1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ২৮

২৮

সেলিনা এসেছিল চাকরির ইন্টারভিউ দিতে। সেখানে আহসানের সাথে তার পরিচয়। আহসান পড়াশোনা করেছে ইংল্যান্ডে। সে এখন বাংলাদেশে এসে একটা ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম দেয়ার চেষ্টা করছে। ফার্মের নাম আউটবক্স। ছোট একটা অফিসও নিয়েছে আহসান। তার এখন কিছু মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ দরকার। সেলিনা মার্কেটিংয়ের কাজ কিছু জানে না। কিন্তু বাড়িতে বসে থাকতে থাকতে সে বিরক্ত। যেকোনোভাবেই হোক, একটা চাকরির ব্যবস্থা তাকে করতেই হবে। আহসানের সাথে কথা বলেও তার ভালো লেগেছে। আহসান চায় একটা উদ্যমী, প্রাণবন্ত টিম। নতুন হোক তাতে ক্ষতি নেই। কিন্তু স্বপ্নটা থাকতে হবে। আহসান কথাও বলে খুব সুন্দর করে। ছোট্ট অফিস। কিন্তু সাজানো গোছানো। প্রথম তিন মাস প্রায় বিনা বেতনেই চাকরিটা করতে হবে। যাওয়া আসা বাবদ হয়তো কিছু হাত খরচ দেয়া হবে। এরপর প্রতিষ্ঠানের অগ্রগতি এবং এমপ্লয়িদের পারফর্মেন্সের ভিত্তিতে বেতন ঠিক করা হবে। সেলিনা একবার ভেবেছিল চাকরিটা সে করবে না। পরে আবার ভাবল, ক্ষতি কী! সেত এমনিতেই বাড়িতে বসে আছে। নিয়মিত বাইরে বের হলে যোগাযোগের একটা সুযোগও তৈরি হয়। তা ছাড়া আহসানের কথাবার্তা তার ভালো লেগেছে। ভদ্র, মার্জিত, রুচিশীল ছেলে।

সে অফিসে জয়েন করে ফেলল। তবে সপ্তাহখানেক সে বুঝতেই পারল না, তার কাজটা আসলে কী! আহসান অবশ্য বলল, প্রথমে কিছু ক্লায়েন্টের সাথে যোগাযোগের ব্যবস্থা সে করে দেবে। সেলিনাকে গিয়ে তাদের সাথে কথা বলতে হবে। প্রতিষ্ঠানগুলোর যেকোনো ধরনের প্রয়োজনে আউটবক্স তাদের সহায়তা করবে। কোনো প্রোগ্রাম আয়োজন করা, বার্ষিক আনন্দ ভ্রমণ, মেলা, কনফারেন্সসহ যাবতীয় প্রয়োজনে আউটবক্স তাদের পাশে আছে।

সবচেয়ে কম বাজেটে সবচেয়ে দৃষ্টিনন্দনভাবে তারা অনুষ্ঠান আয়োজন করে দেবে। দুটো অফিসে গিয়েওছিল সেলিনা। কিন্তু দু জায়গাতেই তার অভিজ্ঞতা খুবই খারাপ। প্রথম যেখানে গেল, সেখানে অফিসের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা তাকে তিনঘণ্টা বসিয়ে রাখলেন। তিনি কী একটা মিটিংয়ে আছেন। মিটিং শেষে তিনি সেলিনাকে না জানিয়েই অফিস থেকে বের হয়ে গেলেন। বিষয়টা সেলিনা নিতে পারেনি। এমনিতেই এই কাজটি তার কাছে যথেষ্ট অসম্মানজনক মনে হয়েছে। তারপর এই ঘটনা।

পরের ঘটনাটি আরো খারাপ। সেলিনাকে দশ মিনিট সময় দিয়েছিলেন ভদ্রলোক। সেলিনা বুঝতে পারল না সে দশ মিনিটে কী বলবে! হড়বড় করে কী বলেছে, তা সে নিজেই জানে না। ভদ্রলোক তাকে বিদায় দিয়ে আহসানের ফোনে মেসেজ পাঠিয়েছেন। সেই মেসেজে তিনি লিখেছেন, ‘এই গাধা মেয়েকে আপনি কেন পাঠিয়েছেন? আর কোনো মেয়ে নেই আপনার অফিসে!

আহসান সেই মেসেজ দেখেছে দিন কয়েক পরে। ততক্ষণে সে ভুলেই গিয়েছে ভদ্রলোকের কাছে কাকে পাঠিয়েছিল সে। বিষয়টা নিয়ে রীতিমতো বিরক্ত হয়েই ছিল আহসান। সে সেলিনাকে ডেকে বলল, ‘মেট্রো এপারেলসে কে গিয়েছিল, আপনি জানেন? কী একটা বাজে ব্যাপার হয়ে গেল বলুনতো?’

সেলিনা সতর্ক গলায় বলল, ‘কেন? কী হয়েছে?’

‘উনি খুবই বিরক্ত হয়ে মেসেজ পাঠিয়েছেন। খুবই অপমানজনক মেসেজ।’

সেলিনা ভয়ে ভয়ে বলল, ‘কী মেসেজ?’

‘কী মেসেজ সেটা শুনতে হবে না। তবে কে গিয়েছিল একটু আমাকে জানানতো!’

সেলিনা আর কথা বলেনি। তবে সে ঘর থেকে বের হওয়ার সময় আহসানের বিরক্তিমিশ্রিত স্বগতোক্তি শুনতে পাচ্ছিল, ‘কোন গর্দভ যে গিয়েছিল কে জানে!’

সেলিনা এই পুরো বিষয়টাই নিতে পারল না। তার সম্পর্কে কেউ এমন কথা বলতে পারে, তা সে ঘুণাক্ষরেও ভাবতে পারেনি। নিশ্চয়ই আহসানের ফোনে এর চেয়েও বাজে কোনো মেসেজ ভদ্রলোক পাঠিয়েছেন। সেলিনা ডেস্কে ফিরে চেয়ারে হেলান দিয়ে চোখ বন্ধ করে বসে রইলো। রাগে, অপমানে তার মাথা ঝিমঝিম করছে। এর মধ্যে আহসান তাকে বারকয়েক ডাকলও। কিন্তু সেলিনা তা শুনল না। সেলিনাকে খুঁজতে এসে দেখল সে চেয়ারে হেলান দিয়ে ঘুমাচ্ছে। আহসান সেলিনাকে ডাকতে গিয়ে আবিষ্কার করল সেলিনার মুখ ফোলা। চোখ লাল। সে নিশ্চয়ই এতক্ষণ কেঁদেছে। ঘটনা কী?

ঘটনা যতক্ষণে উদ্‌ঘাটিত হলো, ততক্ষণে সেলিনা রেজিগনেশন লেটার জমা দিয়ে দিয়েছে। সে আর এই চাকরি করবে না। এক কোটি টাকা বেতন দিলেও না। আহসান তাকে অনেক বোঝাল, তাতে লাভ বিশেষ হলো না। তবে এই ঘটনায় অন্য একটা ব্যাপার ঘটে গেল। পরদিন দুপুরে আহসান তাকে ফোন করে বলল, ‘আপনি এখনো আসেননি?’

সেলিনা ভারি গলায় বলল, ‘কই আসব?’

‘কই আসব মানে? অফিসে?’

‘কীসের অফিস? আমিতো চাকরি ছেড়ে দিয়েছি।’

‘ছেড়ে দিয়েছি বললেতো হবে না। চাকরি ছেড়ে দেয়ার একটা নিয়ম-কানুন আছে না?’

‘চাকরি ছেড়ে দেয়ার আবার কী নিয়ম-কানুন?’

আহসান হাসল, ‘চাকরি করার নিয়ম থাকলে ছাড়ার নিয়ম থাকবে না?’

‘থাকলে থাকুক। আমি আর যাচ্ছি না।’

‘এভাবে বললেইতো আর হবে না। শুনুন অন্য সব জায়গায় চাকরি পাওয়া কঠিন কিন্তু ছাড়া সহজ। আর আমার এখানে ঘটনা উল্টো। এখানে চাকরি পাওয়া সহজ কিন্তু ছাড়া কঠিন।

‘এসব বলে লাভ নেই। আমি একবার যা না বলি, তা আর দ্বিতীয়বার হ্যাঁ বলি না।

‘একটা কথা বলি শুনুন। প্রচণ্ড রেগে গিয়ে, কষ্ট পেয়ে বা আনন্দিত অবস্থায় কখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেবেন না। এসব সময় যে সিদ্ধান্ত নেয়া হয়, তার বেশির ভাগই হয় ভুল সিদ্ধান্ত।

‘আমি রেগে গিয়ে দিই নি।’

‘কষ্ট পেয়েতো দিয়েছেন?’

সেলিনা কথা বলল না। আহসান বলল, ‘আপনি অফিসে চলে আসুন। আপনার চাকরি করতে হবে না। আমার সামনে বসে থাকবেন। তাহলেই হবে। আপনি না থাকলে অফিস কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগে।

কথাটা খুব সাধারণ। কিন্তু এই সাধারণ কথাটিই অসাধারণ লাগল সেলিনার কাছে। সে সারাদিন আহসানের এই কথাটি ভাবল। প্রায় মাসখানেক সে আউটবক্সে কাজ করেছে। এর মধ্যে আহসানের মধ্যে সে অস্বাভাবিক কিছু দেখেনি। তবে অন্যান্যদের তুলনায় আহসান যে তাকে একটু বেশিই প্রশ্রয় দিত, এটি এখন তার মনে হচ্ছে।

সেলিনা অবশ্য তারপরও অফিসে গেল না। আহসান তাকে পরদিনও ফোন করল। তারপর দিনও। প্রায় প্রতিদিনই ফোন দিতে থাকল সে। সেলিনা সেদিন বলল, ‘আপনি রোজ রোজ আমাকে ফোন দিচ্ছেন কেন?’

‘আশ্চর্য, আপনি অফিসে না এলে আপনার বস আপনাকে ফোন দেবে না?’

‘আপনিতো এখন আর আমার বস নন। আমিতো চাকরি ছেড়েই দিয়েছি।’

‘তাহলে এখন আমি কী?’

‘কিছুই না।’

‘তো কিছুইনা কেউ কি আপনাকে ফোন করতে পারে?’

‘না পারে না।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কী?’

তাহলে আমি আপনাকে ফোন করব কী করে?’

‘আপনার আমাকে ফোন করতে হবে কেন?’

‘তাতো জানি না কেন করতে হবে! তবে করতে যে হবে, এটা জানি।’ আহসানের এই কথায় সেলিনার বুক ধক করে উঠল। সে যা ভাবছে, ঘটনা কি আসলেই তা-ই?

আহসান বলল, ‘যেহেতু আপনাকে আমার নিয়মিত ফোন করতে হবে এবং কিছুই না হলে আপনাকে ফোন করতে পারব না। সেহেতু এখনতো আমাকে কিছু একটা হতেই হবে। কী হওয়া যায় বলুনতো?’

সেলিনা এই প্রশ্নের জবাব দিল না। আসলে এই প্রশ্নের উত্তর তার জানা নেই। তবে!

সেই থেকে আহসানের সাথে তার নিয়মিত কথা হতে থাকল। তারা কেউ যে কাউকে বিশেষ কিছু বলেছে, এমন নয়। কিন্তু দুজনই বুঝতে পারছিল, নামহীন বিশেষ সেই সম্পর্কটার দিকে তার খুব দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে।

আহসানের বাবা-মা নেই। তার এক বোন আছে। সে থাকে চট্টগ্রামে। তার সাথেও খুব একটা যোগাযোগ নেই আহসানের। সে ঢাকায় একা থাকে। অনেকদিন ইংল্যান্ডে থাকার কারণে তার বন্ধু-বান্ধবও তেমন একটা নেই এখানে। এই সংসার বিচ্ছিন্নতার কারণেই কী না কে জানে, বিয়েটাও এখনো করা হয়নি তার। বয়সে সেলিনার চেয়ে বছর দুয়েকের বড়ই হবে আহসান। সেলিনা যে ডিভোর্সড সে কথাও সে জানে। কিন্তু এ নিয়ে তার কোনো মাথাব্যথা নেই। খুব সহজ, খুব সাধারণ কিন্তু অনিবার্য এক যাত্রার মতো তাদের সম্পর্কটা এগিয়ে যেতে থাকল। সেলিনা আবার অফিস করা শুরু করল। তার খিটখিটে মেজাজ অনেকটাই শান্ত হলো। সারাক্ষণ বিচ্ছিন্ন চিন্তায় বিচলিত সেলিনা যেন ক্রমশই কেন্দ্রীভূত হতে থাকল একটি গন্তব্যে।

কিন্তু সমস্যা শুরু হলো মাস তিনেক বাদে। আহসানের পুঁজিপাতি যা ছিল তা ক্রমশই ফুরিয়ে আসতে শুরু করল। অথচ ব্যবসায় তেমন কোনো আয় রোজগার দেখা গেল না। বরং দিন যত যেতে থাকল, ততই পরিস্থিতি আরো খারাপ হতে থাকল। অফিসের খরচ কমাতে দুজন কর্মীকে ছাটাইও করতে হলো তার। বাকিদের বেতন দেয়াটাও অনিশ্চিত হয়ে গেল। এই সময়ে সেলিনা শক্ত করে আহসানের হাত ধরার চেষ্টা করতে লাগল। ততদিনে তারা আপনি থেকে তুমিতে এসে ঠেকেছে। সেলিনা বলল, ‘আমার কাছে কিছু জমানো টাকা আছে, টাকাগুলো আমি তোমাকে দিই?’

আহসান হতাশ গলায় বলল, ‘টাকা দিয়ে আমি কী করব?’

‘তোমার এমপ্লয়িদের বেতন দিবে।’

‘দু মাসের জন্য এমপ্লয়িদের বেতন দিতে পারলেই কী আমার সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে?’

‘না, তা হবে না। তবে আপাতত একটা সমাধানতো হবে!’

আপাতত সমাধান কোনো সমাধান না সেলিনা। আপাতত সমাধান মানে সমস্যাকে আরো শক্তিশালী হয়ে ফিরে আসার সুযোগ দেয়া।’

‘তাহলে এখন তুমি কী করবে?’

‘আমি চেষ্টা চালিয়ে যাব। জীবনে কখনো হাল ছাড়িনি আমি। এবারও ছাড়ব না।

‘তার মানে তুমি আমার থেকে টাকাটা নেবে না?

‘না নেব না।’

‘কেন নেবে না?’

‘কারণ আমার কারো ওপর নির্ভরশীল হতে ভালো লাগে না।’

‘এটাকে নির্ভরশীলতা কেন বলছো? আমরা একজন আরেকজনের বিপদে হেল্প করব না?’

আহসান দীর্ঘশ্বাস ফেলে বলল, ‘কেন করব না? অবশ্যই করব। কিন্তু সেই হেল্পের কারণে যেন সমস্যার সমাধান হয়। এমন কিছু করতে হবে। অনর্থক টাকা নষ্ট করেতো লাভ নেই।’

‘তোমার এই সমস্যার পারমানেন্ট সমাধান কী?’

সমাধান একটাই আমার বড়োসড়ো কিছু কাজ পেতে হবে। যেই কাজ থেকে আমি প্রফিট করতে পারব। তুমি বরং দেখো তোমার পরিচিত কারো কোনো বড় অফিস আছে কী না? যেখানে নানা ইভেন্ট হয়। প্রোগ্রাম হয়। প্রিন্টিং-এর কাজ হয়। হয় না এমন? সেসব জায়গায় বলে যদি কিছু কাজ পাইয়ে দেয়া যায়, তাহলে খুব উপকার হয়। আমি দীর্ঘদিন ঢাকায় না থাকার কারণে আমার চেনাজানা লোকের সংখ্যা খুব কম। নেটওয়ার্ক দুর্বল। এখন এই নেটওয়ার্ক তৈরি করাটাই আমার জন্য সবচেয়ে জরুরি।’

পরের ক’টা দিন সেলিনার খুবই মন খারাপ গেল। মছিদা বেগম বললেন, কী হয়েছে তোর?’

‘আমার অফিসে একটা ঝামেলা যাচ্ছে মা।’

‘তোর যে ছাতার অফিস! বেতন দেয়না, কাজ-কর্ম নাই, ওতে আবার ঝামেলার কী আছে। ঝাটা মেরে চলে আয়।’

‘ছিহ মা। এটা কী ধরনের কথা!

‘কেন? ঠিক কথাইতো বলেছি। যে লোক অফিস দিয়েছে তার এইটুক আন্দাজ থাকবে না যে কেবল অফিস দিলেই হবে না, অফিসে কাজও থাকতে হবে। আর্নিং থাকতে হবে তাই না?’

‘সে তো চেষ্টা করছে মা। চেষ্টা যে করছে না তাতো না।’

‘চেষ্টা করলে কিছু হচ্ছে না কেন?’

‘সাথে সাথেই কি হয় মা? সবার একটু সাহায্য-সহযোগিতা দরকার। মানুষটা অনেক দিন দেশের বাইরে ছিল। পড়াশোনা করছে বিদেশে। সেসব ছেড়ে কেবল দেশের টানে চলে এসেছে দেশে কিছু একটা করবে বলে। কিন্তু এসে দেখে এই দেশে মামা-খালু ছাড়া কিছু হয় না। নিজের চেষ্টায়, যোগ্যতায় কিছু হয় না।’

সেলিনার কথার ধরন দেখে মছিদা বেগম সতর্ক হয়ে গেলেন। এতদিন সেলিনাকে তিনি ভালোভাবে লক্ষ করেননি। ভেবেছিলেন, সে যেহেতু এখন চাকরি-বাকরি কিছু একটা পেয়েছে, তাহলে আপাতত বেশ কিছুদিন তাকে নিয়ে চিন্তার কিছু নেই। কিন্তু আজ তার কথা শুনে মনে হচ্ছে ওই চাকরিই তার জন্য নতুন সমস্যা। জীবনের পদে পদে যে সমস্যা পাকাতে সিদ্ধহস্ত, তার জন্য চাকরির ক্ষেত্রও যে নতুন সমস্যা নিয়ে আসতে পারে, এ আর নতুন কী!

তিনি সরু চোখে সেলিনার দিকে তাকালেন, ‘কোন মানুষটার কথা বলছিস?’

‘আহসান।

‘আহসান কে?’

‘আমার অফিসের বস।’

‘তা বসকে কি তুই নাম ধরে ডাকিস?’

মছিদা বেগমের এমন প্রশ্নে সেলিনা অকস্মাৎ হকচকিয়ে গেল। সে বলল, ‘না মানে নাম ধরে ডাকবো কেন? সেতো আর এই মুহূর্তে সামনে নেই, তাই না? এইজন্য বললাম।’

‘হুম।’ মছিদা বেগম গম্ভীর হলেন। ‘সে এখন উনির বদলে সে হয়ে গেছে? শোনো, যাই কোরো ভেবে বুঝে করবা। আমার আর এখন সময় নেই তোমাদের বোঝানোর। আর তোমাদেরও আর সময় নেই ভুল করার। খুব সাবধান।’

সেলিনা সাথে সাথেই কোনো জবাব দিল না। তবে সে পরদিন জাফরের কাছে গেল। জাফর তখন খুব মনোযোগ দিয়ে কাজ করছিল। সেলিনাকে দেখেই সে বলল, ‘যা বলার দ্রুত বলবি। অফিসের বড় একটা কাজ নিয়ে ঝামেলায় আছি। টানা তিন দিন তিন রাত ঘুমাই না।’

‘তাহলে পরে বলি ভাইয়া?’

‘না, পরে বলবি কেন? এক্ষুনি বল। দশ মিনিটের মধ্যে কথা শেষ করবি।’

সেলিনার অবশ্য দশ মিনিটও লাগল না। তার অফিসের জন্য যে তার কাজ দরকার সেটি সে সংক্ষেপে জাফরকে বুঝিয়ে বলল। জাফর সেলিনার কথা কতটা মনোযোগ দিয়ে শুনল, তা বোঝা গেল না। তবে সেলিনা কথা শেষ করতেই সে বলল, ‘আচ্ছা ঠিক আছে। আমি দেখব।’

সেলিনা আরো কিছু বলবে ভাবছিল। কিন্তু সেই সুযোগ আর সে পেল না। তার আগেই জাফর আবারো তার কাজে ডুবে গেল। তারপরের কয়েকটা দিন দ্বিধাদ্বন্ধে কাটতে লাগল সেলিনার। সে একটা জিনিস খেয়াল করেছে, আগে জাফরকে সে মোটেই ভয় পেত না। এমনকি তেমন একটা গুরুত্বও দিতো না। প্রয়োজন না হলে কথা বলত না। কিন্তু ডিভোর্সের পর এ বাড়িতে আসার পর থেকে সে জাফরের মুখোমুখি হতে ভয় পায়। কথা বলতে অস্বস্তি বোধ করে। এর কারণ কী? এর কারণ কী এই যে সে অবচেতনেই ভাবে পুরোপুরি জাফরের ওপর নির্ভরশীল? অর্থনৈতিক বা অন্য কোনো ভাবে? নাকি তার ভেতরে ক্রমশই প্রবল এক ধরনের হীনমন্যতা তৈরি হয়েছে!

পরের মাসে আহসানের সমস্যা আরো ঘনীভূত হলো। তার অফিস ভাড়া বাকি পড়েছে তিন মাসের। ইলেক্ট্রিসিটির বিল, পানির বিল, স্টেশনারি খরচও বাকি পড়েছে। অফিস ভবনের মালিক এসে খুব হৈচৈ করে গেল। বলে গেল, আহসানকে অবশ্যই এ মাসের মধ্যে অফিস ছেড়ে দিতে হবে। তবে ছেড়ে দেয়ার আগে সে অফিসের কোনো আসবাবপত্র সরাতে পারবে না। বকেয়া অফিস ভাড়া যদি সে দিতে না পারে, তা হলে অবশ্যই তাকে তার আসবাবপত্র রেখে আসতে হবে। বাড়িওয়ালা সেগুলো বিক্রি করে যতটা সম্ভব ভাড়া উশুল করবে। বিষয়টা চূড়ান্ত অপমানজনক। সেলিনা বলল, ‘এখন কী করবে?’

আহসান বলল, ‘আরেকটু দেখব।’

‘আরেকটু কী করে দেখবে? তোমাকেতো অফিস ছেড়ে দিতে হবে। তোমার এমপ্লয়িরাওতো তোমার ওপর খেপে আছে। তুমি ক মাস ধরে তাদের বেতন দিতে পারছো না?’

‘তুমি চিন্তা করো না। এর মধ্যে একটা কিছু হয়ে যাবে, দেখো।’

সেলিনা অবশ্য আহসানের কথায় খুব একটা ভরসা পেল না। ছেলেটার জন্য তার মায়াই লাগছে। একটা সৎ, পরিশ্রমী ভালো ছেলে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে এ দেশে ভালো ছেলেদের কোনো মূল্য নেই। মামা, চাচা, খালু না থাকলে এ দেশে কিছু করার নেই। আহসানের এসব কিছু নেই। তার থাকার মধ্যে আছে এক সেলিনা। কিন্তু সেও তার জন্য কিছু করতে পারছে না। এই দুঃখে সেলিনা ভেতরে ভেতরে সংকুচিত হয়ে যাচ্ছে। সে কায়মনোবাক্যে চায় আহসানের জন্য কিছু করতে। কিন্তু উপায় খুঁজে পাচ্ছে না। অথচ তার চোখের সামনে একজন উচ্ছ্বল, ঝলমলে, উদ্যমী তরুণ ক্রমশই নিষ্প্রভ হয়ে যাচ্ছে।

তার ভাবনায় অবশ্য একটা পরিকল্পনা মাঝে মাঝেই আসে। কিন্তু সেই পরিকল্পনা কারো কাছে বলার সাহস তার নেই। এই পরিস্থিতিতে অবশ্য সেটি ছাড়া বিকল্প আর কোনো পথও তার জানা নেই। তবে তার আগে শেষ চেষ্টাটা সে করে দেখতে চায়। মুনিয়ার সাথে একবার কথা বলে দেখা যেতে পারে।

সেই রাতেই সে মুনিয়ার কাছে গেল। গিয়ে দেখে মুনিয়া তার লাগেজ গোছাচ্ছে। সেলিনা অবাক গলায় বলল, ‘কোথাও যাচ্ছো নাকি ভাবি?’

মুনিয়া বলল, ‘হুম।’

‘কোথায়?’

‘বাড়িতে।’

‘বাড়িতে মানে কোন বাড়ি?’

‘আমাদের বাড়ি।’

‘কেন ভাবি?’ সেলিনা অবাক হলো। মুনিয়াকে সহসা সে তার বাবার বাড়ি যেতে দেখেনি। ‘বাড়িতে কিছু হয়েছে? তোমার মা ভালো আছেন?

‘হ্যাঁ ভালো।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কী? কিছু না হলে মায়ের বাড়ি যাওয়া যাবে না?’

‘না, তা না। তুমিতো সহজে যাও না। এইজন্য হঠাৎ…।‘

সেলিনা কথা শেষ করতে পারল না। তার আগেই ঘরে ঢুকল ঋদ্ধি। সে মুনিয়ার লাগেজ গোছানো দেখে কিছুক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে রইলো। গত কিছুদিন থেকেই বাবার সাথে মায়ের ভীষণ ঝামেলা চলছে। তার মা কিছু কিছু কথা তাকে বলেছেও। জাফর নাকি তাকে খুব অপমানজনক কথা বলেছে। কথাগুলো মুনিয়া হজম করতে পারছে না। তার মনে হয়েছে জাফর তাকে সরাসরি খোঁটা দিয়েছে। এবং সেটাও খুবই জঘন্য উপায়ে। সে টাকা-পয়সা সংক্রান্ত বিষয়ে মুনিয়াকে আঘাত করেছে। মুনিয়া বিষয়টা মাথা থেকে তাড়িয়ে দিতে চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। সে প্রখর আত্মসম্মান বোধসম্পন্ন একজন মানুষ। বিষয়টা তার আঁতে ঘা দিয়েছে। মনে মনে তাৎক্ষণিক একটা প্রতিজ্ঞাও করে ফেলেছে সে। যে করেই হোক জাফরের টাকাটা সে ফেরত দেবেই। আর তারপর সে সিদ্ধান্ত নেবে, এ বাড়িতে আর ফিরবে নাকি ফিরবে না! ঋদ্ধি এ কদিনে নানাভাবে মাকে বোঝানোর চেষ্টা করেছে। সে ভেবেছিল মুনিয়াও সেসব বুঝেওছে। কিন্তু মুনিয়া যে সত্যি সত্যিই বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে পারে, এতটা সে ভাবেনি। এখন সেলিনার সামনে বসে এ বিষয়ে কোনো কথা বলা সমীচীন হবে কি না তাও বুঝতে পারছে না সে। কারণ ঋদ্ধি জানে, কিছু কিছু ব্যাপার আছে যেগুলো সেলিনা কিংবা মছিদা বেগমের সামনে বসে আলাপ করতে চায়না মুনিয়া। তারপরও সে বলল, ‘মা, এতরাতে এগুলো কী?’

মুনিয়া ঋদ্ধির কথার জবাব দিল না। সে এক মনে কাপড়-চোপড় গোছাতেই থাকল। সেলিনা ঋদ্ধিকে লক্ষ্য করে বলল, ‘এই ঋদ্ধি কী হয়েছে রে?’

‘কী হবে?’

‘কিছু একটাতো হয়েছেই। ঘটনা কী খুলে বলতো।’

‘ঘটনা কিছু না, নানুর একটু শরীর খারাপ, এইজন্য মা নানুবাড়ি যাচ্ছে। কিন্তু আমি বলছিলাম দুটো দিন পরে যেতে। আমার একটা পরীক্ষা চলছে।’

‘ওহ। আমি ভাবলাম কী না কী! তোর বাবা কই? সে যাবে না?’

‘বাবা তো ঢাকায় নেই। ফিরবে কাল পরশু।’

‘ওহ।’ সেলিনা কিছুটা এগিয়ে মুনিয়ার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। তারপর নরম কণ্ঠে বলল, ‘মন খারাপ করো না ভাবি। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মুনিয়া জবাব দিল না। সেলিনা এবার আলতো করে মুনিয়ার কাঁধে হাত রেখে বলল, ‘তুমি চাইলে আমিও তোমার সাথে যেতে পারি ভাবি।’

মুনিয়া বলল, ‘আমি মায়ের অসুস্থতার কারণে যাচ্ছি না শেলী। আমি যাচ্ছি অন্য কারণে।’

‘অন্য কী কারণ ভাবি?’

‘অন্য কী কারণ তা এই মুহূর্তে আমি তোমাকে বলতে চাচ্ছি না। চাইলে প্রথমেই বলতাম।’

সেলিনা মুহূর্তে থমকে গেল। এমন কাঠখোট্টা কন্ঠে মুনিয়া তার সাথে কথা বলবে এটা সে ভাবেনি। সে দমে যাওয়া কণ্ঠে বলল, ‘সরি ভাবি। আমি বুঝিনি।’

মুনিয়া গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোমার বোঝার কথাও না।’

ঋদ্ধি বলল, ‘তুমি কি এক্ষুনি চলে যাচ্ছো মা?

‘নাহ। ভোর হলে যাব।’

সেলিনা কী করবে ভেবে পাচ্ছে না। হঠাৎ মুনিয়ার কী হয়েছে তাও বুঝতে পারছে না। সে ঘরে ফিরে ঘটনাটা মছিদা বেগমকে জানাল। মছিদা বেগম বললেন, ‘জাফরের সাথে কোনো সমস্যা হয় নাই তো?’

‘ভাইয়ার সাথে কী হবে? সেতো মাটির মানুষ। তার ওপর দিয়ে ভূমিকম্প হয়ে গেলেও টু শব্দটি করবে না।’

‘আমার ধারণা জাফরের সাথেই কিছু হয়েছে।’

‘কী হবে?’

মছিদা বেগম খানিক চুপ করে থেকে বললেন, ‘কে জানে! ওই যে এক ছেলের কথা বলছিলি তুই, ওই সমস্যা নাতো?’

সেলিনা সাথে সাথে জবাব দিল না। তারপর হঠাৎ বলল, ‘আমিতো ঘটনাটা নিশ্চিত না মা। ছেলেটাতো বয়সে অনেক ছোট। আমার চেয়েও ছোট। দিপুর সাথে পড়ে মনে হয়। আজকালকার ছেলেপুলেদের দিয়ে অবশ্য বিশ্বাস নাই। আমি কয়েকদিন রাতে হঠাৎ হঠাৎ দেখেছি যে সে রাস্তার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকে। এখন সেটা কার জন্য থাকে, কে জানে!’

মছিদা বেগম বললেন, ‘সেইদিনতো বললি অন্য কথা।

সেলিনা হাসল, ‘মাথা যখন গরম থাকে, তখন বিষয় একভাবে দেখবা। আবার মাথা যখন ঠাণ্ডা থাকবে, তখন সেই ঘটনাই দেখা যায় অন্যভাবে। বুঝলা?’

হুম। কিন্তু ওই ছেলেতো বসে থাকে, এটাতো সত্য?’

‘এখন থাকে না। আগে থাকত। কে জানে? ঋদ্ধিও তো বড় হচ্ছে। বলাতো যায় না, কার মনে কখন কী দোলা দেয়!

মছিদা বেগম জবাব দিলেন না। তিনি জাফরকে ফোন দিলেন। কিন্তু জাফর ফোন ধরল না। পরদিন ভোরে কাউকে কিছু না বলেই মুনিয়া বাড়ি ছাড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *