1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ১২

১২

সেলিনার ডিভোর্স হয়েছে মাস ছয়েক হলো। ডিভোর্সের সাথে মেজাজ খিটখিটে হয়ে যাওয়ার কোনো সম্পর্ক আছে কী না কে জানে! এ বাড়ির প্রায় সবার সাথেই তার যখন তখন খটোমটো লেগে যায়। এই নিয়ে অন্যদের খুব একটা অভিযোগ না থাকলেও সেলিনার আছে। তার ধারণা সবাই ইচ্ছে করেই তার সাথে এমন করছে। যেহেতু তার ডিভোর্স হয়েছে, ফলে সবাই ভাবছে ঘাড়ে একটা উটকো আপদ এসে জুটেছে। এই আপদ যে করে হোক নামাতেই হবে। আর সেই নামানোর চেষ্টা হচ্ছে যখন তখন তার সাথে যাচ্ছেতাই আচরণ করা।

আজ সকালেই যেমন দিপুর সাথে তার একচোট হয়ে গেল। ভাই-বোনের মধ্যে একমাত্র দিপুই তার চেয়ে ছোট। সে সকালে ইউনিভার্সিটতে যাচ্ছিল। সেলিনা বলল, ‘তুই শাহবাগের দিকে যাচ্ছিস?’

দিপু বলল, ‘হু যাচ্ছি।’

‘তাহলে দশটা মিনিট একটু অপেক্ষা করবি?’

‘কেন?’

‘আমিও একটু ওইদিকে যাব। একসাথে গেলাম। আসলে আমার সাথে দুটো ব্যাগ থাকবেতো, তুই সাথে থাকলে একটু হেল্প হয়।

দিপুর পক্ষে এই মুহূর্তে দশ মিনিট অপেক্ষা করা অসম্ভব। তার সকাল আটটায় টিএসসিতে থাকার কথা ছিল। এখন বাজে ৯টা। সে আজও ঘুম থেকে উঠতে দেরি করেছে। এই এক ঘণ্টায় সুমি কম করে হলেও কুড়িবার ফোন করেছে। ঘুম থেকে উঠে সে ফোন ধরে সুমিকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই হড়বড় করে বলল, ‘আর দশটা মিনিট। কী বিশ্রি জ্যাম রাস্তায়, উফ! এই শহরে মানুষ বাস করতে পারে! পারে, হ্যাঁ? তুমিই বলো? দেড় ঘণ্টা, পাক্কা দেড়টা ঘণ্টা আমি রাস্তায়। এই দেড় ঘণ্টায় মানুষ মোহাম্মদপুর থেকে সায়েন্স ল্যাব পৌঁছাতে পারে না। চিন্তা করো? চিন্তা করো তাহলে এই দেশের উন্নতি কেমনে হবে? অথচ দেড় ঘণ্টায় ঢাকা থেকে কাঠমাণ্ডু চলে যাওয়া যায়!’

সুমি কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু তার আগেই ফোন কেটে দিয়েছে দিপু। এখন কিছু বলতে দেয়া যাবে না। ফোনও ধরা যাবে না আর। যতদ্রুত সম্ভব তাকে টিএসসি পৌঁছাতে হবে। সে মোবাইল ফোনের অ্যাপস থেকে মোটরবাইক ডেকেছে। দুয়েক মিনিটের মধ্যে বাইক চলে আসবে। এই মুহূর্তে কোনোভাবেই তার পক্ষে সেলিনার জন্য অপেক্ষা করা সম্ভব না। এক মিনিটও না। আর সেলিনার দশ মিনিট মানে ঘণ্টা পার। দিপু মিনমিন করে বলল, ‘তুই একটা উবার ডেকে চলে আয় আপা। আমার একটু তাড়া আছে।’

‘কীসের তাড়া তোর?’

‘আছে আপা। একটা জরুরি কাজ আছে।’

‘কী কাজ?’

‘কী কাজ সেটা শুনে তুই কী করবি?’

‘কী করব মানে? তুই কোথায় কী করে বেড়াচ্ছিস সেটা আমাকে জানতে হবে না?’

দিপুর ভয়ানক মেজাজ খারাপ হচ্ছে। তার ইচ্ছে হচ্ছে সেলিনার মুখের ওপর শক্ত কিছু বলে দিতে। কিন্তু সে জানে, বলার সাথে সাথেই সেলিনা কান্নাকাটি করে একটা হুলুস্থুল বাঁধিয়ে ছাড়বে। আবোল তাবোল বকতে শুরু করবে। তারচেয়ে যতটা সম্ভব তাকে বুঝিয়ে বলাই ভালো। সে ঝট করে মিথ্যে বলে ফেলল, ‘আমার পরীক্ষা ছিল সকালে, আমি দেরি করে ফেলেছি আপা।’

‘কীসের পরীক্ষা তোর? আজ পরীক্ষা হলে গতরাতেতো তোর পড়াশোনা করার কথা ছিল। এ বাড়ি আসার পর কোনো দিনতো তোকে এক মিনিটের জন্যও বই ধরতে দেখলাম না। বড় হয়ে গেছিস না?’

‘আপা…’

দিপুকে কথা শেষ করতে দিল না সেলিনা। সে একগুঁয়ে ভঙ্গিতে বলল, ‘কীসে পড়িস তুই? মাস্টার্সে? মাস্টার্সে পড়লেই কেউ বড় হয়ে যায় না। তোর বয়সেও মার হাতে রেগুলার মার খেয়েছি।’

দিপুর মেজাজ রীতিমতো তিরিক্ষি হয়ে উঠেছে। তারপরও যতটা সম্ভব নিজেকে সংযত রেখেই সে বলল, ‘আপা, এসব নিয়ে পরে কথা বলি। এখন যাই?’

সেলিনা কঠিন গলায় বলল, ‘না যাবি না। এখানে দাঁড়িয়ে থাকবি। আমি রেডি হয়ে আসছি।’

সেলিনা রেডি হয়ে এসে দেখে দিপু নেই। সে দিপুকে ফোন করল। কিন্তু দিপু ফোন ধরলো না। সেলিনা ফোনের পর ফোন করতেই থাকল। রাগে তার দিশেহারা অবস্থা। আজ এর একটা বিহিত সে করেই ছাড়বে। কিন্তু তার রাগের সীমা- পরিসীমা পেরিয়ে গেল দিপুর ফোন বন্ধ পেয়ে। সে বারবার ফোন করছে বলে দিপু তার ফোন অফ করে রেখেছে! বিষয়টা কিছুতেই মেনে নিতে পারছে না সেলিনা। সে দুপুর পর্যন্ত একটানা ফোন করে গেল। রাগে তার মাথা ঝিমঝিম করছে। চোয়াল শক্ত হয়ে আছে। ভেতরে ভেতরে একটা জ্বলন্ত আগ্নেয়গিরি হয়ে আছে যেন সে। দিপু ফোন ধরা মাত্রই সেই আগ্নেয়গিরিতে বিস্ফোরণ ঘটবে। কিন্তু দিপুর ফোন আর খুলল না। সেলিনার এখন খুব কান্না পাচ্ছে। এই বাড়িতে সে এতটাই তুচ্ছ? এতটাই গুরুত্বহীন? অনাকাঙ্ক্ষিত?

সেলিনার এই দিগন্তবিস্তৃত দুঃখ অসীম হয়ে গেল তার মা মছিদা বেগমের কথায়। মছিদা বেগম হন্তদন্ত হয়ে তার ঘরে ঢুকলেন। তারপর বললেন, ‘দিপুকে বললাম ফেরার সময় যেন আমার ওষুধগুলো নিয়ে আসে। কিন্তু প্রেসক্রিপশনটাতো পাচ্ছি না। তোর মোবাইলে না প্রেসক্রিপশনের ছবি তোলা আছে? নামগুলো একটু বলবি?’

সেলিনা বলল, ‘দিপুকে কই পেলে তুমি?’

‘কেন? ফোনে?’

‘কখন?’

‘এইতো এখনই। কেন, তোরও কিছু লাগবে?’

সেলিনা হতভম্ব ভঙ্গিতে তার মায়ের হাত থেকে ফোনটা নিল। সে এতক্ষণ দিপুর যে নম্বরটি বন্ধ পাচ্ছিল, সেটিতেই মা দিপুর সাথে কথা বলছে। অথচ নিজের নম্বর থেকে দিপুর ফোন বন্ধ পাচ্ছে সেলিনা! তার মানে দিপু তার নম্বর ব্লক করে রেখেছে?

সেলিনা হাউমাউ করে কাঁদতে শুরু করল। মছিদা বেগম অবাক গলায় বললেন, ‘কী হয়েছে তোর? এই শেলী, শেলী, হয়েছে কী, বল? এই…।’

… সেলিনার কান্না আর থামলো না। সে তার মাকে ঠেলে ঘর থেকে বের করে দিল। তারপর দরজা বন্ধ করে দিয়ে বিছানায় মুখ গুঁজে সন্ধ্যা অবধি শুয়ে রইল।

.

এই পুরোটা সময় মছিদা বেগম তার দরজার পাশে বসে রইলেন। অনুনয় বিনয় করলেন। কিন্তু কিছুতেই কিছু হলো না। সেলিনা দরজা খুলল না। সে মিহি স্বরে কাঁদতে লাগল। তার অভিশপ্ত জীবনকে শাপ-শাপান্ত করতে লাগল। মাগরিবের আজানের সময়ে সে সিদ্ধান্ত নিল, এ জীবন আর সে রাখবে না। ফ্যানের সাথে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করবে। সকলের কাছে অনাকাঙ্ক্ষিত, অভিশপ্ত এই জীবন থেকে সে মুক্তি পাবে।

সেলিনার অবশ্য আত্মহত্যা করা হলো না। তাকে দরজা খোলাল মুনিয়া। এ বাড়িতে একমাত্র মুনিয়ার কথাই সে শোনে। অথচ সবচেয়ে বেশি অপছন্দও করে তাকে। কিন্তু সেটি সে মুনিয়ার সামনে প্রকাশ করতে পারে না। মুনিয়ার আচরণে কিছু একটা আছে, তাকে সরাসরি উপেক্ষা করা যায় না, অমান্য করা যায় না। অপছন্দ করলেও না। আচ্ছা, মুনিয়াকে অপছন্দ করার মতো কি কিছু আছে?

এই প্রশ্নের উত্তর সেলিনা খুঁজেছে। কিন্তু খুঁজেও তেমন কিছু পায়নি। তার কেবল মনে হয়েছে, মুনিয়াকে সে সহ্য করতে পারে না। সে যখন হাসি হাসি মুখে মুনিয়ার সাথে কথা বলে, তখনো সে ভেতরে ভেতরে এক ধরনের প্রবল জিঘাংসা অনুভব করে। এই জিঘাংসার উৎস কোথায় কে জানে?

বিষয়টা যে মুনিয়া বোঝে না তা নয়। সে সবই বোঝে। কিন্তু এগুলোকে সে পাত্তা দিতে চায় না। বেশির ভাগ সময় দেয়ও না। কিন্তু তার এই পাত্তা না দেয়াটাও সেলিনাকে আরো বেশি ক্রুদ্ধ করে তোলে। ভেতরে ভেতরে সারাক্ষণ সে ফুঁসতে থাকে। কিন্তু মুখোমুখি হলেই ভুবন ভোলানো হাসি হেসে মুনিয়াকে জড়িয়ে ধরে সে, ‘ভাবি, তুমি দিন দিন এত সুন্দর হচ্ছো কী করে, বলোতো!’

মুনিয়া হাসে, ‘তোমার সাথে থাকতে থাকতে।

‘যাহ, আমি মোটেও তোমার মতো সুন্দর না।’

‘আমার মতো সুন্দর হতে যাবে কোন দুঃখে! তুমি আমার চেয়েও অনেক বেশি সুন্দর।’

সেলিনা জানে, কথাটা ঠিক নয়। সে দেখতে মোটেও মুনিয়ার চেয়ে সুন্দর নয়। এই বয়সেও নিজেকে কী ফিট রেখেছে মুনিয়া। কম করে হলেও তার চেয়ে বছর দশেকের বড় হবে সে। অথচ এখনো রাস্তায় বের হলে সবাই আড় চোখে মুনিয়ার দিকেই তাকিয়ে থাকে। সেলিনার মাঝে মাঝে মনে হয়, মুনিয়া যে তার চেয়ে দেখতে বেশি সুন্দর, শুধু এই একটি কারণেই তাকে সে অপছন্দ করে। অবশ্য সেলিনার এই ভাবনা স্থির থাকে না। পরক্ষণেই অন্য কোনো ঘটনায় তার আবার মনে হয়, মুনিয়ার ব্যক্তিত্বকে সে অপছন্দ করে। যেভাবে মুনিয়া তার চারপাশের মানুষগুলোকে অবলীলায় নিয়ন্ত্রণ করে, সেটিকে সে অপছন্দ করে। অবচেতনেই নিজের সাথে তুলনা করতে থাকে। এটি তাকে ক্রমাগত আহত করে তোলে। হতাশাগ্রস্ত করে তোলে। সে আসলে কাউকেই নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। এমনকি নিজের স্বামীকেও না।

মুনিয়া বলল, ‘তোমার কী হয়েছে সেলিনা?’

সেলিনা বলল, ‘কিছু হয়নি ভাবি।’

‘তাহলে সেই বিকেল থেকে ওভাবে দরজা বন্ধ করে শুয়ে আছো কেন?’

মাথাটা একটু ধরেছিল।’

‘মাথা ধরলে আজকাল কান্নাকাটি করো তুমি?’

‘আমি কেঁদেছি তোমাকে কে বলল?’

‘বলতে হবে কেন? তোমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে।’

‘আমাকে দেখেই বোঝা যাচ্ছে আমি কান্নাকাটি করেছি?’

‘হুম।’

‘কীভাবে?’

‘তোমাকে খুব স্নিগ্ধ লাগছে। বাচ্চা বাচ্চা লাগছে। মনে হচ্ছে তোমার বয়স কমে গেছে।’

‘কাঁদলে স্নিগ্ধ লাগে?’

‘হুম, লাগে। সুন্দরও লাগে। অনেকক্ষণ কাঁদার পর মন খুব হালকা হয়ে যায়তো, তখন তার প্রভাব পড়ে শরীরেও।

সেলিনা কিছু একটা বলতে গিয়েও পারল না। সে ভেবেছিল দিপুর বিষয়টি নিয়ে বাড়িতে একটা তুলকালাম বাঁধাবে সে, কিন্তু সেটি আর হলো না। মুনিয়া কেমন কেমন করে যেন তার বুক ভার কষ্টটা হাওয়ায় মিলিয়ে দিল। উত্তপ্ত পরিস্থিতিটা শান্ত করে ফেলল নিমেষেই। কিন্তু এই যে মুনিয়ার সবকিছু এত সহজ, স্বাভাবিক ভঙ্গিতে বশ করে ফেলা, এই বিষয়টিই সে নিতে পারে না। নিজেকে খুব তুচ্ছ মনে হয় তার। খুব অকিঞ্চিৎকর মনে হয়। মনে হয় সবখানে সবচেয়ে সরবে নিজের উপস্থিতির সর্বোচ্চ জানান দেয়ার চেষ্টা করেও যেন কোথাও সে নেই। অথচ সবচেয়ে নীরবে, সবচেয়ে সাধারণ হয়ে থাকা মুনিয়া যেন সবখানে রয়ে যায় সবচেয়ে বেশি তীব্র হয়ে।

.

রাতে খাবার টেবিলে অনেকদিন পর সবাইকে পাওয়া গেল। আশফাক এ বাড়ির সবচেয়ে বড় ছেলে হলেও দায়িত্বের জায়গা থেকে সবচেয়ে ছোট জায়গাটাই যেন তার। অসুস্থ স্ত্রী হাফসা, বিশ্ববিদ্যালয় পড়ুয়া ছোট মেয়ে নাদিয়া আর বিয়ে দিয়ে দেয়া বড় মেয়ে নাবিলার সকল দায়ভার ভুলে সে নিশ্চিন্তে যেখানে ইচ্ছে উধাও হয়ে যেতে পারে। আজ বহুদিন পরে তাকে খাবার টেবিলে পাওয়া গেল। তার স্ত্রী হাফসার শরীরটা খানিক ভালো আজ। ফলে আজ আর তার ঘরে খাবার পাঠানো হয়নি। নাদিয়া তার মাকে ধরে নিয়ে এসেছে।

খাবার টেবিলে এসে আফজাল আহমেদের মন ভালো হয়ে গেল। বহুদিন পর টেবিলের চারপাশের সবগুলো চেয়ারই যেন আলো ছড়াচ্ছে। তিনি ঝলমলে গলায় বললেন, ‘রুবেলটা কী চিটাগং থেকে আর ফিরবে না?’

রুবেল তার সেজো ছেলে। সে এখনো বিয়ে-শাদি করেনি। করবে বলে মনেও হচ্ছে না। চট্টগ্রাম শিপইয়ার্ড থেকে জাহাজের পুরনো মালামাল, আসবাবপত্র এনে সে বিক্রি করে। এই পুরনো মালামাল বিক্রির একটা দোকানও তার রয়েছে। পড়াশোনায় খুব একটা আগ্রহ ছিল না বলে রুবেলের এই ব্যবসাপাতি নিয়ে কখনো কোন অভিযোগও করেননি আফজাল আহমেদ। ব্যবসায় তার কী লাভ-লোকসান হচ্ছে, তা নিয়েও কখনো মাথা ঘামান নি। তবে আজকাল যে একটু আধটু দুশ্চিন্তা হয় না আফজাল আহমেদের, তা নয়। রুবেলের বয়সতো কম হয়নি। বোধহয় চল্লিশও পেরিয়ে গেছে। এই বয়সেও যদি বিয়ে-শাদি করে থিতু না হয়, তাহলে সেটি দুশ্চিন্তারই।

জাফর বলল, ‘ও তো ফোনই ধরে না বাবা।’

‘সে তো আমাদেরটাও ধরে না! মানুষ যদি পরিবারের প্রতিই রেসপন্সিবিলিটি ফিল না করে, তাহলে আর তার থাকে কী?’ কথাটা বলতে বলতে তিনি আড় চোখে তার বড় ছেলে আশফাকের দিকে তাকালেন। আশফাক খালি প্লেট সামনে নিয়ে চুপচাপ বসে আছেন। এখনো টেবিলে খাবার দেয়া হয়নি। মুনিয়া আর সেলিনাকেও কোথাও দেখা যাচ্ছে না। তবে তাদের চেয়ারের সামনে টেবিলে খালি প্লেট রাখা। তার মানে তারা আশপাশেই কোথাও আছে। কাজের মেয়ে দুটো খুবই ব্যস্ত। আজ বাড়িতে কোনো বিশেষ দিন নাকি? আফজাল আহমেদ মনে করার চেষ্টা করেও পারলেন না। তিনি আশফাককে লক্ষ্য করে বললেন, ‘আর তোর কী খবর? আজ এতদিন পর হঠাৎ কোথা থেকে উদয় হলি তুই? তাও এই ভর সন্ধ্যাবেলা?’

আশফাক অবশ্য জবাব দিলেন না। তার হয়ে উত্তর দিল নাদিয়া। সে ফিক করে হেসে বলল, ‘এখন ভর সন্ধ্যা দাদাজান? রাত প্রায় এগারোটা বাজে।’

‘সেটা আমাদের কাছে। ওর কাছেতো নয়। ওর কাছে এখন ভর সন্ধ্যাই। রাত একটা দুটার আগেতো তাকে কখনো বাড়ি ফিরতে দেখিনি।’

‘আজ কেন ফিরেছে জানো?’

‘কেন?’

এই মুহূর্তে ঋদ্ধি ঘরে ঢুকল। তার হাতে বড়োসড়ো একটা ছবির ফ্রেম। ফ্রেমটা ওল্টানো বলে ফ্রেমে বাঁধানো ছবিটা দেখা যাচ্ছে না। সে আড়াআড়িভাবে ছবিটা তার বুকের কাছে ধরে রেখেছে। ঋদ্ধির মুখ গম্ভীর। এই গাম্ভীর্য ধরে রাখতে অবশ্য তাকে পরিশ্রম করতে হয়েছে। সে আফজাল আহমেদের সামনে এসে দাঁড়িয়ে বলল, ‘তুমি কী অন্ধকারে চোখে দেখতে পারো দাদাজান?’

আফজাল আহমেদ ভারি অবাক হলেন, ‘অন্ধকারে দেখব কী করে?’

‘মন দিয়ে।’

‘মন দিয়ে আবার দেখা যায় নাকিরে!’

‘হ্যাঁ যায়।’

‘কীভাবে?’

‘দাঁড়াও দেখাচ্ছি…।’ ঋদ্ধি আর কিছু বলার আগেই ঘরের ইলেক্ট্রিসিটি চলে গেল। আর সাথে সাথেই ঋদ্ধি ফিসফিস করে বলল, ‘এবার মন দিয়ে আমাদের দেখতে পাও দাদাজান?’

আফজাল আহমেদ কিছুই বুঝলেন না। অন্ধকারে হঠাৎ অদৃশ্য হয়ে যাওয়া মানুষগুলো যেন জেগে উঠল। সমবেত ফিসফিসানি, চাপা অস্থিরতা আর কতগুলো মানুষের এলোমেলো পায়ের শব্দে পুরো ঘরজুড়ে কেমন একটা অদ্ভুত ভৌতিক আবহ তৈরি হলো। আফজাল আহমেদ বিভ্রান্ত, দ্বিধাগ্রস্ত বোধ করছেন। তিনি তার পাশে বসা মছিদা বেগমের হাতটা শক্ত করে ধরলেন। তারপর নিচু গলায় বললেন ‘ঘটনা কী বলোতো? কী হয়েছে?’

মছিদা বেগম তার কথার জবাব দিলেন না। তবে তিনি তার হাতের মুঠোয় শক্ত করে আফজাল আহমেদের হাতখানা নিয়ে নিলেন। আফজাল আহমেদ আরো কিছু বলতে যাবেন, ঠিক সেই মুহূর্তে লাল-নীল আলোর ঝলকে রঙিন হয়ে উঠল ঘর। এইটুকু ঘরের ভেতরও আঁতশবাজির মতো কী যেন একটা ছড়িয়ে পড়তে লাগল। তারপর একসাথে জ্বলে উঠল সবগুলো আলো। ঝলমলে ঝাঁজালো সেই আলোয় নিজের চোখ মানিয়ে নিতে খানিক সময় লাগল আফজাল আহমেদের। কিন্তু তারপর সবকিছু ক্রমশই স্পষ্ট হয়ে উঠতে লাগল। ঝকঝকে পরিষ্কার ছবির মতো স্পষ্ট। আর তারপর আবার সব ঝাপসা হয়ে যেতে লাগল। জলে ভেজা আয়নার মতো ঝাপসা, অস্পষ্ট। কারণ আফজাল আহমেদের চোখভর্তিও জল। তিনি তার জল টলমল চোখে সেই ঝলমলে রঙিন উজ্জ্বল আলোয় দেখলেন ঘরের এক পাশের দেয়ালে বড় করে তার আর মছিদা বেগমের একটা ছবি টানানো। আর সেই ছবির সামনে সারি বেঁধে দাঁড়িয়ে আছে এ বাড়ির সবাই। আশফাক, জাফর, সেলিনা, দিপু, মুনিয়া, হাফসা, নাদিয়া, ঋদ্ধি! দরজার কাছে পর্দার আড়ালেও কী কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে? কে সে? রুবেল? ধবধবে সাদা পাঞ্জাবি পরা রুবেলকে এতদিন পর দেখে কেমন অচেনা লাগছে। মুখভর্তি দাড়ি তার। গায়ের রং কেমন মলিন হয়ে গেছে। চোখ বসে গেছে কোটরে। সে দাঁড়িয়ে আছে দরজার কাছে! আফজাল আহমেদের বুক কাঁপছে। ঋদ্ধি খানিক এগিয়ে এসে তার হাতে থাকা ছবির ফ্রেমটা আফজাল আহমেদের হাতে তুলে দিয়ে বলল, ‘দেখো।’

আফজাল আহমেদ দেখলেন। প্রায় তার কাছাকাছি চেহারার একজন মানুষ ছবিটাতে। হাতে আকা ছবি। ছবির নিচে ঋদ্ধির নাম লেখা আছে। ঋদ্ধি নিজে এঁকেছে এই ছবি! কতদিন লেগেছে তার এই ছবি আকতে? গত মাসখানেক ধরে সম্ভবত এ কারণেই স্কুল থেকে ফেরার পর খদ্ধির আর দেখা পাওয়া যেত না। আফজাল আহমেদের এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। তিনি এক হাতে ঋদ্ধিকে কাছে টেনে নিলেন। আজ তার জন্মদিন? কততম জন্মদিন? কিছুদিন আগেই না তিনি সত্তর পেরোলেন? গতবছর অবশ্য সবাই তার জন্মদিনের কথা ভুলেই গিয়েছিল। যদিও আফজাল আহমেদ নিজেও এখন আর এসব মনে রাখেন না। কিন্তু আজ এরা সব করেছে কী! তিনি কাঁদছেন। ঋদ্ধি তার হাতের উল্টো পিঠে দাদাজানের চোখ মুছিয়ে দিতে দিতে বলল, ‘দেখেছো, ছবিটার নিচে কী লেখা আছে?’

‘কী?’

‘এই যে দেখো, নিভে গেলে আলো, জ্বেলে দেই মন। কথাটা সুন্দর না?’

‘খুব সুন্দর। কে লিখেছে তুই?’

‘উহু। রাফি ভাইয়া।’

‘রাফি ভাইয়া কে?’

‘দিপু চাচ্চুর ইউনিভার্সিটির বন্ধু।’

‘দিপু চাচ্চুর বন্ধু তোর ভাইয়া হয়?’ পেছন থেকে টিপ্পনি কাটল নাদিয়া। ঘরভর্তি সবাই হা হা করে হেসে উঠল। আচমকা অপ্রস্তুত হয়ে যাওয়া ঋদ্ধি অভিমানী গলায় বলল, দিপু চাচ্চুর ফ্রেন্ড হলেও উনি রথিরও বড় ভাই। আর রথিতো আমার ক্লাসমেট। তাহলে আমার বন্ধুর বড় ভাইকে কি আমি আঙ্কেল ডাকব?’

গুরুতর প্রশ্ন। তার এই প্রশ্নে একমত হলেন আফজাল আহমেদ। তিনি গম্ভীর কণ্ঠে বললেন, ‘না না, সেটা কোনোভাবেই ঠিক হতো না। তা ছাড়া…।’

এ প্রসঙ্গে কথা হয়তো আরো বাড়ত। কিন্তু তার আগেই সবাইকে তাড়া দিল মুনিয়া, ‘আজ আমি আর সেলিনা রান্না করেছি বাবা। বেশি দেরি হয়ে গেলে খাবার ঠাণ্ডা হয়ে মজাটাই নষ্ট হয়ে যাবে। সেটাতো হতে দেয়া যাবে না। এখুনি খাওয়া শুরু করতে হবে। আমার ধারণা খাওয়ার পর সবাই বলবে আমাদের দু’জনের একটা রেস্টুরেন্ট দিয়ে দেয়া উচিত।’

‘এত বাজে হয়েছে খাবার?’ দরজার পাশ থেকে বলল রুবেল।

মুনিয়া বলল, ‘উহু। এতটাই ভালো হয়েছে।’

‘রেস্টুরেন্টের খাবার আবার ভালো হয় নাকি? সব রেস্টুরেন্টেতো বরং লেখা দেখি সম্পূর্ণ ঘরোয়া পরিবেশে ঘরোয়া খাবারের স্বাদ! হা হা হা।’ রুবেলের হাসির সাথে যোগ দিল বাদবাকিরাও।

বহুদিন পর অদ্ভুত সুন্দর একটা রাত কেটে গেল এ বাড়িতে। রাতে ঘুমাতে গিয়ে আফজাল আহমেদের মনে হলো এমন একটা আলো ঝলমলে পরিবারই তিনি চেয়েছিলেন। বড় মেয়ে লাইজুর জন্য অবশ্য মনটা কেমন করছিল। শেষ পর্যন্ত তার সাথে ভিডিও কলে কথা হলো সবার। আফজাল আহমেদ গায়ের ওপর পাতলা কাঁথাটা টেনে দিতে দিতে বললেন, ‘দেখলে? মেজো বৌমা কেমন জাদুর মতো সব করে ফেলল!’

‘কী করে ফেলল?’ অন্ধকারে নিষ্প্রাণ গলায় জবাব দিলেন মছিদা বেগম।

‘এই যে কেমন কেমন করে সবাইকে একসাথে করে ফেলল! অন্য কেউ হলে মোটেও পারত না। তখন এটা সেটা বলে অজুহাত দেখিয়ে সবাই কেটে পড়ত।’

‘হুম।

‘কী হলো তোমার? শরীর খারাপ লাগছে?’

‘নাহ।’

‘তাহলে?’

‘তাহলে কী?’

‘এভাবে কথা বলছ কেন?’

মুনিয়ার কোনো একটা সমস্যা চলছে।’

মুনিয়ার? মানে মেজো বৌমার?’

‘হ্যাঁ।’

‘কী সমস্যা?’

‘তাতো জানি না। আমার কেন যেন মনে হলো, সে পরিকল্পনা করেই এই আয়োজনটা করেছে।’

আফজাল আহমেদ হাসলেন, ‘পরিকল্পনা না করে কি এটা সম্ভব ছিল? কী যে বলো তুমি!’ যেন শিশুসুলভ কোনো কথা বলেছেন মছিদা বেগম, এমন ভঙ্গিতে হাসলেন তিনি। তারপর বললেন, ‘আগেভাগে পরিকল্পনা না করলে এতগুলো মানুষ কখনো এভাবে একসাথে হতো!’

‘উহু। তা না। অন্য কোনো বিষয় আছে। সে সবাইকে ব্যস্ত রাখতে চাইছে। কোনো একটা ব্যাপার থেকে সবার মনোযোগ সরিয়ে দিতে চাইছে।’

‘কী সব আবোল তাবোল বলছো তুমি? মাথা খারাপ হয়ে গেছে তোমার? ‘আমার মাথা খারাপ হয়নি। বুড়ো বয়সে এত বড় জন্মদিনের পার্টি দেখে তোমার মাথা খারাপ হয়ে গেছে। ‘

মছিদা বেগমের কথায় আফজাল আহমেদ খুবই বিরক্ত হলেন। তিনি গজগজ করতে করতে পাশ ফিরে শুলেন, ‘এই হলো তোমার এক সমস্যা। সেই প্রথম থেকেই মেয়েটাকে সহ্য করতে পারো না তুমি। এ বাড়ির জন্য কত কী করছে মেয়েটা! একা হাতে সবকিছু সামলাচ্ছে। এ বাড়ির কারো কোনোকিছু নিয়ে কোনো টেনশন আছে? তারপরও তাকে দুই চোখে দেখতে পারো না তুমি। সাথে যুক্ত হয়েছে সেলিনা। দুজন মিলে কী সব ভাবছো কে জানে!’

মছিদা বেগম বলল, ‘মেয়ে মানুষদের বোঝা পুরুষ মানুষের কাজ না। ওটা মেয়ে মানুষই ভালো পারে। আর তুমিতো জীবনে কখনোই কিছু বুঝলে না। এত বছর হয়ে গেল, ঋদ্ধির বয়স এখন চৌদ্দ, আরেকটা বাচ্চা নেয়া যেত না? নেয়নি। কেন নেয়নি সে? তার শরীর, ফিগার, সৌন্দর্য নষ্ট হয়ে যাবে বলে? সৌন্দর্য বড়, না বাচ্চাকাচ্চা বড়?’

‘ছি ছি ছি। এসব কী বলছো তুমি?’

‘ঠিকই বলছি। জাফরের দিকে তাকিয়ে দেখেছো কখনো? সন্তানের বাবা হয়েইতো তুমি খালাস। ছেলে-মেয়ের কোনো সমস্যার দিকে কখনো খেয়াল রেখেছো তুমি? জাফরের সাথে যে মুনিয়ার কোনো সম্পর্ক নাই, এটা টের পাও?’

আফজাল আহমেদের এবার বিরক্ত লাগছে। তিনি বললেন, ‘মাঝরাতে আর আজেবাজে বকো না প্লিজ। তারচেয়ে ঘুমাও।’

‘আমি আজেবাজে বকছি না। প্রায়ই মাঝরাতে মুনিয়া এক ছেলের সাথে ফোনে কথা বলে। সেই ছেলে বাড়ির সামনে এসে দাঁড়িয়ে থাকে।

‘কী বলছো তুমি মছিদা! ‘

‘হুম।’

‘এই কথা কে বলেছে তোমাকে? তুমি নিজ চোখে দেখেছো?’

‘নিজ চোখে দেখতে হবে কেন? যে দেখেছে, সেই আমাকে বলেছে।’

‘কে দেখেছে? তোমার গুণবতী কন্যা সেলিনা? সে তোমাকে বলেছে?’

মছিদা বেগম এবার আর জবাব দিলেন না। আফজাল আহমেদ বললেন, তুমি দয়া করে আর কখনো এসব কথা আমাকে বলবে না। আর যতদ্রুত সম্ভব সেলিনার একটা ব্যবস্থা করো।’

‘আমি কী ব্যবস্থা করব? মেয়ে কি একা আমার? তোমার কোনো দায়িত্ব নেই?’

‘আমিতো দায়িত্ব নিয়েই বিয়ে দিয়েছিলাম। কিন্তু সেই বিয়ে সে টেকাতে পারল?’

‘বিয়ে না টেকাতে পারার দোষ একা তার না। তুমি বাবা হয়ে কেবল মেয়ের দোষটাই দেখছো?’

‘আমি তোমাদের মতো জোর করে কারো দোষ-গুণ দেখি না। যেটা সত্যি, শুধু সেটাই দেখি।’

‘আহারে! তো এবার তোমার মতো একটা খাঁটি মাটির মানুষ দেখে মেয়ের বিয়ের ব্যবস্থা করো।’

‘আমি বললেইতো আর সে ঝট করে রাজি হয়ে যাবে না। এ বাড়িতে আমার কথা কেউ শোনে? কারো কাছে আমার কোনো গুরুত্ব আছে?’

‘কারো কাছে তোমার কোনো গুরুত্ব না থাকলে আজ রাতে হঠাৎ এতোকিছু কেন হলো? অন্য কোনো কারণ আছে?’

আফজাল আহমেদ আর কথা বাড়ালেন না। তিনি অসাধারণ এক অনুভূতিতে তিক্ত একপোঁচ অস্বস্তি নিয়ে ঘুমাতে গেলেন।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *