আশ্রয় – ১

এক

ভোরের দিকে বৃষ্টি হয়ে গেছে এক পসলা। এরিখের তাঁবুর ক্যানভাসের ওপর বৃষ্টির ফোঁটা মৃদু লয়ে ড্রাম বাজিয়েছে। আধ ঘুমের ঘোরে ওর কানে বেজেছে সে-শব্দ। ভেজা বাতাস লম্বা লম্বা পাইন গাছের শাখায় শোঁ-শোঁ আওয়াজ তুলেছে। তারপর একসময় থেমে গেছে বৃষ্টি।

এরিখ ওয়েনের ঘুম পাতলা হয়ে এল আস্তে আস্তে। আড়মোড়া ভেঙে হাই তুলল ও, পাশ ফিরে শুলো। তাঁবুর ভেতর একপাশে জ্বালানো আগুনের কুণ্ড, সারারাত ধরে জ্বলে এখন নিভে এসেছে প্রায়।

আবার ঘুমোনোর আশায় চোখ বুজল এরিখ। আচমকা ওর ভেতরে কোথাও একটা সূক্ষ্ম সতর্ক-ঘণ্টি বেজে উঠল। মাথা তুলল ও। বৃষ্টি হয়ে যাবার পর প্রকৃতি এখন শান্ত। কিন্তু সেটা যেন স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি বোধ হলো ওর কাছে। আস্তে আস্তে গা থেকে প্রথমে তেরপল, তারপর কম্বল সরিয়ে উঠে বসল ও।

মগলোনে শীত এসে গেছে প্রায়, ঠাণ্ডা বাতাস বইছে। এরিখ আগুনের পাশে গিয়ে হাঁটু গেড়ে বসল। ওর পরনে শুধুই অন্তর্বাস। মজে যাওয়া আগুনের কয়লায় ফুঁ দিতে গিয়ে হঠাৎ মাথা তুলে সোজা হলো ও, পরক্ষণেই পেছন দিকে ঝাঁপিয়ে পড়ল। একটু দূরে রাখা স্পেন্সারের কাছে চলে গেল ওর হাত। ওর সতর্ক কানে তাঁবুর বাইরে ঝোপের ভেতর অস্পষ্ট নড়াচড়ার শব্দ ধরা পড়েছে।

অস্ত্রহাতে একপাক ঘুরল ও। তারপর সন্তর্পণে তাঁবুর বাইরে মাথা বের করল। বনভূমি নিথর, শান্ত; বৃষ্টিপাতের দরুন সে-শান্তভাবকে আরও নিবিড় মনে হচ্ছে। এরিখ সতর্কচোখে তাকাল।

‘অস্ত্র ফেলে দাও!’ গম্ভীর একটা কণ্ঠস্বর ভেসে এল ঝোপের ভেতর থেকে। চার-চারটে অস্ত্র তোমার দিকে তাক করা। কথা না শুনলে…’ ধমক দিল কণ্ঠস্বরের মালিক, ‘স্রেফ ঝাঁঝরা হয়ে যাবে।’

এরিখ শব্দের উৎসের দিকে তাকাল। মিথ্যে ধমক দিচ্ছে না লুকোনো কণ্ঠস্বর। একটা গাছের পেছন থেকে রাইফেলের চকচকে নল তাকিয়ে আছে ওর দিকে।

ওর আঙুল ট্রিগারের ওপর জমে গেল। বনের ভেতর আরও নড়াচড়ার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে। এ-সময় একটু বেচাল দেখলেই, এরিখ বুঝতে পারল, বৃষ্টির মত বুলেট ছুটে এসে ওর তাঁবুটাকে ঝাঁঝরা বানিয়ে ফেলবে। হাত থেকে অস্ত্র নামিয়ে কম্বলের ওপর রাখল ও, ধীরে ধীরে দু’হাত মাথার ওপর তুলল।

‘জো,’ একই কণ্ঠস্বর শোনা গেল আবার, ‘ওর অস্ত্রগুলো নিয়ে নাও আগে।’

একজন লোক বেরিয়ে এল ধীর পায়ে। লোকটা কৃশকায়, একটা হেনরী রাইফেল ওর হাতে, কোমরের কাছ থেকে তাক করা, এরিখের কাছে এসে ওর স্পেন্সারটা তুলে নিল সে। তার ইঙ্গিতে এরিখ নিজের গানবেল্ট তুলে দিল তার হাতে; ওর ক্যাপ অ্যান্ড বল কোল্ট এবং বউই নাইফটাও লোকটার হস্তগত হলো।

‘ঠিক আছে, বস্, কৃশ লোকটি ঘোষণা করল, ‘বেরিয়ে এসো এবার। ওর শিং ভেঙে দিয়েছি।’

তিনজন লোক বেরিয়ে এল জঙ্গল থেকে। তিনজনের গায়েই পনচো, বৃষ্টির ফোঁটা লেগে আছে তাতে। তিনজনই শক্ত সমর্থ, কঠিন লোক। তাদের একজন, এরিখ মনে মনে স্বীকার করল, অন্তত ওর মত দু’জনের সমান চওড়া হবে। একটা দোমড়ানো হ্যাট লোকটার মাথায়, তার ওপর একটা রঙচঙে নোংরা রুমাল পেঁচিয়ে বাঁধা চিবুকের সাথে; বিশাল মুখমণ্ডল এবড়োখেবড়ো, পাথুরে টিলার মত।

‘আগুন জ্বালাও, ডগ,’ নিজের লোকদের একজনকে হুকুম দিল লোকটা, তারপর এরিখের দিকে ফিরল। ‘কফি আছে?’

এরিখ বুড়ো আঙুলের ইশারায় একটা থলে দেখিয়ে দিল। আমি কি প্যান্ট পরে নিতে পারি?’

‘কেন?’ ডগ থলে হাতড়ে কফির সরঞ্জাম বের করল। ‘ন্যাংটো বলে লজ্জা পাচ্ছ বুঝি?’ এরিখের দিকে তাকিয়ে দাঁত বের করল ও।

এরিখ খুঁড়িয়ে হেঁটে এক কোণে রাখা কাপড়চোপড়ের কাছে গেল। প্যান্ট পরতে পরতে কাঁধের ওপর দিয়ে ফিরে চাইল ও। ‘তোমাদের উদ্দেশ্যটা কী? জানতে পারি?’

ডগ ভেংচি কাটল। ‘কথা শোনো ওর!’ কফি বানাচ্ছে সে। ‘কিটি যেন জানে না, না?’

প্রকাণ্ডদেহী চতুর্থ জনের দিকে তাকাল। ‘ওর মালপত্র চেক করো,’ হুকুম দিল সে। ‘নিশ্চয় একটা রানিং আয়রন থাকবে ওর সাথে।’

চতুর্থজন এরিখের মালপত্র চেক করতে শুরু করল। এরিখ লক্ষ করল, লোকটা দোআঁশলা। বিশাল চ্যাপটা মুখ, গুটিবসন্তের দাগে ভরা। মেহগনি রঙের কুৎসিত মুখমণ্ডলে গর্তে বসানো ক্রুর নীলাভ চোখ- যে কেউ আতঙ্কিত হবে।

বিশালদেহী এরিখের দিকে তাকাল। ‘নাম কি তোমার?’

‘ওয়েন, এরিখ ওয়েন।’

‘পেশা কি?’

‘শিকার।’

‘অ। আমি জর্জ চ্যাপম্যান,’ নিজের নাম বলল সে। ‘ডব্লিউ বার র‍্যাঞ্চের মালিক। বাইরের লোকও এখানে শিকার করতে আসে, জানতাম না।’

‘এখন তো জেনেছ।’

‘তা জেনেছি,’ এরিখের সঙ্গে একমত হলো লোকটা। ‘টেক্সাসের লোক?’

‘হ্যাঁ।’

‘কতদিন ধরে এদিকে আছ?’

‘মাসখানেক হবে।’

এরিখ বিছানার ভাঁজ হাতড়ে তামাকের সরঞ্জাম বের করল। আড়চোখে চাইল চ্যাপম্যানের দিকে। চ্যাপম্যান ওকে দেখছে একদৃষ্টিতে।

‘বিদ্রোহী মনে হয়!’

এরিখ পাইপ ধরাল। আমি কনফেডারেট ছিলাম। বিদ্রোহী বলতে যদি তুমি ওদের বুঝিয়ে থাকো…’

কাঁধ ঝাঁকাল চ্যাপম্যান। এরিখের পায়ের দিকে আড় চোখে তাকাল। ‘আহত?’

‘হুঁ।’

‘কোন্ রেজিমেন্টে ছিলে?’

‘সিক্সথ টেক্সাস। মুরের ডিভিশন।

দোআঁশলা কাছে এগিয়ে এল। ‘নেই, বস্।’ একঘেয়ে কণ্ঠে জানাল ও। ‘ভাল ভাবেই খুঁজেছি।’

‘তাতে কিছু প্রমাণিত হচ্ছে না। মাথায় সামান্য ঘিলু থাকলে কেউই ওটা হাতের কাছে রাখবে না। এরিখের দিকে ফিরল ও। তুমি সম্ভবত চ্যান্সেলসভাইলে আহত হয়েছিলে?’

‘না।’ এরিখ মাথা নাড়ল। ‘যতদূর জানি লংস্ট্রীটের ফার্স্ট কোর তখন সাফোকেই ছিল।’

‘তো?’

‘চিকামগায়।

ডগ থুতু ফেলল। ‘জঘন্য মিথ্যুক তো! ওটা ছিল ব্রাক্সটন ব্রাগের লড়াই। বস্,’ বিশালদেহীর দিকে ফিরল ও, ‘যে-লোক যুদ্ধ সম্পর্কে মিথ্যে বলছে, সে কি অন্য ব্যাপারে সত্য বলবে?’

চ্যাপম্যান ওকে পাত্তা দিল না। ‘তাহলে তুমি মুরের লোক ছিলে এবং ব্রাগের পক্ষে যুদ্ধ করেই আহত হয়েছ?’

ডগ আগুন উসকে দিল। আমাদের সাথে দড়ি আছে,’ সুপারিশ করল ও, চলো, ঝুলিয়ে দিই। এখানে কেউই ওকে চেনে না।’

‘যুদ্ধ সম্বন্ধে কী জানো তুমি?’ ঘোঁৎ করে বিরক্তি প্রকাশ করল র‍্যাঞ্চমালিক। ‘তুমি তো সে-সময় আরকানসাসে বসে পচা ডিমে তা দিচ্ছিলে। মুরগি চুরি আর সৈন্যদের সাথে জুয়া খেলে সময় কাটাচ্ছিলে। এই লোক,’ এরিখের দিকে ইঙ্গিত করল সে, ‘সত্যি কথাই বলছে।’

‘চিকামগায়!’ নাক ঝাড়ল ডগ।

চ্যাপম্যান মাথা দোলাল। ‘বুড়ো লংস্ট্রীট সেপ্টেম্বর মাসে দক্ষিণ ভার্জিনিয়া সেনাদল থেকে আলাদা হয়ে ব্রাগের সঙ্গে যোগ দেয়। সাম লংস্ট্রীটের প্রথম কোরের মুরের ডিভিশন, যেটার নাম সিক্সথ টেক্সাস, ওটা ছিল তখন চিকামগায়।’

‘তাই?’ ডগ এরিখের দিকে তাকাল। ‘আমি দুঃখিত, ল্যাংড়া মিয়া!’ দেঁতো হাসি হাসল সে।

এরিখের মুখ লাল হয়ে উঠল। চুপচাপ পাইপ টানতে লাগল ও। নিজেকে বোঝাল, এখনও সময় হয়নি। জো তাঁবুর পেছনে টহল দিচ্ছে, ওর রাইফেল এরিখকে কাভার করে রেখেছে। চতুর্থ ব্যক্তি, ওক টিকাউ যার নাম, একমনে নখ পরিষ্কার করছে ওর ধারাল মেক্সিকান চুচিলার আগা দিয়ে। ওর চোখ এরিখের ওপর, ভুরুর নিচ থেকে এদিক-ওদিক তাকানোর ফাঁকে ফাঁকে ওকে ওজন করে নিচ্ছে।

পাইপ ঝাড়ল ও। ‘হঠাৎ আমার ওপর হামলে পড়লে কেন, চ্যাপম্যান? জানতে পারি?’

চ্যাপম্যান হাসল। ‘গত মাসে প্রায় চারশো গরু হারিয়েছি আমরা। ট্র্যাক অনুসরণ করে এখান থেকে দক্ষিণ দিকে ক্যানিয়নের শেষ পর্যন্ত গিয়েছি। কিন্তু তারপরই হাওয়া। এখানকার সব র‍্যাঞ্চারেরই একই অবস্থা। মরিয়া হয়ে খুঁজছে ওরা অপরিচিত যে-কোন লোককে। কেউ যদি নিজের সম্পর্কে সন্তোষজনক তথ্য দিতে না পারে, কপালে খারাবি আছে তার।’

‘আমার মতই অপরিচিতদের, তাই না?’

‘হ্যাঁ। তোমার মতই।’

এরিখ চোয়ালে হাত ঘষল। ‘আমি নেহাৎ শিকারী।’ শান্তভাবে সাফাই গাইল ও। ‘র‍্যাঞ্চার আর দক্ষিণের টহলদার সৈনিকদের কাছে শিকারের মাংসবিক্রিই আমার কাজ।’

‘এদিকে তো যথেষ্ট শিকার মেলার কথা নয়,’ জো মন্তব্য করল। ‘নাকি মেলে?’

‘মেলে না। তবে নুন, বেকন, তামাক, কফি আর কার্তুজ কেনার পয়সা হয়ে যায়। তাছাড়া…’ একটু থেমে বলল ও, ‘জায়গাটা পছন্দ আমার।’

‘নিঃসঙ্গ নেকড়ের মত, তাই না!’ চ্যাপম্যান ব্যঙ্গ করল।

‘একাকী থাকতে চাওয়া কিংবা শিকার করাকে নিশ্চয় অপরাধ বলে ভাবছ না তোমরা?’ এরিখ জানতে চাইল।

‘না,’ ওকে আশ্বস্ত করল র‍্যাঞ্চার। অন্তত যতক্ষণ কোনও লোক অন্যের স্টক থেকে শিকার না করে।’

‘কাউকে পেয়েছ এদিকে?’

‘না। পাব বলে আশাও করিনি।’

এরিখ চিন্তিতমুখে চুপ করল। ডগ কফির কাপ ভর্তি করে দিল। ওকে নিয়ে কি করব আমরা, বস্?’ প্রশ্ন করল ও।

‘অধৈর্য হয়ো না,’ চ্যাপম্যান পরামর্শ দিল। ‘হয়তো ও কিছু দেখে থাকবে।’ জিজ্ঞাসুদৃষ্টিতে চাইল সে এরিখের দিকে।

এরিখ ডগের বাড়িয়ে দেয়া কফির কাপ গ্রহণ করল। ‘হপ্তাখানেক আগে,’ কফিতে চুমুক দিল ও, ‘এখান থেকে মাইল পাঁচেক দক্ষিণে ক্রীকের শেষ মাথায় গরুর ডাক শুনেছিলাম…’

‘সম্ভবত আমরাও ওগুলোকে ট্রেইল করেছিলাম,’ মাথা নাড়ল চ্যাপম্যান। ‘শেষ পর্যন্ত কিছুই পাওয়া যায়নি।’

‘এইটুকুই জানি আমি।’ এরিখ কফির কাপে লম্বা চুমুক দিল।

সিগারেট রোল করল চ্যাপম্যান। ‘এই অঞ্চল সম্পর্কে কতটা জানো তুমি?’ জানতে চাইল ও।

‘অনেকের চেয়ে বেশি, এরিখ জবাব দিল। ‘দু’বছর ধরে শিকার করছি, শীতকালেও। একবার তো প্রায় মরতে বসেছিলাম শীতে জমে।’ হাসল সে

চ্যাপম্যান উঠে দাঁড়াল। নিজের লোকদের তাড়া দিল। ‘চলো যাই।’

তিনজন একবার এরিখকে দেখে নিয়ে চ্যাপম্যানের দিকে চাইল।

‘ওর কি হবে?’ জানতে চাইল ডগ।

‘ওকে শিকার করতে রেখে যাব,’ চ্যাপম্যান জবাব দিল।

লিটকে রেখে গেলে আরও ভাল হত,’ ডগ দ্বিমত পোষণ করল।

‘সি সি।’ টিকাউ একমত হলো ওর সঙ্গে। ওয়েনের দিকে চাইল সে। ওর চোখ চক চক করছে।

চ্যাপম্যান এরিখের হাত ধরল। ওর পাইপের বাউলে নিজের সিগারেটের শেষাংশ গুঁজে দিল। এরিখ অনুভব করল, প্রচণ্ড শক্তি লোকটার মুঠোয়। ধূসর চোখের অন্তর্ভেদী দৃষ্টিতে ওকে বিদ্ধ করল লোকটা। তারপর হাসল।

‘রক্তপিপাসু বেজন্মা, সব কটাই, না?’ নিজের লোকদের দিকে ইঙ্গিত করল চ্যাপম্যান।

‘বিনা প্রমাণে ঝোলানো যায় না,’ মন্তব্য করল জো। ডগ আর টিকাউর সঙ্গে মতের মিল হয়নি ওর।

চ্যাপম্যান এরিখের হাতকে নিপীড়ন থেকে রেহাই দিল। হাতটা অসাড় হয়ে গেছে, ভাবল এরিখ।

‘ডগের হাত দড়িতে সব সময়ই চালু,’ ব্যাখ্যা করল ডব্লিউ বার র‍্যাঞ্চের মালিক। ‘গরু কিংবা মানুষ, যাই বলো। আর ওককে খারাপ বললে কমই বলা হয়। ওর সম্পর্কে, এরিখ, তুমি জেনে রাখতে পারো। মা ইউটে, বাবা হাফ মেক্সিকান হাফ ওলন্দাজ- তার মানে ডবল দোআঁশলা। এ-অঞ্চলে ওর মত দক্ষ ট্র্যাকার দ্বিতীয়টি নেই।’ ভুরু কুঁচকে কিছু ভাবল কয়েক সেকেন্ড। ‘তুমি থাকতে পারো এখানে,’ অনুমতি দেবার ভঙ্গিতে বলল র‍্যাঞ্চমালিক ‘তবে না জানিয়ে চলে যাবার চেষ্টা কোরো না। ওক প্রেতকেও ট্রেইল করতে পারে।…আমরা নিশ্চিত নই যে, তুমি গরু চুরির মত জঘন্য কাজে জড়িত আছ। কিন্তু যদি নিশ্চিত হই, থুতু ফেলল ও, ‘ওক তা জানবে। দ্বিতীয় বার তোমার সাথে এতটা ভদ্রতা নাও দেখাতে পারি।’

নিজের লোকদের দিকে তাকাল র‍্যাঞ্চমালিক। ‘চলো।’

‘এখনও ভেবে দেখো, বস্, ডগ ঘ্যান ঘ্যান করল, ‘ওকে ঝুলিয়ে দেয়াই উচিত আমাদের। গরুচোরের জন্যে ওটাই একমাত্র শাস্তি।’

‘থামো তুমি!’ চ্যাপম্যান ধমক লাগাল। ‘বাজে বোকো না।’

র‍্যাঞ্চারের পিছু পিছু বৃষ্টিভেজা ঝোপের ভেতর ঢুকে গেল লোকগুলো। কয়েক মুহূর্ত পরেই ভেজা মাটিতে ঘোড়ার খুরের ভোঁতা শব্দ শোনা গেল। কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে মনে মনে পরিস্থিতি বিচার করল এরিখ। ডগ লেইকারের ঘিনঘিনে হাসি আর ওক টিকাউর সাপের মত মসৃণ চোখের দৃষ্টি অস্বস্তিতে ভোগাচ্ছে ওকে। এখান থেকে সরে পড়ার তাগিদ বোধ করল ও। তাড়াতাড়ি তাঁবু গুটিয়ে নিল। মালপত্র বিশেষ কিছু নেই; চার বছরের যোদ্ধা জীবন ওকে যথাসম্ভব কম জিনিসপত্র নিয়ে চলতে শিখিয়েছে

শীত এসে গেছে প্রায়। এরিখ দক্ষিণে সনোরার দিকে যাবার কথা ভাবল। মালপত্র গুছিয়ে নিয়ে ঝরনার কাছে গেল ও। ওখানে একটা জায়গায় ওর ঘোড়া লুকানো; ঘোড়া নিয়ে আগের জায়গায় ফিরে এসে ওটার পিঠে চাপাল ওগুলো।

ও যখন চলতে শুরু করল, তখন সূর্য পুবদিকের পর্বতশীর্ষ থেকে উঁকি দিচ্ছে। একটু পরেই খোলা আকাশে বেরিয়ে পড়বে ওটা। ঘোড়ার ঘাড়ে মৃদু চাপড় দিয়ে বিড় বিড় করল এরিখ, ‘চলে যাবার সময় হলো রে। এখানে কারও কাছে আমরা খাতির পাব না।’

এবড়োখেবড়ো ট্রেইল বেয়ে নিচে নেমে এল ও। সূর্য এখন পর্বতশীর্ষ পেরিয়ে আরও ওপরে উঠেছে। ও মাঝে-মধ্যে স্যাডল থেকে পেছনে মাথা ঘুরিয়ে ফেলে আসা ঝোপ ঝাড় পরীক্ষা করছে। সুনসান নীরবতা চারদিকে, জীবনের চিহ্ন নেই কোথাও। শুধু, মাথার ওপরে, আকাশে দু’একটা শিকারী চিল অলস পাখা মেলে ভাসছে।

‘ধ্যাত্তেরি!’ খিস্তি আওড়াল এরিখ। ভালই ছিল ওর ক্যাম্পটা। একা একা থাকার জন্যে আদর্শ জায়গা। কিন্তু এরকমই হয়। যখনই, ও দেখেছে, কোন একটা জায়গা পছন্দ হয় ক্যাম্প করার জন্যে, মোটামুটি একটু গুছিয়ে বসে- তখনই এরকম কিছু একটা ঘটে। আসলেই যুদ্ধের পর পাঁচ বছরের মধ্যে গোটা অ্যারিযোনা যেন বেকার, ভবঘুরে, প্রাক্তন সৈনিক, সেটলার আর রাসলারের আখড়ায় পরিণত হয়েছে। দুর্নীতি আর অনাচারে ছেয়ে গেছে সবকিছু। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, প্রত্যেকেই প্রত্যেকের দিকে সন্দেহের চোখে তাকাচ্ছে।

একটা অগভীর উপত্যকায় পৌছল ও, ধোঁয়ার গন্ধ নাকে ভেসে এল। এদিক-ওদিক তাকাতেই একটা কাঠের তৈরি ঘর চোখে পড়ল ওর। ঘরের পেছন দিকটা ঢালু জায়গা, নেমে গেছে ওটা ওদিকে। এরিখ ঘরটার দিকে এগোল। কাছাকাছি হতেই একটা ঘোড়া ডেকে উঠল করাল থেকে। সম্ভবত জিস্টারকে অভ্যর্থনা জানাল ওটা। হঠাৎ ঘরের দরজা খুলে গেল সশব্দে, একটা মেয়ে বেরিয়ে বারান্দায় এসে দাঁড়াল। এরিখকে এক নজর দেখল মেয়েটা, তারপর ভেতরে ঢুকে গেল।

এরিখ ফটকের কাছে গিয়ে ঘোড়া থামাল। নামতে যাবে- এমন সময় মেয়েটি বেরিয়ে এল আবার।

‘ওখানেই দাঁড়াও,’ পরিষ্কার কণ্ঠে উচ্চারণ করল মেয়েটি।

এরিখ ধীরে-সুস্থে ঘোড়া থেকে নামল। তারপর মেয়েটির নির্দেশমত দাঁড়িয়ে পড়ে ওর দিকে তাকাল। মেয়েটার কৃশ, বাদামী রঙের হাতে একখানা ভারী শার্পস রাইফেল। মুখিয়ে আছে ওটা এরিখের দিকে।

‘কে তুমি? কি চাও এখানে?’ মেয়েটি প্রশ্ন করল।

সশব্দে শ্বাস টানল এরিখ। ‘মেয়েদের হাতেও অস্ত্র!’ জিস্টারকে বলল ও নিচুস্বরে। সশব্দে শ্বাস টানল ঘোড়াটাও। যেন বোঝাতে চাইল, এরিখের মত সেও লক্ষ করেছে ব্যাপারটা। এরিখের হাত ওর কানের পাশ ঘেঁষে দোমড়ানো হ্যাটের ওপরে উঠে গেল।

‘পথিক,’ জবাব দিল এরিখ। ‘এখান দিয়ে যাচ্ছিলাম। বাড়িঘর দেখেই মনে হলো আমার কিছু নুন আর কফির দরকার।’

‘এগিয়ে আসো, আস্তে আস্তে।’ সতর্ক কণ্ঠে বলল মেয়েটি।

এরিখ এগিয়ে গেল। কাছে গিয়ে মেয়েটিকে ভাল করে দেখবার সুযোগ পেল সে। বিশ কি একুশ বছর হবে বয়স। চুল সোনালি নয়, মধুরঙা বলা যায়; পরিপাটি করে আঁচড়ানো। ধূসর চোখ, মুখ কিছুটা চৌকো, নিখুঁত সুন্দরী বলা যাবে না- তবে সারাক্ষণ ঘোড়ার পিঠে কাটানো নারীসঙ্গবর্জিত একজন পুরুষের কাছে যথেষ্ট আকর্ষণীয়া, স্বীকার করতেই হবে।

‘এরিখ ওয়েন, আমার নাম,’ বলল ও।

‘কোত্থেকে এসেছ?’

‘টেক্সাস থেকে, ম্যাম।’ এরিখ হাসল।

মাথা নাড়াল মেয়েটি। এখন কোত্থেকে? ওর কণ্ঠে কিছুটা অসহিষ্ণুতা।

‘উত্তর থেকে,’ জানাল এরিখ। ‘দক্ষিণে যাচ্ছি, সনোরায়।’

‘ওদিকে কাউকে দেখেছ?’

‘দেখেছি। চারজন লোক।’

‘কারা ওরা?’

‘একজন নিজের পরিচয় দিয়েছে চ্যাপম্যান বলে, জর্জ চ্যাপম্যান। বাকি তিন জন জো, ডগ আর ওক টিকাউ।’

‘ডব্লিউ বার। চ্যাপম্যান মালিক। বাকিরা কর্মচারী হবে।’ থামল মেয়েটা। ‘আর কাউকে দেখোনি?’

এরিখ মাথা নাড়ল। ‘না,’ মেয়েটার দিকে চেয়ে আছে ও। মেয়েটা চিন্তিত। ‘দেখিনি।’

আমার বাবা ওখানে কোথাও আছে।’ এরিখ যেদিক থেকে ট্রেইল বেয়ে নেমে এসেছে, সেদিকের পাহাড়ের দিকে তাকাল মেয়েটা। আমি ওয়েন্ডি ক্লে,’ এরিখের দিকে চোখ ফেরাল ও, ‘ডেভিড ক্লের মেয়ে।’

আঙুল মটকাল এরিখ, মাথার ওপর হাততোলা অবস্থায়। ‘আমি কি হাত নামাতে পারি?’

ওয়েন্ডি মাথা ঝুঁকিয়ে অনুমতি দিল, কিন্তু ওর রাইফেল এরিখের পেটের ওপর থেকে এক চুলও সরল না।

‘এখানে কি করছিলে তুমি?’

‘এখানেও সে-প্রশ্ন!’ বিড়বিড় করল এরিখ।

‘মানে?’

‘কিছু না।’ এরিখ দ্রুত হাসল। ‘স্রেফ কিছু না, ম্যাম। আমি একজন শিকারী। বেশিরভাগ সময় ওই পাহাড়েই কাটিয়েছি। একজন নিরাশ্রয় ভবঘুরেও বলতে পারো আমাকে।’

‘তাহলে,’ ওয়েন্ডি আড়চোখে তাকাল ওর জরাজীর্ণ পোশাকের দিকে, ‘ঘোড়াটা একটু বেমানান, না?’

এরিখ জ্বলে উঠল। ‘সেটা আমার সমস্যা!’

‘তাহলে তুমি আমার বাবাকে দেখোনি?’ প্রসঙ্গ পাল্টাল মেয়েটি। ‘তোমার মতই লম্বা, চোখ-চুল ধূসর। একটা মেয়ারে চেপেছে।’

‘না,’ সোজা-সাপ্টা জবাব দিল এরিখ।

মেয়েটি ঠোঁট কামড়াল। ওর চোখে অনিশ্চিত দৃষ্টি, এরিখকে পাশ কাটিয়ে দূরের পাহাড়ের দিকে চলে গেছে। ওর হাতে ভারি রাইফেল, তবু, এরিখ ওকে একটা বাচ্চা মেয়ে ছাড়া অন্য কিছু ভাবতে পারছে না, যে মেয়ে নিজের বাবাকে হারিয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে খুঁজছে।

‘আমাদের দু’জন লোক সকাল বেলা বাবাকে খুঁজতে বেরিয়েছে, ‘ মেয়েটি এরিখকে জানাল। ‘বাবার গতরাতেই ফেরার কথা। আমাদের লোকগুলো এখনও কোন খবর আনতে পারেনি।’

এরিখ চোয়াল ঘষল। এদিকে শুনলাম গরুচোরের উৎপাত খুব। তোমার বাবা হয়তো রাসলিঙের চিহ্ন-টিহ্ন কিছু পেয়েছে, ফলে ফিরতে দেরি হচ্ছে।’

মেয়েটি রাইফেল নামাল। ‘তোমাকে বোধহয় বিশ্বাস করা যায়। তুমি যদি,’ প্রস্তাব দিল ও, ‘বাবার খোঁজে যাও, তোমার চাহিদা মিটিয়ে দেব আমি।’

এরিখ সাথে সাথে প্রস্তাবটা নাকচ করে দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু মেয়েটির দিকে তাকিয়ে মত পাল্টাল। দুশ্চিন্তায় মেয়েটিকে প্রায় অসুস্থ দেখাচ্ছে।

‘ঠিক আছে, ম্যাম।’ বলল সে, ‘যাব আমি। কোন পথে গেছে তোমার বাবা?’

‘যে পথে তুমি এসেছ, সে পথে মাইল খানেক গেলে ট্রেইল থেকে একটা পথ বেরিয়েছে দেখতে পাবে, ডান দিকে। ডীপ শ্যাডো ভ্যালির পথ ওটা। বাবা ওখানে কোথাও আছে।’ বিষণ্ণ স্বরে পথের হদিস বাতলাল মেয়েটি।

এরিখ ওর ঘোড়ার কাছে গেল। ঘাড় ফিরিয়ে মেয়েটির দিকে তাকাল ও। ‘কি কি চেয়েছিলাম, ভুলে যেয়ো, ম্যাম। তোমার বাবাসহ ফিরে এসে মেয়েলি হাতের রান্না খাবার কথা ভাবছি আমি। ঘোড়ায় চড়ল ও।

‘বাবাকে নিয়ে এসো,’ সম্মতি জানাল মেয়েটি। ‘দুটোই পাবে।’

এরিখ ব্যাক-ট্রেইলে কিছুদূর গিয়ে নির্দেশিত পথটি পেল। মোড় নিল সে। কিছুক্ষণ ঘোড়া চালিয়ে একটা নিচুমত উপত্যকায় গিয়ে পৌঁছল। অন্ধকার, স্যাঁতসেঁতে উপত্যকা; একদিকের পাহাড়ের চুড়ো ছুরির ফলার মত ওপরের দিকে উঠে গিয়ে সূর্যালোককে আড়াল করেছে। বাতাস ভারি, ভ্যাপসা গন্ধমাখা; ছায়া-ছায়া অন্ধকারে সব অস্পষ্ট। ঠাণ্ডা বাতাস হুল ফোটাচ্ছে এরিখের কানে আর মুখে। শিপস্কিনের তৈরি কোটের কলার তুলে দিল সে। বিড় বিড় করল, ‘ছায়া উপত্যকা না মৃত্যু উপত্যকা? মনে হয়, শেষেরটাই।’ নিজের অভিমত ব্যক্ত করল সে, নিজের কাছেই।

জিস্টারই প্রথম জানান দিল। মৃদু অথচ তীক্ষ্ণ স্বরে ডাকল ওটা, নাক ঝাড়ল ঘোৎ করে, পরমুহূর্তেই ভয়ে চমকে উঠে একদিকে ঝাঁপিয়ে পড়ার উপক্রম করল। এরিখ দ্রুত ঘোড়া সামলে নিয়ে অস্ত্র বের করল। এদিক- ওদিক তাকাল সে। কিছুই ঘটল না। পিঠে মৃদু চাপড় দিয়ে শান্ত থাকতে নির্দেশ দিল ও জিস্টারকে; তারপর স্পেন্সারটা নিজের উরুর ওপর আড়াআড়ি ভাবে রেখে সন্তর্পণে বৃষ্টিভেজা অন্ধকার ঝোপ পরীক্ষা করতে লাগল।

ডানদিকে খসখসে একটা শব্দ হলো। গাছের সাথে কোন কিছুর ঘর্ষণের শব্দ। এরিখ তীক্ষ্ণ দৃষ্টিতে ছায়া-অন্ধকারে তাকাল। ছায়ার মধ্যে অপেক্ষাকৃত গাঢ় আরেকটা ছায়া। আস্তে আস্তে অন্ধকার কিছুটা সয়ে এল ওর চোখ। চমকে উঠল ও। একটা মানুষ!

মানুষটা ঝুলছে একটা গাছের ডাল থেকে। মৃদু বাতাসে দুলছে একটু একটু। এরিখ ঘোড়া থেকে নামল। দু’হাতে জঙ্গল সরিয়ে ওটার কাছে গিয়ে পৌঁছল ও। ঝুলন্ত লোকটার পায়ের গোছা ধরে নিজের দিকে ফিরিয়ে মুখ দেখল। লোকটার মুখ বিকৃত, চোখ বিস্ফারিত। ছায়া-অন্ধকারেও তার চোখের রঙ এরিখের দৃষ্টি এড়াল না। ধূসর। লোকটার মাথায় টুপি নেই, চুল পেছন দিকে ওল্টানো। লোকটার চুলের রঙ লক্ষ করল এরিখ- ধূসর।

ওয়েন্ডির বর্ণনার সঙ্গে মিলিয়ে নিল ও। বিড়বিড় করল, এই লোকই ডেভিড ক্লে।

পিছিয়ে এল ও। শিস দিল। ঘোড়াটা নার্ভাস ভঙ্গিতে দাঁড়িয়ে ছিল, আস্তে আস্তে কাছে এল ওটা। এরিখ ঘোড়ার স্যাডলে উঠে দাঁড়াল। কোমর থেকে ছুরি বের করে দড়ি কেটে লাশটাকে সাবধানে নিচে নামাল। তারপর আড়াআড়িভাবে ঘোড়ার পিঠে তুলে নিল ওটাকে। ঘোড়ার বুকের নিচ দিয়ে দড়ি চালিয়ে লাশের পায়ের গোছা আর হাতের কবজি শক্ত করে বাঁধল, যাতে পড়ে না যায়। ঘোড়াটা প্রথমে একটু অস্বস্তি প্রকাশ করলেও মেনে নিল শেষ পর্যন্ত। ওটার পিঠে চড়ে ব্যাক-ট্রেইল ধরল এরিখ।

‘সত্যি ওটা মৃত্যু-উপত্যকা,’ জিস্টারের সাথে কথা বলছে ও। ‘বল্ তো, মেয়েটাকে কিভাবে খবরটা দিই?’

নাক ঝাড়ল জিস্টার ঘোঁৎ করে। জানে না ও।

এরিখ ডেভিড ক্লের প্রাণহীন দেহের দিকে তাকাল। ঘোড়ার পিঠে আড়াআড়ি ভাবে উপুড় হয়ে পড়ে আছে দেহটা। ঘোড়ার চলার তালে তালে নড়ছে। উঁচু হচ্ছে, নিচু হচ্ছে, কেঁপে উঠছে। জীবিত মানুষের জন্যে অস্বস্তিকর অবস্থা-কিন্তু মৃতের জন্যে কিছুই না। অথচ কালও জীবিত ছিল লোকটা, নিজের হাতে ঘোড়া চালিয়েছে। আর আজ! গা গুলিয়ে উঠল ওর।

ডগের কথামত কাজ হলে ওর নিজের অবস্থাও এরকম হত। কপাল ভাল বলতে হবে ওর। যেভাবেই হোক, চ্যাপম্যানকে বিশ্বাস করাতে পেরেছে ও নিজের কথা। তাতেই ডগ এবং টিকাউর ইচ্ছে সফল হয়নি। শুধু তা-ই নয়, চ্যাপম্যান যাবার সময় বদান্যতা দেখিয়ে এরিখের অস্ত্রশস্ত্রও ফেরত দিয়ে গেছে। বদান্যতা? হয়তো বা। তবে ওর হুমকির কথাও ভোলেনি এরিখ।

চ্যাপম্যান ওকে এ জায়গা ছাড়তে নিষেধ করেছে। বলে গেছে আগামীবার তারা অতটা ভদ্র নাও হতে পারে। তবে, এরিখ ভাবল, একটা কথা জেনে যায়নি যে, আগামীবার তারা ওকে এরকম অসতর্ক অবস্থায় নাও পেতে পারে। সে যা-ই হোক, এরিখ ওদের কথা মানবে না। আজই এ জায়গা ছেড়ে চলে যাবে ও। আজই ও ঘোড়া ছোটাবে সনোরার পথে

মূল ট্রেইলের কাছাকাছি আসতেই ঘোড়ার খুরের শব্দ শুনল ও। সতর্ক হলো। কিন্তু ট্রেইল ছেড়ে ঝোপের ভেতর লুকোনোর আগেই ঘোড়- সওয়ারদের সাথে দেখা হয়ে গেল ওর। তাদের একজন ওকে দেখেই অস্ত্রে হাত দিতে গেল। কিন্তু চোখের পলকেই এরিখের হাতে স্পেন্সার উঠে এল। লোকটার পেট সই করল ও। হাত সরাও ওখান থেকে। আজকের জন্যে যথেষ্ট বিরক্ত হয়েছি আমি।’

লোকটা আধাআধি বের করে আনা কোল্টটা ঠেলে ঢুকিয়ে দিল আবার খাপের ভেতর। ‘আমি যদি ভুল না দেখে থাকি, জেন্ট,’ সঙ্গীকে বলল ও, ‘এটা ডেভিড ক্লে’র লাশ!’

জেন্ট ঘোড়াসহ সামনে এগিয়ে এল। এরিখের দিকে তীক্ষ্ণ চোখে তাকিয়ে প্রশ্ন করল, ‘কী ঘটেছিল?’ ডেভিড ক্লের মৃতদেহের দিকে ইঙ্গিত করল ও।

এরিখ শান্তকণ্ঠে জবাব দিল, ‘ডীপ শ্যাডো ভ্যালিতে পেয়েছি ওকে। গাছের ডালে ঝুলছিল।

চরকির মত ঘুরে গেল জেন্টের ঘোড়া। ‘ঠিক তাই ঘটেছে, সেথ।’ উদ্ভ্রান্তের মত সঙ্গীকে বলল ও, ‘গোলমালের আশঙ্কা করছি আমি। চামড়া বাঁচাতে হলে এক্ষুণি ভাগা উচিত আমাদের।’

স্পেন্সারটা নাড়াল এরিখ। ‘দাঁড়াও!’ হুকুম করল সে। ‘তোমরা ক্লে’র লোক?’

‘ছিলাম, মিনিটখানেক আগেও, ‘ সেথ জবাব দিল। ‘কেন?’

‘মিস ক্লে বলছিল তোমরা তার বাবাকে খুঁজতে বেরিয়েছ।’

তাকে পেয়েছি আমরা, বন্ধু। তোমার ঘোড়ার পিঠে, মৃত, সেথ জবাব দিল। জেন্টের দিকে ফিরল ও। ‘চলো ভাগি, দড়ি হাতে ওদের কাউকে দেখার আগেই—’

ঘোড়ার পেটে স্পারের খোঁচা লাগাল লোকটা। এরিখ কিছু বলার আগেই ট্রেইলে গিয়ে পড়ল। জেন্টও অনুসরণ করল সঙ্গীকে। কিছুক্ষণের মধ্যেই তাদের ঘোড়ার খুরের শব্দ মিলিয়ে গেল।

কাঁধ ঝাঁকাল এরিখ। ঘোড়া নিয়ে র‍্যাঞ্চের দিকে এগোল। ঘরের কাছাকাছি এসে একটা ঝোপের পাশে দাঁড় করাল ঘোড়াটাকে। তারপর ঘরের দিকে পা বাড়াল।

ওয়েন্ডি অপেক্ষায় ছিল। এরিখ ফটকের কাছে পৌছার আগেই ওকে দেখতে পেল সে। দৌড়ে বেরিয়ে এল মেয়েটা। ফটক পেরিয়ে এরিখের মুখোমুখি হলো। একটু দূরেই দাঁড়িয়ে আছে ঘোড়াটা শান্ত ভঙ্গিতে। মেয়েটি দেখল।

বাবা!’

এরিখ মাথা থেকে টুপি নামাল। নড করল সে, বিষণ্ন মুখে।

‘কি করে পারল ওরা?

এরিখ জবাব দিল না। মাটির দিকে তাকিয়ে রইল ও। জানে, মেয়েটা ওকে প্রশ্ন করছে না।

‘ওরা কি করে পারল?’ মেয়েটির কণ্ঠ রুদ্ধ হয়ে এল। দৌড়ে বাবার কাছে গেল ও; লাশের ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল। ‘খোদা!’ মাথা নাড়ল অস্বীকারের ভঙ্গিতে। ‘আমি বিশ্বাস করি না। বাবার ফাঁসিতে ঝোলার কোন কারণ নেই।’-

এরিখের চলে যেতে ইচ্ছে হলো। মেয়েটি এবার ওর দিকে ফিরল। ‘কারা?’

‘জানি না।’ এরিখ মাথা নাড়ল। ‘আমি একে ডীপ শ্যাডো ভ্যালিতে পেয়েছি।’ থামল ও একটু। ‘ফেরার পথে জেন্ট আর সেথকে দেখলাম। লাশ দেখে ভেগে গেল ওরা।’

‘হ্যাঁ।’ ঘৃণাসূচক ভঙ্গি করল ওয়েন্ডি। ওদের কাছে আমি ওটাই আশা করেছিলাম, ঠিক অন্যদের মতই। আমাদের র‍্যাঞ্চ ছোট। চ্যাপম্যানের সাথে বাবার কথা কাটাকাটি হবার পর থেকেই আমাদের লোকেরা ভাগতে শুরু করেছিল।

‘ওরা এ কাজ করল কেন?’ এরিখ জিজ্ঞেস করল। ‘তোমার বাবাকে…’

কাঁধ ঝাঁকাল ওয়েন্ডি। ‘তুমি এখানে নতুন। মাস খানেক ধরে এখানে গরু চুরির হিড়িক পড়েছে। প্রত্যেক বাথান মালিকই তার প্রতিবেশীর দিকে সন্দেহের চোখে চাইছে।

‘আমরা মাস খানেক আগেই এ জায়গা কিনেছিলাম। একদিন চ্যাপম্যান এসে বাবাকে গরু চুরির ব্যাপারে অভিযুক্ত করে। ওক টিকাউ আমাদের পাইনস ভ্যালির স্টকে তিনটা ডব্লিউ বারের ছাপমারা বাছুর খুঁজে পায়। চ্যাপম্যান এজন্যে বাবাকে প্রচুর কথা শুনিয়েছিল।’

‘তুমি তাহলে চ্যাপম্যানকে সন্দেহ করো?’

‘কে জানে?’ অস্পষ্ট ভঙ্গিতে মাথা নাড়ল ওয়েন্ডি। এটা অন্য কারও কাজও হতে পারে। তবে চ্যাপম্যানের বক্তব্য ছিল স্পষ্ট।’

এরিখ এগিয়ে এসে ওর কাঁধে হাত রাখল। মৃদু চাপ দিল সান্ত্বনার ভঙ্গিতে। ‘তুমি ঘরে যাও, ম্যাম। আমি তোমার বাবাকে কবর দেব।’

‘কবর দেবার জন্যে ছোট্ট একটা ঢালু জায়গা আছে।’ হাত নেড়ে র‍্যাঞ্চহাউসের পেছনে দেখাল ওয়েন্ডি। ওখানেই কবর খুঁড়তে পারো।’ এরিখের দিকে চাইল ও; ওর চোখে কৃতজ্ঞতা

ঘুরে হাঁটতে শুরু করল মেয়েটি। এরিখ পেছন থেকে তার দিকে তাকিয়ে রইল। মেয়েটি ঘরে ঢুকে যাবার পর ছোট্ট একটা নিঃশ্বাস ফেলল ও, তারপর বার্নের দিকে গেল।

একটা কোদাল খুঁজে নিয়ে বেরিয়ে এল ও বার্ন থেকে। জিস্টারকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল র‍্যাঞ্চহাউসের পেছনে। সকাল থেকে এই পর্যন্ত ঘটে- যাওয়া ব্যাপারগুলো নিয়ে ভাবছে ও। অস্বস্তি বোধ করছে। চ্যাপম্যান ওকে এ জায়গা থেকে নড়তে নিষেধ করেছে। পরিষ্কার হুমকি বলা যায় এটাকে। এমন কি, ওর কেন যেন মনে হচ্ছে, দোআঁশলাটার বরফশীতল চোখ হয়তো এই মুহূর্তেও র‍্যাঞ্চটাকে নজরে রেখেছে।

র‍্যাঞ্চহাউসের পেছনে গিয়ে পৌঁছল ও। ঢালু জায়গাটা একটা কবরস্থান। তিনটে শাদা পাথরের ফলক, তাতে সূর্যালোক ঝকঝক করছে। এরিখ ফলকগুলোর লেখায় চোখ বুলাল :

অ্যানজেল ব্রাউন
মিন্টোর হাতে নিহত।
শান্তিতে ঘুমাও।

হ্যাগার্ড ব্রাউন
বয়স-৮।
জ্বরে মৃত্যু।

পৃথিবী থেকে স্বর্গে সে তার পুরস্কারের দিকে প্রত্যাবর্তন করেছে।

সান ব্রাউন
ঘোড়ার পিঠ থেকে পড়ে মৃত্যু।
আমাদের ক্ষতিই স্বর্গের লাভ।

পুরো কবরস্থানটা ঘাসে আবৃত। এরিখ কবরের জায়গা বেছে নিয়ে মাটিতে কোদাল বসাল।

এই প্রথম কবর খুঁড়ছে না ও। ঘাসের চাপড়া তুলতে তুলতে ও আগের কবরগুলোর কথা ভাবল। অ্যালথান’স ল্যান্ডিং থেকে শুরু করে মুরের ডিভিশনে থাকাকালীন রক্তক্ষয়ী টেক্সাসের রণক্ষেত্র; তারপর গেইনেস মিল, ফ্রীম্যান ফোর্ডের মধ্য দিয়ে গ্রোভটন, সেকেন্ড ম্যানাসাস, শাপবাগ, গেটিসবার্গ এবং চিকামগা পর্যন্ত; অনেক কবর খুঁড়তে হয়েছে ওকে, আত্মীয়- অনাত্মীয় নির্বিশেষে।

আত্মীয়ের মধ্যে ও গেইনেস মিলে চাচাতো ভাই স্যামের কবর আর গেটিসবার্গ থেকে পিছু হটার পথে এক অখ্যাত জায়গায় বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে নিজের ভাই ক্যাবের কবর খুঁড়েছে। তারপর টেনেসির এক হাসপাতালে দীর্ঘদিন কাটিয়ে যখন বাড়িতে ফিরেছে, তখন চাচা মারফি ওকে গেরিলাদের হাতে নিহত ওর বাবা-মার কবর দেখায়। সে একজন ভবঘুরে, ভাবল এরিখ, এতে আশ্চর্যের কি আছে? তার ঘর-বাড়ি নেই, আত্মীয়-স্বজন কেউই নেই। বন্ধুবান্ধবহীন নিঃসঙ্গ একজন মানুষ সে, নির্জনতা ছাড়া ওর আর কীই বা কাম্য থাকতে পারে? ওর কোন পিছুটান নেই। একমাত্র চাচা মারফি, সেও মারা গেছে টেক্সাসে, কিছুদিন আগে।

দীর্ঘশ্বাস ফেলল এরিখ। যুদ্ধ! যুদ্ধই ওকে ওর ষোলো বছর বয়সে টেনে নিয়েছে তার রক্তাক্ত আলিঙ্গনে; তারপর উগরে দিয়েছে বমির মত। চার বছর পরে সে বমি থেকে উঠে এসেছে যে, সে আর তখন ষোলো বছরের নিখুঁত তরল তরুণ নয়, বিশ বছর বয়সী পোড়-খাওয়া এক কঠিন যুবক। আর যুদ্ধের এই মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাই ওর অন্তরে মানুষের সাথে মানুষের যে অবিরাম দ্বন্দ্ব, তার বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণার আগুন জ্বালিয়ে দিয়েছে

কবর খোঁড়া শেষ হতেই মেয়েটি আস্তে আস্তে হেঁটে এল ঢালু কবরস্থানটায়। তার হাতে একখানা কম্বল আর একটা ক্যানভাস। এরিখ ঘোড়ার পিঠ থেকে লাশ নামাল। মেয়েটা ঘাসের ওপর ক্যানভাস পেতে তার ওপর কম্বল বিছিয়ে দিয়েছে। এরিখ কম্বলের ওপর লাশ শোয়াল। তারপর ওটাকে ভাল করে মুড়িয়ে নিল।

মুখ থেকে ঘাম মুছল এরিখ। ‘আইনের লোকেরা আসার আগে কবর দেয়াটা কি ঠিক হবে?’ পরামর্শ দেবার ভঙ্গিতে বলল ও।

মেয়েটা দ্রুত মুখ তুলে তাকাল। ‘আইন? কিসের আইন?’ তিক্তস্বরে পাল্টা প্রশ্ন করল ও। ‘আইন-টাইনের বালাই নেই এখানে।

এরিখ কোন মন্তব্য করল না।

‘বাবাকে কবরে নামিয়ে দাও,’ শান্তস্বরে বলল ও। ‘বাবার জন্যে দুঃখ করার কেউ নেই, আমি ছাড়া। আর প্রতিশোধ— সে-ও আমাকেই নিতে হবে।’

এরিখ মৃতদেহটা আলগোছে বয়ে কবরের পাড়ে নিয়ে গেল। সাবধানে কবরে নামাল লাশ। তারপর মেয়েটার দিকে তাকাল। ঠিক আছে?’

‘হ্যাঁ,’ শুকনো চোখে সায় দিল মেয়েটি।

সামান্য ইতস্তত করল এরিখ। ‘বাইবেল থেকে কয়েকটা লাইন পড়লে ভাল হত না?’ শেষ পর্যন্ত বলে ফেলল ও।

বাবাকে কবর দিয়ে দাও,’ মেয়েটি অবিচলিত স্বরে জবাব দিল। আমি জানি, একজন সৎ লোক হিসেবেই ঈশ্বর তাকে গ্রহণ করবেন।’

মাটি পড়তে শুরু করল। মেয়েটি দাঁড়িয়ে থেকে একদৃষ্টে দেখতে লাগল। এরিখ কবরের গর্ত ভরিয়ে দিয়ে এদিক-ওদিক খুঁজে পাথরের টুকরো কুড়িয়ে এনে কবরের ওপর বিছিয়ে দিল। তারপর একটু পিছিয়ে এসে একমুহূর্তের জন্যে মাথা নত করে বাইবেল থেকে কয়েকটি লাইন নিচুস্বরে আওড়াল। যে লোকটাকে সে কোনদিন চিনত না, তার জন্যে প্রার্থনা করল, তারপর কোদালটা তুলে নিয়ে জিস্টারের কাছে গেল। জিস্টার দাঁড়িয়ে ছিল চুপচাপ, এরিখ ওটাকে হাঁটিয়ে নিয়ে চলল র‍্যাঞ্চহাউসের সামনে। মেয়েটা ওর প্রার্থনা শেষ হবার আগেই চলে গিয়েছে।

কিছু একটা ঝিক করে উঠল। এরিখের চোখের কোণে ধরা পড়ল তা। উপত্যকার ওদিকে নিবিড় জঙ্গলের মধ্যে এক জায়গায় গাছপালা কিছুটা হালকা, প্রায় ফাঁকাই বলা যায়। ওখান থেকে কেউ তাদের ওপর নজর রাখছে, বুঝতে পারল ও। ও ইচ্ছে করেই জিস্টারকে ওখানে দাঁড় করাল। বাঁধল একটা গাছের সাথে। হাসল, মনে মনে। ফিল্ডগ্লাস হাতে র‍্যাঞ্চটাকে পর্যবেক্ষণ করছে যে লোকটা, যথাস্থানে পৌছাবার মত একটা খবর পাবে।

মেয়েটি ওর অপেক্ষায় বারান্দায় দাঁড়িয়ে ছিল। এরিখ এসে পৌঁছলে একটা থলে বাড়িয়ে দিল ওর দিকে।

‘তোমার নুন আর কফি।’

এরিখ ধন্যবাদ জানাল। হাত বাড়িয়ে ওগুলো নিয়ে মেয়েটির দিকে তাকিয়ে হাসল ও। মেয়েটি ওকে দেখছে।

‘কাজ খুঁজছ তুমি?’ জিজ্ঞেস করল ও।

‘না।’

‘আমি এখন একা,’ বলল মেয়েটি। ‘জেন্ট আর সেথই ছিল শেষ দুই কাউবয়।…পাইনস ভ্যালিতে আমার পঞ্চাশটা গরু রয়েছে।’

‘একা?’ প্রশ্ন করল এরিখ।

‘রবার্ট বাটলারেরগুলোও ওখানে আছে। বাবা ওর বন্ধু ছিল। বাবা ফিরে না আসা পর্যন্ত বাটলার ওগুলোর দেখাশোনা করবে এরকম কথা ছিল।’

মেয়েটির কণ্ঠে নিঃসঙ্গতার আর্তি; এরিখকে সংক্রমিত করল সেটা। ‘ঠিক আছে,’ সিদ্ধান্ত নিয়ে ফেলল ও। ‘আমি থাকব, মিস ওয়েন্ডি। যদ্দিন তোমার সাহায্যের প্রযোজন থাকবে।

ওয়েন্ডির চোখ উজ্জ্বল হলো। হয়তো অনেকদিন থাকতে হবে তোমাকে,’ এরিখকে বলল সে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *