1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ২১

২১

আফসানা আহমেদের নতুন বইয়ের মোড়ক উন্মোচন হবে। মোড়ক উন্মোচন করবেন তার বাবা নুরুন্নবী চৌধুরী। এই উপলক্ষে তিনি কলেজে এসেছেন। কলেজজুড়ে একটা সাজ সাজ রব পড়ে গেছে। পড়ন্ত বিকেলে কলেজ মাঠে ছাত্রছাত্রীদের সামনে মোড়ক উন্মোচন করা হবে।

মোড়ক উন্মোচন অনুষ্ঠানে আরো গণ্যমান্য লোক উপস্থিত হয়েছেন। কলেজের অধ্যক্ষও রয়েছেন। কবিতার বইয়ের নাম ‘এই আমি এক অন্য মানুষ। ‘ বইয়ের মোড়ক উন্মোচন পরবর্তী বক্তৃতায় অধ্যক্ষ সাহেব নানা কিছু বললেন। এই ঘুণে ধরা, ক্ষয়ে যাওয়া সমাজের মূলে কুঠারাঘাত করতে কবিতার ভূমিকা কী বিশাল, তরুণ প্রজন্মের নৈতিক অবক্ষয় রোধে তাদের শিল্প-সাহিত্য চর্চায় আত্মনিয়োগ করা উচিত। তিনি কবি হেলাল হাফিজের কবিতা থেকেও উদ্ধৃত করলেন, ‘এখন যৌবন যার, যুদ্ধে যাওয়ার তার শ্রেষ্ঠ সময়।’ যুদ্ধ মানে কেবলই ঢাল-তলোয়ার, পিস্তল-বন্দুকের যুদ্ধ নয়। কবিতার শব্দে শব্দে, বাক্যে বাক্যেও যুদ্ধ হতে পারে। সেই যুদ্ধ বদলে দিতে পারে মানুষ, সমাজ ও রাষ্ট্রকেও। এই যুদ্ধে কবিতার শব্দই হাতিয়ার। ইত্যাদি নানা কথা বলে তিনি তার বক্তৃতা শেষ করতে যাবেন। কিন্তু সমস্যা হলো এই শেষটাতে এসেই। তিনি আফসানা চৌধুরীর প্রশংসা করতে গিয়ে বললেন, ‘একজন প্রকৃত কবি তার ভাষায়, তার শব্দে, তার আচারে কবিতাকে ধারণ করেন। তিনি যা বলতে চান, যা বোঝাতে চান তা তার বইয়ের নাম থেকে শুরু করে নিজের নামের মাধ্যমেও প্রতিফলিত করার চেষ্টা করেন। এটা অনেকটা মেটাফোরের মতো। অনেকে অবশ্য সাহিত্যে মেটাফোর এবং সিমিলিকে মিলিয়ে ফেলেন। এই বিষয়েও বিস্তর আলোচনা প্রয়োজন। কিন্তু হাতে পর্যাপ্ত সময় নেই বলে আজ কাব্যভাষায় মেটাফোরের ব্যবহার নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে পারছি না। কিন্তু আপনারা লক্ষ করবেন, আফসানা চৌধুরী তাঁর কবিতার বইয়ের নামকে যথার্থভাবে ফুটিয়ে তুলতে গিয়ে নিজের নামেও প্রতীকী পরিবর্তন ঘটিয়েছেন। তিনি তার নামে আফসানা চৌধুরীর পরিবর্তে আফসানা আহমেদ ব্যবহার করেছেন। যেহেতু কবিতার বইয়ের নাম এই আমি এক অন্য মানুষ, সেহেতু তিনি সেটি তার নামের মাধ্যমেও ফুটিয়ে তোলার চেষ্টা করেছেন। কে জানে, হয়তো এই বইটি যিনি লিখেছেন, এই বইয়ের যেই কথাগুলো আমরা যার বলে জানি, সেগুলো আসলে অন্য কারো অব্যক্ত অনুভূতি। এমন হতে পারে না? পারে। সাহিত্যতো এমনই, আমরা নিজেদের কথা বলতে গিয়ে আসলে অন্য অসংখ্য মানুষের কথা, অনুভূতিটাই বলে ফেলি।’

.

সন্ধ্যার পরপর নুরুন্নবী চৌধুরী চলে গেলেন। যাওয়ার আগে কুঞ্চিত কপালে তিনি আফসানাকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘ঘটনা কী বলতো?’

‘কী ঘটনা বাবা?’

অধ্যক্ষ সাহেব না বললেতো আমি খেয়ালই করতাম না। তোর নামের শেষে আহমেদ এলো কোত্থেকে?’

আফসানা হাসল, ‘এটা তেমন কিছু না বাবা।’

‘কেমন কিছু না? হঠাৎ নিজের নাম বদলে ফেললি!

‘নামতো বদলাইনি বাবা। শেষেরটুকু বদলেছি। কবি-লেখকদের নামের একটা

ব্যাপার আছে। চৌধুরী টৌধুরী খুব একটা যায় না।’

‘কে বলল যায় না? প্রমথ চৌধুরীর নামের শেষে চৌধুরী নেই?’

‘তুমি এসব বুঝবে না বাবা। আমারটা আমাকেই ভাবতে দাও।’

নুরুন্নবী চৌধুরী আর কিছু বললেন না। তিনি মেয়ের ওপর প্রচণ্ড বিরক্ত। একই সাথে চিন্তিতও। ছোটবেলা থেকেই আফসানা প্রচণ্ড জেদি, একগুঁয়ে। তার ওপর কোনোকিছু চাপিয়ে দেয়া যায় না। তার সিদ্ধান্তেরও বাইরে যাওয়া যায় না। কিন্তু সে তার জীবন নিয়ে একের পর এক ভুল করেই চলেছে। এখন তার বয়সও হয়েছে। তবুও জীবন সম্পর্কে তার উপলব্ধি স্পষ্ট নয়। গাড়িতে ওঠার সময় তিনি আচমকা আফসানাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর ফিসফিস করে বললেন, ‘এখনো সময় আছে মা। বয়স কারো জন্য বসে থাকে না। একটা সময় পর সবার একজন নিজের মানুষ লাগে। ঘর-সংসার লাগে। সন্তান লাগে। বাইরের পৃথিবী যখন তার জন্য সংকুচিত হয়ে যায়। ঘরটাই তখন তার পৃথিবী। আমার দিকে তাকা, আমার হাতেও কিন্তু খুব বেশি সময় নেই রে মা।’

আফসানা কিছু না বললেও বাবার কথার শেষ অংশটুকুতে তার কম্পিত গলা আর ভেজা চোখ আফসানার দৃষ্টি এড়াল না। আজকাল আফসানার নিজেরও খুব অস্থির লাগে। সময় যে দ্রুত বয়ে যাচ্ছে, তা সেও জানে। কিন্তু কী করবে সে?

সেদিন রাতে আশফাকের সাথে তার কথা হলো। আফসানা কোমল কণ্ঠে বলল, ‘তোমার শরীর খুব খারাপ হয়ে যাচ্ছে আশফাক।’

আশফাক যেনো প্রস্তুত হয়েই ছিলেন। তিনি বললেন, ‘শরীরকে কে নিয়ন্ত্রণ করে, জানোতো?’

আফসানা জবাব দিল না। তবে উৎসুক চোখে তাকাল। আশফাক বললেন, শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করে মন। কেউ যদি মানসিকভাবে অসুস্থ থাকে, তার শরীরতো বিদ্রোহ করবেই।’

‘এটা তুমি সত্যি সত্যিই বোঝো?’

‘বুঝব না কেন? এই যে আমি, আমাকে দেখো। দেখে বুঝতে পারো না?’

‘তুমি পারো?’

‘কী?’

‘বুঝতে।’

‘বুঝতে না পারলে বললাম কী করে?’

‘সে তো কেবল নিজেরটুকু বুঝলে। কিন্তু অন্যেরটুকুও তো বুঝতে হবে, তাই না?’

‘অন্যেরটুকু কী বুঝব?’

‘এই যে তোমার কারণে অন্য একটা মানুষও প্রতি মুহূর্তে নিঃশেষ হয়ে যাচ্ছে, এইটুকু বোঝো? তার মন, তার শরীর, তার স্বপ্ন-সম্ভাবনা এমনকি বেঁচে থাকাটুকুও অনিশ্চিত হয়ে যাচ্ছে, বোঝো?’

আশফাক কথা বললেন না। জানালার বাইরে গাঢ় অন্ধকার। তিনি সেই গাঢ় অন্ধকারের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইলেন। আফসানা বলল, শব্দ শুনতে পাচ্ছো?’

আশফাক চোখ তুলে তাকালেন, ‘কীসের শব্দ?

‘ঘড়ির কাটার। তুমি শুনতে না পেলেও আমি পাই। প্রতিটি মুহূর্তে, প্রতিটি সেকেন্ডের শব্দ আমি টের পাই। আমার সময় শেষ হয়ে আসছে আশফাক। এটা কী পরিমাণ যন্ত্রণার তোমার ধারণা আছে?’

আফসানা সামান্য থামল। তারপর বলল, ‘আমি ডাক্তারের সাথে কথা বলেছি আশফাক। আমার হাতে খুব বেশি সময় নেই। নানা শারীরিক জটিলতা আমার আছে। বয়স বেড়ে যাচ্ছে। তারপরও এখনো হয়তো সামান্য হলেও সম্ভাবনা আছে। কিন্তু আরেকটু সময় গেলে হয়তো আর কখনোই আমি কনসিভ করতে পারব না। তুমি বুঝতে পারছো?’

‘পারছি।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে আমি কী করব? তুমিই বলো।’

শান্ত আফসানা মুহূর্তেই যেন অগ্নিমূর্তি ধারণ করল। সে চিৎকার করে বলল, তুমি বুঝতে পারছো না তুমি কী করবে? তুমি আজ এক্ষুনি এই মুহূর্তে বিয়ের কথা সবাইকে ঘোষণা করে জানাবে। একটা মানুষের পক্ষে যতটা সহ্য করা সম্ভব তার সবটা আমি করেছি। কিন্তু আমি আর পারব না আশফাক। আমার পক্ষে আর সম্ভব না।

আশফাক মিনমিন করে বললেন, ‘আমাকে আর কটা দিন সময় দাও।’

‘কদিন? তুমি এক্ষুনি আমাকে বলবে। এই মুহূর্তে বলবে, আর কদিন সময় তুমি চাও। বলো, এক্ষুনি বলো। বলো।’

‘আমিতো তোমাকে বলেছিই যে নাদিয়ার বিয়েটা পর্যন্ত সময় আমাকে তোমার দিতেই হবে।’

ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল আফসানা। তারপর বলল, ‘কিন্তু সেটা কতদিন? তুমি যদি আগামী দশ বছরেও নাদিয়ার বিয়ে না দাও, সেই দশ বছর আমি অপেক্ষা করব? সময় আমার জন্যে অপেক্ষা করবে?’

‘দশ বছর কেন লাগবে?’

‘তাহলে কয় বছর লাগবে? বলো, কয় বছর লাগবে?’

‘ও কেবল ফার্স্ট ইয়ারে পড়ে। আরো অন্তত তিন চারটা বছরতো লাগবেই।’

রাগে, দুঃখে আফসানার মরে যেতে ইচ্ছে হচ্ছে। প্রবল আক্রোশে দু হাতে নিজের মাথা চেপে ধরল সে। তারপর বলল, ‘একবার ভাবো তো, তিন চার বছর না, ধরো আরো দশ বা পনেরো বছর সময় আমি তোমাকে দিয়ে দিলাম। এই সময়ের আগে তুমি নাদিয়ার বিয়ে দিতে পারবে না। তখন কী হবে?’

‘অতবছর তো লাগবে না। তুমি বুঝতে পারছো না।’

‘আমি বুঝতে পারছি আশফাক, কিন্তু তুমি পারছো না। তুমি নাদিয়ার বাবা। তুমি জানো, আরো পনেরোটা বছর নাদিয়ার বিয়ের জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব না। কারণ তখন সময় থাকবে না। তার আগেই তাকে বিয়ে দিতে হবে। কিন্তু একবার আমার কথা চিন্তা করেছো তুমি? কিংবা আমার বাবার কথা? কীসের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছি আমরা?’

আফসানা হঠাৎ হাউমাউ করে কেঁদে ফেলল। কান্নার দমকে তার শরীর কাঁপছে। আশফাক সামান্য ঝুঁকে আফসানাকে দুহাতে ধরার চেষ্টা করলেন। কিন্তু পারলেন না। আফসানা ঝটকা মেরে তার হাত সরিয়ে দিল। সে মাথা তুলল দীর্ঘ সময় পর। তার চোখ লাল। মুখ থমথমে। চোখের দৃষ্টি কেমন ঘোলাটে। সে আশফাকের চোখে চোখ রেখে বলল, ‘তোমার আসল উদ্দেশ্যটা আমি বুঝে গেছি আশফাক।’

‘কী বুঝেছো?

‘তুমি আসলে সুযোগ খুঁজছো, আমার কাছ থেকে পালিয়ে যাওয়ার। আর এজন্যই সবার আগে মানুষের কাছে আমাকে দোষী হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছো? মিথ্যে হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছো। তাই না?’

‘মানে?’

‘মানেতো খুবই সহজ। আমি বোকা বলেই এতদিন বুঝিনি। আজ বিকেলে বইয়ের মোড়ক উন্মোচনে অধ্যক্ষ সাহেব কী বললেন ওগুলো? এই বই নাকি আমি লিখিনি, অন্য কেউ লিখেছে। কে লিখেছে ওই বই, হ্যাঁ? তুমি? কিন্তু সেই কথা অধ্যক্ষ সাহেব কী করে জানলেন? তুমি তাকে বলেছো?’

আশফাক ভারি অবাক হলেন, ‘কী বলছো তুমি এসব? আমি কেন এগুলো কাউকে বলতে যাব? আর অধ্যক্ষ সাহেবও এটা বলেন নি। তুমি ভুল বুঝছো।

‘আমার সবই তো ভুল আশফাক। সব ভুল। ভুল না হলে এত বড় একটা বোকামি আমি কী করে করলাম। শোনো আশফাক, অনেক হয়েছে। আর না। তোমার অবশ্যই এ বছরের মধ্যে যা করার করতে হবে। না হলে আমি নিজে থেকে তোমার বাসায় গিয়ে তোমার বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানের সামনে যা বলার বলে আসব। এটা শুধু কথার কথা না আশফাক। আই মিন ইট। মাইন্ড ইট।’

আশফাক খপ করে দু হাতে আফসানার হাত ধরে ফেললেন। তারপর অনুরোধের ভঙ্গিতে বললেন, ‘আমি তোমার অবস্থাটা বুঝি না এমন না। আমি সবার অবস্থাটাই বুঝি। কিন্তু আমার অবস্থাটা আমি কাউকেই বোঝাতে পারি না। বিশ্বাস করো, আমি মনে মনে নাদিয়ার জন্য ছেলে খুঁজছি। ভালো একটা ছেলে পেলেই আমি নাদিয়ার বিয়ের ব্যবস্থা করে ফেলব। যত দ্রুত সম্ভব। তুমি দেখো।

‘আমি আর দেখতে পারব না আশফাক। আমি অনেক দেখেছি। এবার আমার করার পালা।’ বলে থামল আফসানা। তারপর বুক ভরে নিঃশ্বাস নিল সে। তারপর আচমকা বলল, তোমার আর কিছু করতে হবে না। যা করার আমিই করব।’

আশফাক ভীত গলায় বললেন, ‘কী করবে তুমি?’

‘নাদিয়ার জন্য ছেলে দেখব।’

‘মানে?’ বিস্মিত গলায় বল্ল আশফাক।

আফসানা শান্ত, স্বাভাবিক গলায় বলল, ‘মানে নাদিয়ার জন্য আমি ছেলে দেখব। তুমি ভয় পেয়ো না, ভালো ছেলেই দেখব। আমার স্বার্থেই দেখব। সে ভালো থাকলে আমরাওতো ভালো থাকব তাই না?’

আশফাক কোনো কথা বললেন না। আফসানা আলতো হাতে আশফাকের হাত ছুঁয়ে দিল। তারপর শক্ত করে আশফাকের কম্পিত হাতখানা ধরলো। তারপর মমতার্দ্র কণ্ঠে বলল, ‘তুমি ভয় পেয়ো না আশফাক। আমি ভালো ছেলেই দেখব। প্রয়োজনে তুমি নাদিয়াকে এখানে নিয়ে এসো। ছেলে মেয়ে দুজন দুজনকে দেখেই সিদ্ধান্ত নেবে। তারা পরস্পরকে পছন্দ করলেই কেবল বিয়ে হবে। না হলে হবে না। কিন্তু চেষ্টা করতে দোষ কী বলো? আমি হয়তো নাদিয়ার কেউ না, কিন্তু তার ওপর আমারওতো একটা দায় আছে, দায়িত্ব আছে। আছে না?’

আশফাক এবারও কথা বললেন না। আফসানা আশফাকের হাত ছেড়ে দিয়ে তার গালে আলতো করে হাত বোলাল। তারপর আদুরে গলায় বলল, ‘একটা কথাতো তুমি অস্বীকার করবে না আশফাক?’

‘কী কথা?’

‘নাদিয়ার ওপর আমারও তো একটা অধিকার আছে? আছে না?’

আশফাক চুপ করে রইলেন। আফসানা বলল, ‘এই যে দশটা বছর, এই দশটা বছর তোমার মেয়ে দুটোর বেড়ে ওঠা, পড়াশোনা থেকে শুরু করে আর সবকিছুর পেছনে কী আমার কোনো কন্ট্রিবিউশন নেই? তোমার স্ত্রীর চিকিৎসা থেকে শুরু করে কোন জিনিসটাতে আমি আমার সর্বোচ্চ চেষ্টাটা করিনি আশফাক? একবার ভেবে বলোতো?’

কী বলবেন আশফাক? আসলেইতো তার বলার কিছু নেই। আফসানার কথাতো মিথ্যে নয়। মফস্বলের এই কলেজের চাকরিতে তিনি যে বেতন পান, তাতে নিজের একার চলতেই নাভিশ্বাস উঠে যায়। সেখানে বছরের পর বছর তার যখন যা প্রয়োজন আফসানা দিয়েছে। কখনো কোনো হিসেব চায়নি। নাবিলা আর নাদিয়ার পড়াশোনা, ইউনিভার্সিটিতে ভর্তি, টিউশন থেকে শুরু করে হাফসার চিকিৎসার খরচ পর্যন্ত সে আফসানার কাছ থেকে নিয়েছে। নাবিলার বিয়ের সময়ও দামী উপহার দিয়েছে। বিশাল অঙ্কের নগদ অর্থ সাহায্য করেছে। এই এত এত কিছুর বিনিময়ে আফসানার কবি হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠার ইচ্ছেটুকুই শুধু তিনি পূরণ করেছেন। আর কিছুই না। সত্যিইতো, এই জীবনে আফসানার ঋণ তিনি কী দিয়ে শোধ করবেন!

আশফাক হাত বাড়িয়ে আফসানাকে কাছে টানলেন। তারপর তার মাথাটা টেনে নিলেন নিজের কাঁধে। দু হাতে জড়িয়ে ধরে রইলেন দীর্ঘসময়। আফসানা বলল, ‘আমি কেন এত অস্থির হয়ে আছি তুমি বুঝতে পারছো না? আমার খুব ভয় হচ্ছে। সময়টা চলে যাচ্ছে দ্রুত।’

আশফাক অস্ফুট কণ্ঠে বললেন, ‘আমি বুঝতে পারছি।’

তাহলে আমার ওপর বিশ্বাস করো। দেখো আমি কী করি।’

আশফাক চুপ করেই রইলেন। আফসানা আশফাকের হাতটা হাতের মুঠোয় নিয়ে বলল, ‘আমি আমার নিজের জন্য হলেও নাদিয়ার জন্য সবচেয়ে ভালো চেষ্টাটাই করব। তুমি দেখো। এই ভরসাটুকু অন্তত আমার ওপর রাখো। এই এতদিনে তোমার কোনো বিপদেই যে মানুষটা দূরে সরে যায়নি। তারওপর এই বিশ্বাসটুকু অন্তত রাখো।’ আফসানা কাঁদছে। তার কান্নার শব্দ, বুকের কম্পন ছুঁয়ে যাচ্ছে আশফাকের বুক। তিনি শক্ত করে আফসানাকে জড়িয়ে ধরলেন। তারপর বললেন, ‘আচ্ছা, তুমি যা ভালো মনে করো, সেটাই করো। আমার আর কোনো আপত্তি নেই।

রাতের বাকি সময়টুকুতে দুজন ক্লান্ত, বিধ্বস্ত, শঙ্কিত মানুষ যেন পরস্পরকে জড়িয়ে ধরে আশ্রয় খোঁজার চেষ্টা করতে লাগল। সেই আশ্রয় তারা পেল কী না কে জানে! তবে বহুকাল পর অদৃশ্য কোথাও আড়াল হয়ে থাকা সত্যিকারের ভালোবাসার অনুভূতি, নির্ভরতার বোধ তাদের দুজনকে ছুঁয়ে গেল। একটা নতুন আলোর ভোর যেন জেগে উঠল নতুন এক সম্ভাবনা নিয়ে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *