1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ২

নাবিলা চুপচাপ বসে আছে। তার সামনে বসে আছে সাজ্জাদ। সাজ্জাদের চোখ লাল। সে গলা অবধি মদ গিলে এসেছে। বিয়ের প্রথম দিকে এই নিয়ে খুব হৈচৈ করত নাবিলা। এখন আর করে না। না করার কারণও অবশ্য আছে। সেই কারণ বলার মতোও কেউ আর নেই তার। সে মাকে কিছু বলতে পারে না। বাবাকেতো না-ই। মাঝে মাঝে নাদিয়াকে হয়তো কিছু বলা যায়। কিন্তু নাবিলা জানে, সে নাদিয়ার জীবনটাও কঠিন করে ফেলেছে। বড় বোন নিজের ইচ্ছেয় বিয়ে বা সম্পর্ক নিয়ে বড়োসড়ো ভুল করে ফেললে তার জের পোহাতে হয় ছোট বোনকে। নাদিয়াও পোহাচ্ছে। এই বয়সে তার ঝলমলে প্রজাপতির মতো ডানা মেলে উড়ে বেড়াবার কথা। এক পৃথিবী স্বপ্নের রং চোখে-মুখে ছড়িয়ে ভেসে বেড়াবার কথা। কিন্তু যখনই কোনো স্বপ্ন তার চোখের পাতায় ভর করতে চায়, সে চট করে চোখ মেলে তাকায়। অনবরত ঝাঁজালো জল ছেটাতে থাকে চোখে। যতক্ষণ না অবধি সেই রঙচঙে স্বপ্নটা ধুয়ে-মুছে যায় চোখ থেকে, ততক্ষণ অবধি সে দাঁতে দাঁত চেপে নির্ঘুম দিন-রাত্রি কাটিয়ে দেয়। সে জানে, তার স্বপ্ন দেখতে মানা। তার এই স্বপ্নবিহীন জীবনের পাণ্ডুলিপি লিখে দিয়েছে তার বড় বোন নাবিলা।

নাবিলা তার নিজের জীবনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায়টি লিখেছে ভুল গল্পে, ভুল সিদ্ধান্তে। এই গল্প নতুন করে লেখার ক্ষমতা আর তার নেই। বিষয়টা জানে বলেই সারাক্ষণ কুঁকড়ে থাকে সে। কিন্তু সবকিছু যখন সহ্যের সীমা ছাড়িয়ে যায়, তখন বাধ্য হয়েই ছোটবোন নাদিয়াকে ফোন করে কাঁদে সে। নাদিয়া বড় বোনকে আশ্বস্ত করার চেষ্টা করে, ‘দেখিস একদিন সব ঠিক হয়ে যাবে। দুলাভাই বুঝতে পারবেন উনি যা করছেন তা ঠিক নয়। তুই দেখিস।’

নাবিলা কাঁদে। সে নাদিয়ার কথা শোনে কিনা বোঝা যায় না। কাঁদতেই থাকে। নাদিয়া সেই একই গলায় বলে, ‘তুই কাঁদিস না আপু। তুই কাঁদলে আমার ভালো লাগে না। আমারও কান্না পেয়ে যায়।’ নাদিয়া অবশ্য কাঁদে না। তবে নাবিলাও কান্না থামায় না। ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদতেই থাকে। তার এই একটা জীবন হয়তো কান্নার ফোঁটা ফোঁটা জলেই লিখে রেখেছে কেউ। সেই জল শেষ না হওয়া অবধি তাকে কাঁদতেই হবে, তা সে জানে। জীবনের এমন এক অন্ধ গলিতে সে ঢুকে পড়েছে, যেই গলি থেকে বেরুনোর কোনো পথ তার জানা নেই।

রাত তিনটা বাজে। ফরিদপুরের ছোট্ট এই মফস্বল শহর সুনসান। দূরে হেঁটে যাওয়া কারো পায়ের শব্দ, কোনো পাতা ঝরার শব্দও হাওয়ায় ভেসে কানে আসে। তারপরও সাজ্জাদ চড়া গলায় বলল, ‘তুই আমাকে কী ভাবিস? আমি রাস্তার ফকির?’

নাবিলা জবাব দিল না। তার আর মার খেতে ভালো লাগে না। সাজ্জাদ বলল, ‘তোর বাপকে বল আমাকে একসাথে আট লাখ টাকা দিতে। আগের বারের মতো ভেঙে ভেঙে দিলে হবে না। ভাঙা টাকা কোনো কাজে লাগে না। ভাংতি টাকা দেখলেই আমার মদ খেতে ইচ্ছে করে। এই যে আমি এত মদ খাই, এর জন্য কে দায়ী বল?’

নাবিলা মাথা নিচু করে বসে আছে। সাজ্জাদ যে প্রতি রাতেই মদ খায়, বিষয়টা এমন নয়। তবে সপ্তাহে দুয়েকদিন খাবেই। আবার মদ খেলেই যে সে নাবিলার গায়ে হাত তোলে, ব্যাপারটা তাও নয়। তবে মাসে দুয়েকদিন এই ঘটনা ঘটেই। আজও ঘটবে কিনা সে জানে না। সাজ্জাদ বলল, ‘বিয়ের আগে কে ফষ্টিনষ্টি করে না, তুই বল? তাই বলে জোর করে বিয়ে দিয়ে দিতে হবে? তোর বাপ করে নাই? সেও করেছে। এখনো করে। যেই কলেজে সে পড়ায়, সেই কলেজের ম্যাডামের সাথে তার কী সম্পর্ক বল? এই যে বিয়েতে এত টাকা খরচ হলো, এই টাকা সে কই পেয়েছে? আমাকে যে টাকা দিয়েছে, সেই টাকা সে কই পেয়েছে? আমি জানি না ভেবেছিস? আমি সব জানি। তোর বাপ হলো একটা নিমহারামি। নিমহারামি কি বুঝিস?’

একটু থেমে সে আবার বলল, ‘নিমহারামি হলো বাইরে ফিটফাট, ভেতরে সদরঘাট। তোর বাপ হলো ওইটা। বাইরে দেখলে মনে হয় ভাঁজা মাছ উল্টে খেতে জানে না। আসলেতো কাঁটাসহ খেয়ে ফেলে। কয় টাকা বেতন পায় সে ওই কলেজে? ওই কটা টাকাই যদি বেতন পায়, তাহলে এতটাকা সে আমারে দিল কীভাবে? ভেতরে অন্য ঘটনা আছে। সেও ওই মহিলার সাথে ফষ্টিনষ্টি করে। এইটারে ইংরেজিতে বলে জিগালো। টাকার বিনিময়ে…। বুঝলিতো? সে ওই মহিলার…।’

নাবিলা আর চুপ থাকতে পারল না। সে বলল, তুমি সীমা ছাড়িয়ে যাচ্ছো সাজ্জাদ…।

সাজ্জাদ সপাটে চড় বসাল নাবিলার গালে। নাবিলা ছিটকে পড়তে পড়তেও সামলে নিল। সাজ্জাদ নির্বিকার ভঙ্গিতে হাসল, ‘এত আস্তে চড় খেয়ে ব্যথা পেলেতো সমস্যা! তুইতো ছাত্রীও ভালো ছিলি না। খারাপ ছাত্রী হলে মার খাওয়ার অভ্যাসতো থাকতে হবে। হবে না?’

সাজ্জাদের সাথে বছর পাঁচেক আগে নাবিলার পরিচয়। সাজ্জাদরা কয়েক বন্ধু মিলে কলেজ ভর্তির কোচিং দিয়েছিল। সেই কোচিংয়ে ভর্তি হয়েছিল সে। সাজ্জাদ কথা বলতো সুন্দর করে। পড়াতোও ভালো। ব্যাচের সব মেয়েরা মুগ্ধ হয়ে তাকিয়ে থাকত তার দিকে। নাবিলা অবশ্য ভীতু ধরনের মেয়ে। ভালো লাগলেও সে কখনো অন্য মেয়েদের মতো ড্যাবড্যাব করে সাজ্জাদের দিকে তাকিয়ে থাকতে পারতো না। পরীক্ষা কিংবা মডেল টেস্টের পেপারে বিশেষ কিছু লিখেও দিতে পারতো না। সেই সাহস তার কোনো কালেই ছিল না। এমনকি ক্লাস শেষে কঠিন কোনো বিষয় বুঝতে পারেনি বলে আলাদা করে সাজ্জাদের রুমে বুঝতেও যেতে পারত না। তারপরও আর সব মেয়েদের রেখে কেমন কেমন করে যেন সাজ্জাদের চোখ পড়ে গেল নাবিলার ওপরই। সেবার হিসাববিজ্ঞানে খুব খারাপ করে ফেলল নাবিলা। যদিও অতটা খারাপ রেজাল্ট হবে সেটা বিশ্বাসই হচ্ছিল না তার। ক্লাস টেস্টের খাতা হাতে সাজ্জাদ গম্ভীর গলায় বলেছিল, কাল বিকেলে দেখা করবে। তোমার সাথে সিরিয়াস আলাপ আছে।’

সিরিয়াস আলাপ অবশ্য কিছু হয়নি। দীর্ঘসময় তাকে বসিয়ে রেখে শেষে সাজ্জাদ বলেছিল, ‘পড়াশোনা বিষয়টা কেমন জানো?’

নাবিলা চোখ তুলে তাকিয়েছিল। সাজ্জাদ বলেছিল, ‘পড়াশোনা বিষয়টা একটা বিশাল ফাঁকি। এখানে শোনার চেয়েও দেখার ভূমিকা বেশি। অথচ পড়াদেখা বাদ দিয়ে লোকে একে বলে পড়াশোনা। কী উদ্ভট না?’

নাবিলা জবাব দেয়নি। সাজ্জাদ নাবিলার চোখে চোখ রেখে বলেছিল, ‘এইজন্য আমি শোনার চেয়ে দেখি বেশি, বুঝলে?’

নাবিলা বোঝেনি। কিন্তু সে জানত তার সামনে বসা ছেলেটার জন্য তার বুকের ভেতর কেমন ছটফটানি হয়। না দেখলে তেষ্টা তেষ্টা লাগে। সাজ্জাদ তার খাতায় গোটাগোটা অক্ষরে লিখে দিয়েছিল, ‘আমি তোমাকে দেখতে চাই। দেখে দেখে তোমাকে পড়তে চাই। সারাটা জীবন। একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো।’

সাজ্জাদ ঠিক বলেনি। সে নয়, বরং একান্ত বাধ্যগত ছাত্রী হয়ে গেল নাবিলা। সে বুঝতে পারছিল, সাজ্জাদ একটা চোরাবালির মতো। এখানে ডুবে গেলে সে আর কখনোই উঠতে পারবে না। অবশ্য তখন উঠতে চায়ওনি সে। সাজ্জাদ তখন সীমাহীন মুগ্ধতার নাম। সেই মুগ্ধতা বাড়তে বাড়তে অন্ধ করে দিয়েছিল নাবিলাকে। বছর দুয়েক বাদে এক সন্ধ্যায় সাজ্জাদ এসে বলল, ‘তোমার কাছে টাকা হবে?’

‘টাকা!’ চমকে গিয়েছিল নাবিলা।

‘হ্যাঁ, খুব প্রয়োজন।’

নাবিলা প্রয়োজনটা আর জানতে চায়নি। মেয়েদের চিরকালীন সঞ্চয়ের অভ্যাস। তারও কিছু ছিল। তার সেই সঞ্চয়টুকু সাজ্জাদের হাতে তুলে দিতে কী যে ভালো লাগছিল নাবিলার! কিন্তু তখনো কী সে জানত, সাজ্জাদও ডুবে গেছে ভয়াবহ এক চোরাবালিতে! তার টকটকে লাল চোখ, এলোমেলো চলন-বলন কিংবা নেশাসক্ত মুখশ্রী যে নাবিলার চোখে পড়েনি তা নয়। কিন্তু মুখোমুখি দাঁড়িয়ে, চোখে চোখ রেখে শক্ত গলায় সে কথাটুকু বলবার সাহসটা কখনো হয়ে ওঠেনি নাবিলার। বলা হয়ে ওঠেনি আরো কতকিছুই। আর হয়নি বলেই এক ভয়ংকর ভুলের পর সে যখন উদ্ভ্রান্তের মতো একা একা মুক্তির উপায় খুঁজছিল। সমুদ্রে ডুবে যেতে থাকা সাঁতার না জানা এক মানুষের মতো খড়কুটো খুঁজছিল, তখন আচমকা তার মা তাকে ডেকে বলেছিলেন, ‘তোর কি শরীর খারাপ?’

সেদিন সে কম্পিত, সন্ত্রস্ত গলায় বলেছিল, ‘নাতো মা, কেন?’

হাফসা বলেছিলেন, ‘এদিকে আয়, আমার কাছে এসে বোস।’

সে রাজ্যের সাহস জড় করে নিয়ে এসে তার মায়ের সামনে বসেছিল। হাফসা দীর্ঘ সময় মেয়ের দিকে তাকিয়ে থেকে বলেছিলেন, ‘কী হয়েছে বল?’

কী বলবে সে? আঁতিপাঁতি করে খুঁজেও সেদিন বলার মতো কিছু পায়নি সে। কিন্তু হাফসার অমন অন্তর্ভেদী দৃষ্টির সামনে বসেও থাকতে পারছিল না। সেদিন চোরের মতো পালিয়ে বেঁচেছিল। কিন্তু হাফসার দৃষ্টি তাতে ক্ষান্ত দেয়নি। তার চোখও এড়ানো যায়নি। দিন পনেরো বাদে মেয়েকে একা ঘরে ডেকে দরজা বন্ধ করতে বললেন তিনি। তারপর হাউমাউ করে কাঁদলেন। নাবিলা চেষ্টা করছিল এটা সেটা অনেক কিছু বলে মায়ের চোখকে ফাঁকি দিতে। কিন্তু পারেনি সে। হাফসা আচমকা বললেন, ‘জামা খোল।’

‘জামা কেন খুলবো মা? এসব তুমি কী বলছো!’ নাবিলা চেষ্টা করেও তার গলা শক্ত করতে পারেনি।

হাফসা হিসহিসে কণ্ঠে বলেছিলেন, ‘হারামজাদী, তুই জামা খোল। তোর প্যাটে কী বাঁধাইছোস তুই, আমারে দেখতে দে?’

নাবিলা তখন তিন মাসের গর্ভবতী। ভয়াবহ দুশ্চিন্তায় তার চোখের নিচে কালি পড়ে গেছে। রাতের পর রাত নির্ঘুম, কান্না-ক্লান্ত, ফ্যাকাশে এক মানুষ সে। ঘটনার পর থেকে সাজ্জাদ উধাও। তাকে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। ততদিনে তার কোচিং সেন্টার উঠে গেছে। দশবার ফোন দিলে সে একবার ফোন ধরে। নাবিলার তখন দিশেহারা অবস্থা। তার বিন্দুমাত্র ধারণা নেই এমন পরিস্থিতিতে কী করতে পারে একটা মেয়ে! কাকে কী বলবে সে? কীভাবে বলবে? কতদিন আর এভাবে লুকিয়ে রাখতে পারতো সে নিজেকে!

হাফসা অবশ্য মাথা গরম করলেন না। তিনি ঠাণ্ডা মাথায় ঘটনা খুলে বললেন আশফাককে। ঘটনা শুনে আশফাকের ছোটোখাটো স্ট্রোকের মতো হয়ে গেল। শেষ উপায় অবশ্য মুনিয়া। মুনিয়া সব শুনে বলল, ‘এখন কী করতে চান ভাবি?’

হাফসা ঠাণ্ডা গলায় বললেন, ‘ছেলেটারে খুঁজে বের করো। এই মেয়ে আমি ঘরে রাখব না। এরে আমি বিয়ে দেব। ওই ছেলের সাথেই দেব। তুমি দ্রুত ব্যবস্থা করো।

সাজ্জাদ অবশ্য সহসা বিয়েতে রাজি হলো না। তার নানা দাবি দাওয়া, শর্ত। প্রায় সকল শর্তই মেনে নিলেন হাফসা। আশফাককে বড় অঙ্কের টাকার ব্যবস্থাও করতে হলো। বিদেশ থেকে তার বড় বোনও কিছু পাঠালেন। লজ্জায়, অপমানে, অপরাধবোধে আড়ষ্ট নাবিলা তখন বাড়ি থেকে পালিয়ে যেতে পারলে বাঁচে। নাবিলা আর সাজ্জাদকে ঢাকায় বাসা ভাড়াও করে দেয়া হলো। সাজ্জাদের একটা চাকরি-বাকরি হওয়া অবধি এই ব্যবস্থা। সাজ্জাদ অবশ্য বিয়ের দিন দুয়েকের মাথায় নাবিলাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে গেল। তারপর গর্ভপাত করাল আরো কিছুদিন পর।

এই নিয়ে কারো দ্বিরুক্তি করার কোনো সুযোগও অবশ্য রইলো না। সমস্যা শুরু হলো এরপর। হঠাৎ করেই নাবিলাকে ঢাকায় রেখে একা ফরিদপুরে নিজেদের গ্রামের বাড়িতে চলে এলো সাজ্জাদ। তারপর থেকে আর কোনো খবর নেই তার। মাসখানেক পরে সে ফোন করে জানাল, তার মোটা অঙ্কের নগদ টাকা দরকার। সেই টাকায় নিজের শহরে ব্যবসা-বাণিজ্য করবে সে। আশফাকের পক্ষে তখন এককালীন অত টাকার ব্যবস্থা করা সম্ভব না। কিন্তু সাজ্জাদের শর্তে রাজি না হয়েও উপায় রইল না তার। সে মাসে মাসে নির্দিষ্ট একটা টাকা পাঠাতে লাগল সাজ্জাদকে। কিন্তু তাতে পরিস্থিতির কোনো উত্তরণ ঘটল না। বরং আরো অবনতি হলো। সেই অবনতি হওয়া পরিস্থিতির কথা অবশ্য কেউ জানলো না। নাবিলা হাসি হাসি মুখে মায়ের সাথে কথা বলে। বাবার সাথে কথা বলে। নাদিয়ার সাথেও বলে। তবে কেবল নাদিয়ার কাছেই কেঁদে বুক ভাসাতে পারে সে। অকপট, ভানহীন হতে পারে। আর কারো কাছে নয়। জগতে আর কোথাও সেই জায়গাটুকু তার নেই। নিজের ইচ্ছেয় যতটুকু পথ সে সামনে এগিয়েছে, ঠিক যেন ততটুকু পথই রুদ্ধ করে এসেছে পেছনে। তাই ফেরার আর পথ নেই তার।

নাবিলা ভেবেছিল সে কাঁদবে না। কিন্তু তার চোখের কোল গড়িয়ে জল নামছে। সাজ্জাদ চাপা গলায় বলল, ‘আমার সামনে বসে ফ্যাঁচফ্যাচ করে কাঁদবি না। তোর কান্না দেখলে আমার মাথায় খুন চেপে যায় নাবিলা।’

নাবিলা এক হাতে মুখ চেপে ধরে দাঁড়িয়ে রইল। সাজ্জাদ বলল, ‘তুই টাকার ব্যবস্থা কর। তোর বাবাকে ফোন কর। আমার টাকা লাগবে। এই মাসের মধ্যে লাগবে।’

নাবিলা কথা বলল। সে ভেজা, শ্লেষ্মা জড়ানো গলায় বলল, ‘বাবা অত টাকা কই পাবে? তুমিতো বাবার অবস্থা জানো। জানো না?’

সাজ্জাদ ক্রুঢ় ভঙ্গিতে হাসল, ‘কই পাবে সেটা আমি কী জানি! তোর বাপতো ভাড়া খাটে, ভাড়া খেটে আনতে বল!’

নাবিলা এবার আর নিজেকে সামলাতে পারল না। সে চিৎকার করে বলল, তুমি আমার বাবাকে নিয়ে আর একটা নোংরা কথা বলবে না। একটাও না।’

‘কেন? বললে কী করবি তুই?’

নাবিলা শক্ত হাতে খাটের স্ট্যান্ড ধরে দাঁড়িয়ে আছে। তার হাত কাঁপছে। সাজ্জাদ বলল, ‘মারবি আমাকে? মারবি? আয়, মার। আয়।

সাজ্জাদ দু পা সামনে এগুলো। তারপর আচমকা লাথি বসাল নাবিলার পেট বরাবর। নাবিলা ছিটকে পড়লো শোকেসের ওপর। ঝনঝন শব্দে কাচ ভেঙে ছড়িয়ে পড়ল মেঝেতে। শোকেসটা বিকট শব্দে উল্টে পড়ে গেল। দরজার ওপাশ থেকে শফিক ভীত কণ্ঠে ডাকল, ‘ভাইজান। ভাইজান।’

সাজ্জাদ চিৎকার করে বলল, ‘এতরাতে এইখানে কোনো ঝামেলা করবি না শফিক। ঘুমাতে যা।’

শফিক সাজ্জাদের ছোট ভাই। সে ফরিদপুর থেকে বিএ পাস করে ঢাকায় এক কলেজে সান্ধ্যকালীন মাস্টার্স করছে। সাথে এক এনার্জি বাল্বের কোম্পানিতে পার্টটাইম মার্কেটিং এক্সিকিউটিভ হিসেবে কাজ করছে। টিউশনও করায় দুটো। তারা দুই ভাই এক বোন। বোনের বিয়ে হয়েছে বরিশালে। সে কালেভদ্রে বাড়িতে আসে। বাবা নেই। মা অসুস্থ। সেই মাকে দেখতেই বাড়ি এসেছে শফিক। খানিকটা চুপচাপ স্বভাবের ছেলে সে। নাবিলার সাথে সাজ্জাদের আচরণ সম্পর্কে সে কম-বেশি জানে। কিন্তু এবার বাড়ি আসার পর থেকে যে অবস্থা সে দেখছে, তা একপ্রকার অচিন্তনীয়ই।

শফিক আবারো দরজায় নক করল। সাজ্জাদ বিশ্রি ভাষায় গাল বকে দরজা খুলে দাঁড়াল। শফিক বলল, ‘তুমি কি ভাবিকে মেরে ফেলবে?’

‘ফেললে ফেলবো, তাতে তোর কী?’

শফিক জবাব দিল না। সে সাজ্জাদকে ঠেলে সরিয়ে দিয়ে ঘরে ঢুকল। নাবিলা মেঝেতে পড়ে আছে। তার কপালের পাশ কেটে রক্ত বেরুচ্ছে। হাতের তালুতে ভাঙা কাচের টুকরো বিধে আছে। ভয়ংকর বিষয় হচ্ছে সে নড়াচড়া করছে না। মৃত মানুষের মতো নিথর পড়ে আছে। শফিক তাকে বার কয়েক ডাকল, কিন্তু কোনো সাড়া দিল না নাবিলা।

নাবিলাকে হাসপাতালে নেয়া হলো ভোরের আলো ফোটার সাথে সাথেই। তার জ্ঞান ফিরল তারও কিছুক্ষণ পর। কিন্তু নাবিলা কারো সাথে কোনো কথা বলল না। চুপচাপ শূন্য চোখে নির্নিমেষ তাকিয়ে রইলো সে। শফিক বলল, ‘ভাবি, তুমি ঢাকায় যাবে?’

নাবিলা জবাব দিল না। শফিক বলল, ‘তোমার ভালো চিকিৎসা আর বিশ্রাম দরকার ভাবি। কয়েকটা দিন ঢাকায় থেকে এসো। দেখবে ভাইজানও তখন কিছুটা হলেও বুঝবে। তাকে জোর করে কিছু বোঝানো যাবে না, যদি না সে নিজ থেকে বোঝে।’

নাবিলা তখনো কথা বলল না। সে এই অবস্থায় কখনোই ঢাকায় যেতে চায় না। তার এই চেহারা সে বাড়ির কাউকে দেখাতে চায় না। বিকেলে অবশ্য সাজ্জাদ হাসপাতালে এলো। সুস্থ, স্বাভাবিক, শান্ত একজন মানুষ। সে নাবিলার পাশে এসে বসল। তারপর বিড়বিড় করে বলল, ‘আমার মাথার ঠিক থাকেনা নাবিলা। নানান চিন্তা, টেনশন। এইজন্য মাথার ঠিক থাকে না। কী করব বলো!’

নাবিলা যেমন ছিল, তেমনই নির্জীব পড়ে রইল। সে জানে, সাজ্জাদের এই চেহারা স্থায়ী কিছু নয়। সে আবার নেশা করবে, আবার মাঝরাতে রক্তচক্ষু নিয়ে ঘরে ফিরবে। আবার সেই একই দৃশ্যের পুনরাবৃত্তি হবে। সাজ্জাদ নাবিলার হাত ধরে কাঁচুমাচু গলায় বলল, ‘অনেক টাকা লোন করে ফেলেছি। সেই টাকা শোধ করতে পারছি না বলে লোকে দিনরাত আমাকে খোঁজে। আমি লুকাই থাকি। দেখা হলেই গাল-মন্দ করে। অপমান করে। আয়-রোজগারও কিছু নাই। এইজন্য আমার মাথা উল্টাপাল্টা হয়ে যায় নাবিলা। তুমি আমাকে মাফ করে দাও।’

নাবিলা সব জানে, সব বোঝে, তারপরও কোনো এক ব্যাখ্যাহীন কারণে এই লোকটাকে সে উপেক্ষা করতে পারে না। অবজ্ঞা করতে পারে না। লোকটা সামান্য নরম গলায় কথা বললেই তার মনে হয় আগের ঘটনাগুলো সব দুঃস্বপ্ন ছিল। সে এখন ঘুম থেকে জেগে উঠতেই সেই ভয়ংকর দুঃস্বপ্ন ভেঙে গেছে। নাবিলা তার ব্যান্ডেজ বাঁধা হাতের মুঠোতে সাজ্জাদের হাতটা আলতো করে ধরল। তার দু চোখের কোল বেয়ে অঝর ধারায় নেমে আসতে লাগল একজোড়া দুঃখবতী নদী।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *