1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৩৬

৩৬

মুনিয়াকে চমকে দিয়ে পরদিন সন্ধ্যায় বাড়িতে এসে হাজির হলো জাফর। সে সরাসরি অফিস থেকে এসেছে। সাদা শার্টের হাতা গোটানো ঘর্মাক্ত ক্লান্ত জাফরকে দেখে বহুকাল পর কেমন অদ্ভুত এক অনুভূতি হলো মুনিয়ার। জাফর নির্বিকার ভঙ্গিতে বলল, ‘তাড়াতাড়ি রেডি হয়ে নাও।’

‘রেডি হয়ে নাও মানে?’

‘রেডি হয়ে নাও মানে বাড়ি যেতে হবে। আজ আমার গাড়িও ছেড়ে দিতে হবে। ড্রাইভার ছুটিতে যাবে। বেশিক্ষণ দেরি করা যাবে না।’

মুনিয়া জাফরের ভাবভঙ্গি কিছু বুঝছে না। তার আচরণে ভারি অবাক লাগছে। সে বলল, ‘তুমি এভাবে বললেই আমি তোমার সাথে চলে যাব, এটা কীভাবে ভাবলে?’

‘তাহলে কীভাবে বললে যাবে?’

‘কোনোভাবে বললেই যাব না।’

‘তাড়াতাড়ি করো প্লিজ। ড্রাইভার বসে আছে। ওকে ছেড়ে দিতে হবে। আর আমার শরীরটাও ভালো লাগছে না। চলো চলো।’

জাফরের গলার স্বর যেন নিশ্চিন্ত। যেন সে জানে, মুনিয়া তাকে উপেক্ষা করতে পারবে না। জাফরের এই ভঙ্গিটা কি মুনিয়ার ভালো লাগছে? এই আত্মবিশ্বাসী, এই কর্তৃত্বপরায়ণ ভঙ্গি? যেন মুনিয়ার ওপর কী প্রবল অধিকার তার। মুনিয়া না চাইতেও বিষয়টা একটু বেশিই ভালো লাগছে তার। মনে মনে খানিক অবাকও হলো সে। শেষ কবে জাফরকে দেখে এমন অনুভূতি হয়েছিল জানেনা মুনিয়া।

নিজেকে হঠাৎ খুব স্বার্থপর আর দ্বিচারী মনে হতে লাগল তার। হয়তো শেষ কদিনে রাফির কথাগুলো তাকে সমূলে নাড়িয়ে দিয়েছে। হয়তো ওই সম্পর্কটাতে নিজের অস্তিত্ব সংকটের শুরুটাও টের পেতে শুরু করেছে সে। আর এসব কারণেই কি অবচেতনেই ঘরে ফিরতে চাইছে সে? দিনশেষে ক্লান্ত, বিধ্বস্ত প্রতিটি মানুষ যেমন ঘরে ফেরে? তবে কি জাফরই তার ঘর? তাহলে রাফি কী?

এতকাল পরও জীবন যে এমন অনির্বচনীয় উপলব্ধি নিয়ে এভাবে সামনে এসে দাঁড়াবে কে জানত! মুনিয়া ভাবেনি জাফর তাকে নিতে আসতে পারে। বা আসলেও সেটি তার কাছে আলাদা কোনো অর্থ বহন করবে বলে সে ভাবেনি। কিন্তু জাফরের এই আসাটুকু অদ্ভুত এক ভালোলাগা হয়ে তার বুকের বাঁ পাশে লেপ্টে রইলো। আচ্ছা, এই অনুভূতিটুকুও কি শারীরিক? এখানে শরীর কোথায়? এটা মোটেও শরীরী অনুভব নয়। কিন্তু রাফির কথাগুলোও মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না সে, পুরোপুরি অস্বীকারও করতে পারছে না। তবে নানা ঘটনা, নানান সম্পর্ক, সম্পর্কের অলিগলিগুলো যেন মুহুর্মুহু তাকে ভাবাতে লাগল। জাফর কি এই এতদিন তার অনুপস্থিতি একটুও অনুভব করেছে?

মুনিয়া রাতেই বাড়ি ফিরল। কিন্তু বাড়ি ফিরে খানিক আগের সেই ভালোলাগার অনুভূতির অনেকটাই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। জাফর তাকে আনতে গিয়েছিল ভালোবেসে কিংবা তার অনুপস্থিতি অনুভব করে নয়। সে তাকে আনতে গিয়েছিল অন্য কারণে। বাড়িতে তখন তুমুল কুরুক্ষেত্র। অথচ সে কীনা জাফরকে দেখেই কত কিছু ভাবল, কত কী অনুভব করল। এত বোকা কেন সে! এমনতো নয় যে সে জানেনা, এ বাড়িতে কারো প্রিয়জন নয়, কেবলই প্রয়োজন সে। তাহলে জাফরকে দেখেই অমন বেহায়ার মতো কেন চলে এলো? ভেতরে ভেতরে জাফরের ভালোবাসার জন্যও এতটাই কাঙাল হয়েছিল সে! এই ভাবনাগুলো মুনিয়াকে স্বস্তি দিচ্ছিল না। তবে সেগুলো গুছিয়ে ভাবার সময়ও পেল না।

বাড়িতে মোটামুটি যুদ্ধাবস্থা। গতকাল সন্ধ্যায় রুবেল এসে হাজির হয়েছে। তার সাথে লাল শাড়ি পরা এক মেয়ে। সেই মেয়ে এসে লাজুক ভঙ্গিতে আফজাল আহমেদের পা ছুঁয়ে সালাম করল। একদম টিভি সিনেমার দৃশ্যের মতো রুবেলও মিনমিন করে বলল, ‘তোমাদের বউমা বাবা। ‘

‘আমাদের বউমা মানে?’

‘হুট করেই বিয়েটা করে ফেললাম। কাউকে কিছু জানাতে পারিনি।’

আফজাল আহমেদ একবার ভেবেছিলেন একটু রাগ-টাগ করবেন কিন্তু মছিদা বেগম তাকে চোখের ইশারায় জানালেন, রুবেল যে বিয়ে করেছে এতেই তিনি খুশি। এই নিয়ে রাগ বা ক্ষোভের কিছু নেই। বাড়িতে ছোটখাটো একটা হুলুস্থুল লেগে গেলেও এই বিয়ে নিয়ে সবচেয়ে বেশি প্রতিক্রিয়া দেখাল সেলিনা। সে তার মাকে আড়ালে টেনে নিয়ে গিয়ে বলল, ‘বিয়ে যে করছে, রাতে থাকবে কই?’

‘রাতে থাকবে কই মানে? তোর ঘরে থাকবে।’

‘আমার ঘরে কেন থাকবে? আর আমার ঘরে থাকলে আমি থাকব কই?’

‘তুই দিপুর ঘরে থাকবি।’

‘তাহলে দিপু কই থাকবে?’

‘দুয়েক রাত ড্রইংরুমে শোবে। তারপর ওরা চলে গেলে তখন আবার যার যার ঘরে সে সে থাকবি। যা এখন দিপুকে বল কিছু ফুল-টুল এনে তোর ঘরটা সাজাতে।’

‘মা!’ প্রায় চিৎকার করে উঠল সেলিনা। ‘এরা যে দুয়েকদিন থাকবে তোমাকে বলেছে?’

‘বলতে হবে কেন? রুবেল কি আর ঘরে থাকার ছেলে?’

বিয়ে করলে প্রথম প্রথম সব ছেলেই ঘরের ছেলে হয়ে যায় মা।’

‘হলে হবে, সমস্যা কী? তুই তো দিপুর ঘরেই থাকছিস।’

‘ওই অতটুকু ঘরে আমি থাকতে পারব না মা। আর ওই ঘর কি মানুষের বসবাসযোগ্য আছে? ওটাতো আস্ত এক গোয়ালঘর।’

‘কটা দিন একটু কষ্ট কর। দেখবি, তারপর সব ঠিক হয়ে যাবে।’

‘আমি পারব না মা। আর তারপর যদি দেখো, এরা পার্মানেন্টলি এখানে থেকে যাচ্ছে, তখন কী করবে?’

‘শুধু শুধু ঝামেলা করছিস। যদি থাকেও বউ থাকবে। রুবেলতো আর থাকবে না। ওর বাইরে বাইরে কাজ। তুই তখন বউর সাথে থাকলি!’

মছিদা বেগমের কথা শুনে সেলিনা হাঁ হয়ে রইলো। তার বিশ্বাস হচ্ছে না তার মা তাকে এমন কথা বলতে পারে। সে বলল, ‘তোমার মাথা ঠিক আছে মা?’

‘আমার মাথা ঠিকই আছে, তোদের মাথা ঠিক নেই। আমি যখন প্রথম তোর বাবার বাড়িতে আসি তখন তাদের দুই রুমের বাসা। সেই বাসায় লোক থাকে ছয় জন…।’

‘এইসব পুরনো কাসুন্দি আমাকে শোনাবে না মা। আমি আমার রুম কাউকে দেব না। মরে গেলেও না। আমি এক্ষুনি গিয়ে ঘরের দরজা বন্ধ করে ঘুমিয়ে পড়ছি।

সেলিনা গেলও। তবে সেই রাতের জন্য অনেক অনুনয় বিনয় করে তাকে রাজি করানো গেল। কিন্তু পরের সারাটাদিন এই নিয়ে মছিদা বেগমের সাথে সেলিনার তুমুল বাগবিতন্ডা হয়ে গেল।

বিকেলে রুবেল বলল, ‘মা, তুলিদের বাড়ি থেকেতো দুয়েকজন মেহমান আসতে চাইছে। তারা কোথায় তাদের মেয়ে বিয়ে দিয়েছে, সেটা তারা দেখতে শুনতে চায়। এমনিতেইতো জামাই বুড়া। তারপর বংশ-পরিচয় কিছু না জেনেই মেয়ে দিয়ে দিয়েছে। এখন যদি দেখে জামাই ঠেলাওয়ালা, তাহলেতো বিপদ। হা হা হা।’

রুবেলকে কখনো এভাবে হাসতে দেখেননি মছিদা বেগম। তিনি ভ্রু কুঁচকে বললেন, ‘কবে আসবে?’

‘আগামী সপ্তাহে।’

‘ওহ। তুই তাইলে একদিন আগেই চলে আসবি। বাজার সদায়তো করতে হবে।’

‘কোত্থেকে চলে আসব?’

‘কাজে থেকে। কাজে যাবি না তুই?’

‘না মা। তুলি আমাকে স্পষ্ট বলে দিয়েছে, আগামী একমাস নো কাজ কর্ম। ও ঘর সাজাবে। তোমাদের ঘরও সাজাবে। ড্রইংরুমের জন্য কী কী কিনবে, তার লিস্টও করেছে। আমরা আপাতত কয়েকদিন ঘুরে ঘুরে বাজার করব।’

মছিদা বেগমের এতক্ষণে মনে পড়ল বউয়ের নাম তুলি। তিনি আর কিছু বললেন না। দুদিনেই ছেলের পরিবর্তন দেখে তিনি মোটামুটি হতভম্ব। তারপরও রুবেল যে শেষ পর্যন্ত বিয়েটা করেছে, এটা ভেবেই তিনি খুশি। তিনি মেয়ের বিষয়ে টুকটাক কথাও বলেছেন। রুবেলের সাথে তুলির পরিচয় পুরনো ফার্নিচার কিনতে গিয়ে। তুলিরা থাকত উত্তরা। সেখান থেকে তারা চলে যাচ্ছে নারায়ণগঞ্জ। যাওয়ার আগে বাসার পুরনো ফার্নিচারগুলো তারা বিক্রি করে দিতে চায়। সেই ফার্নিচার দেখতে গিয়েই তুলির সাথে রুবেলের পরিচয়। প্রেমের বিষয়টা অবশ্য কীভাবে কী হয়ে গেল, রুবেল তা জানে না। তবে তুলি মেয়ে ভালো। সে ডিগ্রী পড়ে। দেখতেও মোটামুটি ভালো। তার বাবা থাকে সৌদি আরব। ভাই-বোনদের মধ্যে সেই বড়। তার ছোট দুই ভাই রয়েছে। সেই দুই ভাইয়ের অত্যাচারে সবাই অতিষ্ট। বড় বোনের বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তারা খুবই একা বোধ করছে। দুই ভাই একসাথে বায়না ধরেছে, তাদের দুজনকে বোনের বাড়িতে রেখে আসতে হবে। তারা বড় বোনের বাসায় থেকেই পড়াশোনা করবে।

দিন গড়ানোর সাথে সাথেই বাড়ির পরিস্থিতি উত্তপ্ত হয়ে উঠছিল। সেলিনা বারকয়েক রান্নাঘরে এসে মায়ের সাথে চোটপাট করে গেল। মছিদা বেগম কিছু বললেন না। বলার অবশ্য কিছু নেইও তার। যে সমস্যা শুরু হয়েছে, তার সমাধান তিনি জানেন না। এই বাড়িতে এই সমস্যার একমাত্র সমাধান যে করতে পারতো সেও বাড়িতে নেই। সুতরাং চুপ করে থাকা ছাড়া আর উপায় কী? দুপুর নাগাদ সেলিনা মোটামুটি অনশন করে বসল। শুধু যে অনশনই করে বসল, তাই নয়। সে রান্নাঘরে ঢুকে মুরগির মাংসের হাড়ির ভেতর পানি ঢেলে দিল। মছিদা বেগম হায় হায় করে তেড়ে এলেও কোনো লাভ হলো না।

সেলিনা কঠিন চোখে তাকিয়ে বলল, ‘এখনতো কেবল মুরগির হাড়িতে পানি ঢেলেছি। এরপর ঢালবো পোলাও কোর্মার হাড়িতে। এক বয়াম লবণ সব ঢেলে রেখে দেব। দেখব আমাকে ঘর থেকে বের করে এ বাড়িতে কে শান্তিতে থাকে।’

মছিদা বেগম খানিক শক্ত হলেন, ‘তোর বয়স হয়েছে না শেলী? বয়স হলে মানুষের বিচার বুদ্ধি বাড়ে, আর তোর বিচার বুদ্ধি দেখি দিনদিন কমছে। ঘটনা কী?’

‘ঘটনা হচ্ছে আমি মেয়ে খারাপ। তুমি খারাপ মেয়ে পেটে ধরেছো, এইতো বলবে? বলো, তাতে আমার কিছু যায় আসে না।’

‘যায় আসে না মানে? এই বাড়িতে নতুন একটা বউ এসেছে, তোর আপন ভাইয়ের বউ। তার প্রতি তোর কোনো দায় দায়িত্ব নেই?’

‘এই বাড়িতে আমিও একটা মেয়ে এসেছি। ডিভোর্সড হয়ে এসেছি। রুবেলের আপন মায়ের পেটের বোন। সেই বোনের প্রতি তার কোনো দায় দায়িত্ব নেই? সে সেই দায় দায়িত্ব কিছু পালন করেছে? জীবনে কোনোদিন আমাকে একটা ফোন করেছে? জিজ্ঞেস করেছে, আমি কেমন আছি, কী অবস্থায় আছি?’

‘সবাই কি একরকম হয়? ও ছোটবেলা থেকেই একটু আলাভোলা। সাংসারিক জ্ঞানবুদ্ধি একটু কম তার। এতকিছু সে বোঝে না।’

‘আহালে, আমাল দুই দিনেল বাচ্চা।’ সেলিনা ব্যাঙ্গাত্মক ভঙ্গিতে বলল। ‘সে কিছুই বোঝে না, আর বিয়ে করার এক দিনের মাথায় সব বুঝে গেল! বউয়ের প্রতি কী দায়িত্ব, বউয়ের সংসারের প্রতি কী দায়িত্ব, সব?’

সেলিনার সাথে বেশিক্ষণ কথা চালানো সম্ভব না। মছিদা বেগমের নিজেরও এখন ভয় হচ্ছে। এই ভর দুপুরেই সে এই অবস্থা করছে। রাত হলে না জানি নতুন বউয়ের সামনে কী অঘটন ঘটিয়ে ফেলে। তিনি ফোন করলেন জাফরকে, ‘জাফর, যে করেই হোক মেজো বউকে সাথে নিয়ে আজ বাড়ি ফিরবি।’

জাফর রাজ্যের কাজে ডুবে ছিল। সে বলল, ‘মেজো বউ কে?’

মছিদা বেগম হতাশ গলায় বললেন, ‘মুনিয়া। মুনিয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরবি।’

‘কেন?’

‘কেন টেন আমি বলতে পারব না। আমার কলিজাটা কালা করে দিছিস তোরা সবাই মিলে। যেমন বাপ, তেমন তার ছেলে- মেয়ে। ইচ্ছে হয়, যেদিকে দু চোখ যায়, চলে যাই। কিন্তু তাতো আর পারি না। তাই দুনিয়াতেই হাবিয়া দোজখের যন্ত্রণা ভোগ করে যাচ্ছি।’

‘কী হয়েছে? তুমি অকারণে চ্যাঁচাচ্ছো কেন?’

‘আমি চ্যাঁচাচ্ছি না? অকারণে চ্যাঁচাচ্ছি? হ্যাঁ, আমার কথাতো এখন সবার কাছে চ্যাচানোই মনে হবে। কোন কুক্ষণে যে আমি এই বাড়িতে…।’ মছিদা বেগম কান্না শুরু করলেন। জাফর কাজ রেখে শান্ত হয়ে মায়ের কথা শুনল। এবং বুঝতে পারল যে বাড়ির অবস্থা আসলেই ভয়ানক। মুনিয়া ছাড়া এই পরিস্থিতি সামলানোর কোনো উপায় নেই। তবে মছিদা বেগমের ভাগ্য ভালো, তুলির বাড়ি থেকে আসা মেহমান বেশি রাত হওয়ার আগেই চলে গেল। মছিদা বেগম ভেবেছিলেন, তারা বুঝি মেয়েজামাই সঙ্গে করে নিয়ে যাবে। এই আশা দিয়েই তিনি সেলিনাকে নিরস্ত করে রেখেছিলেন। কিন্তু অনেক বুঝিয়েও তুলির বাবা-মা তুলিকে সাথে নিয়ে যেতে পারল না। তুলি তাদের বলল, ‘মা, এখন থেকে এটাইতো আমার আসল বাড়ি। আর এ বাড়ির সবাই আমাকে খুব স্নেহ করেন। কয়েকটা দিন থেকে, বাসা বাড়ি গোছগাছ করে, তারপর আসব।’

তখন থেকে মছিদা বেগমের বুক ধড়ফড় করছে। আফজাল আহমেদের কাছ থেকে নিয়ে দু দফা তিনি প্রেসারের ওষুধ খেয়েছেন। কিন্তু তাতেও তার প্রেসার কমছে না। সেলিনার ভাব-ভঙ্গি সুবিধার মনে হচ্ছে না। সে যেকোনো সময় যে কোনো অঘটন ঘটিয়ে ফেলতে পারে।

জাফর মুনিয়াকে নিয়ে বাড়ি ফিরল রাত দশটায়। অদ্ভুত ব্যাপার হলো গেটের কাছে তখন মছিদা বেগম দাঁড়িয়ে। মছিদা বেগমের সাথে দাঁড়িয়ে আছে ঋদ্ধিও। দৃশ্যটা দেখে মুনিয়ার কেন যেন কান্না পেয়ে গেল। সেদিন খুব ভোরে কাউকে কিছু না জানিয়ে এই বাড়ি থেকে বের হয়ে গিয়েছিল সে। বুকের ভেতর অমিত উপেক্ষার যন্ত্রণা তার দৃষ্টি ঝাপসা করে রেখেছিল। আজও সেই চোখজোড়া ঝাপসাই। কিন্তু বুকভর্তি হয়ে আছে পরিপূর্ণ ভালোলাগায়। মছিদা বেগম মুনিয়াকে দেখেই অসহায় শিশুর মতো কাঁদতে লাগলেন। যেন মুনিয়া ছাড়া এই ভয়াল বিপদ থেকে তাকে রক্ষা করার আর কেউ নেই। মুনিয়া অবশ্য কোনো তাড়াহুড়া করল না। সে মছিদা বেগমকে জড়িয়ে ধরে তার ঘরে গিয়ে বসল। তারপর সবকিছু শুনে সে বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না মা। এটা এমন কোনো সমস্যা না। সব ঠিক হয়ে যাবে।’

মছিদা বেগম অবশ্য চিন্তা করছেনও না। তিনি জানেন মুনিয়া যখন এসেছে তখন আর তার চিন্তা নেই। মুনিয়া নতুন বউয়ের সাথে দেখা করল। তুলি একটু ছটফটে স্বভাবের সহজ এক মেয়ে। প্রথম দেখাতেই তাকে ভালো লেগে গেল মুনিয়ার। সমস্যা হচ্ছে সেলিনা। সেলিনা কেঁদে কেটে মুখভার করে বসে আছে। মুনিয়া তাকে দোতলায় নিজের ঘরে নিয়ে বসাল। তারপর বলল, ‘তোমার সাথে আমার জরুরি কিছু কথা আছে শেলী।’

সেলিনা অবশ্য তাতে আগ্রহ দেখাল না। সে যেমন ছিল, তেমনই বসে রইলো। মুনিয়া বলল, ‘সেই কথাগুলো বলার জন্য আমার সময় দরকার। এ কদিনে আমি অনেক ভেবেছি, কথাগুলো কার সাথে শেয়ার করা যায়, কিন্তু ভেবে পাচ্ছিলাম না। গত কিছুদিন থেকেই মনে হচ্ছিল, যদি তোমার সাথে কথাগুলো শেয়ার করা যেত, তাহলে বোধহয় ভালো হতো।’

সেলিনা জানে, এটা মুনিয়ার একটা কৌশল। সে কৌশলে তাকে সহজ করার চেষ্টা করছে। মুনিয়া বলল, ‘কথাগুলো খুবই ব্যক্তিগত। এমনকি এই কথাগুলো আমি কারো সাথেই শেয়ার করতে পারছি না। তোমার থেকে আমার পরামর্শ দরকার। আমি একটা জটিল সমস্যায় ঢুকে পড়েছি। কিন্তু সেই সমস্যা থেকে আমি বের হতে পারছি না।’

সেলিনা বিষয়টাতে আগ্রহ দেখাবে না ভাবলেও ভেতরে ভেতরে সে এক ধরনের কৌতূহল বোধ করছে। মুনিয়া বলল, ‘তুমি কী কথাগুলো শুনবে?’

‘কী কথা?’

‘একটু সময় লাগবে আমার। সবচেয়ে ভালো হয় তুমি যদি আজ রাতে আমার সাথেই থাকো।’

‘আমি থাকলে ভাইয়া কই থাকবে?’

‘সে নিচে দিপুর ঘরে থাকতে পারে। বা ঋদ্ধির সাথেও থাকতে পারে।’

বিষয়টা সেলিনার কাছে স্বাভাবিক মনে না হলেও সে তার সহজাত কৌতূহলের কাছে হেরে গেল। বলল, ‘কিন্তু ভাইয়া কিছু মনে করবে না?’

‘সেটা আমি দেখছি। তুমি এক কাজ করো, নিচে তোমার ভাইয়ার থাকার ব্যবস্থা করে এখানে চলে এসো। এর মধ্যে আমিও একটু ফ্রেশ হয়ে নেই।’

সেলিনা স্পষ্ট বুঝতে পারছে বাড়িতে সৃষ্ট অস্থির পরিস্থিতিটা স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে মুনিয়া। কিন্তু তারপরও সে মুনিয়াকে উপেক্ষা করতে পারছে না। মুনিয়াকে সে যতই অপছন্দ করুক, যতই মুনিয়ার এই সর্বপ্লাবী ক্ষমতাটাকে অগ্রাহ্য করার চেষ্টা করুক, তারপরও মুনিয়ার এই আমন্ত্রণ সে এড়িয়ে যেতে পারল না।

রাতভর মুনিয়ার সাথে সেলিনার কথা হলো। অদ্ভুত ব্যাপার হলো সেই কথায় মুনিয়া তার ব্যক্তিগত কোনো গোপন কথা বলার আর সুযোগ পেল না। বরং সেলিনা হড়বড় করে একের পর এক তার দুঃখ, তার অপ্রাপ্তি আর অপমানের গল্প বলে যেতে লাগল। সেই গল্প শেষ হলো আহসানের প্রসঙ্গে এসে। আহসানের সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে দীর্ঘ গল্প শুরু করল সে। মুনিয়া খুব আগ্রহ নিয়ে সেই গল্প শুনল। গল্পের শেষে হাউমাউ করে কাঁদল সেলিনা, এমন একটা ভালো মানুষ, অথচ দেখো ভাবি ভাগ্যটা কী খারাপ! মাঝে মাঝে এত মন খারাপ হয় যে মানুষটার জন্য কিছুই করতে পারছি না। আল্লাহ যদি আমাকে সেই ক্ষমতা দিত, তাহলে আমার সবকিছু দিয়ে হলেও তাকে আমি একটু শান্তি দিতাম।

মুনিয়া বলল, ‘অবশ্যই পারবে।’

সেলিনা খানিক উত্তেজিত কণ্ঠে বলল, ‘আমার মাথায় একটা প্ল্যান আছে ভাবি।’

‘কী প্ল্যান?’

সেলিনা দ্বিধামিশ্রিত কণ্ঠে বলল, ‘আগে বলো তুমি কিছু মনে করবে না। আর এক্ষুনি কাউকে কিছু বলবে না?

‘বলব না।’

‘প্রমিজ করো।’

‘প্রমিজ।’ মুনিয়া হাসল। সেলিনা ভেতরে ভেতরে খুবই সহজ একটা মানুষ। সেটা তার সাথে না মিশলে টের পাওয়া যায় না। সেলিনা অবশ্য সাথে সাথেই তার অতিগুরুত্বপূর্ণ পরিকল্পনাটির কথা বলল না। বরং তার মন খারাপ হয়ে গেল। সে বিষণ্ণ গলায় বলল, ‘কিন্তু প্ল্যানটা এখন আর হবে না ভাবি।’

‘কেন হবে না?’

‘রুবেল ভাইয়া যে বিয়ে করে ফেলল! ও বিয়ে না করে ফেললে একদম সব ঠিকঠাক মিলে যেত। তুমি শুধু বাবা-মাকে একটু বোঝালেই হতো।’

‘আগে বলো তুমি। শুনেতো দেখি!’

‘ধরো আহসান আর আমি যদি বিয়ে করে ফেলি তাহলে কেমন হয়?’

মুনিয়া একটু ভেবে বলল, ‘ভালোই হয়। কিন্তু সাবধান, একবার কিন্তু চুন খেয়ে মুখ পুড়েছে।’

‘তা কী আর আমাকে বলতে হবে ভাবি! এইজন্যইতো কত ছেলে কত কিছু করল, কিন্তু কাউকেই পাত্তা দিলাম না। অথচ দেখো, আহসানকে দেখেই মনে হলো, ওর সাথে আরো আগেই দেখা হওয়া উচিত ছিল আমার।’

‘আচ্ছা, প্ল্যানটা বলো।’

‘ভাবি, ঢাকায়তো আহসানের কেউ নেই। এখন ওর সাথে যদি আমার বিয়ে হয়, তাহলেতো এটাই ওর একমাত্র ফ্যামিলি তাই না?’

‘হুম।’

‘তাহলে, ধরো আমরা বিয়ে করার পর আলাদা না থেকে যদি এখানেই থাকি, সেটাই সবচেয়ে ভালো হয় না? দূরে গিয়ে কই থাকব বলো? ছেলেটার বাবা-মা নেই, ভাই-বোন থেকেও নেই। ছোটবেলা থেকে একা একাই বড় হয়েছে। এখন এখানে এলে কিন্তু ও সবাইকে পাবে। তা ছাড়া সবাই মিলে-মিশে থাকার একটা আনন্দওতো আছে। তাই না?’

‘হুম।’

তারপর ধরো, আরো একটা ব্যাপার আছে। এখনতো ওর বিজনেসে একটু ঝামেলা যাচ্ছে। এই মুহূর্তে আলাদা একটা বাসা ভাড়া করা। সেই বাসায় ফার্নিচার কেনা। বাসা ভাড়া দেয়া। অফিস ভাড়া দেয়া। বুঝতেইতো পারছো, ওর জন্য প্রায় অসম্ভব। এখন আমরা যদি নিচে আমার ঘরটায় থাকতাম। ও তো একাই মানুষ। আলাদা কোনো খরচ তো আর নেই। মাঝে মাঝে না হয় বাজার সদায় করে দিল। কিন্তু কত বড় একটা সাপোর্ট হবে, বুঝতে পারছো?’

‘পারছি।’

তারপর ধরো, আমাদের ছাদটাতো ফাঁকাই পড়ে আছে, ওখানে যদি কোনোভাবে ও দুটো ঘর তুলে একটা অফিস মতো করে ফেলে, তাহলে ওর অফিসের পেছনে যে টাকাটা প্রতি মাসে দিতে হয়, সেটাও আর দিতে হবে না। এমন না যে ওর অফিসে বাইরের কোনো লোকজন আসবে। এই ধরনের অফিসে বাইরের লোকজন আসে না। বরং আমাদেরই বাইরে বিভিন্ন অফিসে যেতে হয়। ফলে বাড়ির কারো কোনো সমস্যাই হবে না। তা ছাড়া তুমি আর ভাইয়াও ওর অনেক উপকার করতে পারবে। যেহেতু ওর ইভেন্ট ম্যানেজমেন্ট ফার্ম।’

‘এগুলো আহসানকে বলেছো?’

‘পাগল! এগুলো শুনলে আমার সাথে ও আর কথাই বলবে না। ঘরজামাই থাকার মতো ছেলে ও? ইম্পসেবল। আর ওকে যদি এসব বলে কেউ রাজি করাতেও পারে, তবে তা একমাত্র তুমিই ‘

মুনিয়া কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। তবে সে স্পষ্ট বুঝতে পারছে, বাড়িতে যে ঝামেলা শুরু হয়েছে, সামনের দিনগুলোতে তা আরো ভয়াবহ রূপ নেবে। বিষয়টা ভাবতেই অস্থির লাগা শুরু করেছে তার।

সেলিনা বলল, ‘তা ছাড়া আরেকটা জিনিস ভাবোতো ভাবি।’

‘কী?’

‘আমার কি বয়স কম হয়েছে? কয়েকদিন পর আর বিয়ের জন্য ভালো পাত্র পাওয়া যাবে? আহসানের মতো দূরের থাক, দুই-তিন বাচ্চার বাপ বুড়া-ধুরা লোকও দেখবে কত বাহানা করবে। তুমিই বলো, এর চেয়ে ভালো কি আর কিছু হয়?’

সেলিনার কথার এই অংশের সাথে একমত মুনিয়া। কিন্তু তারপরও পুরো বিষয়টাতে তার মন সায় দিচ্ছে না। তা ছাড়া রুবেল বিয়ে করায় পরিস্থিতি এখন ঘোলাটে হয়ে উঠেছে। এই অবস্থায় সেলিনা যদি সত্যি সত্যি এভাবে বিয়ে করতে চায়, তাহলে সে ছেলেটাকে নিয়ে থাকবে কই? তারা যদি দিপুর ঘরেও থাকে, তাহলে দিপু কই থাকবে? সমস্যা হচ্ছে, সেলিনা যেহেতু মনে মনে এই সিদ্ধান্ত নিয়েই নিয়েছে, সেহেতু তাকে সেখান থেকে নড়ানো প্রায় অসম্ভব কাজ হবে। কিন্তু এই সমস্যার সমাধান কীসে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *