আশ্রয় – ১৩

তেরো

চাঁদ ঠিক মধ্যাকাশে; এরিখ আর গাস ল্যামেল নতুন ক্যাম্পের জায়গা নির্বাচন করে ঘোড়া থেকে নামল। ক্যানিয়নটা পুবদিক হতে ক্রমশ নিচু হয়ে এসেছে এদিকে, সমতলের সঙ্গে মিশে গেছে প্রায়। ওটার ঠিক মধ্যস্থল থেকে নেমে আসা একটা মাঝারি আকারের অগভীর ঝরনার পাড়ে ক্যাম্প করার উদ্যোগ নিল ওরা।

ক্যানিয়নটা বক্স নয়। দক্ষিণ দিকে খাড়া দেয়াল, সুচাল উপরিভাগ বিভিন্ন সময়ে প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ভেঙে চুরে প্রায় চ্যাপ্টা হয়ে গেছে। ছোট ছোট গাছপালা জন্মেছে ওখানে, লতা-গুল্মে ছেয়ে আছে। তবে জমকাল নয়। অতদূর থেকে এবং চাঁদের অমন ম্লান আলোতেও ওদের শ্রীহীন উষ্কখুষ্ক রূপ এরিখের দৃষ্টি এড়াতে পারল না। রুক্ষ পাথুরে মাটিতে সামান্য প্রাণরস আহরণ করে কোনমতে পাথরের ফাঁকফোকর থেকে মাথা তুলেছে ওরা জীবনের দিকে।

উত্তর দিকটা খোলা, ক্রমশ ঢালু হতে হতে মিশে গেছে দূরে, উপত্যকা সমতলে। ক্রস অ্যারো র‍্যাঞ্চটা ওদিকে, এরিখ যেখানে তাঁবু খাটাচ্ছে, সেখান থেকে প্রায় সোজা অবস্থানে। মাঝখানে বিস্তৃত অঞ্চল এবড়োখেবড়ো, উঁচু- নিচু পাথরে ভরা; কাঁটাঝোপ, লতাপাতা আর মাঝে-মধ্যে লম্বা লম্বা গাছপালার অগভীর জঙ্গলে পূর্ণ।

সুবিধেমতন দুটো গাছ বেছে নিয়ে তেরপল টাঙাতে লেগে গেল গাস। এরিখ পর্যবেক্ষণের দৃষ্টিতে দক্ষিণ দিকের দেয়ালের মাথায় তাকাল। রুইন্স ক্যানিয়ন ওখান থেকে মাইল তিনেক দক্ষিণে হবে, মনে মনে হিসেব করল সে।

হাত বাড়িয়ে দেয়ালের দিকে নির্দেশ করল এরিখ। ‘আমার মনে হয় ওটার ওপারে রুইন্স ক্যানিয়ন পর্যন্ত জায়গাটা মেসা হতে পারে, গাস।’

‘হতে পারে।’ গাস একটা গাছের নিচের দিকের একটা ডালের সঙ্গে তেরপলের এক মাথার রশি পেঁচিয়ে শক্ত গিঠ দিল।

‘আমি দেয়ালের মাথায় চড়ার কথা ভাবছি,’ এরিখ জানাল ওকে।

‘চড়লে হয়তো দেখতে পাবে প্রচুর জমি ওদিকে।’ তেরপলের আরেক মাথা আরেকটা গাছের সাথে বাঁধতে বাঁধতে মন্তব্য করল গাস।

‘আমিও সে রকম ভাবছি।’ ওর দিকে চাইল এরিখ, সকৌতুকে। তুমি কি ভাবছ? চড়বে নাকি?’

‘নাহ্,’ মাথা নাড়ল গাস। ‘পাহাড়ী ছাগল হবার কোন ইচ্ছে নেই আমার।’

এরিখ হাসল। ‘কাল সকালে ঘুম থেকে উঠলে তোমার সঙ্গে আমার মতের মিল হবে হয়তো। কি বলো?’

‘না,’ একমত হলো না গাস। ‘সামান্য ঘুমে মত পাল্টায় না আমার।’

এরিখ আর কিছু বলল না। তীক্ষ্ণ চোখে আরেকবার পর্যবেক্ষণ করল সে দেয়ালের মাথাটা। গাসের তাঁবু খাটানো শেষ হলে কম্বল বিছিয়ে ঘুমিয়ে পড়ল ওরা। খুব একটা ভাল ঘুম হলো না এরিখের। ঘুমের ঘোরে কয়েকবার অস্পষ্ট কিছু শব্দ শুনতে পেল ও। কিন্তু অস্পষ্ট হলেও ওগুলো যে গরুর ডাক, তাতে ওর কোন সন্দেহ রইল না আর।

ভোরে ঘুম থেকে উঠে নাস্তার আয়োজনে লেগে গেল গাস। পর পর দু’কাপ কফি খেয়ে এরিখ জেমস ক্র্যামারের দোকান থেকে আনা রশিটা বের করল। গাসকে পানির ক্যান্টিনটা ভরে দিতে বলে খাপ থেকে ফিল্ডগ্লাস বের করে কাচগুলো মুছে নিল যত্নের সাথে। গাস ঝরনা থেকে ক্যান্টিন ভরে আনল।

তুমি দেখছি, আচ্ছা বেপরোয়া লোক!’ ক্যান্টিনটা একপাশে রেখে দেয়ালের মাথায় তাকাল ও। ‘একটা পিঁপড়াও ওটা বেয়ে উঠতে চাইলে দু’বার ভাববে।’

‘হয়তো। তবে আমি পিঁপড়া নই।’ ফিল্ডগ্লাসটা খাপে ঢোকাল এরিখ। ‘তা ছাড়া, না-উঠে উপায় কী? আমার ধারণা, গরুগুলো ওদিকেই কোথাও লুকোনো আছে। কাল রাতে অন্তত ছ’সাতবার ওদের ডাক শুনেছি। গত রাতের মধ্যে যদি পাখা না-গজিয়ে থাকে, তাহলে আমি নিশ্চিত যে, এখান থেকে রুইন্স ক্যানিয়নের মধ্যেই কোথাও আছে ওগুলো।’

‘তোমার ধারণা সত্যিও হতে পারে।’ একটু দ্বিধান্বিত দেখাল গাসকে। ‘তবে এসব ক্ষেত্রে মাঝে-মধ্যে ভৌতিক কাণ্ড-টাণ্ডও ঘটে কিছু কিছু।’ চোখজোড়া গোল আলুর মত বড় বড় করে তুলল বুড়ো। প্রায় ফিস ফিস করে বলল, ‘আমি এমনও শুনেছি, মরুভূমিতে ঘুরে বেড়াচ্ছে ভয়ঙ্কর লাল এক বিশাল উট। ওটার পিঠে চেপে বসে আছে একটা কঙ্কাল – হাতে তরোয়াল আর বুকের কাছে ঢাল। কল্পনা করতে পারো?’ স্বয়ং মৃত্যুই যেন চেপে বসে আছে রক্তের মত টকটকে লাল রঙের ভয়ালদর্শন এক বিশাল উটের পিঠে!’

‘বিচিত্র নয়।’ এরিখ হাসল। দেয়ালের ওপর নজর বুলাল সে। তবে ওখানে কোন ভৌতিক উট কিংবা গরুর পাল দেখার আশা করছি না আমি। মরুভূমি এখান থেকে বহুদূরে। আমি বরং রক্ত-মাংসের তৈরি গরু দেখার কথাই ভাবছি।’

হাল ছেড়ে দেবার ভঙ্গি করল গাস। ‘তো আমাকে কি করতে হবে?’

‘রকস্প্রিং যেতে হবে, জেমস ক্র্যামারের কাছে। পারবে?’

‘ওদিকের পথে অতটা খাড়া দেয়াল নেই!’ সখেদে জবাব দিল গাস। এরিখের পাহাড়ে চড়ার পরিকল্পনা পছন্দ হচ্ছে না ওর।

‘বুয়েনো।’ রশির বান্ডিল খুলে চেক করতে শুরু করল এরিখ। ‘চ্যানি বিয়ারি সম্পর্কে গত রাতে আমাকে যা শুনিয়েছ, সেটা জেমসকেও শোনাবে। জেমস ওয়েন্ডিকে ওর ব্যাপারে হুঁশিয়ার করুক, এটা আমি চাই। আর—সাবধানে থেকো, গাস।‘

‘থাকব।’

এরিখ আবার তাকাল দেয়ালের মাথায়। ‘আমার যদি কিছু ঘটে, তাহলে টোকারের মৃত্যুর ব্যাপারে সত্যি কথাটা শুনিয়ে দিয়ো সবাইকে। লিখিতভাবেই। অবশ্য যদি ইচ্ছে করে।’

‘ইচ্ছে করবে। আর কিছু?’

‘হ্যাঁ। জেমসকে জিজ্ঞেস করবে ‘রাইলি’ নামের কোন লোক কিংবা জিনিসের খোঁজ পাওয়া গেছে কি না।’

‘রাইলি?’ ভ্রূ কুঁচকাল বুড়ো। ‘কানা রাইলির কথা বলছ নাকি তুমি?’

চোখ সরু করে ওর দিকে চাইল এরিখ। ‘চেনো?’

‘চিনতাম।’ ঠোঁট ওল্টাল গাস। ‘জঘন্য একটা লোক। রাসলার, ঘোড়াচোর…এবং কোনটা ছিল না সে?’

‘ছিল না?’

টাকসনের এক বেশ্যালয়ে মারা যায় বছর দুয়েক আগে। খুন। বিগনোজড মোলি নামের এক বেশ্যার সমালোচনা করেছিল ও রেগেমেগে। বলেছিল শুধু নাকই নয়, মোলির আঙুলগুলোও নাকি পাকা কলার মত বেঢপ মোটা। ধারণা করা হয়…’

‘বাদ দাও।’ মাথা নাড়ল এরিখ। ‘এ রাইলি সে রাইলি নয়।’

ঘোড়ার পিঠে স্যাডল চাপাল গাস। এরিখ ওর দিকে তাকিয়ে হাসল। ‘ফিরে এসে,’ বলল ও, কানা রাইলি আর লম্বানাকী মোলির গল্প শোনাবে আমাকে। ঠিক আছে?’

‘ঠিক আছে।’ ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল গাস, হাত নাড়ল। ফিরে আসব আমি। তুমি ঠিক থেকো।’

এরিখ উঠল। ক্যান্টিনটা কোমরের বেল্টের সাথে ঝুলিয়ে নিয়ে রশির বান্ডিল কাঁধে ফেলে ঝোপঝাড় সরিয়ে এগিয়ে চলল ক্যানিয়ন ওয়ালের দিকে। দেয়ালের ক্লিফ থেকে একটা ফাটল তেরছা হয়ে নেমে এসেছে নিচে দেয়ালের গোড়া পর্যন্ত। ওখানে গিয়ে থামল এরিখ। ফাটলটা পর্যবেক্ষণ করল সতর্কচোখে। গোড়ার দিকটা ততটা খাড়া নয়। একটা ভাঙা পাথরের স্তূপের ওপর চড়ল এরিখ, ধীরে ধীরে পায়ে হেঁটে উঠতে লাগল ওপরের দিকে।

এক নাগাড়ে প্রায় একশো ফুট ওঠার পর ঘাড় ফিরিয়ে নিচে তাকাল সে। গাসকে দেখা যাচ্ছে না এখন, জঙ্গলের আড়ালে চলে গেছে বুড়ো। আরও বিশ ফুটের মত উঠল ও; তারপর বিশ্রাম নিতে বসল একটা ক্ষয়ে-যাওয়া পাথরের ওপর। কাঁধ থেকে রশিটা নামিয়ে ওটার এক মাথায় ফসকা গেরো দিল ও। তারপর ওপরে দেয়ালের মাথা হতে বেরিয়ে থাকা একটা পাথর লক্ষ্য করে ছুঁড়ে দিল রশির ফসকা গেরো দেয়া মাথাটা। প্রথমবার আটকাল না। আবার ছুঁড়ল ওটাকে। এবারও ব্যর্থ হলো ও। সময় নিয়ে যত্নের সাথে আবার ছুঁড়ল ও রশি, সফল হলো এবার। পাথরটার সুচাল আগায় রশির গেরো আটকে গেলে টেনে ভিড়িয়ে নিল গেরোটাকে।

বড় করে শ্বাস টেনে ফুসফুস ভরে নিল ও। ছাড়ল আস্তে আস্তে। মানসিক প্রস্তুতি নিল পাঁচ সেকেন্ড বিশ্রাম নিয়ে। তারপর থুতু ছিটিয়ে হাতের তালু ভিজিয়ে নিয়ে রশি ধরল শক্তহাতে। ধীরে ধীরে বেয়ে উঠতে শুরু করল ওপরের দিকে।

খুব বেশি পরিশ্রম করতে হলো না ওকে রশি বেয়ে উঠতে। খাড়া দেয়াল সংলগ্ন হওয়াতে মাঝে-মধ্যে রশি থেকে পা ছাড়িয়ে দেয়ালের খাঁজে পা রাখতে পারল ও। তবু যখন পাথরটার ওপর চড়ে বসল, তখন ওর ঘাম বেরিয়ে গেছে। দেয়ালের গায়ে হেলান দিয়ে ওপরে তাকাল ও। আরও প্রায় বিশ ফুটের মত উঠতে হবে। তবে রশির প্রয়োজন হবে না আর। মোটামুটি ঢালু পথটা পায়ে হেঁটেই ওঠা যাবে।

পিপাসা অনুভব করল এরিখ। গলা শুকিয়ে গেছে। কোমরে ঝোলানো ক্যান্টিনটার দিকে তাকিয়ে মাথা নাড়ল অসম্মতির ভঙ্গিতে। ওপরে উঠেই খাওয়া যাবে পানি।

‘গাস ঠিকই বলেছিল, নিচের দিকে চেয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে ভাবল ও। ‘পিঁপড়াকেও দ্বিতীয়বার চিন্তা করতে হবে এটা বেয়ে উঠতে চাইলে। অথচ দেখো, এ পথ দিয়েই কি না নিচে নামতে হবে আবার। বাস্!’

প্রায় পাঁচ মিনিট বিশ্রাম নেবার পর উঠে দাঁড়াল এরিখ। পাথরের মাথা থেকে সাবধানে রশিটা খুলে গুটিয়ে নিল। বাকি পথটুকু ধীরে-সুস্থে বেয়ে চূড়ার মাথায় চড়ল। ক্যান্টিন থেকে পানি খেয়ে নিয়ে সিগার জ্বালাল, দক্ষিণে হাঁটতে শুরু করল এরপর।

মাঝে-মধ্যে বৃষ্টির পানি গড়িয়ে পড়ার কারণে তৈরি খাদগুলো বাদ দিলে পুরো জায়গাটা একটা মেসা। হাঁটুসমান উঁচু ঝোপঝাড়ে পূর্ণ উপরিভাগ; ক্যাটক্ল’, ওকোটিলা আর পিটাহায়ার ঝোপ দুলছে বাতাসে। এরিখের সামনে প্রায় আধ মাইল দূরে একটা উঁচুমত টিলা। ওটা লক্ষ্য করে এগিয়ে চলল ও।

পায়ের কাছে মৌমাছির গুঞ্জনের মত ভোঁতা একটা শব্দ হতেই সচকিত হলো ও। নিচের দিকে তাকিয়ে শব্দটার উৎস খুঁজে পেয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ল একদিকে, – খিস্তি করল, পর মুহূর্তেই পিস্তল বের করে উদ্যতফণা ডায়মন্ডব্ল্যাকটার মাথা সই করে ট্রিগার টিপে দিল। বিচূর্ণমস্তক সাপটা লুটিয়ে পড়ল একপাশে শরীর মোচড়াতে মোচড়াতে। ধীরে-সুস্থে উঠে দাঁড়াল এরিখ, ঝোপঝাড় সরিয়ে টিলায় চড়তে শুরু করল। এক সময় টিলার মাথায় উঠে দাঁড়াল ও।

কোমর থেকে ফিল্ডগ্লাসটা হাতে নিল এরিখ, চোখে লাগিয়ে দক্ষিণ দিকে তাকাল। ওদিকে বিরাট অঞ্চল। মেসাটা ঢালু হতে হতে কোণাকুণিভাবে চলে গেছে রুইন্স ক্যানিয়নের দিকে। রুইন্স ক্যানিয়নের ওদিকে আর কোন ক্যানিয়ন চোখে পড়ল না ওর, অনেকক্ষণ ধরে জায়গাটাকে পর্যবেক্ষণ করেও।

চোখ থেকে ফিল্ডগ্লাস নামিয়ে সিগারেট রোল করল এরিখ। ‘এখানেই কোথাও থাকবে গরুগুলো। নিজেকে শোনাল। ‘আমরা যেগুলোর ডাক শুনেছি, গাসের ধারণানুযায়ী, ওগুলো যদি ভূতদের গরু না হয়ে থাকে।

সিগারেট জ্বালিয়ে বসল সে একটা পাথরে হেলান দিয়ে। টুপির নিচ থেকে চোখ কুঁচকে দূর দিগন্তের দিকে চাইল।

হঠাৎ ঠোঁট থেকে সিগারেট নামাল ও; হ্যাটটা ঠেলে কপাল থেকে পেছনে সরিয়ে দিল। খুব ক্ষীণ একটা ধোঁয়ার রেখা ওর চোখে পড়েছে আকাশের গায়ে। রুইন্স ক্যানিয়নের ওদিকে কোথাও হবে ওটার উৎস, অনুমান করল সে। ফিল্ডগ্লাসটা নিয়ে আবার চোখে লাগাল। হ্যাঁ, ধোঁয়াই বটে। খুব চিকন নাল ধরে উঠছে ওপরের দিকে। অতদূর থেকে খালিচোখে দেখতে পাবার কথা নয়। ও দেখতে পেয়েছে বলতে গেলে নেহাত আকস্মিকভাবেই।

ফিল্ডগ্লাস খাপে ঢুকিয়ে উঠে দাঁড়াল এরিখ। লতাপাতা আর ঝোপঝাড় সরিয়ে সামনের দিকে হাঁটতে শুরু করল। অসংখ্য ছোট-বড় পাথর ছড়িয়ে- ছিটিয়ে রয়েছে টিলার গায়ে। ওগুলোর মধ্য দিয়ে পথ করে নিতে গিয়ে রীতিমত পরিশ্রম করতে হচ্ছে ওকে। সূর্য মাথার ওপর থেকে আগুন ঝরাচ্ছে যেন, ঘামে ভিজে জবজবে হয়ে গেছে ওর পোশাক-আশাক; তবু হেঁটে চলল ও সামনের দিকে।

দুপুরের দিকে এরিখ ঢালের মাথায় গিয়ে পৌছল। চমকে উঠে নিচু স্বরে গাল বকল ও নিচের দিকে তাকিয়ে। ওর সামনে, ঢালের নিচে অসংখ্য ছোট- বড় ক্যানিয়ন। এগুলোর অস্তিত্ব টিলার ওপর থেকে দেখে আগে বোঝা যায়নি। দক্ষিণ দিকে কিছুটা দূরে একটা খাড়া পাহাড় দেখতে পেল ও। পাহাড়ের গা থেকে বুড়ো মানুষের দাঁতের মত ছোট-বড় নানা আকারের পাথর ঠেলে বেরিয়ে আছে। পাহাড়ের পাদদেশে লাল মাটির ঢাল, তাতে সবুজ গাছপালার সমারোহ। তার মানে, অনুমান করল এরিখ, ওখানে নিশ্চয় পানির উৎস রয়েছে।

ডান দিকে তাকাল ও। অনেক নিচে একটা বিস্তীর্ণ পাথুরে জমি। ইতস্তত বিক্ষিপ্ত মরাটে উদ্ভিদের সমাবেশ ওখানে। এরিখ ধোঁয়ার উৎসটা খুঁজল। কিন্তু অনেকক্ষণ ধরে তীক্ষ্ণচোখে তাকিয়েও দেখতে পেল না।

ক্যানিয়নের মেঝে ঢাল থেকে অনেক নিচে। এরিখ বুঝতে পারল, ও যেখানে দাঁড়িয়েছে, সেখান থেকে গরুর খোঁজ পাবার কোনই আশা নেই। দক্ষিণের দেয়ালটা ওখান থেকে রুইন্স ক্যানিয়নের মধ্যে ব্যারিকেডের মত দাঁড়ানো। অনেকক্ষণ পর্যন্ত ফিল্ডগ্লাসের সাহায্যে ক্যানিয়নের মেঝেয় গরুর ট্র্যাক খুঁজে পাবার ব্যর্থ চেষ্টা করল ও। শেষে হাল ছেড়ে দিয়ে ফিল্ডগ্লাস খাপে আটকাল। পিছু ফিরে যেদিক থেকে এসেছে, সেদিকে হাঁটা শুরু করল আবার।

নিজের ক্যাম্পের কাছাকাছি এসে থমকে দাঁড়াল এরিখ। ক্যাম্পের পাশে গাছের সাথে একটা মেয়ার বাঁধা, ক্রস অ্যারো ব্র্যান্ডের। এরিখের সাড়া পেতে গাস বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। এরিখের দিকে চেয়ে একগাল হাসল বুড়ো। হাঁক ছাড়ল, ‘এই যে পাহাড়ী ছাগল!’

‘কার ঘোড়া ওটা?’

‘তোমার একজন মেহমান এসেছে, অ্যামিগো!’

ওয়েন্ডি বেরিয়ে এল ভেতর থেকে। ‘তোমার কাছেই আমাকে আসতে হলো, এরিখ।’

ওর বিষণ্ণ কণ্ঠস্বর এরিখকে স্পর্শ করল। হাসল ও। ‘তোমাকে দেখে খুশি হয়েছি, ম্যাম। কেন এসেছ?’

‘গাস যখন জেমসের কাছে যায়, আমি তখন ওখানে ছিলাম,’ জবাব দিল ওয়েন্ডি। ‘হল চ্যাপম্যান যে তোমাকে মিথ্যে অভিযোগেই গ্রেফতার করেছে, গাস তা জানিয়েছে আমাকে। এরিখ, আমি ভয় পাচ্ছি। চ্যানি বিয়ারি এমন ভাব দেখাচ্ছে যেন ক্রস অ্যারোর মালিক আমি নই, ও-ই। ও আমাকে পীড়াপীড়ি করছে ওকে পাওয়ার অভ অ্যাটর্নি দেবার জন্যে। আমি সরাসরি ‘না’ বলাতে মুখ ভার করে আছে এখন সারাক্ষণ। ওর লোকেরা আকারে-ইঙ্গিতে ভয় দেখাচ্ছে আমাকে। মনে হয়, শেষ পর্যন্ত গোলমাল করবে ওরা।’

আমি আগেই ওর ব্যাপারে তোমাকে সাবধান করতে চেয়েছিলাম, ওয়েন্ডি।’

ওয়েন্ডি বিব্রত চোখে চাইল ওর দিকে। ‘তোমার কথা শোনা উচিত ছিল,’ মেনে নিল ও। ‘বেশির ভাগ গরুই হারিয়েছি আমি। বিয়ারি আর তার লোকেরা শুয়ে-বসেই দিন কাটাচ্ছে এখন। তাস খেলছে সারাক্ষণ, খামারের জন্যে কুটোটিও নাড়ছে না। রবার্ট বাটলার আমার সঙ্গে দেখা করতে চাওয়ায় ওকে ওরা পিস্তলের মুখে ভাগিয়ে দিয়েছে। এক নাগাড়ে অভিযোগ করল ওয়েন্ডি এরিখের কাছে।

ওর কথা ধৈর্যের সঙ্গে শুনল এরিখ। আমরা রাসলিঙের বিরুদ্ধে কাজ করছি,’ বলল ও। ‘যতদিন না এতে সফল হই, ততদিন ওকে সহ্য করতে হবে, ওয়েন্ডি।’

‘ও খুব বিপজ্জনক লোক। আমি র‍্যাঞ্চ থেকে পালিয়ে জেমসের কাছে চলে এসেছি। চ্যানি র‍্যাঞ্চে ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করছে। আমাকে…’ থামল ওয়েন্ডি একটু, …ও আমাকে তুমি আসার পর থেকেই শুধু বিয়ের প্রস্তাব দিচ্ছে। আমি কি করব এখন, এরিখ?’

‘আপাতত চুপ করে থাকবে। আমাদের এদিকের কাজ শেষ না-হওয়া পর্যন্ত। আর…’ একটু ভাবল এরিখ, ‘এখানে থাকতে পারবে না তুমি। ক্র্যামারদের সঙ্গে থাকো বরং কিছুদিন।

ওয়েন্ডি মাথা নাড়ল। ‘ওখানেও ধাওয়া করেছে চ্যানি। লোকজনকে বলে বেড়াচ্ছে। আমার সাথে নাকি ওর বিয়ের কথাবার্তা পাকা হয়ে গেছে। ক্রস অ্যারো নিয়ে ওর কি কি পরিকল্পনা আছে, দু’বেলা তার ফিরিস্তি শোনাচ্ছে সবাইকে। এরিখ, তুমি আর গাস চলে আসার পর হতে একা হয়ে গেছি আমি। আমার পিঠ ঠেকে গেছে দেয়ালে।’

গাস এতক্ষণ শুনছিল, এবার নাক গলাল। ‘ওকে আমাদের সঙ্গেই থাকতে দাও। সেটাই উচিত।’ সুপারিশ করল ও। ওই ভোঁদড়টাকে আমি ভাল করেই চিনি। মিস ওয়েন্ডি ওখানে এক মুহূর্তের জন্যেও নিরাপদ নয়, এরিখ।’

ওর দিকে তাকাল এরিখ। কী জেনে এসেছ তুমি শহর থেকে?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘অনেক কিছুই। অ্যাসোসিয়েশনের মীটিং হয়ে গেছে। কিছু লোক ক্যানিয়নের দক্ষিণ দিকে চলে গেছে, আর কিছু ব্লু বার্ডসের উত্তর দিক ব্লক করার জন্যে বার্জারের আদেশের অপেক্ষায় আছে। ওই নেতৃত্ব দিচ্ছে ওদের,’ গড়গড় করে খবর বলে গেল গাস। তোমার কি অবস্থা? পেয়েছ কিছু?’

ক্লিফের দিকে তাকাল এরিখ। আমার ধারণা ছিল এখান থেকে রুইন্স ক্যানিয়ন পর্যন্ত মাঝখানের জায়গাটা একটা মেসা হবে,’ বলল সে। কিন্তু ধারণা ঠিক হয়নি। মাঝখানেও একটা ক্যানিয়ন রয়েছে, একটু পশ্চিম ঘেঁষে প্রচুর পানি, আর ঘেসো জমিরও অভাব নেই ক্যানিয়নটায়। গরু-টরু অবশ্য দেখিনি। দূর থেকে ধোঁয়ার আভাস পেয়েছিলাম মনে হয়েছিল, কাছে গিয়ে আর খুঁজে পাইনি। এছাড়া পুব থেকে ক্যানিয়নে ঢোকার কোন পথ দেখতে পাইনি, সম্ভবত পশ্চিম থেকেও তাই।’

কাঁধ ঝাঁকাল ওয়েন্ডি। ‘ওই একই রহস্য।

এরিখ ওর দিকে তাকাল। ‘তোমার ফিরে যাওয়াই ভাল, ওয়েন্ডি।’

‘ওকে থাকতে বলো, এরিখ।’

ওয়েন্ডি এরিখের দিকে চাইল। আগ্রহ আর আবেদনের চিহ্ন ওর চোখে। ‘উঁহু,’ মাথা নাড়ল এরিখ। কষ্ট হবে তোমার এখানে। খুব কঠিন আর বিপজ্জনক জীবন এটা।’

‘হোক। ওকে থাকতে দাও তুমি।’ গাস ওয়েন্ডির পক্ষ নিল। রাঁধতে রাঁধতে খাওয়ার অরুচি ধরে গেছে আমার। মেয়েদেরই কাজ ওটা।’ হাসল ও।

‘ঠিক আছে,’ অগত্যা হাল ছেড়ে দিল এরিখ। চোয়াল চুলকাল। কিন্তু বিপদের আশঙ্কা দেখা দিলেই রকস্প্রিং চলে যাবে তুমি। ওখানে জেমস তোমার দেখা শোনা করবে।’ স্পেন্সারটা হাতে নিল ও। ‘আমি একটু ব্লু বার্ডস থেকে ঘুরে আসি।’

গাস ভেতরে ঢুকল। একটা শার্ট, একটা ট্রাউজার এবং একজোড়া বুট নিয়ে বেরিয়ে এল আবার। নিজের পরনের জরাজীর্ণ পোশাকের দিকে তাকিয়ে লাজুক হাসল ও। ‘তোমার অ্যামিগো হিসেবে কেমন দেখাবে আমাকে?’ নতুন পোশাকগুলো দোলাল ও এরিখের চোখের সামনে।

‘চমৎকার দেখাবে। পরবে নাকি এখন?’

নাহ্! তুমি ফিরে আসো আগে।’

এরিখ ঘোড়ায় চড়ল। ওয়েন্ডির দিকে তাকিয়ে, একটু হেসে ঘোড়া ছোটাল ও ব্লু বার্ডস ক্যানিয়নের দিকে।

.

ক্যানিয়নে ঢুকে একটা পাথরের সামনে ঘোড়া থামাল এরিখ। ক্যানিয়নের ভেতরে পাহাড় এবং গাছগাছড়ার ছায়া। এরিখ পর্যবেক্ষণের ভঙ্গিতে তাকাল চারদিকে। উত্তর দিকে চোখ পড়তেই সতর্ক হয়ে উঠল ও। ধুলো উড়ছে প্রায় আধ মাইল দূরে। জিস্টারকে নিয়ে একটা পাথরের আড়ালে চলে গেল এরিখ। স্পেন্সারটা হাতে নিয়ে অপেক্ষা করতে লাগল।

ঘোড়ার খুরের শব্দ কানে এল ওর। ক্রমে কাছে চলে এল শব্দটা। একজন অশ্বারোহীকে বাঁক পেরিয়ে আসতে দেখা গেল একটু পরেই। ও যে পাথরটার আড়ালে লুকিয়েছে, সেটাকে সামান্য দূরে রেখে পাশ কাটিয়ে যেতে লাগল অশ্বারোহী। চিনতে পারল এরিখ লোকটাকে। জর্জ চ্যাপম্যান।

আচমকা ডেকে উঠল জিস্টার। চ্যাপম্যান চকিতে ঘাড় ফেরাল। এরিখকে দেখামাত্র লাগাম ঝাড়া দিয়ে ঘোড়ার পেটে স্পার দাবাল ও। বিদ্যুৎ গতিতে জঙ্গলের ভেতর গা ঢাকা দিল ওর বিশাল বে ঘোড়াটা।

অপেক্ষা করল এরিখ। তারপর জিস্টারকে দাঁড় করিয়ে রেখে পায়ে হেঁটে সন্তর্পণে জঙ্গলের দিকে এগোল। কিছুদূর যেতেই চ্যাপম্যানের হ্যাট দেখতে পেল ঝোপের আড়ালে। পেছন থেকে ওদিকে এগোল ও পা টিপে টিপে।

‘জর্জ,’ ডাকল এরিখ। ‘ধরা পড়ে গেছ তুমি। বেরিয়ে এসো এবার, ধীরে ধীরে।’

‘অবশ্যই,’ জর্জ চ্যাপম্যান সাড়া দিল মৃদু কণ্ঠে।

চরকির মত ঘুরে গেল এরিখ। মাত্র দশ ফুট দূরেই চ্যাপম্যানকে দেখল ও। দাঁড়িয়ে আছে বিশালদেহী লোকটা ওর পেছনেই। মাথায় হ্যাট নেই, হাতে উদ্যত রাইফেল।

নিজেকে গাল দিল এরিখ। লেজে গোবরে করে ফেলেছে ও ব্যাপারটাকে। অতি পুরানো আর সস্তা একটা ফাঁদে পা দিয়ে ফেলেছে নির্বোধের মত।

‘তোমার হাতে অস্ত্র আছে, ওয়েন। গুলি করার চেষ্টা করো। তাহলে তোমার শরীরে একটা ফুটো করে দেবার ছুতো পেয়ে যাব আমি।’

স্পেন্সার আঁকড়ে ধরল এরিখ। চ্যাপম্যান হাসল। ‘সত্যিই!’ বলল সে। ‘ভাবছ বুঝি আমি হয়তো মিসও করতে পারি? আর তোমার গুলি ফসকাবে না?’

‘হ্যাঁ।’ এরিখ শান্তস্বরে জবাব দিল। ‘তুমি কি ভাবছ? অসম্ভব?’

‘তুমি,’ ওর চোখে তাকাল চ্যাপম্যান, ‘মাথা ঠাণ্ডা রাখতে পারো বটে।’

একে অন্যের দিকে তাকিয়ে রইল ওরা। মাপছে পরস্পরকে। দীর্ঘ কয়েকটি মুহূর্ত চলে গেল। নিস্তব্ধ ক্যানিয়নের ভেতর পাথরের সাথে ঘোড়ার খুরের অস্পষ্ট আওয়াজ ছাড়া আর কোন শব্দ শোনা গেল না কিছুক্ষণ।

‘আমি একা,’ চ্যাপম্যানই প্রথমে কথা বলল। ‘তোমার সাথে কিছু কথা আছে আমার।’

‘হ্যাঁ, আমারও আছে,’ সায় দিল এরিখ। ‘তোমাকে কিছু জিনিস ব্যাখ্যা করতে হবে, চ্যাপম্যান।

চ্যাপম্যান রাইফেলের নল নিচু করল। হ্যামার নামিয়ে নিল সে। তাই? ঠিক আছে। হয়তো পরস্পরকে বুঝতে পারব আমরা এতে।’

‘শুরু করো।’ স্পেন্সার নামিয়ে নিল এরিখও।

চ্যাপম্যান মেকিংস বের করে সিগারেট রোল করল। এরিখের দিকে বাড়িয়ে দিল মেকিংসটা। ‘তুমি নিশ্চয় স্বীকার করো যে, সাবধানে শব্দ বাছাই করল ও, ‘আমি তোমাকে প্রথম দিনই ঝুলিয়ে দিতে পারতাম।’

‘আমাকে ঝুলিয়ে দেবার সঙ্গত কোন কারণ ছিল না তোমার হাতে দ্বিমত পোষণ করল এরিখ।

‘সেটার দরকারও ছিল না,’ হাসল চ্যাপম্যান। ‘এখানে বাইরের যে- কোন অপরিচিত লোককেই সন্দেহের চোখে দেখা হয়। ডগকে না-থামালে ও সত্যি সত্যিই তোমাকে ঝুলিয়ে দিত। দিত না?’

‘দিত,’ স্বীকার করল এরিখ।

চ্যাপম্যান সিগারেট জ্বালাল। ‘আমি কোনদিনই বিশ্বাস করিনি যে, টোকারকে তুমি গুলি করেছ।’

‘কেন?’

‘তুমি সে রকমের লোকই নও।’

‘তাই?’ ব্যঙ্গ করল এরিখ। ‘তা জেরি ফক্সের ব্যাপারে কি ভাবছ?’

ওর ব্যঙ্গকে গায়ে না মেখে চ্যাপম্যান পাল্টা প্রশ্ন করল, ‘ওকে কে খুন করেছে, এরিখ?’

‘জো রীভস।’

‘হুঁ।’ মাথা দোলাল চ্যাপম্যান। ‘তোমার কথাই মেনে নিচ্ছি আমি।’

‘সে তোমার দয়া!’ আবারও বিদ্রূপ করল এরিখ। কিন্তু কেন বলো তো?’

হাসল চ্যাপম্যান। ‘সত্যি বলতে কী, আমার ধারণা ছিল, তুমি লোকটা সুবিধের নও। গোলমাল পাকাতে ওস্তাদ,’ চ্যাপম্যান বলতে লাগল, ‘তুমি জানো, আমি ক্রস অ্যারো র‍্যাঞ্চটা কিনতে চেয়েছিলাম, এখনও চাই। তার মানে কিন্তু এই নয় যে, ওয়েন্ডি বেচতে না-চাইলেও ওকে জোর করে বেচতে বাধ্য করব। মেয়েদের সঙ্গে লড়াই করার রুচি আমার নেই। তবে বিয়ারির ব্যাপারে আমার বক্তব্য ভিন্ন।’

‘সে ব্যাপারে আমার তরফ থেকে বাধা পাবার আশঙ্কা কোরো না তুমি।’

‘বিয়ারি বোধ হয় ক্লোর মেয়েকে বিয়ে করবে।’

‘ভুলেও তা ভেব না,’ এরিখ কঠিন কণ্ঠে জবাব দিল।

ডান কানের লতি চুলকাল চ্যাপম্যান। ‘অনেকের ধারণা, রাসলিঙের পেছনে আমার হাত আছে। ঘিলুহীন গর্দভের দল সব, না? আমার টাকা আছে, প্রচুর। এই অঞ্চলের সবার সেরা বাথানটা আমার, সবচে’ বড় গরুর পালটাও। আসলে সবারই চোখ টাটাচ্ছে এতে, কি বলো?’ থামল চ্যাপম্যান।

‘যাই হোক,’ আবার শুরু করল ও। ‘তোমার ব্যাপারে আমি অনেক চিন্তা -ভাবনা করেছি। তুমি সাহসী, শক্তিমানও। আমার ভাই হল, ডগ লেইকার, ওক টিকাউ—এদের বিরুদ্ধে দাঁড়িয়েছ তুমি। টিকাউ মরেছে তোমার হাতে। লেইকারকে তুলোধুনো করেছ। সবচে’ বড় কথা, ডব্লিউ বারকে ঘাঁটিয়েও এ- অঞ্চলে থাকার সাহস দেখিয়েছ এবং চ্যানি বিয়ারিকেও শত্রু বানিয়ে ফেলেছ।’ চ্যাপম্যান চুপ করল।

‘যথেষ্ট প্রশংসা করেছ, চ্যাপম্যান। এবার বলো মতলবটা কী।’

তীক্ষ্ণচোখে ওর দিকে চাইল চ্যাপম্যান। ‘কিন্তু যে কারণে সত্যি তোমার প্রশংসা পাওয়া উচিত, সেটা এখনও বলা হয়নি। এরিখের মুখের সামনে হাত নাড়ল ও নিষেধের ভঙ্গিতে। ‘না, আমাকে শেষ করতে দাও। সে রাতে যখন আমার লোকেরা তোমাকে রকস্প্রিঙে তাড়া করেছিল, তখন তুমি আমাকে হঠাৎই বাগে পেয়ে গিয়েছিলে। ইচ্ছে করলে সে-মুহূর্তে শেষ করে দিতে পারতে। সেটাই হত স্বাভাবিক। কিন্তু তুমি তা করোনি। খুলিতে মেরে অজ্ঞান করেছিলে স্রেফ আত্মরক্ষার খাতিরেই।

এরিখ সিগারেট জ্বালাল, টান দিয়ে ধোঁয়া ছাড়ল সে।

‘আরেকটা দিকেও তুমি আমার মনোযোগ আকর্ষণ করতে পেরেছ। জেমস ক্র্যামার এখন কিছুটা ঝগড়াটে আর রুক্ষ হয়ে গেছে। ওটা অবশ্য বুড়ো বয়সের দোষে। কিন্তু লোক হিসেবে সৎ ও। ওর সঙ্গে তোমার মাখামাখির দামও আছে। আসলে সেটা দেখেই আমার মনে হয়েছে যে, আমি মনে মনে যে লোকটাকে খুঁজেছি, সে লোক তুমিই। সৎ, নির্ভীক এবং পরিশ্রমী।’

এরিখ বিরক্ত হলো। ‘অত তেল মেরো না তো! আদতেই তুমি একটা বুড়ো শেয়াল।’ চ্যাপম্যানকে ওর সম্বন্ধে নিজের মতামত জানিয়ে দিল সে।

বিশাল থাবা মেলে ওর নাকের সামনে হাত নাড়ল চ্যাপম্যান। ‘মোটেই তা নই, এরিখ। আসলে বড় যন্ত্রণায় আছি আমি এখন। ওই রাসলিঙের মূলোচ্ছেদ করতে গিয়ে প্রচুর টাকা নষ্ট হয়েছে আমার। নিজের লোক নিয়ে আশ-পাশের সব এলাকা চষে ফেলেছি, লাভ কিছুই হয়নি। হল একটা অকর্মার ধাড়ি। বেশিক্ষণই সে ব্যস্ত নিজের শেরিফগিরির তারকাটিকে ঝকঝকে রাখার কাজে। বাকিটা কাটাচ্ছে রকস্প্রিঙের সুন্দরী মেয়েদের বুকে-পাছায় চোখ বুলিয়ে। আমি তাকে বেতন দিচ্ছি, শেরিফের কাজটাও জুটিয়ে দিয়েছি, অথচ আমার সাহায্যে একটি দিনের জন্যেও ওকে পাইনি।’

‘কেন?’ এরিখ মন্তব্য করল, ‘ডগই তো তোমার সব দেখাশোনা করছে।’

আবার সিগারেট রোল করল চ্যাপম্যান। ‘ভাল কথা, ডগ আর ওক যখন তোমাকে ট্রেইল করেছিল, সিগারেট ধরাল ও, কি ঘটেছিল তখন ওখানে?’

‘ওটা’ এরিখ কাঁধ ঝাঁকাল, ‘লেইকারকেই জিজ্ঞেস করো বরং।’

‘ওককে তুমিই হত্যা করেছ?’

‘করেছি। নয়তো ওই আমাকে হত্যা করত, ‘ কৈফিয়ত দিল এরিখ।

‘ভয়ঙ্কর লোক ছিল ও,’ কিছুক্ষণ নির্বাক থেকে চ্যাপম্যান মন্তব্য করল।

এরিখ হাসল। ‘আশা করি,’ বলল সে, ‘এখন থেকে আমার পেছনে লোক লাগাবার বদ অভ্যাস আর থাকবে না তোমার।’

মাথা নাড়ল চ্যাপম্যান। ‘তোমার পেছনে কোন লোক লাগাইনি আমি।’

‘তাহলে কে লাগিয়েছিল ওদের?’

কাঁধ ঝাঁকাল চ্যাপম্যান। ‘সম্ভবত ওটা ওদের নিজস্ব পরিকল্পনা ছিল। আমি শুধু একবারই পাঠিয়েছিলাম, রুইন্স ক্যানিয়নে। পরবর্তীতে ওরা নিজেদের ইচ্ছেতেই গেছে তাহলে।’

এরিখ নিশ্চুপ হয়ে রইল কিছুক্ষণ। পরে বলল, ‘তো এখন কি করতে বলো আমাকে? কী আশা করো আমার কাছে?’

‘কিছুই না,’ চ্যাপম্যান জবাব দিল। ‘তুমি তোমার মতই চলবে। তবে এটা জেনে নিতে পারো যে, আরও অনেকের মত আমিও তোমার ওপর নির্ভর করছি। এখানকার জঞ্জাল সাফ করে এই এলাকাকে সৎ লোকদের জন্যে বাসোপযোগী করো তুমি। খোঁজ খবর নাও; রাসলিঙের মূলোচ্ছেদ করো। কথা দিচ্ছি, প্রয়োজনের সময় ডব্লিউ বারের পূর্ণ শক্তিকেই তুমি সাহায্য হিসেবে পাবে। ঠিক আছে?’

‘তোমার কথা বিশ্বাস করি না আমি।’

হাতের তালু মেলে ধরল চ্যাপম্যান এরিখের সামনে। ‘আমাদের প্রথম সাক্ষাতের কথাটা মনে করো, এরিখ। তোমার তাঁবুতে বসে কি বলেছিলে তুমি? বলোনি তুমি চিকামগায় আহত হয়েছিলে?’

‘হ্যাঁ, বলেছিলাম-এবং সত্যিই বলেছিলাম।’

‘আমিও তা বিশ্বাস করেছিলাম। কারণ যুদ্ধের সময় কিছুদিন আমিও ছিলাম তোমার ডিভিশনের অধীনে। আমারটার নাম ছিল ওল্ড ফোর্থ আরকানসাস।’

চ্যাপম্যানের বাড়িয়ে-ধরা হাতটা ধরে, সজোরে টান দিল এরিখ; উচ্ছ্বসিত সে। ‘ফোর্থ আরকানসাস! দারুণ একটা রেজিমেন্ট ছিল ওটা—প্রায় সিক্সথ টেক্সাসের মতই।’

‘প্রায়ই?’ হাসল চ্যাপম্যান। ‘ঠিক আছে। পুরো এক বোতল রেড-আই সামনে নিয়ে এ-ব্যাপারে আলাপ করব একদিন। কি বলো?’

খুশির সাথে সায় দিল এরিখ। ‘অবশ্যই। যেদিন তোমার সময় হবে।’

কাজের কথায় এল চ্যাপম্যান। ‘আমাকে এখানে কঠোর আর উদ্ধত হতে হয়েছে। অনেকটা দায়ে পড়েই। এখানে একজন লোককে সারাক্ষণই অ্যাপাচি, ঘোড়াচোর, রাসলার আর খারাপ আবহাওয়ার বিরুদ্ধে লড়াই করে টিকে থাকতে হয়। এদেশে দুর্বলের জায়গা নেই। কিন্তু ডেভিড ক্লে ফাঁসিতে ঝোলার পর হতেই আমার ভেতরে এক ধরনের পরিবর্তন এসে যায়।

‘কার কাজ, জর্জ? ওটা?’

‘কুইন সাবে?’ হাত ওল্টাল চ্যাপম্যান। ‘তবে,’ অদ্ভুত এক কাঠিন্য ফুটে উঠল ওর গলায়, ‘যদি তাকে খুঁজে পাই, যেই হোক সে, ওকে আমি কচু- কাটা করব!’

‘প্রথম কোপটা আমাকে দিতে দিয়ো,’ এরিখ গম্ভীর কণ্ঠে বলল।

নিজের ঘোড়ার দিকে হাঁটতে শুরু করল চ্যাপম্যান। ‘তোমাকে প্রকাশ্যে সাহায্য করা সম্ভব নয়,’ বলল সে। ‘কেন, তা তুমি জানো। জেমস ক্র্যামার আর ওর অ্যাসোসিয়েশনের কথা আমার জানা আছে। জো যে ওটার হয়ে কাজ করত, সেটাও আমার অজানা ছিল না। কিন্তু ওর মৃত্যুর ব্যাপারে কিছুই করার ছিল না। তবে, তোমাকে বলছি, এই নাটকের শেষ দৃশ্যে যদি বাজি- পটকা ফোটানোর দরকার হয়, তাহলে ডব্লিউ বার তোমাকে তার যোগান দেবে। আমি জর্জ উইলিয়াম চ্যাপম্যান নিজের হাতে গুলি ছুঁড়ব তখন।’

লাফ দিয়ে ঘোড়ায় চড়ল চ্যাপম্যান। ছায়াচ্ছন্ন ক্যানিয়নের ভেতর দিয়ে উত্তরাভিমুখে ঘোড়া হাঁকাল

এরিখও তার ঘোড়ার কাছে গেল। জিস্টারের ঘাড়ে হাত বুলিয়ে ওর কেশর নেড়ে দিল। ‘শোন, জিস্টার, যতই বুড়ো হচ্ছিস, ততই আক্কেল-বুদ্ধি কমে যাচ্ছে তোর। এই চ্যাপম্যানকে, বুঝলি, এই আরকানসাসের ঘাঘুটাকে আমি সত্যিই বিশ্বাস করে ফেলেছি।

জিস্টারের পিঠে চড়ে হাইডিং-ক্যানিয়নের দিকে যাত্রা করল ও। সূর্য ডুবে গেছে প্রায়। অন্ধকার জাঁকিয়ে বসার সাথে সাথে ঠাণ্ডা বাতাস বেরিয়েছে ক্যানিয়নের ভেতর। এরিখের মাথার ওপর একটা নিঃসঙ্গ পেঁচা নিঃশব্দে ডানা ঝাপটাল। দূরে ক্যানিয়নের কোথাও নিষ্ফল অভিযোগে হাহাকার করে উঠল এক একাকী কয়োট।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *