1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ১৯

১৯

বহু বছর পর আজ জাফরের গাড়িটা নিয়ে বের হলো মুনিয়া। প্রখর দিনের শেষে ক্লান্ত বিকেল। আশুলিয়ার রাস্তাটায় অবশ্য ফুরফুরে হাওয়া। রাস্তার পাশে দিগন্ত বিস্তৃত জলরাশি। সেই জলের শরীরজুড়ে অসংখ্য ছোট ছোট ঢেউ। মুনিয়ার পাশে বসে রাফি। সে চুপচাপ। থমথমে। মুনিয়াও। দুজনের মাঝখানে কোথায় যেন একটা সুতো কেটে গেছে। একটা চাপা উদ্বিগ্নতা। একটা ভয়।

মুনিয়া বলল, ‘তুমি কিন্তু আপাতত আর বাড়ির সামনে ওভাবে এসো না। ‘ রাফি বলল, ‘হুম।’

‘তোমার কি শরীর খারাপ?’

‘উহু।’

‘তাহলে?’

রাফি জবাব দিল না। মুনিয়া বলল, ‘তুমি কি এখনো আমার ওপর রেগে আছো?’

‘উহু।’

‘তাহলে?’

‘খুব অস্থির লাগছে। ঘুম হচ্ছে না। ঘুমালেই নানা দুঃস্বপ্ন দেখছি।’

মুনিয়া ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ফেলল। তারপর বাঁ হাত বাড়িয়ে রাফির হাত ছুঁয়ে দিয়ে বলল, ‘সব ঠিক হয়ে যাবে।’

রাফি কথা বলল না। মুনিয়া বলল, ‘কিছুদিন একটু আমাদের দেখা না হওয়াটাই ভালো। কে কখন কীভাবে দেখে ফেলে বলাতো যায় না। তা ছাড়া…।’

‘তা ছাড়া কী?’

সবাই এখন একটু সতর্ক হয়ে গেছে। আমি সব টের পাই। আর আমাদেরতো রোজই দেখা হচ্ছে, তাই না?’

‘রোজ? কীভাবে?’ রাফি কপাল কুঁচকে তাকাল।

‘কেন? তুমিতো রথিকে নিতে প্রায় রোজই স্কুলে আসো।’

‘হুম।’ রাফি ম্লান গলায় বলল।

মুনিয়া গাড়িটা বেড়িবাঁধের ভেতরে লম্বা ঘাসের আড়ালে দাঁড় করাল। তারপর বলল, ‘এত আপসেট কেন তুমি?’

রাফি হাসার চেষ্টা করল। কিন্তু তাতে বরং তাকে আরো বিষণ্ন, আরো চিন্তিতই মনে হলো। মুনিয়া বলল, ‘বরং আমার নিজেরইতো আপসেট হওয়া উচিত তোমার ওপর, তাই না?’

‘কেন?’ রাফি মুখ তুলে তাকাল।

মুনিয়া জবাব দিল না। সে দীর্ঘশ্বাস ফেলে জানালার বাইরে আকাশ দেখতে থাকল। রাফি বলল, ‘আমি সর্বোচ্চ চেষ্টা করছি টু বি অলরাইট। কিন্তু তারপরও তুমি আপসেট কেন? তোমার সাথে আমার দেখা পর্যন্ত হয়না আজকাল।’

‘কেন হবে না? বললামইতো, স্কুলে রোজ দেখা হয়।’

রাফি ম্লান হাসল, ‘কীভাবে?’

‘ওভাবে?’

‘তুমিতো তখন রাশভারি শিক্ষক। দেখা হলে সালাম দিয়ে কথা বলতে হয়। বা মুহূর্তের জন্যও দেখতে পাই না। আমি যে একটা বাজে অবস্থার মধ্য দিয়ে যাচ্ছি, সেটা তুমি বুঝতে পারো?

মুনিয়া এবার যেন শক্ত হলো, ‘আমি বাজে অবস্থার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি না? তোমার চেয়ে আমার অবস্থা কি কম খারাপ? একবার জাস্ট ভাবোতো, বাড়িতে ওই অবস্থা। সারাক্ষণ আমাকে নিয়ে ফিসফাস, ডিটেকটিভের মতো পেছনে লেগে থাকা। আর স্কুলে কি চলছে জানো? বুঝতে পারো কিছু? আমিওতো একটা মানুষ তাই না? সবকিছু মেইনটেইন করি হাসিমুখে। কাউকে কোনোকিছু কখনো বুঝতে দিই না, দিই?’

রাফি জবাব দিল না। মুনিয়া যেন এবার আর তার ক্ষোভটা চেপে রাখতে পারল না। ঋদ্ধির খাতায় রাফির লেখা কবিতার লাইন দুটো দেখার পর থেকেই তার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। অস্থির হয়ে আছে। অনেক চেষ্টা করেও নিজেকে শান্ত করতে পারছে না সে। ভেবেছিল এ বিষয়ে রাফিকে কিছু বলবে না সে। এমনিতেই নানা ঝামেলায় আড়ষ্ট হয়ে আছে তারা দুজন। তারপরও সে শ্লেষাত্মক গলায় বলল, ‘যদি দেখতেই না পাও, তাহলে রোজ স্কুলে আসো যে?’

‘তুমি বলছো আসবো না?

‘আমি কিছুই বলছি না। জাস্ট জানতে চাইছি। যদি দেখাই না হয়, তাহলে রোজ আসো কেন?’

রাফি গম্ভীর গলায় বলল, ‘তুমিতো আজকাল ফোনই ধরো না। ধরলেও কথা বলতে চাও না। ফোনে কথা বলতেও নাকি সমস্যা। তাহলে?’

‘তাহলে স্কুলে কি কথা হয়?’

‘যতটুকু যা হয়। অন্তত না হওয়ার চেয়েতো ভালো।’

মুনিয়া হঠাৎই কথাটা বলে ফেলল, ‘নাকি অন্য কোনো কারণ আছে স্কুলে আসার?’

‘মানে!’ রাফি হঠাৎ ধরতে পারল না মুনিয়ার কথার মূল সুর। গত কিছুদিন থেকেই একটা তীব্র অস্থিরতা নিয়ে দিন কাঁটছে তাদের। এই সময়ে রাফি চেষ্টা করছে যতটা সম্ভব শান্ত থাকার। কিন্তু তারপরও সবকিছু কেমন এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে। সে সতর্ক ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি কি কোনো কারণে চাও যে আমি আর রথিকে আনতে স্কুলে না যাই?’

রাফি ভেবেছিল মুনিয়া এবার অন্তত নমনীয় হবে। কিন্তু তার ভাবনা ভুল প্রমাণিত করে দিয়ে সে বলল, ‘আমি বললে তুমি শুনবে?’

‘কেন শুনব না? নিশ্চয়ই শুনব। কিন্তু কারণটাতো অন্তত বলবে?’

কী কারণ বলবে মুনিয়া? এই কারণ সে জগতে কারো কাছেই কখনো বলতে পারবে না। নিজের কাছেও না। যে সত্য সে অনুভব করছে, সেই সত্যের মুখোমুখি সে নিজেও কখনো হতে চায়নি। শুধু সে কেন, জগতে কেউই কখনো এমন কোনো সত্যের মুখোমুখি হতে চাইবে না। কিন্তু যে ভয়ানক বাস্তবতা সে টের পাচ্ছে, তা থেকে তার মুক্তি কীসে? মুনিয়া জানে না। রাফির প্রতি ঋদ্ধির অমন বেপরোয়া আকর্ষণ সে স্পষ্টই টের পায়। কিন্তু রাফি, রাফি কী ভাবছে? সেও কি ঋদ্ধির প্রতি কোনো অনুরাগ অনুভব করে? এই কথাটা ভাবতে গেলেই জগতের সকল আড়ষ্টতা এসে তাকে জেঁকে ধরে। নিজেকে খুব নোংরা আর তুচ্ছ মনে হয় তার। আর সব দুশ্চিন্তা, ভয় ছাপিয়ে কেবল এই তীব্র অস্বস্তিকর অনুভূতিটাই তাকে আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে রাখে। কী আশ্চর্য, উদ্ভট এক সমীকরণে সে আটকে গেছে! সে একাই কেবল জানে কী তীব্র লজ্জা, সঙ্কোচ আর ভয়াবহ মানসিক যন্ত্রণা প্রতিটি মুহূর্তে তাকে কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।

রাফি বলল, ‘চুপ করে আছো কেন? কী হয়েছে আমাকে বলবে?

মুনিয়া কী বলবে ভেবে পেল না। কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে সে হঠাৎ বলল, ‘এই পরিস্থিতিতে স্কুলের দিকটাতে কম আসাই ভালো।’

‘কেন? কোনো সমস্যা হচ্ছে?’ উদ্বিগ্ন চোখে তাকাল রাফি।

মুনিয়া খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘ঠিক সমস্যা না। তবে রফিকুল আলমের বিষয়টা নিয়ে পুলিশ খুব সতর্ক হয়ে গেছে। স্কুলের প্রায় সবাই-ই আন্ডার অবজার্ভেশনে আছে। সেদিন দেখলাম দুজন অভিভাবককেও কী সব জিজ্ঞাসাবাদ করল। দপ্তরি থেকে ক্যান্টিন বয়, দারোয়ান থেকে ঝাড়ুদার, সবাইকেই জিজ্ঞাসাবাদ করছে। বুঝতেই পারছো পরিস্থিতি। এর মধ্যে ধরো কোনোভাবে কেউ যদি তোমার-আমার বিষয়টা ঘুণাক্ষরেও আঁচ করতে পারে, তাহলে কী হবে ভেবে দেখেছো? কখন কী থেকে কী হয়ে যাবে, কেউ জানে না। আর এটাতো বোঝো, মানুষ এক কথা থেকে পাঁচ কথা ছড়ায়। কোন বিপদ থেকে কোন বিপদ নেমে আসবে কে জানে!’

‘তোমার আমার সম্পর্ক কে আঁচ করবে? কীভাবে আঁচ করবে?’

‘আমি জানি না, আমার কেন যেন খুব ভয় হয়। মনে হয় এই বুঝি কেউ জেনে ফেলল। তা ছাড়া বাসার বিষয়টাতো জানোই।’

রাফি কথা বলল না। মুনিয়া তাকে বলেছে, বাসায় কেউ কেউ মুনিয়াকে সন্দেহ করে। তাদের ধারণা, কারো সাথে মুনিয়ার বিশেষ কোনো সম্পর্ক আছে। সেলিনা এবং মছিদা বেগম যে বিষয়টা নিয়ে সতর্ক, সেটাও জানে রাফি। তবে তারা এখনো জানেন না, ছেলেটা কে! বিষয়টা চিন্তার। তবে তারপরও মুনিয়ার আচরণে খুবই অবাক হচ্ছে রাফি। তার মনে হচ্ছে, মুনিয়া যা বলতে চাইছে তা সে স্পষ্ট করে বলতে পারছে না। ফলে কথাটি সে ঘুরিয়ে পেঁচিয়ে অন্যভাবে বলার চেষ্টা করছে। কিন্তু তার সাথে গত বছর কয়েক ধরে মুনিয়ার যে বোঝাপড়া গড়ে উঠেছে, তাতে তারা পরস্পরের কাছে যথেষ্ট স্বচ্ছ, স্পষ্ট। কোনো লুকোছাপা নেই, আড়াল নেই। তাদের বয়সের ব্যাবধান অনেক হওয়ার পরও, মুনিয়া যে তার ওপর অনেকটাই নির্ভরশীল, রাফি তা জানে। মাঝে মাঝে অবাকও হয় সে।

যে মুনিয়া তার চারপাশের জগতের কাছে প্রবল ব্যক্তিত্বশালী, প্রচণ্ড রাশভারি এক নারী, সেই মুনিয়াই আবার রাফির কাছে এলে যেন মুহূর্তেই হয়ে যায় অভিমানী এক কিশোরী। কত তুচ্ছ বিষয়েও দিনের পর দিন সে অভিমান করে দূরে সরে থাকে! আবার গোপন গহিন কান্নায় অপেক্ষা করতে থাকে রাতের পর রাত। এই বিষয়টা খুব ভাবায় রাফিকে। তার স্পষ্ট মনে আছে, মুনিয়া তাকে একবার জিজ্ঞেস করেছিল, ‘এই যে আমি তোমার চেয়ে বয়সে এত বড়, এ জন্য তোমার আফসোস হয়?’

রাফি বলেছিল, ‘উহু।’

মুনিয়া অবাক গলায় জিজ্ঞেস করেছিল, ‘কেন?’

রাফি বলেছিল, ‘কারণ প্রেমে পড়লে সব বয়সের মেয়েরাই ষোড়শী কিশোরী হয়ে যায়।’

কথাটা শুনে মুনিয়া হেসেছিল। কিন্তু রাফির সত্যি মনে হয়, প্রেমে পড়লে আসলেই সব বয়সের মেয়েরাই ষোড়শী কিশোরী হয়ে যায়!

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *