আমি কে – অমিতানন্দ দাস

আমি কে? – অমিতানন্দ দাস

সুমিতা,

তোমার সঙ্গে এক বছর দেখা হবে না, এখনও বিশ্বাস হচ্ছে না। এই তো ক’ঘণ্টা আগে তুমি ছিলে, ভবিষ্যতের কত কথা হল, আর কাল ভোরেই কিনা চলে যাব লক্ষ। মাইল দূরে বিশ্বাস করি কী করে? বিশ্বাস করি কী করে যে, তোমাকে ছাড়া জীবন চলবে? তোমাকে এক সপ্তাহ না পাওয়া অসহ্য মনে হয়েছে। জানি না, মহাশূন্যের নির্জন পরিবেশে এক বছর কাটবে কী করে। তোমার কষ্ট হবে জানি, সেটা আরও মনে বাজে। আমাদের বয়স যে বড় অল্প– আমার উনিশ, তোমার আঠারো–এক বছর! আমাদের জীবনে সে যে অনেক।

এক-একবার মনে হচ্ছে, ভুল করছি। দরকার ছিল না আমার এই চাঁদে ট্রেনিং-এর, দরকার ছিল না আমাদের মঙ্গলগ্রহে যেতে নাম লেখাবার। আজকের পৃথিবীটা বড় ঘিঞ্জি, রুক্ষ, যান্ত্রিক, তার অনেক কিছুই আমাদের ভালো লাগে না– তবু, আমরা তো পরস্পরকে পেতাম নিরবচ্ছিন্নভাবে। অবশ্য এখন আমার ফেরার পথ বন্ধ। স্পেস ক্যাডেট স্কুলে ঢোকার পরেও সময় ছিল, এখন আর নেই। আমার ঘরের জানলা দিয়ে দেখতে পাচ্ছি দূরে, মাইলখানেক দূরে, লঞ্চিং প্যাডের ওপরে ওরা মহাকাশযানকে প্রস্তুত করছে। রাতের অন্ধকারকে ওরা তাড়িয়েছে হাজার হাজার পাওয়ারের আর্ক ল্যাম্প দিয়ে। মধ্যরাত্রির নিস্তব্ধতার বুক চিরে ছুটে আসছে পাম্প, কম্প্রেসর, গাড়ি, লাউডস্পিকার থেকে ছুটে আসা জট পাকানো নানা যান্ত্রিক শব্দ। ওই মহাকাশযানটা বুঝিবা এক কুটিল যন্ত্রদানব, আমাদের মাঝে লাখো মাইলের ব্যবধান সৃষ্টি করে ও পাবে আনন্দ।

নিজের জন্য ভয় করি না, ভয় আমাদের ভালোবাসার হানি হয়, যদি আমার থেকে তোমার কোনও ক্ষতি হয়। তোমাকে বলেছিলাম, তুমি উড়িয়ে দিয়েছিলে। কিন্তু আসল কথাটা যে তোমাকে বলা হয়নি। তুমি জানো, আমার ভালোবাসায় খাদ নেই, কিন্তু একটা কথা গোপন রেখেছি। তুমি ছাড়া পৃথিবীতে আমার আপন কেউ নেই, তবু- গোড়াতে ভয় ছিল জানলে আমাকে ভালোবাসতে পারবে না। এখন বলেও শান্তি পাব না। তোমাকে যদি চিনে থাকি তো জানি, এখন বললে তুমি কথাটার বিষয়ে চিন্তা করবে না, যথেষ্ট গুরুত্ব দেবে না। বলবে ও কিছু না… আগে না বলে অন্যায় করেছি, তোমায় ঠকিয়েছি আমি যে, মানে… এ-সমস্যা একান্তই আমার, পৃথিবীতে আমার একার। আমি যে আর সকলের মতো নই…

কথাটা বলতে পারলাম না, রেকর্ডারের সুইচ বন্ধ করে দিলাম।

অন্ধকার-নিস্তব্ধ ঘরে আমি একা। বাইরে থেকে ভেসে আসছে মহাকাশ বন্দরের নানা বিচিত্র আলো, শব্দ। এক থমথমে প্রতীক্ষার আবহাওয়া। আর ঘরের ভিতর আমার হৃদস্পন্দন বুঝি দেওয়ালে দেওয়ালে মাথা কুটে ফিরে, শরীরটাকে মুচড়ে মুচড়ে খুঁজে বেড়াচ্ছে মনের প্রশ্নের জবাব, জীবনের চরম সমস্যার সমাধান।

আবার রেকর্ডারটা তুলে নিলাম, চালু করলাম চৌম্বক চিঠি লেখার ইলেকট্রনিক কার্ড রেকর্ডার।

সুমিতা, পারবে তুমি আমাকে সেভাবে ভালোবাসতে? তোমার জীবন নষ্ট হয়ে যেতে পারে জানলেও তুমি কি পারবে ভালোবেসে যেতে, যেমন আমরা ভালোবেসেছি? এই এক বছরে ভেবে দেখো–আমার একান্ত অনুরোধ, মনে সামান্য সন্দেহ বোধ করলেও তুমি আমার কথা ভুলে যেও। আমাদের ভালোবাসার তীব্রতার দীপ্তি যদি হারিয়ে যায়, তবে আমি চাই না সে-ভালোবাসার স্মৃতির ম্লান ছায়ায় জীবন কাটাতে, চাই না তোমাকে টেনে আনতে এক মলিন, ধূসর, চিন্তাসঙ্কুল জীবনের মাঝে। আমরা পরস্পরকে ভুলতে পারি না, কিন্তু… কিন্তু তোমার তো… তোমার তো বাধা নেই। আমার যে পৃথিবীতে আপন কেউ থাকতে পারে না। আমি কি জানি না…

থেমে গেলাম। সুমিতাকে বলতেই হবে, এখনই–বলতেই হবে, যা আমি ছাড়া পৃথিবীতে কেউ জানে না। কিন্তু যা আমি নিজে ঠিক বুঝি না, সুমিতাকে বোঝাব কী করে?

জানতেন আমার বাবা। তিনি মারা গেছেন বছর বারো আগে। আঠারো বছর বয়স হবার পর উত্তরাধিকারসূত্রে পাওয়া বাবার ডায়েরি পড়ে তবেই জানতে পারলাম কথাটা। সুমিতাকে তার আগেই ভালোবাসতাম–ডায়েরি পাবার পর, সেই থেকে আঁকড়ে ধরলাম জীবনকে, সুমিতাকে–দুয়ে মিলে এক হয়ে গেল। ডায়েরির কথাটা থেকে গেল গোপনে।

আঠারো বছর বয়স। বাবা সাচ্ছল্য দিয়ে গেছিলেন, কিন্তু আমার ছিল না কোনও আত্মীয়স্বজন, আপনজন। কেউ না, একজনও না। ডায়েরি পড়ে বুঝলাম যে, এটা ছিল অবধারিত। এই অবস্থায় দিশা হারিয়ে ফেললাম, গোপন কথা গোপনে রেখে ডায়েরিটা পর্যন্ত নষ্ট করে ফেললাম, কিন্তু আমি নিজে তো সে কথাগুলো ভুলতে পারি না।

একটা উপায় ছিল। ডায়েরিটা যদি বাবার সমকক্ষ কোনও বৈজ্ঞানিককে দেখাতাম। ভেবে নিয়েছিলাম, কিন্তু তা হলে আমার স্বাভাবিক জীবনযাপন করা হত অসম্ভব, কারণ আমি তখন হয়ে দাঁড়াতাম এক চমকপ্রদ বৈজ্ঞানিক স্যাম্পল। বাবাকে অশেষ শ্রদ্ধা করি এই কারণে তিনি খ্যাতির মোহে আমাকে সার্কাসের জীব করে তোলেননি, কিন্তু অন্য যে কোনও বৈজ্ঞানিকের পক্ষে তা করা হবে একান্তই স্বাভাবিক, খ্যাতির মোহ ছাড়াও শুধু মানুষের জ্ঞান বাড়াবার জন্যেই স্বাভাবিক। কিন্তু ওই জ্ঞানের জন্যে আমি আমার ব্যক্তিগত জীবন বিসর্জন দেব না।

সব কারণে পৃথিবীর ওপরে বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়লাম, মন ছুটে গেল মহাকাশের দিকে। সঙ্গিনী পেলাম সুমিতাকে। সুমিতা ভালোবাসে প্রকৃতিকে–তা সে শ্যামল, সুন্দরই হোক আর রুক্ষ, কর্কশই হোক। দশ-বিশ কোটি মানুষের উই-এর ঢিবির মতো শহরের জীবন ওর কাছে দুর্বিসহ। মঙ্গলগ্রহের পাথর বিশ্লিষ্ট করে অক্সিজেনের আবহাওয়া বানিয়ে উপনিবেশ স্থাপনের পরিকল্পনা তখন সবে শুরু হচ্ছে–নাম লেখালাম আমরা, প্রথম হাজার অভিযাত্রীর মধ্যেই। সেই জীবনের পথে পা বাড়াতে চলেছি, এখন ডায়েরির কথাটা সুমিতাকে না বললেই নয়।

মহাকাশযানের আশপাশে ব্যস্ততা কমে এসেছে, প্রস্তুতিপর্ব শেষ হয়ে এল। বাঁ হাতের কবজিতে ডান হাতের আঙুল বোলালাম–ডাকটিকিটের মতো চামড়ার সঙ্গে সাঁটা হাতঘড়িটার গায়ে সংখ্যাগুলো চকচক করে উঠল–০২: ১৪: ৩৮, রাত সোয়া দুটো। সাড়ে চারটের সময়ে রিপোর্ট করতে হবে, সময় নেই। সুমিতাকে যা বলার বলতে হবে এক্ষুনি। আবার রেকর্ডারে বলতে শুরু করলাম–

সুমি, তুমি প্রকৃতিকে ভালোবাস। যান্ত্রিক সভ্যতার কৃত্রিম দুনিয়াটা তোমার লাগে অসহ্য। তোমাকে আমি বলতে পারিনি যে আমি, মানে প্রকৃতির অংশ নই। আমি কৃত্রিম। আমার বাবা ছিলেন বৈজ্ঞানিক, তিনি আমাকে তৈরি করেন গবেষণাগারে–আমি পৃথিবীর প্রথম এবং সম্ভবত একমাত্র জীবিত ‘টেস্টটিউব বেবি’। জানো তো বছর পনেরো আগে মানুষ তৈরির গবেষণার ওপরে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়।

সুমিতা বুঝে দেখো কথাটার তাৎপর্য। আমার সে-বুদ্ধিকে তুমি শ্রদ্ধা করেছ তা রক্ত মাংসের কমপিউটার মাত্র, আমার যে-হাতের স্পর্শে তুমি আনন্দ পেয়েছ তা কৃত্রিম, যান্ত্রিক। আমার মন? জানি না। হয়তো আমার মধ্যে স্বাভাবিক কিছুই নেই। যে-ফর্মুলা থেকে আমার প্রথম কোষটি তৈরি করা হয়, তার মধ্যেই হয়তো নিহিত ছিল আমার মন, স্বভাব, জীবনের প্রতিটি রন্ধ্রে, প্রতিটি মুহূর্তে। আমি জানি না, জানি না আমি কী, আমি কে…

চিন্তা চিন্তা আর চিন্তা। না বললে চিন্তা, বললেও চিন্তা। আমার প্রথম ক্রোমোজোম, ডিএনএ অণু তৈরি হবার সময়েই এ ছিল অবধারিত–চিন্তার টাইডাল ওয়েভ আমাকে গ্রাস করবে। চিন্তাস্রোতে আমার জীবন ভেসে যাবে। সবই হয়তো ছিল অবধারিত। ওই ডিএনএ অণু সিন্থেসিস প্রক্রিয়ায় কমপিউটার ক্যালকুলেশনের মধ্যেই হয়তো নিহিত ছিলাম পুরো আমি। আমার তা হলে নিজস্ব কিছু নেই, আমি–আমি এক মনুষ্যযন্ত্র পৃথিবীর প্রথম জ্বালা-যন্ত্রণা। তবু আমি যন্ত্র। রক্তমাংসের যন্ত্র, তবু যন্ত্র।

মানুষের কতটা বংশগতির ফল আর কতটা পরিবেশের? আমার বংশগতি ছিল ওই ফর্মুলাতে, কিন্তু পরিবেশ তো বাবা মানবিক করে তুলেছিলেন। নিজে আমাকে দত্তক নিয়েছিলেন, কুড়িয়ে পাওয়া ছেলে হিসাবে বার্থ সার্টিফিকেট লিখিয়ে। মারা যাবার আগে তিনি আমার ভার দিয়ে গেছিলেন এক বয়স্ক স্নেহশীল দম্পতির হাতে। তাঁরা আমার কেউ নন, আসলে বাবাও আমার কেউ নন–তবু মানবিক পরিবেশে যন্ত্র হলেও আমি গড়ে উঠেছি মানবিক যন্ত্র হিসাবে। আমার কতটা মানবিক, কতটা কৃত্রিম? জানি না।

বাঁচতে গেলে জানা দরকার, কিন্তু জানতে গেলে আর বাঁচার পথ থাকবে না। অনেক ভেবেছি, এ-সমস্যার সমাধান নেই।

শুধু দেখেছি, এক ক্ষীণ আশার আলো। হয়তো আমার ডিএনএ সিন্থেসিস পুরো নকলভাবে হয়নি, হয়তো বিভিন্ন মানুষের ডিএনএ-র বাছাই করা অংশ জুড়ে জুড়ে তৈরি হয়েছে আমার ওই ব্লপ্রিন্ট। তা হলে তো আমি পুরো নকল নই, তাহলে তো আমি মানুষের প্রতীক–আমার ডিএনএ সিন্থেসিস তো সভ্যতার আগুনে মানুষজাতির সিন্থেসিস–তাহলে তো আমি ভবিষ্যতের ইঙ্গিত। কিন্তু কীভাবে আমাকে তৈরি করা হয়েছিল, তা জানি না, কেউ কোনওদিন জানবে না। ডায়েরি ও সংশ্লিষ্ট কাগজ যে আমি পুড়িয়ে ফেলেছি। পরিচিতি গোপন রাখতে আমি হারিয়েই ফেলেছি নিজের পরিচিতি। আমি যন্ত্র না ভবিষ্যতের মানুষ?

আমি জানি না।

কিন্তু আমি যাই-ই হই, আমি ভালোবেসেছি। আমি জেনেছি অন্তরাত্মার আগুনের চরম রূপ। সে তো মিথ্যে নয়। সে-আগুনে হতে পারে যন্ত্রের মানুষে রূপান্তর। সব জেনে, সব বুঝে সুমিতা যদি পারে আমাকে আপন করে নিতে, তাহলে যন্ত্র হয়ে তৈরি হলেও আমি হতে পারি মানুষ।

তাহলে সুমিতার উত্তর তো আমাকে জানতে হবে। চিঠি নয়, ফোন– শেষ রাতে!

০৩: ৪৮: ২৫৷

সময় নেই, চল্লিশ মিনিট বাদেই আমার ডাক পড়বে। এক্ষুনি—

কিন্তু না।

একটা কথা ভুলে গেছিলাম। আমি প্রথম কৃত্রিম মানুষ, আমি এক এক্সপেরিমেন্ট। এক্সপেরিমেন্টে ভুল থাকে, প্রথমবার ভুল থাকাই স্বাভাবিক। আর মানুষ তৈরির ভুল থাকার অর্থ–আমি অসম্পূর্ণ মানুষ। আমার ব্ল প্রিন্টে কতটা ভুল ছিল, আমি জানি না, কিন্তু আমি জানি আমি অসম্পূর্ণ মানুষ। আমার শরীরে বল আছে, মাথায় বুদ্ধি আছে, মনে তেজ, হৃদয়ে অনুভূতি আছে। কিন্তু আমি অসম্পূর্ণ অস্বাভাবিক। বেশি সংখ্যায় খাবারে আমার অ্যালার্জি, খালি গায়ে কড়া রোদ লাগালে বুকে, পিঠে কালশিটে পড়ে, পেটে অ্যাপেন্ডিক্স নেই, সকলে ভাবে এসব দৈবাৎ ঘটেছে– শুধু আমি জানি, এর আসল কারণ।

সুমিতাকে জানানো উচিত ছিল। ও যে জানে না, ওর ভালোবাসার পরিণতি কী হতে পারে। ছোটখাটো জিনিসকে আমাদের ভয় করার প্রয়োজন নেই কিন্তু আমার ডিএনএ অসম্পূর্ণ, তাহলে সন্তানের কী হবে? জানি না সে ঝক্কি নেওয়া উচিত কি না, মস্তিষ্ক বলে উচিত নয়। কিন্তু সুমিতার ভালোবাসা ছাড়া পারব কি একা দাঁড়াতে পুরো পৃথিবীটার বিরুদ্ধে?

০৪: ০২: ১২।

সুমিতা খুব সম্ভবত জেগে বসে ভাবছে আমার কথা। এই মূহূর্তে ফোন করলে ও আমার কোনও কথা কানে নেবে না, চিন্তা করবে না। সেটা উচিত হবে না। থাক, বরং চাদে পৌঁছেই চিঠি লিখব।

কিছু না করা সহজ সমাধান, কিন্তু আমাকে খুঁজে পেতে হবে সঠিক সমাধান।

শেষ মুহূর্ত। এই বিশ মিনিট পর আছে এক বছরের প্রতীক্ষা। এখন কথাটা বলা কি হঠকারিতা? না বলা কি কাপুরুষতা?

কিন্তু গোপনীয়তা যে অসহ্য! সুমিতা ও আমার মধ্যে তো এত বড় গোপনীয়তা থাকার কথা নয়। সুমিতা মার্জনা করতে পারে, কিন্তু আমার বিচারে যে এ অমার্জনীয়।

সুমিতা আমাকে বুঝবে, নিজেকেও বুঝবে। ও পরিবে চিন্তার বন্যায় বাঁধ দিতে, ও পারবে খুঁজে দিতে আমার আমিত্ব। ও আমাকে বলবে আমি কে, আমি কী। ওর হাতেই শুধু হতে পারে কৃত্রিম, অসম্পূর্ণ আমি-র সম্পূর্ণ মানবজন্ম।

স্বয়ংক্রিয় টেলিফোনে বললাম সুমিতার নিজস্ব নাম্বারটা, বললাম আমার নাম। মুহূর্তে ভেসে এল ওর গলা… এক্ষুনি জানতে পারব আমি কে।