ছিল না। আসলে আমার সে সময়ের মানসিক অবস্থা তোমাকে বুঝে নিতে হবে। একদিকে নগদ টাকার লোভ, অন্যদিকে বিবেকের দংশন—দুটো মিলে আমাকে অস্থির করে তুলেছিল। যাহোক, মাতাল অবস্থায় চ্যানির সাথে প্রচুর গল্প করি। পেটের কথা সব হড়বড় করে বেরিয়ে পড়েছিল তখন। না-বেরোলেও শান্তি পেতাম না। তুমি জানো, মানুষ যেমন কোন কোন সময় নীরবতা পছন্দ করে, তেমনি একেক সময় কথা বলতে পারলেই বর্তে যায়। আমারও সে-অবস্থা হয়েছিল ওদিন।’

পাইপে টান দিল ও। নিভে গেছে। ছাই ঝেড়ে নতুন তামাক ভরল ওটায়। ‘ও-রাতেই টাউন মার্শাল খুন হলো আততায়ীর হাতে। খবর পেয়ে দেখতে যাই আমি। মার্শালের সাথে টাকা-পয়সা ছিল কি না এবং সেগুলো এখন কার হাতে, কিছুই কাউকে জিজ্ঞেস করতে পারলাম না। কারণ ওতে নিজেরই ফেঁসে যাবার আশঙ্কা ছিল। আমার কথা কেইবা বিশ্বাস করত? সাধারণ একজন ভবঘুরে কাউহ্যান্ড ছাড়া আর কিছু তো নই আমি।

‘যাহোক, চ্যানি আমাকে নিয়ে নিরাপদে সীমান্ত পেরোয়। এরপর থেকে আমার সাথেই থাকে ও। তাকে কয়েকবার এড়াতে গিয়েও পারিনি সারাক্ষণই ওর নজর থাকত আমার ওপর। এই সময় হঠাৎ ও প্রচুর টাকা খরচ করতে শুরু করে। ছয় মাস পর আমরা আবার সীমান্তের এপারে আসি। এরপরও ও আমাকে ছাড়েনি। আসলে ওর ছোটখাট কাজ-কর্ম করার জন্যে একজন লোকের দরকার ছিল এবং সেসব ও আমাকে দিয়ে করাত। পালাবার চেষ্টা করলে পে-রোল ডাকাতির কথা জানিয়ে দেবার হুমকি দিত। এরপর আমার আর কিইবা করার থাকত, বাছা?’

মাথা দোলাল এরিখ। শিস দিল ঠোঁট গোল করে। ‘ও তো দেখছি তোমার কাঁধে ভালভাবেই চেপে বসেছিল। মৃদু হাসল ও।

‘সেটা সত্যি—আবার ঠিক সত্যিও নয়।’ আগুনের কুণ্ড থেকে খুঁচিয়ে ছোট্ট এক টুকরো কয়লা বের করে আনল গাস। চিমটার সাহায্যে তুলে নিয়ে পাইপ ধরিয়ে নিয়ে বলল, ‘মাঝে মাঝে ও এমন ভাব দেখাত, যেন দুনিয়ায় আমিই ওর একমাত্র বন্ধু। কোন কোন সময় আমার উপদেশ শুনত ও, আবার কোন কোন সময় ওর কথাই মানতে হত আমাকে।’

পাইপে টান দিয়ে প্রচুর ধোঁয়া ছাড়ল গাস। আসলে সবটাই আমার বোকামি। পে-রোল ডাকাতি থেকে শুরু করে মার্শালের অফিসে গোপনে টাকা রেখে আসা, চ্যানিকে বলা পর্যন্ত। জীবনে অত টাকা আমি দেখিনি এর আগে একত্রে। তাই যখন টাকাটা রোজগার করলাম, বৈধ কিংবা অবৈধ যেভাবেই হোক, টাল সামলে উঠতে পারিনি। সোজা কথায়, পুরো ব্যাপারটাকে আমি লেজে-গোবরে করে ফেলেছিলাম অত্যন্ত হাস্যকর ভাবেই।’

বাধা দিল এরিখ বুড়োকে। ‘তুমি কি এখনও বুঝতে পারোনি মার্শালকে খুন করে কে টাকাটা হাতিয়ে নিয়েছিল?’

ঘাড় ফিরিয়ে পেছনে জঙ্গলের দিকে তাকাল গাস, যেন দেখে নিচ্ছে ওখানে আড়ি পেতে কেউ ওর কথা শুনছে কি না। তারপর এরিখের দিকে ফিরে প্রায় ফিস ফিস করে বলল, ‘মনে হয় পেরেছি।’

‘কার কাজ? চাইলে হয়তো তুমি এখন ওটার মীমাংসা করে নিতে পারো।’

গাস সঙ্গে সঙ্গে কোন জবাব দিল না। গা থেকে খসে-যাওয়া কম্বলখানা টেনে নিয়ে ধীরে-সুস্থে কাঁধে জড়াল সে। তারপর শান্তকণ্ঠে বলল, ‘না।’

‘না কেন?’ ওর মুখের দিকে ঝুঁকল এরিখ। ‘তুমি কিছু একটা লুকোচ্ছ। কী সেটা, গাস? হয়তো আমি তোমাকে সাহায্য করতে পারব।’

চুপচাপ কিছুক্ষণ পাইপ টানল গাস। তারপর মুখ তুলল। ‘হ্যাঁ, তুমি হয়তো পারবে। চ্যানির বিরুদ্ধে তোমাকে আমার সাহায্য করার অনেক কারণের মধ্যে একটা হলো এই যে, ওর বিরুদ্ধে লড়ার সাহস ও শক্তি দুটোই আছে তোমার, চ্যাপম্যানদের বিরুদ্ধেও।’

‘বলে যাও।’

‘হুঁ। তারপর, যা বলছিলাম, আমরা মেক্সিকোয় চলে যাই। ওখানে চ্যানি দারুণ বিলাসী জীবন যাপন করতে শুরু করে। ভাল কাপড়চোপড়, খাওয়া- দাওয়া তো বটেই, তার সাথে প্রচুর আমোদ-প্রমোদেও জড়িয়ে পড়ে ও। ওখানকার সব ব্রাউন সিনোরিটাদের সঙ্গে দারুণ খাতির জমে ওঠে ওর। ওদের নিয়ে প্রচুর হৈ-চৈ করে বেড়াত।

‘সবচে’ ভাল মদ ছাড়া ছুঁতো না ও, সবচে’ সেরা কাবালা ছাড়া চড়তে চাইত না। এমন কি, উঁচু স্টেকের জুয়া নাহলে খেলতও না। অথচ আমার দিন কাটছিল ওর ছিটেফোঁটা দানের ওপর। আমার খারাপ লাগত, রাগারাগি করতাম ওর সাথে, ও পাত্তা দিত না। এ অবস্থায় অনেক বড় বড় শহর ঘুরেছি ওর সাথে। চিহুয়াহুয়া, প্যারাল, টরিয়ন, ডুরাঙ্গো – কোনটা নয়? আমি সব সময় ভেবে অবাক হতাম খরচ করার জন্যে অত টাকা ও পায় কোথায়? অথচ দু’জনের কেউই আমরা কুটোটি নাড়তাম না।’

পাইপ টানতে টানতে চুপচাপ শুনে যেতে লাগল এরিখ। জানে, বুড়োকে কথার নেশায় পেয়ে গেছে, সবটুকু শেষ না-করে থামবে না।

‘দিন পাঁচ-ছয়েক আগের কথা,’ শুরু করল গাস। ‘চ্যানি আমাকে দক্ষিণ থেকে আরও কিছু গরু নিয়ে আসতে বলেছিল। টাকার দরকার ছিল এবং সে তা আগেই ওয়েন্ডির কাছ থেকে নিয়ে রেখেছিল সম্ভবত। যাবার দিন ওর কাজের তাড়া ছিল নাকি কোথায়, তাই সকালে ঘুম থেকে উঠেই চলে যায় ও। আমাকে বলে গেল প্রয়োজনীয় টাকা-পয়সা যেন আমি ওর ওয়ারব্যাগ থেকেই নিই। টাকার জন্যে ওর ব্যাগ খুললাম আমি। বন্ধ করার সময় ব্যাগের একদম তলায় জিনিসটা দেখলাম। একটা কাগজ, ভাঁজ করা। কৌতূহলী হয়ে ভাঁজ খুলে দেখলাম। অর্ধেকটা ছেঁড়া। এরিখ, তুমি কি জানো কিসের কাগজ ছিল ওটা?’

‘কি করে জানব?’

ঝুঁকে এরিখের হাঁটুতে গুঁতো লাগাল বুড়ো। ‘ওটা ছিল একটা পেপার বাইন্ডার!’ প্রায় চুপে চুপে বলল ও। ‘আর্মিরা ব্যবহার করে থাকে বিভিন্ন আউটফিটের টাকা আলাদা আলাদা করে রাখার জন্যে। সি কোম্পানি, থার্ড ক্যাভালরি, ফোর্ট বউই’র ছাপ ছিল ওটায়।

মাথা দোলাল এরিখ। বুঝতে পেরেছি।’

‘আমি কিন্তু তখনও বুঝতে পারিনি। অত শীঘ্রিই যদি কিছু বুঝতে পারতাম, তাহলে আর এই বুড়ো বয়সেও ঘোড়ার পিঠকেই বাড়িঘর ভাবতে হয়? তবে এখন বুঝতে পারছি। ভেবে দেখো, চ্যানির সাথে প্রথম যখন আমার দেখা হয়, তখন ও ছিল কপর্দকহীন। আর আমরা সীমান্ত পেরোতে না-পেরোতেই আলাদিনের চেরাগ পেয়ে গেল? মাসের পর মাস বেকার বসে বসে প্রচুর টাকা ওড়াত ও। কোনদিনই জুয়ার টেবিলে জিততে পারেনি ও।’

‘অর্থাৎ’ এতক্ষণে কথা বলল এরিখ, ‘তুমি বলতে চাইছ মার্শালকে খুন

করে টাকাটা চ্যানি বিয়ারি নিজেই হাতিয়ে নেয়, এই তো?’

‘ঠিক ধরেছ,’ মাথা দোলাল গাস।

চুপচাপ কাটল কিছুক্ষণ এরপর। এরিখ ওই জঘন্য চরিত্রের ছেলেটার কথা ভাবল। গাসের মত একটা ভাল মানুষ বুড়োকে পেয়ে ওই নোংরা খেলা খেলতে পেরেছে ও। একটা মৃত গলিত শেয়ালের নাড়ি-ভুঁড়ির চেয়েও নোংরা ওর মন-মানসিকতা। এখন আবার সেই ঘৃণ্য খেলাটাই খেলতে যাচ্ছে ও ওয়েন্ডির সাথে, ওর একমাত্র সম্বল র‍্যাঞ্চটা হজম করার বদ মতলবে।

গাস ওর পাইপ জ্বালাল। এখন তুমি নিশ্চয়ই বুঝতে পেরেছ ওর কাছ থেকে কেন পালিয়ে এসেছি আমি? তবে, চ্যানি এটা কোনদিন ভুলবে না। ওকে চিনি আমি—দেখামাত্রই গুলি করে মারবে ও আমাকে।’

‘তুমি ফের সীমান্তের দিকে পালালেই পারো। ওখান থেকে…’

‘না, এরিখ,’ গাস মাথা নাড়ল। ‘শোনো, আমি কখনও অত ভাল মানুষ ছিলাম না। কিন্তু ডেভিড ক্লে’র সঙ্গে দক্ষিণে কাজ করার সময় আমার সঙ্গে অত্যন্ত ভাল ব্যবহার করে ও। আমি কখনও চাইব না ওই বকোয়াজ ছেলেটো ক্লে’র মেয়েকে ওর নিজের র‍্যাঞ্চ থেকে উচ্ছেদ করুক। তুমি চ্যানির বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছ, চ্যাপম্যান আর বাটলারকে সমস্যায় ফেলে দিয়েছ, এটা দারুণ পছন্দ হয়েছে আমার। এ জন্যেই তোমার সাথে যোগ দিয়েছি আমি। ওদের শায়েস্তা করার মত সাহস আর বুদ্ধি, আমার বিশ্বাস, তোমার আছে। এটার একটা হেস্তনেস্ত না-হওয়া পর্যন্ত কোথাও যাওয়া সম্ভব নয় আমার পক্ষে। এমন কি, স্বর্গেও না।’

‘নরকে?’ এরিখ ফোড়ন কাটল।

‘সেক্ষেত্রে নরক-পালকে ধৈর্য ধরতে হবে।’ হাসল গাস।

হঠাৎ কানখাড়া করল এরিখ। খুব অস্পষ্ট হলেও, গরুর ডাক শুনতে পেয়েছে ও। উঠে দাঁড়াল সে, গাসকে বলল, ‘শোনো!’

গা থেকে কম্বল ফেলে দিল গাস। দাঁড়িয়ে গেল। শুনতে পেয়েছে ও নিজেও। ‘গরু!’

‘আমার সাথে এসো।‘

স্পেন্সারটা তুলে নিল এরিখ; ঢুকে গেল জঙ্গলের ভেতর। ওর পিছু পিছু গাসও। ক্যানিয়নের মুখে চলে এল ওরা, দূরে ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের দিকে তাকাল। গাস বলল, ‘দক্ষিণ দিক থেকেই আসছে।’

অপূর্ণ চাঁদের মরাটে আলো ক্যানিয়ন জুড়ে। উত্তর থেকে বয়ে আসা ঠাণ্ডা বাতাস কাপড়চোপড় ভেদ করে হুল ফোটাচ্ছে ওদের শরীরে। দূর থেকে ভেসে আসা গরুর ডাককে মরাটে চাঁদের আলো আর ঠাণ্ডা বাতাসের প্রভাবেই যেন অশরীরী প্রেতের কোলাহল বলে মনে হলো এরিখের। এবার নিয়ে ছয়বার শুনেছে ও এরকম গরুর ডাক। ওদিকে, যেদিক থেকে ডাক আসছে, মাইলকে মাইল ঘন জঙ্গল আর পাহাড়-ক্যানিয়ন ছাড়া র‍্যাঞ্চ-ফ্যাঞ্চ কিছুই নেই। তাহলে কোত্থেকে আসে এ ডাক? এরিখ কেঁপে উঠল। ভয়ে না ঠাণ্ডায়, ঠিক বুঝতে পারল না।

ওর বাহু টান দিল গাস। ‘ঘোড়া!’

এরিখও দেখল। জঙ্গলের ভেতরে ঢুকে পড়ল ওরা, উঁকি দিল। নিঃসঙ্গ একজন অশ্বারোহী চলে এল ওদের পাশাপাশি। মন্থর গতিতে হাঁটছে ওর ঘোড়া। কান খাড়া করে কিছু শোনার ভঙ্গিতে স্যাডলে বসে আছে আরোহী।

‘গোল্ড বার্জার, গাস ফিস ফিস করল এরিখের কানে। ‘ডব্লিউ বারের পাশেই ছোট্ট একটা র‍্যাঞ্চ ওর। ক্রস অ্যারোতে দেখেছিলাম একদিন। হারিয়ে-যাওয়া গরুর খোঁজে এসেছিল। প্রায় বিশটির মত হবে বলেছিল।’

‘লোক কেমন?’

‘ওয়েন্ডি খাতির-টাতির করেছে দেখলাম। চ্যাপম্যানদের ঘৃণা করে ও। মুখেই আনতে চায় না ওদের নাম, পাছে মুখ তেতো হয়ে যায়। হাসল গাস নিঃশব্দে।

এরিখ চান্স নিল একটা। ‘বার্জার,’ ডাকল ও নিচু স্বরে।

বনভূমির ছায়ায় লুকিয়ে পড়ল বার্জার পলকেই। ‘কে?’ সন্দিগ্ধ কণ্ঠে জানতে চাইল ও সেখান থেকে।

‘ওর সঙ্গে কথা বলো, গাস, এরিখ বলল।

গাস একটা পাথরের ওপর দাঁড়াল। ‘গাস ল্যামেল। ক্রস অ্যারোর লোক। এদিকে চলে আসো।’

‘তোমার সাথে আর কে আছে?’

‘বন্ধু। এসে যাও।’

ঘোড়া থেকে নেমে কোল্ট বের করে নিল বার্জার। এগিয়ে এল ধীরে ধীরে। কাছে এসে তীক্ষ্ণ চোখে তাকাল এরিখের দিকে। ‘ওয়েন! এসব কি, ল্যামেল? জানতে পারি?’

‘পারো। কিন্তু তার আগে তোমার ঘোড়া নিয়ে আসো এদিকে। যাচ্ছিলে কোথায়?’

‘গরুর খোঁজে। কেন জানি মনে হচ্ছে এদিকেই কোথাও আছে ওগুলো।’

এরিখ র‍্যাঞ্চারের দিকে তাকাল। পুরানো শুকনো ক্ষতচিহ্নে ভরা এবড়োখেবড়ো মুখ। ওর মনে পড়ল, কিভাবে ডব্লিউ বারের লোকদের নির্যাতনের শিকার হয়েছিল লোকটা। ডেভিড ক্লে নাক না গলালে মারাই পড়ত।

‘এই মাত্র কিছু গরুর ডাক শুনেছি আমরা।’ দূরে ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের দিকে হাত প্রসারিত করল গাস। ‘ওদিক থেকেই এসেছে। তুমি নিশ্চয় ওদিকে যাবার কথা ভাবছ না?’

‘দেখি।’ বার্জার এরিখের দিকে চাইল। ‘সঙ্গী হিসেবে তুমি ভাল লোক বেছে নিয়েছ, একথা বলতে পারছি না ল্যামেল।

‘উঁহু,’ ওর সাথে একমত হলো না ল্যামেল। ‘তুমি ভুল করছ, গোল্ড। ভাল লোক এরিখ। তুমি ওর ওপর নির্ভর করতে পারো।’

‘ও একটা খুনী। নাক সিঁটকাল র‍্যাঞ্চার। ‘তিনটে খুন করেছে পর পর। ওর ওপর নির্ভর করতে বলছ? হাহ্!’

‘বার্জারের বিশ্বাস অর্জন করতে কষ্ট হবে। সৎ লোক ও, সরলও। তবে একগুঁয়ে। যেটা বিশ্বাস করে, ওটাকেই সার সত্য ভাবে,’ ভাবল এরিখ। আরেকটা চান্স নিল ও। শান্তকণ্ঠে বলল, ‘জেমস আমাকে বিশ্বাস করে, বার্জার।’

‘তাতে কি?’ পাত্তা দিল না র‍্যাঞ্চার। ‘ওতে আমার ধারণা পাল্টাবে না।’

‘ঠিক আছে। এরিখ হাসল। ‘জো’র সঙ্গে আমি একত্রে কাজ করছিলাম।’

‘কী?’ অস্ত্র খাপে ঢোকাল বার্জার। ‘তাহলে তুমি অ্যাসোসিয়েশনের খবর জানো!’

‘হ্যাঁ।’

‘জো’র সাথে কাজ করছিলে বলছিলে। জো কোথায় এখন?’

‘নেই,’ শান্তকণ্ঠে জানাল এরিখ। ‘ফাঁসিতে ঝুলিয়েছে কেউ ওকে।’

ফ্যাকাসে হয়ে গেল গোল্ড বার্জারের মুখ। ‘বিশ্বাস করতেই কষ্ট হচ্ছে আমার,’ শুকনো কণ্ঠে মন্তব্য করল ও। ওর সাড়া-শব্দ না-পেয়ে আমরা আরও অন্য কিছু ভাবতে যাচ্ছিলাম। আবোল তাবোল… বোঝোই তো।’

‘লোকটা সৎ ছিল, বার্জার। সবাইকে নিয়ে শান্তিতে থাকার স্বপ্ন ছিল ওর,’ এরিখ বিষণ্ণ কণ্ঠে বলল।

‘মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝছি না আমি,’ গাস নাক গলাল। ‘বুঝিয়ে বলবে একটু, এরিখ?’

ফিরে যাবার জন্যে তৈরি হলো এরিখ। ‘জেমস ক্র্যামার আর কিছু সৎ র‍্যাঞ্চার মিলে একটা অ্যাসোসিয়েশন গড়ে তুলেছে এখানে। জো রীভস স্টক ডিটেকটিভ হিসেবে কাজ করত অ্যাসোসিয়েশনের হয়ে। জেমসের অনুরোধে আমিও কাজ করতে রাজি হয়েছিলাম। তেমন কিছু অবশ্য জানতে পারিনি আমরা।’

বার্জার ঘুরে দাঁড়াল। শিস দিল সে তীক্ষ্ণ সুরে। ‘একা নই আমি। পেছনে সঙ্গী আছে একজন। বিশ্বস্ত।’

বনভূমির ছায়ার ভেতর থেকে আরেকজন অশ্বারোহী বেরিয়ে এল। কাছে আসতেই কঠিন হয়ে উঠল এরিখের মুখ। রবার্ট বাটলার। বাটলার সম্ভাষণ জানাল ওদের। হ্যালো, ওয়েন! গাস!’

দ্রুত পিছিয়ে গেল এরিখ বার্জারের কাছ থেকে, ক্রুদ্ধ দৃষ্টিতে তাকাল ওর দিকে। বার্জার আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে হাত নাড়ল। ‘রবার্ট এখন অ্যাসোসিয়েশনের একজন সদস্য। কিছুদিন আগে ওকে আমরা প্রস্তাব দিয়েছিলাম। একত্রে কাজ করব আমরা, ওয়েন।’

ঘোড়া থেকে নামল বাটলার। হাত বাড়িয়ে দিল এরিখের দিকে। ‘গতস্য শোচনা নাস্তি। গতকাল কি ঘটেছিল, আজ সেটা ভুলে গেছি আমি, এরিখ। তুমিও ভুলে যাও। অবশ্য আমি স্বীকার করি যে, আমার মেজাজ একটু চড়া, মাঝে-মধ্যে ঠিক রাখতে পারি না। তবে এটাও সত্য যে, ওয়েন্ডিকে আমি ভালবাসি। ওরা এখানে আসার পর থেকেই। ঠিক আছে, সেটা সমস্যা হবে না। এদিকের কাজ-কর্ম শেষ হবার পর নিজেদের মধ্যে আপোষেই ঠিক করে নেব আমরা ও কার হবে। রাজি?

হাত বাড়াল এরিখ, বাটলারের প্রসারিত হাতটা ধরল। চমৎকার পোশাক পরেছে রবার্ট বাটলার, চোখ ফেরানোই দায়। হয়তো ভাল লোকই ও, এরিখ ভাবল, আর ঈশ্বরই জানেন, এই জঘন্য রাসলিঙের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্যে যত বেশি সম্ভব ভাল এবং বিশ্বস্ত লোকেরই দরকার।

‘চলো, কফি খাওয়াব আমি,’ প্রস্তাব দিল ও।

এরিখের ক্যাম্পে গেল ওরা সবাই। গাস কফির সরঞ্জাম বের করল। আগুনের কুণ্ডের পাশে গোল হয়ে বসল ওরা। শুকনো কাঠ গুঁজে দিল গাস আগুনে। আগুন ধরে উঠল। কফির পট চড়িয়ে দিল ও পাথরের চুলোয়।

বার্জার সিগার জ্বালাল। ‘ঘোড়ার ডিম এ জায়গাটার মাথা-মুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারি না আমি।’ ধোঁয়া ছাড়ল ও। যতবারই গরুর পেছনে দৌড়েছি, দেখা গেছে, ট্র্যাকসহ গায়েব হয়ে গেছে ওগুলো। রবার্ট বলছে, দক্ষিণে চলে যায়; আমার ধারণা কিন্তু অন্যরকম। আমার মনে হয়, ওগুলো ক্যানিয়নের কাছেই আছে কোথাও।’

‘তোমার ধারণাই মনে হয় ঠিক।’ এরিখ একমত হলো বার্জারের সাথে। ‘আমি নিজেও কিছু ট্রেইল করেছি; ঘুরে ফিরে ক্যানিয়নের মধ্যেই শেষ হয়ে গেছে ওগুলো। বাইরে যাবার কোন চিহ্ন চোখে পড়েনি আমার।’

ওদের ধারণাকে হাত নেড়ে নাকচ করে দিতে চাইল বাটলার। হয়তো। কিন্তু কোথায় ওগুলো?’

‘বিশাল অঞ্চল এটা,’ চারদিকে হাত ঘুরিয়ে আনল গাস। অসংখ্য ক্যানিয়ন, প্রচুর চারণভূমি, অজস্র পানির উৎস রয়েছে এখানে। চাইলে তুমি হাজার হাজার গরু লুকিয়ে রাখতে পারবে এ জায়গায়, সবার অলক্ষেই।

‘ডেভিড ক্লেও তাই মনে করত,’ বার্জার একমত হলো গাসের সাথে। ‘জো রীভসও।’

নিজের পাইপে তামাক ঠাসল এরিখ। ‘ওদের দু’জনের ভাগ্যে কি ঘটেছে, আমরা সবাই তা জানি। আমার মনে হয়, তারা ঠিক পথেই এগোচ্ছিল। সে জন্যে ওদের প্রাণ দিতে হয়েছে,’ গম্ভীর স্বরে মন্তব্য করল ও।

‘এসবের পেছনে জর্জ চ্যাপম্যানের হাত রয়েছে বলেই আমার বিশ্বাস, ‘ বাটলার বলল। ‘একটা নোংরা শুয়োর ওটা, পিচ্ছিল শেয়াল!’

‘আমার সন্দেহ আছে,’ একটু ইতস্তত করে মত প্রকাশ করল বার্জার। ‘প্রচুর খাটছে ও রাসলিঙের বিরুদ্ধে। ওর নিজের গরুও হারাচ্ছে, সম্ভবত সবার চেয়ে বেশি।’

‘হাহ্,’ হাসল রবার্ট বাটলার। ‘ওটা বাইরের রূপ ওর।’ নিজের সিদ্ধান্তে অটল সে। ‘রাসলিঙ বন্ধ করার নামে সারাক্ষণই বনে-জঙ্গলে ঘোরে ও। কিছু লোক ওর সাথে থাকে আর বাকিরা করে গরু চুরি। নইলে, ভেবে দেখো তো, কি দরকার ওর অত লোকের? ও আসলে ক্ষমতালোভী। খেলছে সাবধানে, সেট-আপও ভাল। প্রচুর লোকজন তার, যে-কোন কাজ করছে ওর স্বার্থে। ওদিকে হল চ্যাপম্যান শেরিফ, দিনকে রাত বানিয়ে দেবে ভাইয়ের জন্যে। ওর নোংরা কাজে যে-ই বাধা দিতে গেছে, তাকেই সরিয়ে দিয়েছে ও। ডেভিড ক্লোকে, জো রীভসকে এবং এখন ওয়েনকেও। যদিও ওদের দুজনের মত দুর্ভাগ্য হয়নি ওর।’

‘আমাকে ও ভাগায়নি, এরিখ মৃদুস্বরে বলল। ‘আমাকে ভাগানোর পেছনে চ্যানি বিয়ারির ভূমিকাই মুখ্য।’

‘তাহলে সম্ভবত ওকেও আমাদের সন্দেহের তালিকায় রাখা উচিত, ‘ বার্জার প্রস্তাব করল।

‘না,’ মাথা নাড়ল গাস। ‘ওকে আমি জানি। ওর অন্য ধান্দা।’

কফি নামিয়ে কাপে ঢেলে দিল ও। বাটলার ওর কাপ হাতে নিল। ‘বাদ দাও,’ বলল সে। এখানে হৈ-হল্লা করে কোন মীমাংসায় আসা যাবে না।’ চুমুক দিল সে কফিতে। দারুণ হাত তোমার, গাস, কফিতে।’ প্রশংসা করল সে। ‘শোনো। একটা পরিকল্পনা আছে আমার মাথায়। কাজ হবে আশা করি এতে। গাস আর এরিখ ব্লু বার্ডসের আশে পাশে ঘুর ঘুর করবে। এর মধ্যে বার্জার, তুমি জেমসকে বলে অ্যাসোসিয়েশনের মীটিং ডাকাও। সবাই সবার লোকজন নিয়ে তৈরি থাকবে। ব্লু বার্ডসের দক্ষিণাংশে চৌকি বসাব আমরা আপাতত। এর পরেও যদি গরু খোয়া যায়, তাহলে উত্তরাংশেও বসাব। তারপর গোটা ক্যানিয়ন চষে ফেলব। খোদার কসম, ওখানকার, এমন কি প্রতিটা ঝরাপাতা পর্যন্ত উল্টে পাল্টে দেখব আমরা।

‘ভালই মনে হচ্ছে বুদ্ধিটা,’ বার্জার সমর্থন জানাল কফিতে চুমুক দিতে দিতে।

‘খারাপ নয়।’ কফি শেষ করে পাইপ ধরাল এরিখ। ‘তবে একটা খুঁত আছে, বাটলার, তোমার পরিকল্পনায়।’

‘কী রকম?’

‘ধরলাম, ক্যানিয়নের উত্তর-দক্ষিণ উভয় মুখ বন্ধ করেই চষতে শুরু করলে তুমি। এ কাজে তোমাকে সাহায্য করার জন্যে অ্যাসোসিয়েশনভুক্ত প্রত্যেক র‍্যাঞ্চার তাদের লোকজন নিয়ে এল। কিন্তু এতে প্রত্যেকটা র‍্যাঞ্চই বেশ কিছুটা সময়ের জন্যে অরক্ষিত হয়ে পড়বে। এখন রাসলারদের জনবল যদি প্রচুর হয়, তাহলে তারা আরেকটা সুযোগ পেয়ে যাচ্ছে। প্রতিটি র‍্যাঞ্চ থেকে বাকি গরুগুলোও ঝেঁটিয়ে নিয়ে যাবে তারা সে সুযোগে এবং সেগুলো লুকিয়ে রাখার জন্যে ব্লু বার্ডস ছাড়াও আরও অনেক জায়গার খোঁজ জানা থাকবে তাদের।’

‘দূর!’ হাসল বাটলার। অমন জায়গা আর কোথায়? আর যদি থাকেও, থাকুক না। নাহয় তাদের সে সুযোগ দিলামই আমরা। কিন্তু এদিকে যখন ওদের এখনকার আস্তানাটা ভেঙে দেব, উদ্ধার করে ফেলব গরুগুলো, তখন স্বভাবতই ভড়কে যাবে ওরা। হুট করে কোথাও চালান দেবার সাহস করবে না ধরা পড়ার ভয়ে। ইতোমধ্যে ওদের নতুন আস্তানাও ভেঙে দেব আমরা, বাকি গরুগুলোও উদ্ধার করে ফেলব। ঠিক আছে?’

চুপচাপ পাইপ টেনে গেল বার্জার, কোন মন্তব্য করল না। এরিখ কাঁধ ঝাঁকাল। ‘আমি আর গাস আমাদের অংশ ঠিকই করব।’ অস্পষ্ট স্বরে জবাব দিল ও।

বার্জার ধূমপান শেষ করে হাত বাড়াল এরিখের দিকে। যে কোন ব্যাপারে.’ এরিখের চোখে চোখ রাখল সে, ‘গোল্ড বার্জারের ওপর নির্ভর করতে পারবে তুমি, ওয়েন।’

ওরা চলে গেলে গাস এরিখকে জিজ্ঞেস করল, ‘কি ভাবছ, ওয়েন? অন্যমনস্ক দেখাচ্ছে তোমাকে।’

‘ভাবছি না শুধু, ভয়ও পাচ্ছি, গাস। আরও অনেক রক্তপাতের ভয়, মৃত্যুর ভয়। যতদিন রাসলারদের উৎখাত করা না-যায় এখান থেকে, ততদিন এখানকার কোন মানুষই নিরাপদ নয়। সে যাক। এ মুহূর্তে আমাদের সর্ব প্রথম করণীয় হলো পাততাড়ি গুটানো।’

‘পাততাড়ি গুটাব কেন?’ আমাদের এখানকার ক্যাম্পটা তো বেশ আরামদায়ক।

‘ছিল।’ বুড়োর দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে চাইল এরিখ। ‘ততক্ষণ, যতক্ষণ তুমি আর আমি ছাড়া এটার খবর আর কেউ জানত না।…আমি একা খেলতেই পছন্দ করি, গাস। একাই খেলব শেষ পর্যন্ত।’

হাসল গাস। ‘আমার কথা কিছু বললে না যে, এরিখ? তুমি এখন আর একা নও।’

থুতু ফেলল এরিখ। ‘একবারে তোমার আক্কেল খোলেনি, বুড়ো? চ্যানি বিয়ারির মত আমিও যদি চেপে বসি তোমার কাঁধে?’

‘খুশি হয়ে বহন করব,’ হাসল বুড়ো দাঁত বের করে।

দ্রুত মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে ক্যাম্প ছাড়ল ওরা। এরিখ পশ্চিমে মুখ নিল।

‘ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের পথ ওদিকে নয়,’ গাস মনে করিয়ে দিতে গেল এরিখকে, ‘ওখানেই তো যাচ্ছি আমরা, নাকি?’

‘না।’ বুড়োর দিকে ঘুরল এরিখ, অর্ধবৃত্তাকারে একটা হাত ঘুরিয়ে এনে বলল, ‘এই ক্যানিয়নটা, আমার মনে হয় অনেক বড়। ওদিকে গিয়ে কোথাও ক্যাম্প করব আজ রাতের জন্যে। বক্স না-হলে কাল ভোর হবার আগেই বেরিয়ে যাব ওদিক দিয়ে।

চুপচাপ এগোল ওরা। নীরব ক্যানিয়ন, সাড়া-শব্দ নেই কোথাও, কেবল ওদের বাহনগুলোর পরিচিত পায়ের শব্দ ছাড়া। দূরে, ক্যানিয়নের কোথাও রাতজাগা নিঃসঙ্গ কয়োটের বিষণ্ণ বিলাপ আর হাড় কাঁপানো ঠাণ্ডা বাতাসের করুণ অস্পষ্ট দীর্ঘশ্বাস মিলে অপূর্ণ চাঁদের ফিকে আলোয় এক অপার্থিব পরিবেশ। এরই মধ্যে এরিখের তীক্ষ্ণ শ্রুতিশক্তিসম্পন্ন কানে এসে পৌছল দূরাগত গরুর হাঁক। গাস অবশ্য শুনল না। এরিখও জানাল না তা ওকে। থাক না বেচারা নিজের মনে, ভাবল ও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *