1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৩৩

৩৩

দুপুরের ঘটনার পর থেকে মুনিয়া যেন আরো ভার হয়ে আছে। সেদিন রাফির কথাগুলো শোনার পর থেকে এমনিতেই শারীরিক ও মানসিকভাবে বিধ্বস্ত বোধ করছিল মুনিয়া। তারওপর আজ দিপুর ওইটুক কথা যেন আলপিনের মতো কানে বিঁধে আছে তার, ‘তুমিতো মোটা হয়ে যাচ্ছো ভাবি, বয়স বেড়ে যাচ্ছে কিন্তু!’

খুব সামান্য এক কথা। কিন্তু প্রবল আতঙ্কে ভোগা কোনো মানুষ যেমন সামান্য শব্দেই আঁতকে ওঠে, অনিরাপদ বোধ করে, তেমনি মুনিয়াও অস্থির হয়ে রইলো। ওই কথাটুকুই মুনিয়ার ভেতর জেগে ওঠা সংশয়টাকে আরো তীব্র করে তুলল। সে কি সত্যি সত্যিই বুড়িয়ে যাচ্ছে? এই বয়সে তার শরীরে আরো মেদ জমতে থাকবে, ত্বকের টানটান ভাবটা ক্রমশই শিথিল হতে থাকবে, সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু এই স্বাভাবিক ব্যাপারটিই সে মেনে নিতে পারছে না। তার মনে হচ্ছে, সে ক্রমশই অপাংক্তেয় হয়ে যাবে, গুরুত্বহীন হয়ে যাবে। কিন্তু তাহলে এই মুনিয়ার পরিচয়টা কি কেবলই শরীরী? তার আর কোনো পরিচয় নেই? জীবনের যে প্রবল বিরুদ্ধ স্রোতে সে এতদিন যুদ্ধ করেছে, নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য যে লড়াই করেছে, তার সবই কি তবে মূল্যহীন? নিজের নারী, স্ত্রী, মা কিংবা প্রেমিকা সত্তার বাইরেও আলাদা একটা পরিচয় প্রতিষ্ঠার জন্য, আলাদা একটা অবস্থান তৈরির জন্য যে কণ্টকাকীর্ণ দুর্গম পথ সে পাড়ি দিয়েছে, তার সবই কি তবে অর্থহীন?

যদি তা না-ই হবে, তবে সেসব পরিচয় ছাপিয়ে শেষ পর্যন্ত কেন তার নিজের কাছেই নিজের শরীরী পরিচয়টাই বড় হয়ে উঠছে? কেন মনে হচ্ছে কেবল শরীরের আবেদন ফুরিয়ে গেলেই সে তার প্রেমিকের কাছেও গুরুত্বহীন হয়ে যাবে? তাহলে কি পুরুষের কাছে নারীর শরীরী সৌন্দর্যই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ? নারীর কাছে তবে গুরুত্বপূর্ণ কী? মুনিয়ার হঠাৎ মনে হলো, তার চারপাশের নারীদের যে ভাবনা, যে অনুশীলন, যে অভ্যস্ততা সে তার রোজকার জীবনে দেখে তাতে তার উপলব্ধি, নারী নিজেই মূলত তার শরীরী সৌন্দর্যের কারণে পুরুষের কাছে গুরুত্ব পাওয়াটাকেই সবচেয়ে আরাধ্য, সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে।

.

এমনকি সে নিজেও তার ব্যতিক্রম নয়। ব্যতিক্রম নয় তার কিশোরী কন্যাও। কী অদ্ভুত!

.

এই ভাবনা এলোমেলো করে রাখল মুনিয়ার সকাল-সন্ধ্যা-রাত। তার এখন মনে হচ্ছে, সে তার চারপাশে যেসকল নারীকে চেনে, জানে, বোঝে তারা সকলেই চেতনে-অবচেতনে, ভাবনায়-আচরণে এই একটা জিনিসই অনুশীলন করে, আর তা হচ্ছে, তাদের আর সব যোগ্যতার চেয়েও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হচ্ছে তাদের শরীরী সৌন্দর্য! ফলে সেই সৌন্দর্য আঁকড়ে ধরার জন্য উদগ্রীব হয়ে থাকে তারা। আর ফুরিয়ে যাওয়ার ভয়ে সদা সন্ত্রস্ত হয়ে থাকে। নারীর নিজস্ব নারী সত্তাটি যেন তাই অবচেতনেই ঈর্ষান্বিত হয়ে উঠতে থাকে প্রচলিত ভাবনায় তার চেয়ে ‘রূপবতী’ অন্য কোনো নারীর প্রতি! আচ্ছা, সে নিজেও কি এমন? নাকি অন্যরকম? নাকি তার এই ভাবনা, এই বোঝাপড়াটাই ভুল?

.

আচ্ছা, সে কী রাফির কারণে ঋদ্ধিকে কখনো ঈর্ষা করে? এই যে সে শারীরিকভাবে অস্তগামী এক সূর্য আর ঋদ্ধি কেবল ঝলমলে আলো নিয়ে শুরু করা সদ্য এক ভোর! সেখানে কতজনের চোখ ঝলসে যাবে। ক্ষণিকের জন্য এই ভয়ানক ভাবনাও তার মাথায় উঁকি দিয়ে গেল। তবে মুনিয়ার খুব জানতে ইচ্ছে করছে, ঋদ্ধি আজকাল কী ভাবে? সে কি তার মায়ের কথা ভাবে? রাফিকে নিয়ে আজকাল কী ভাবছে সে? ঋদ্ধি যদি কখনো রাফির আর তার সম্পর্কের কথা জানে, তাহলে কী করবে? আচ্ছা, রাফি কেন আবারো ওখানের দেয়ালে ওই লাইনটা লিখতে গেল?

আমাকে হারাতে দিলে নিখোঁজ বিজ্ঞপ্তিতে ছেয়ে যাবে তোমার শহর… সে কী তবে…! এই ভাবনার বাকি অংশটুকু আর ভাবতে পারে না মুনিয়া। জগতের সকল অস্বস্তি ঘিরে ফেলে তাকে।

ইচ্ছে করেই রাফির সাথে বেশ কিছুদিন কথা বলল না মুনিয়া। তারপর একদিন দীর্ঘসময় কথা হলো তাদের।

মুনিয়া থমথমে গলায় বলল, ‘এমনিতেই মাথার ওপর ভয়াবহ বিপদ ঝুলছে রাফি। তারওপর তুমি দেখছি সেই বিপদকে টেনে না নামিয়ে ছাড়বে না।’

‘কীসের বিপদ?’

‘দেয়ালে আবারও ওসব কী লিখে রেখেছো তুমি?’

ভালোবাসলে এমন কতকিছু করতে হয়। আগেতো তোমার বাড়ির সামনে বসে বসে কবিতা পড়তাম। কিন্তু সেদিনের ঘটনার পরতো সব বন্ধ।’

‘কিন্তু আমিতো আর ওখানে থাকি না!’

‘তাতে কী! অভ্যাসটাতো আছে। হয়তো ফিরে গিয়ে দেখে তুমি চমকে যেতে।’

মুনিয়া এই কথায় দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল, ‘যাকে তুমি ভালোবাসো না, তাকে চমকে দিয়ে কী লাভ?’

‘কে বলেছে তোমাকে আমি ভালোবসি না?’

‘তুমিই বলেছো। তুমি ভালোবাসো আমার শরীর

‘তোমার শরীর আর তুমি কি আলাদা?’

‘আলাদা নই, কিন্তু ভালোবাসা যদি কেবলই শরীরী হয়, তবে সেটি আর ভালোবাসা থাকে না।’

‘কী থাকে তাহলে সেটা?’

‘কিছুই থাকে না।’

রাফি মৃদু হাসল, ‘ভুল বললে, ভালোবাসায় শরীর না থাকলেই বরং ভালোবাসা মরে যায়। তখন সেটা আর দশটা সম্পর্কের মতো পানসে, নিস্তেজ হয়ে যায়।’

‘তাহলে শরীরী আকর্ষণ ফুরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথেই ভালোবাসাও ফুরিয়ে যায়?’

‘সেটা নির্ভর করছে তুমি ভালোবাসা বলতে কী বোঝো, তার ওপর।’

‘মানে?’

‘মানে তুমি যদি ভাবো দিনের পর দিন পাশাপাশি থাকাই ভালোবাসা, তবে সেটা সারাজীবনই থাকে। কিন্তু নারী-পুরুষের ভালোবাসা বলতে সম্ভবত আমরা অন্য কিছু বুঝি। আর সেটা নিয়ন্ত্রণ করে শরীর। কিন্তু এই সত্যটা জেনেও আমরা তা স্বীকার করতে চাই না। অস্বস্তি লাগে।’

শরীর ভালোবাসা নিয়ন্ত্রণ করে? এ কথা তোমাকে কে বলেছে? ভালোবাসা নিয়ন্ত্রণ করে মন।’

‘দুটোই দুটোকে নিয়ন্ত্রণ করে। তবে মনের ওপর শরীরের প্রভাব বেশি।’

‘কীভাবে? বরং উল্টোটা হওয়ার কথা, শরীরের ওপর মনের নিয়ন্ত্রণ থাকার কথা। তাই না?’

‘ধরো মানুষের বয়স বেড়ে যাওয়ার সাথে সাথে রোমান্টিসিজম কমে যায়, যায় না?’

‘হুম যায়।’

‘কেন?’

‘কারণ তখন নানা দায়-দায়িত্ব থাকে, সন্তান-সন্ততি হয়ে যায়, ব্যস্ততা বেড়ে যায়। তা ছাড়া বয়স বেড়ে গেলেতো এমন হবেই। এটাই স্বাভাবিক।’

রাফি হাসল, ‘বয়স বেড়ে যায় মানে কী?’

‘বুড়ো হয়ে যাওয়া

‘আর বুড়ো হয়ে যাওয়া মানে?’

‘কী?’

‘শরীর বুড়িয়ে যাওয়া। তাই না?’

‘হুম।’

‘আর শরীর বুড়িয়ে গেলে সবার আগে কী ফুরিয়ে যায়, জানো?’

মুনিয়া কৌতূহলী চোখে তাকাল। রাফি বলল, ‘রোমান্টিসিজম ফুরিয়ে যায়।’ মুনিয়া সাথে সাথে জবাব দিল না। চুপ করে রইলো। রাফির কথা তার মানতে ইচ্ছে হচ্ছে না। কিন্তু উপযুক্ত কোনো যুক্তিও খুঁজে পাচ্ছে না সে।

রাফি বলল, ‘আর যে আরাধ্য ভালোবাসার জন্য নারী-পুরুষের এত এত ফ্যান্টাসি, বিরহ, প্রেম তাও রোমান্টিসিজম ফুরিয়ে যাওয়ার সাথে সাথে ফুরিয়ে যায়। তখন যা থাকে তার নাম মায়া, নির্ভরতা, অভ্যাস।’

‘মায়া, নির্ভরতা এগুলো কি ভালোবাসা নয়?’

‘অবশ্যই ভালোবাসা। তবে সব মায়া-নির্ভরতাই ভালোবাসা নয়। মায়া ভালোবাসার একটা অংশ মাত্র। নারী-পুরুষের এই ভালোবাসাতে মায়া থাকেই, কিন্তু সব মায়াতে এই ভালোবাসাটা নাও থাকতে পারে।’

মুনিয়ার সবকিছু এলোমেলো লাগছে। সে কেন কথা বলল না। রাফি বলল ‘তুমি যে বলছো নানা রেসপন্সিবিলিট, সন্তান-সন্ততি হয়ে যায়, ব্যস্ততা বেড়ে যায় ফলে রোমান্টিসিজম কমে যায়, কথাটা সত্যি না।’

‘সত্যি না?’

‘নাহ।’

‘তাহলে সত্যি কী?’

‘সত্যি হচ্ছে শরীর পুরনো হয়ে যায়। শরীরী রহস্য উদ্ঘাটিত হয়ে যায়, এ কারণে রোমান্টিসিজম ফুরিয়ে যায়।’

তুমি কয়েকদিন ধরে খুব উল্টাপাল্টা বকছো রাফি।’

‘তাই?’ রাফি হা হা শব্দে হাসল।

‘হ্যাঁ। তুমি কি কাইন্ডলি একটু সাইকিয়াট্রিস্টের সাথে কথা বলবে? তোমাকে কেমন অন্যরকম লাগছে।’

রাফি রাগলো না। হাসল সামান্য। তারপর বলল, ‘এই যে তুমি আর আমি, আমরা ব্যস্ত না?’

‘হু।’

আমাদের সোশ্যাল রেসপন্সিবিলিটিজ নেই

‘আছে।’

‘তোমারতো আরো বেশি আছে। তোমার মেয়ে, স্বামী, শ্বশুর-শাশুড়ি, স্কুল, পরীক্ষা, হাজারটা দায়িত্ব, হাজারটা ব্যস্ততা। কিন্তু কই, তোমার আমার সম্পর্কেতো রোমান্টিসিজম কমেনি? কমেছে?’

মুনিয়া জবাব দিল না। সে আগ্রহ নিয়ে শুনছে। রাফি বলল, ‘এখনো কমেনি। অথচ তোমার হাজবেন্ডের সাথে তোমার সম্পর্কে কি রোমান্টিসিজম আছে?’

মুনিয়া চুপ করে রইলো। রাফিই বলল, ‘নেই। কেন নেই জানো? কারণ তোমাদের পরস্পরের কাছে পরস্পরের শরীর পুরনো হয়ে গেছে। শরীরী রহস্য উদঘাটিত হয়ে গেছে। হয়তো সময় গেলে আমাদেরও থাকবে না।’

রাফির কথাগুলো মানতে ইচ্ছে করছে না মুনিয়ার। তার মাথায় অসংখ্য পাল্টা যুক্তিও রয়েছে। কিন্তু সেই সব যুক্তি সে গুছিয়ে বলতে পারছে না। রাফি বলল, ‘তুমি হয়তো বলবে পারিবারিক, ব্যক্তিগত অনেক ইস্যু নিয়ে তোমাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি হয়েছে, শরীরের কারণে নয়। কিন্তু ধরো, এমন অনেক বিষয় আছে, যেগুলো নিয়ে তোমার সাথে আমার কোনো ঝগড়াই হয় না, কোনো দূরত্বই হয় না, বরং আরো আদুরে হয়। আমরা দুজনই মেনে নিই বা গ্রাহ্যই করি না। কিন্তু ওই একই ঘটনা তোমার হাজবেন্ডের সাথে ঘটলে ওটা নিয়েই তুলকালাম ঘটে যায়। হয় না এমন?’

একটু থেমে রাফি আবার বলল, ‘ষাট বছরের বৃদ্ধের যখন তার কাছাকাছি বয়সের স্ত্রীর সাথে সারাক্ষণ খটোমটো লেগেই থাকে। যখন রোমান্টিসিজম বলতে কোনো ব্যাপারই আর থাকে না। তখন সেটিকে আমরা স্বাভাবিক ধরে নেই। ধরে নিই এসবের কারণ কেবল বয়স। কিন্তু বয়স মানেই কি শরীর নয়? সেই বৃদ্ধ লোকটিও যদি হঠাৎ তার অর্ধেক বয়সের কোনো মেয়েকে বিয়ে করে ফেলে, তখন তার ফলাফল কী দাঁড়ায় জানো? আমি নিজের চোখে দেখেছি, আমাদের পাশের বাসার বাড়িওয়ালা। ধবধবে সাদা দাড়ি, সারাক্ষণ বউ পেটায়। হঠাৎ সে তার চেয়ে অর্ধেক বয়সের তরুণী এক মেয়েকে বিয়ে করে ফেলল। এখন দেখি তার সাদা দাড়ি কলপ দিয়ে কালো করেছে। পাঞ্জাবি ছেড়ে রংচঙা হাওয়াই শার্ট পরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। মাঝে মাঝে নতুন বউয়ের জন্য ফুল, চকলেটও কিনে নিয়ে যেতে দেখা যায়। খুব স্বাভাবিক মনে হয়। কিন্তু এখানেও আসল ব্যাপারটা কিন্তু ওই শরীরই! সে একটা নতুন শরীর পেয়েছে। সেই অনুদঘাটিত নতুন শরীর এতদিন পরও তাকে আবার রোমান্টিক করে তুলেছে। যেটা তার স্ত্রীর পুরনো শরীর পারেনি।’

‘সেটা পুরুষের বেলায় সত্যি হতে পারে। মেয়েদের বেলায় নয়।’

‘আমিতো পুরুষই, আমি তাই পুরুষের কথাই বলছি। মেয়েদের বেলায় কী হয়, সেটা মেয়েরাই ভালো বলতে পারবে। তবে মানুষ যা প্রকাশ করে, আসল ঘটনা তা নয়। এই সম্পর্কে শরীরই সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ। শরীর ছাড়া বাকি যেটা থাকে সেটা ওই পাশাপাশি সহাবস্থান। ভালো বন্ধুর মতো, ভালো আত্মীয়ের মতো। কিন্তু যে দুর্দান্ত, পাগলাটে প্রেম বা ভালোবাসাকে আমরা কেবল মানসিক বলে গ্লোরিফাই করার চেষ্টা করি, তার মূল শেষ অবধি ওই শরীরই। কিন্তু সেটি স্বীকার করার সাহস আমাদের নেই। কারণ, আমাদের প্রচলিত ভাবনায় সেটি অশিষ্ট, অশালীন, অশোভন।’

বলবে না বলবে না ভেবেও শেষ পর্যন্ত কথাটা বলে ফেলল মুনিয়া, ‘তোমার কথা হয়তো সত্যি কিংবা মিথ্যা, আমি ঠিক জানি না। কিন্তু আমার খুব মন খারাপ হয়ে যাচ্ছে রাফি।’

‘আমি মন খারাপ করার মতো কিছু বলিনি।’

‘তুমি মন খারাপ করার মতো কিছু বলোনি?’

‘উহু। পৃথিবীর সকল সম্পর্কের, সকল অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশ হচ্ছে শরীর।‘

‘মানে?’

‘মানে খুব সহজ। ধরো, দুজন মানুষ পরস্পরকে প্রচন্ড ভালোবাসে। বা ধরো তারা পরস্পরের স্বামী-স্ত্রী। তো হঠাৎ করে এই দুজনের একজন যদি অন্য কোনো সম্পর্কে যুক্ত হয়ে পড়ে, তৃতীয় কারো সঙ্গে, তখন সেই দুজনের একজনের জন্য সেটি কষ্টকর না?’

‘হুম।’ মুনিয়া অস্ফুটে বলল।

রাফি বলল, ‘এখানে একটা ইন্টারেস্টিং অবজার্ভেশন আছে। ধরো সেই সম্পর্কটা যদি কেবলই মানসিক হয়, মানে শরীর পর্যন্ত না গড়ায়, তাও কিন্তু মেনে নেয়া সম্ভব হয়। কিন্তু যদি এই স্বামী-স্ত্রীর একজন জানে যে তার সঙ্গীর সেই অন্য সম্পর্কটা শুধু মন অবধি না, শরীর পর্যন্তও গড়িয়েছে, তখন কিন্তু সেটি আর মেনে নেয়া সম্ভব হয়না। হয়?’

মুনিয়া কথা বলল না। চুপ করে রইল। রাফি বলল, ‘তার মানে কী দাঁড়াল? আমরা মুখে মুখে শুধু মনের শুদ্ধতার কথা বলি। মনকে গুরুত্বপূর্ণ বলি। কিন্তু আসলে আমাদের কাছে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো শরীর। শারীরিক শুদ্ধতা। প্রিয় মানুষের মন কখনো-সখনো অন্যের হয়ে গেলেও সেটি আমরা মেনে নেয়ার কথা ভাবতে পারি। কিন্তু তার শরীর কোনো এক মুহূর্তের ভুলেও অন্যের হয়ে গেলে সেটি আমরা মেনে নিতে পারি না। মেনে নেয়ার কথা ভাবতেও পারি না। অথচ আমরা সবসময় সেই একই জাবর কাটতে থাকি, ভালোবাসায় শরীর নয়, মনই আসল। আসলেই কি তাই?’

মুনিয়া আরো খানিক চুপ করে থেকে বলল, ‘এরও ব্যাখ্যা আছে।’

রাফি ধীরে মাথা নাড়ল, ‘হুম। হয়তো আছে। কিন্তু সেই ব্যাখ্যাতেই আমি তোমাকে বলি, শরীরই সকল অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশক।’

‘সকল অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশ হচ্ছে শরীর?’ মুনিয়া এতক্ষণেও যেন এতোটা অবাক আর হয়নি।

‘হুম। রাগ হোক কিংবা মায়া। দুঃখ হোক কিংবা আনন্দ, ভালোবাসা হোক কিংবা ঘৃণা এই সবকিছুর সর্বোচ্চ প্রকাশ কেবল শরীরই করতে পারে।’

মুনিয়া তাকিয়ে রইলো। তবে কথা বলল না।

রাফি বলল, ‘ধরো, আমাদের যখন কারো ওপর প্রচণ্ড রাগ, ঘৃণা কিংবা ক্রোধ হয়, তখন কী ইচ্ছে হয়? ইচ্ছে হয় না, ওই মানুষটাকে ধরে যদি ইচ্ছে মতো পেটাতে পারতাম?’

মুনিয়া ভাবছে। যেন গভীর ধ্যানভগ্ন এক সারস পাখি সে, ‘হুম।’

‘তার মানে শারীরিকভাবে ওই মানুষটাকে যদি আঘাত করতে পারতাম! বা ধরো ছোট্ট তুলতুলে পুতুলের মতো দেখতে একটা শিশু, তাকে দেখলেই মনে হয় না জড়িয়ে ধরে খুব আদর করতে পারতাম? চেপে ধরে চুমু খেতে পারতাম, কিংবা গাল টেনে দিতে পারতাম? এর সবই কিন্তু প্রবলতম অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশ। আর সেই সর্বোচ্চ প্রকাশটা হচ্ছে শারীরিক। তবে সকল শারীরিক প্রকাশই কিন্তু যৌনতা নয়।’

মুনিয়া কথা বলল না। সে থম মেরে তাকিয়ে আছে আকাশে। রাফি বলল, ‘ধরো তোমার মাকে তুমি প্রচণ্ড মিস করছো, অনেকদিন বাদে তার সাথে তোমার দেখা হলো, তুমি তখন কী করবে? তাকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরবে। মানে শারীরিক স্পর্শ। একটা মানুষ প্রচণ্ড ভয় পেয়েছে, তুমি তাকে সাহস দিতে শক্ত করে তার হাত ধরবে, মানে শারীরিক স্পর্শ। এখন সকল শারীরিক স্পর্শ মানেই কিন্তু যৌনতা নয়। আমি বলেছি সকল সম্পর্কের বা অনুভূতির সর্বোচ্চ প্রকাশের মাধ্যম হচ্ছে শরীর। এটি সম্পর্ক ভেদে ভিন্ন ভিন্ন বার্তা দেয়। সকল বার্তাই কিন্তু যৌনতা প্রকাশক নয়। যেমন ধরো, তুমি নারী হিসেবে যখন একজন পুরুষকে ভালোবাসবে, কিংবা একজন পুরুষ তোমাকে নারী হিসেবে ভালোবাসবে, তখন সেও তোমাকে শারীরিকভাবেই চাইবে। অর্থাৎ সেই সম্পর্কের সর্বোচ্চ প্রকাশও শরীর। এবং এই শরীরিক স্পর্শটা যৌনতা প্রকাশক। আসলে যেভাবেই আসুক, শরীর ছাড়া ভালোবাসা হয় না।’

.

শেষের এই কথাটা আর মাথা থেকে তাড়াতেই পারল না মুনিয়া। এই কথাটা সে বিশ্বাসই করতে পারে না। রাফির প্রতি তার এক ধরনের শারীরিক অনুভূতি যে কাজ করেনি, তা নয়। তবে তা সম্পর্কের অনেক পরে এসেছে। কিন্তু রাফির ক্ষেত্রে ঘটনাটি উল্টো। মুনিয়ার প্রতি তার শারীরিক আসক্তি কাজ করেছে আগে। পরে ধীরে ধীরে গভীর একটা মানসিক টানও অনুভব করেছে। এবং সেটি সে নির্দ্বিধায় স্বীকারও করেছে। শুধু মুনিয়াই নয়, বয়সে বড় আরো অনেকের প্রতিই এই বিশেষ আসক্তিটা তার ছিল। রাফি মুনিয়াকে কথাটা বলেছিল। সে বলেছিল, এটাকে ইংরেজীতে বলে Gerontophile.

মুনিয়া অবশ্য সে সময় এতকিছু ভাবার মতো অবস্থায় ছিল না। টগবগে, দুরন্ত, ক্ষ্যাপাটে এক পাগল প্রেমিক রাফি তখন তাকে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে সর্বপ্লাবী ভালোবাসায়। জীবনের একান্ত গোপন আক্ষেপ, অপ্রাপ্তি আর উপেক্ষার পাত্রগুলো ভাসিয়ে দিয়ে প্রবল ভালোবাসায় কানায় কানায় পরিপূর্ণ করে তুলছে তাকে।

.

সেই রাফিকে আজকাল এত অচেনা লাগে মুনিয়ার। তবে কি সে শারীরিকভাবে ফুরিয়ে যাচ্ছে? তবে কি রাফির কথাই ঠিক, এই সম্পর্কটা কেবলই শারীরিক? জীবনের আর সকল ভাবনা ছাপিয়ে এই ভাবনাই মুনিয়াকে সন্ত্রস্ত করে রাখল। আয়নায় প্রসাধনীবিহীন মুখ দেখতে গেলেই মনে হয়, বয়স ক্রমশই ছাপ রেখে যাচ্ছে শরীরে। আর মাত্র কটা দিন, তারপর চামড়ার ভাঁজে ভাঁজে জেগে উঠতে থাকবে আরো কত শত সহস্র অপেক্ষা আর উপেক্ষার গল্প, কে জানে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *