1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৩৯

৩৯

বাড়ির সামগ্রিক অবস্থা খুব থমথমে হয়ে উঠেছে। এরই মধ্যে সেলিনা এসে মুনিয়াকে বলল, ‘ভাবি আমি ঠিক করেছি, তোমরা কোনো ব্যবস্থা না করলেও যত দ্রুত সম্ভব আমি বিয়ে করে ফেলব।’

মুনিয়া বলল, ‘বাবা-মাকে কিছু বলেছো?’

‘আমি বলতে পারব না। পারলে তুমি বলো।’

মুনিয়া সেলিনাকে শান্ত করার চেষ্টা করল। সে বলল, ‘এই অবস্থায় এটা নিয়ে কথা বলা ঠিক হবে না। একটু অপেক্ষা করি?’

সেলিনা বেপরোয়া ভঙ্গিতে বলল, ‘আমার হাতে অত সময় নেই ভাবি। তা

ছাড়া আহসানের অবস্থাও ভালো না। তার পথে বসার জোগাড়।

‘সে তো তাহলে এ বাড়িতেই উঠছে?’

সেলিনা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। নির্বিকার ভঙ্গিতে চলে গেল। মুনিয়ার কেন যেন মনে হলো দুয়েকদিনের মধ্যেই সেলিনা ঘটনা ঘটিয়ে ফেলবে।

.

সেলিনা তারপর গেল তার মায়ের কাছে। গিয়ে বলল, ‘তোমার সাথে জরুরি কথা আছে মা।’

মছিদা বেগম ভয়ে ভয়ে বললেন, ‘কী কথা?’

সেলিনা ভনিতা না করে সরাসরিই কথাটা বলল, ‘আমি বিয়ে করব মা।’

কথা শুনে মছিদা বেগম প্রথমে হকচকিয়ে গেলেন। এমন সোজাসাপ্টাভাবে সেলিনা তার বিয়ের কথা বলবে এটা তিনি আশা করেননি। মছিদা বেগম কিছুটা সময় নিয়ে ধাতস্ত হলেন। তারপর সেলিনার কাছ থেকে ঘটনার বিস্তারিত বিবরণ শুনে চুপ করে রইলেন। এই মেয়েকে নিয়ে তার তীব্র ভয়। একজীবনে অসংখ্য ভুল সে করেছে। কিন্তু সেই ভুল থেকে শিক্ষা নেয়ার কোনো লক্ষণ তার মধ্যে নেই। অনেক ভাবনা-চিন্তা করে অবশেষে মছিদা বেগম নিজেই এলেন মুনিয়ার সাথে কথা বলতে। তিনি প্রায় ফিসফিস করে বললেন, ‘ঘটনা কী বলোতো বউ?’

‘কোন ঘটনা?’

‘শেলী এইগুলা কী বলতেছে?’

‘কী মা?’ যেন কিছুই জানে না, এমন ভঙ্গিতে বলল মুনিয়া।

‘ওই যে আহসান না যেন কী এক ছেলে, তার বিষয়ে।’

‘জি মা?’ মুনিয়া প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল। মছিদা বেগম সামান্য ভেবে বললেন, তুমি একটু দেখোতো মা ঘটনাটা কী? সে এখন বলতেছে এই ছেলেরে নাকি তার পছন্দ হয়েছে। ছেলে নাকি দেখতে শুনতে ভালো। সবচেয়ে বড় কথা আনম্যারেড। এইটা নিয়ে সে খুব খুশি। কিন্তু তুমিই বলো মা, এত ভালো ছেলে হলে সে ডিভোর্সি মেয়ে কেন বিয়ে করবে? দেশে কী মেয়ের আকাল পড়ছে? ঘটনা নিশ্চয়ই কিছু আছে।’

মুনিয়া হাসল, ‘তা হবে কেন মা? ডিভোর্সি হলে তাকে আনম্যারেড ছেলে বিয়ে করতে পারবে না, এটা কেমন কথা? যার যাকে ভালো লাগবে, সে তাকেই বিয়ে করতে পারে। যদি দুই পক্ষেরই কোনো সমস্যা না থাকে। ‘

‘কিন্তু মা কথায় আছে না, চুন খাইয়া মুখ পুড়লে, দই দেখলেও ভয় লাগে। আমার এখন হইছে ওই অবস্থা। মেয়ের জীবনে একবার এত বড় এক স্পট পড়ল, এখন সামনে কী হয় না হয় আল্লাহই জানে! বোঝোইতো মা, খুব ভেবে বুঝে কাজ করতে হবে।’

মুনিয়া কোনো কথা বলল না। মছিদা বেগম হঠাৎ মুনিয়ার হাত জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘আমি আর কয়দিন মা, এই বাড়ির ভালো বলো, মন্দ বলো, সব ওই তোমারই দেখতে হবে। সেলিনাতো তোমার আপন বোনের মতোই। তুমি যা ভালো মনে করো করো। ও যেহেতু এত করে বলতেছে। আর আমারওতো ওরে নিয়া সবসময় একটা পেরেশানি। তুমি একটু ছেলেটারে দেখো মা।’

মছিদা বেগম ঘর থেকে বের হওয়ার আগে আবার ফিরে এলেন। তারপর মুনিয়ার হাত ধরে বললেন, ‘মাগো, তুমি আমার নিজের মেয়ের মতোই না শুধু, তুমি আমার নিজের মেয়েই। এইজন্য তোমারে ভালোও যেমন বাসি, তেমনি শাসনও করি। পেছনে অনেক ভালো-মন্দ বলছি, কত কী করছি, এইসব মনে রেখো না। শোনো, একটা কথা সবসময় মনে রাখবা, শাসন করা তারই সাজে সোহাগ করে যে! শাসনও আমি করি, ভালোওতো আমিই পাই, নাকি? এইটা সবসময় মনে রাখবা।’

তিনি মুনিয়াকে জড়িয়ে ধরলেন। মুনিয়া কিছু বলল না। তবে তার বুকের ভেতর লুকিয়ে রাখা চাপা ক্ষতগুলো যেন আবার জেগে উঠতে চাইল। মছিদা বেগমের এই রূপ তার অচেনা নয়। মুনিয়ার ধারণা, কেবল বিপদে পড়লেই তিনি নমনীয় হয়ে ওঠেন, মন ভোলানো কথা বলেন। কিন্তু বিপদ কেটে গেলে মুহূর্তেই স্বমূর্তি ধারণ করেন। এ কারণে সে আজকাল আর এসব নিয়ে আহ্লাদিত হয় না।

.

সেলিনার বিষয়টা নিয়ে সে রাতে জাফরের সাথে কথা বলতে গেল। জাফর অবশ্য বিষয়টি গুরুত্ব দিল না। সে তার চিরাচরিত নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘তুমি যা ভালো মনে করো সেটাই করো।’

মুনিয়া একটু বিরক্তই হলো, ‘এই সংসারটা আমার না জাফর, তোমার আমার হলেও তোমার আগে।’

‘এত হিসেব করে কি সংসার চলে?’

‘তুমি হিসেব কষো না?

‘আমি আবার কী হিসেব কষলাম?’

মুনিয়া হাসল, ‘মানুষ নিজের মুখটা কখনো অন্যের আয়নায় দেখতে চায় না, সে সবসময় নিজের আয়নায় অন্যের মুখটা দেখাতে চায়। এই যে আমি রাগ করে ও বাড়িতে চলে গেলাম তুমি একদিন একটা ফোন দেয়ারও প্রয়োজন মনে করোনি?’

‘আমিতো তোমাকে আনতে গিয়েছিলাম, যাইনি?’

‘কেন আনতে গিয়েছিলে, ভালোবেসে? আমাকে ছাড়া তোমার খুব খারাপ লাগছিল, এই জন্য?’ মুনিয়া ব্যাঙ্গাত্মক হাসল। তারপর বলল, ‘অথচ দেখো আমি কী বোকা, আমি কিন্তু তাই ভেবেছিলাম। আর তোমাকে দেখেই ড্যাংড্যাং করে চলে এলাম।’

জাফর বুঝতে পারছে, পরিস্থিতি আবার উত্তপ্ত হচ্ছে। সে শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘আমিতো যেতাম। কিন্তু কাজের চাপে যেতে পারিনি। ওদিকে মা ওই দিন খুব করে বলছিল, রুবেল যেদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে বিয়ে করে এল, তখন সেলিনার সাথে বাঁধল ঝামেলা। তখন তোমাকে খুব দরকার ছিল।’

‘আচ্ছা, একটা কথা বলোতো, প্রয়োজন ছাড়া আমার আর কোনো মূল্য আছে তোমাদের কারো কাছে? তোমরা কেউ কখনো প্রয়োজন ছাড়া একটা ভালো কথাও আমার সাথে বলো? সামান্য ভালো আচরণ করো? এই বাড়ির কেউ? কখনো করো না। তোমার মা, সেই তোমার মা, এখন বিপদে পড়েছে, এখন আমি তার মেয়ে। আর যখন প্রয়োজন শেষ হয়ে যাবে, তখন?’ মুনিয়ার বুকের ভেতরটা হঠাৎ ভারী হয়ে এলো। রাফির সেদিনের কথাগুলো সে এখনো কিছুতেই মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না। আসলেই, সবার কাছে সে কেবল প্রয়োজনই।

প্রবল অভিমান আর উপেক্ষার যন্ত্রণায় বুকটা জমাট পাথরের মতো ভারী হয়ে আছে যেন। সে ভেজা গলায় বলল, ‘আমি একটা অভিশপ্ত মানুষ জাফর। আই এম কার্সড। একটা জঘন্য অপাংক্তেয় মানুষ। না হলে তোমরা সবাই আমাকে এত অপছন্দ করবে কেন? কেন!’ হঠাৎ কেঁদে ফেলল মুনিয়া। জাফর ছুটে গিয়ে তাকে ধরার চেষ্টা করল। কিন্তু মুনিয়া সেই সুযোগ দিল না। সে ঝটকা মেরে জাফরকে সরিয়ে দিল। তারপর বলল, ‘আমার বেঁচে থাকাটা মিনিংলেস, বুঝলে? শুধু শুধু বেঁচে আছি আমি! আমার জায়গায় অন্য যে কোনো মেয়ে হলে কবে সুইসাইড করত! একটা মেয়ে পেটে ধরেছি, সেই মেয়েটার কাছে পর্যন্ত আমার কোনো গুরুত্ব নেই। কোনো ভালোবাসা নেই। আমার মতো মানুষ কেন বেঁচে থাকবে বলোতো!’

মুনিয়া কাঁদছে। কান্নার দমকে তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। কে জানে তার এই কান্না ভেজা, উপেক্ষা আর অভিমানে নিথর হয়ে থাকা বুকের ভেতর কোথাও তখন রাফির মুখটাও ভেসে উঠছে কিনা! তবে সেই সারাটা রাত সে এক অবর্ণনীয় যন্ত্রণায় নির্জীব হয়ে রইলো মুনিয়া। শেষ রাতের দিকে জাফর তাকে ডাকল, ‘মুনিয়া।’

মুনিয়া জবাব দিল না। জাফর তাকে হাত বাড়িয়ে কাছে টানল, ‘শোনো।’

মুনিয়া তাও সাড়া দিল না। জাফর এবার নিজেই সরে এলো মুনিয়ার কাছে। তারপর তার কানের কাছে ঠোঁট নিয়ে বলল, ‘পৃথিবীতে সবাই কি একরকম হয় বলো?’

মুনিয়া চুপ। জাফর বলল, ‘আমি মানুষটাই যেন কেমন, নিজেকে ঠিকঠাক বোঝাতে পারি না। কারো কাছে প্রকাশ করতে পারি না। মনে মনে কতকিছু যে করব বলে ভাবি, কিন্তু তার কিছুই ঠিকঠাক করতে পারি না। অথচ সেই না করতে অথচ মনে মনে ভাবা বিষয়গুলোও তুমি বুঝতে পারো না বলে উল্টো পারা, আমারই কষ্ট হয়।’

জাফর একটু থামল। মুনিয়া যেমন ছিল, তেমন শুয়েই রইলো। জাফর বলল, ‘এই যে তোমার পাশে রোজ রাতে শুয়ে থাকি, খুব মনে হয়, তোমাকে একটু ডাকি। কিন্তু ডাকাটা আর হয়ে ওঠে না। মনে হয়, তুমিওতো আমাকে ডাকতে পারো। তখন মনে মনেই অভিমান হয়। এতবছরের সম্পর্কেও দূরত্বটা এভাবেই তৈরি হয়।’

মুনিয়া নিঃসাড় পড়ে আছে। জাফর বলল, ‘এই যে এখন তোমাকে ডাকছি, তারপরও তুমি যে সাড়া দিচ্ছো না, এটা নিয়েও অভিমান হচ্ছে। কী করব আমি বলো? সবাইতো একরকম হয়না, হয়?’

জাফরের গলার স্বরটাও ভারী, ভেজা, ‘আমি একটু কেমন জানি! আমারও খুব কষ্ট হয় মুনিয়া। কিন্তু সেই কষ্টটা আমি কখনো কাউকে বোঝাতে পারি না।’ শেষ দিকটায় এসে জাফরের গলাটা যেন বুজে এলো।

মুনিয়া হঠাৎ তার একটা হাত বাড়িয়ে জাফরের হাতখানা ধরল। তবে পাশ ফিরল না। উল্টোদিকে মুখ করেই শুয়ে রইলো। জাফর বলল, ‘আমি না হয় তোমাকে বুঝতে পারি না, তুমিতো আমাকে বুঝতে পারো!

মুনিয়া চুপ করেই রইলো। তবে এখন সে নিঃশব্দে কাঁদছে। তার শরীরের কম্পন টের পাচ্ছে জাফর। সে হাত বাড়িয়ে মুনিয়ার মুখটা তার দিকে ফেরাল। মুনিয়ার বন্ধ চোখের পাতা গলে নেমে আসা জল শীতল ছোঁয়া দিল জাফরের হাতে। জাফর সেই চোখের জল ছুঁয়ে প্রায় ফিসফিস করে বলল, ‘আমি না হয় বোকা, আমার না হয় বুদ্ধি কম। কিন্তু তুমিতো অনেক বুদ্ধিমতী। এখন তুমিও যদি আমার মতো হয়ে যাও, তাহলে চলে? সবাই যদি একইরকম হয়….

সে মুনিয়াকে বুকের কাছে টেনে নিয়ে এলো। তারপর চকিতে চুমু খেলো তার ঠোঁটে। তারপর কী ভেবে সাথে সাথেই অপরাধীর মতো আবার দূরে সরে এলো। হয়তো ভাবল, এমন কান্না ক্লান্ত মুনিয়াকে এই মুহূর্তে এভাবে চুমু খাওয়াটা তার ঠিক হয়নি। নিজের বিবেচনাবোধের প্রতি আরো একবার সংশয় তৈরি হলো তার। যেন প্রয়োজনের মুহূর্তে কখনোই নিজের কর্তব্য ঠিক করতে পারে না সে। বরং অতিরিক্ত সতর্ক হতে গিয়ে সবকিছু আরো এলোমেলো করে ফেলে। মুনিয়া কাছ থেকে একটা তীব্র প্রতিক্রিয়ার আতঙ্ক নিয়েই অপেক্ষা করছিল জাফর। এই বুঝি আবারও ক্ষিপ্ত হয়ে উঠবে মুনিয়া।

মুনিয়া অবশ্য ক্ষেপল না। বরং চমকে দিল জাফরকে। হাত বাড়িয়ে জাফরের চুলের মুঠি ধরে নিজের আরো কাছে টেনে আনল তাকে। তারপর পাগলের মতো চুমো খেতে থাকল সে। যেন তেষ্টাক্লান্ত কোনো পথিক শুষে নিচ্ছে জলের শেষ বিন্দুটুকুও। সেই সাথে শুষে নিচ্ছে জীবন। আর কে না জানে জলের অন্য নামই জীবন! ভেতরে ভেতরে ক্রমশই মরে যেতে থাকা মুনিয়া হয়তো শুষে নিচ্ছিল জীবনও। কিন্তু সেই জীবনটুকু দিতে জাফর কি প্রস্তুত? কিংবা সত্যি সত্যিই মুনিয়া তা নিতে জানে?

আধো অন্ধকারে দুজন নারী-পুরুষ যখন আবার সুদীর্ঘ বছর পর তাদের অবচেতন অভিমান, উপেক্ষা ও অপেক্ষার দিবস-রজনী কাটিয়ে তাদের শেষ দূরত্বটুকুও ঘুচিয়ে দিল, তখনো এই প্রশ্নের উত্তর রয়ে গেল অজানাই।

পরের দুটো দিন ভালোই গেল মুনিয়ার। কিন্তু বুকের ভেতর জমে থাকা অস্থিরতার থমথমে মেঘ হাওয়ায় মিলিয়ে গিয়ে আর আলো ঝলমলে রোদে ভেসে যাওয়া হলো না। ওই মেঘ ভিড় করে ভারী করে রাখল মনের আকাশ। সেই আকাশে আরো ঝড় হয়ে এলো পরদিন সন্ধ্যা। কাউকে কিছু না জানিয়ে আহসানকে নিয়ে বাড়িতে উপস্থিত হলো সেলিনা। তার পরনে বিয়ের শাড়ি। আহসান পরে আছে পাঞ্জাবি। তারা কাজি অফিস থেকে বিয়ে করে এসেছে। পাশাপাশি ঘরে রুবেল আর তুলির সাথেই থাকতে শুরু করল তারা। একটি শান্ত, নিস্তব্ধ বাড়িতে শুরু হলো ভয়াবহ অশান্তির ঝড়। সেই ঝড়ে কেঁপে উঠল অন্যরাও।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *