1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৪৪

৪৪

এই বাড়িটা কেমন ঘুম ঘুম।

সন্ধ্যাবেলা নাদিয়া যখন বাবার সাথে গেট পেরিয়ে ঢুকল, তখন বৃষ্টি নেমেছে। গেটের ভেতর থেকে অনেকদূর অবধি মসৃণ লাল ইটের সরু রাস্তা। রাস্তার দু ধারে মেহগনি আর দেবদারুর সারি। একটা পিলারের মাথায় ইলেক্ট্রিকের বাতি জ্বলছে। তার আলোয় মেহগনির কালচে সবুজ পাতাগুলো চকচক করছে। মাগরিবের আজানের সময়টাতে চারপাশ এমন শূন্য, নিঃসাঢ় আর ম্লান লাগতে কখনো দেখেনি সে। মিনিট দুয়েক হাঁটতেই ঘন গাছপালার ঝোপঝাড়ের ভেতর থেকে খানিকটা পুরনো ধাঁচের সাদা বাড়ির অবয়বটা উঁকি দিল। দোতলা বাড়ির বারান্দায় বাতি জ্বলছে। নিচতলায় ভূতুড়ে অন্ধকার। বাঁধানো আঙিনায় পা রাখতেই বেটেখাটো একটা লোক ছুটে এলো। মাথার পেছনে অল্প চুল। নাকের নিচে ঘন সাদা গোঁফ। মুখভর্তি খোঁচা খোঁচা দাড়ির ভেতর থেকেও বিগলিত কিন্তু সৌম্য হাসিটা আলো ছড়াচ্ছে। আশফাক সেদিকে তাকিয়ে পরিচিতের ভঙ্গিতে বললেন, ‘স্যুটকেসগুলো দোতলায় নিয়ে যা তো তালেব। আর সুফিয়াকে বল নাদিয়ার ঘরটা ঠিক করে দিতে।’

.

তালেবের শব্দহীন হাসি এবার উচ্চকিত হলো। সে বলল, ‘সেই কথা আর বলতে হবে না স্যার। ম্যাডাম সবকিছুর ব্যবস্থা করে রেখেছেন।’

‘আফসানা চলে এসেছে!’ আশফাক যেন খানিক অবাক হলেন!

‘না স্যার। ম্যাডামের ফিরতে ফিরতে রাত হবে।’

নাদিয়া কিছুই বুঝতে পারছে না। সে দুপুরের দিকে বাবার সাথে তার কলেজ দেখতে এসেছে। কলেজটা দারুণ সুন্দর। এখানে এত সুন্দর একটা কলেজ থাকতে পারে, তার ধারণাতেই ছিল না। সবচেয়ে মজার ব্যাপার হলো, সে কলেজে ঢোকামাত্রই সবাই তাকে যেভাবে অভ্যর্থনা জানিয়েছে, তাতে হকচকিয়ে গিয়েছিল সে। কলেজে জহিরুল নামে এক ভদ্রলোক প্রশাসনিক পদে চাকরি করেন। তিনি নাদিয়াকে পুরো কলেজ ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে দেখালেন। আশফাকের পরপর দুটো ক্লাস ছিল। তিনি ক্লাস নিতে চলে গেলেন। তাতে অবশ্য নাদিয়ার কোনো সমস্যা হলো না।

জহিরুল প্রচণ্ড বিনয়ী এবং যত্নবান একজন মানুষ। তার বয়স বেশি না হলেও মাথায় চুল কম। এ কারণে বয়সের তুলনায় তাকে দেখতে খানিকটা ভারীই লাগে। তিনি পুরোটা সময় নাদিয়াকে নিয়ে শশব্যস্ত হয়ে রইলেন। তবে নাদিয়ার সম্পর্কে ভদ্রলোকের অতিরিক্ত কৌতূহল আর ব্যক্তিগত, পারিবারিক নানা প্রশ্নে খুবই বিরক্ত হলো নাদিয়া। যদিও ভদ্রতাবশত সেটা প্রকাশ করল না সে। তবে তার রুমে যেতেই নাদিয়াকে চমকে দিল জহিরুল। একগুচ্ছ দোলনচাঁপা উপহার দিল সে। সাথে নানা ধরনের উপহার। যেন এখানকার সবাই আগেভাগেই জানত যে নাদিয়া আসবে। আর এ কারণে আগে থেকেই প্রস্তত হয়েছিল তারা। কিন্তু নিজের প্রতি সবার এমন আলাদা যত্নের কারণ বুঝল না নাদিয়া। বিশেষ করে জহিরুল যেন দীর্ঘদিন থেকেই তার সম্পর্কে জানে। তার নানা কথাবার্তা, আচার-আচরণে তেমনই মনে হতে লাগল নাদিয়ার। বিষয়টাতে সে ভারি অবাক হলো। তবে মুখে সেটি প্রকাশ করল না।

.

আশফাকের ক্লাস শেষে জহিরুল তাদের দুজনকে সঙ্গে নিয়ে কলেজের আশপাশে নানা জায়গাই ঘুরিয়ে দেখাল। বিস্তৃত শালবনের কোল ঘেঁষে কী দারুণ জায়গা! ঘন শালবনের ভেতর দিয়ে পিচঢালা চওড়া রাস্তা। সেখান দিয়ে সারাক্ষণই সাঁই সাঁই করে ঢাকার দিকে গাড়ি যায়। তবে আশফাক এখন যেই বাড়িটাতে নাদিয়াকে নিয়ে এসেছেন, সেই বাড়িটা অনেক ভেতরে। সুনসান নীরবতায় অন্ধকার বিচ্ছিন্ন এক বাড়ি। আশপাশে যেন ঘন বন ছাড়া আর কিছুই নেই। নাদিয়া এর আগে কখনো এখানে আসেনি। ফলে প্রথমবার বলেই কী না কে জানে, একটু বেশিই থমথমে লাগছে চারপাশ। যেন বিচ্ছিন্ন, নিঃসঙ্গ কোনো বন্দিশালা। তবে তার বাবা যে এখানে নিয়মিতই আসেন এবং এখানে যে তার বেশ একটা কর্তৃত্ব রয়েছে তা খুব সহজেই বোঝা যাচ্ছে।

দোতলার বারান্দায় এসে অবশ্য নাদিয়ার মন ভালো হয়ে গেল। বাড়ির দখিন দিকের সীমানাপ্রাচীর ঘেঁষেই বিস্তৃত বিল। সেই বিলে যেন এখনো সন্ধ্যে নামেনি। কেমন ম্লান সোনারঙা এক আলো ছড়িয়ে আছে বিলজুড়ে। নাদিয়া ঘোরগ্রস্তের মতন সেদিকে তাকিয়ে রইলো। কী আশ্চর্য, একই সন্ধ্যা অথচ এ বাড়ির আলোটুকু যেন অভিমান করে সব ওখানে গিয়ে ছড়িয়ে পড়েছে। এখানে তাই অন্ধকার, ওখানে আলো। সেই আলোয় নাদিয়ার মন কেমন করে উঠল। ইশ্, ঠিক এই জায়গাটায়, ঠিক এই মুহূর্তে শফিক যদি থাকত!

আচমকা ঝড়ের মতো দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এলো তার বুক চিরে। সে কি তাহলে এই পুরোটা সময় আনমনে শফিকের কথাই ভাবছিল? না হলে এই মুহূর্তটাতে এমন করে শফিকের কথাই কেন মনে হবে তার?’

সে শফিকের নম্বরটাতে আরো একবার ফোন করল। এখানে ফোনের নেটওয়ার্ক খুবই খারাপ। তবে তাতেও লাভ ক্ষতি কিছু হলো না। কারণ শফিকের নম্বর এখনো বন্ধ।

এখানে একটা শীতের আমেজ। বৃষ্টি হচ্ছে। হয়তো মৌসুমের শেষ বৃষ্টি। এই বৃষ্টিই জাঁকিয়ে শীত নিয়ে আসবে। বৃষ্টির তোড় বাড়ছে। তেলতেলে মসৃণ মোজাইকের চওড়া বারান্দার মেঝেতে যেন ক্রমশই জেগে উঠছে জলের আয়না। কম ভোল্টের বৈদ্যুতিক বাল্বের হলদেটে আলোয় সেই আয়নাখানা হঠাৎ যেন কেঁপে উঠল। নাদিয়া ঝট করে ঘাড় ঘুরিয়ে তাকাল। তার আচমকা মনে হলো এই বারান্দাটা ঝলমলে আলোয় ভরে গেছে। সেই আলোয় ধবধবে সাদা শাড়ি পরা কী সুন্দর একটা মেয়ে তার সামনে দাঁড়িয়ে আছে। সাদা শাড়িতে কাউকে এত সুন্দর লাগতে পারে, নাদিয়ার তা জানা ছিল না। নাদিয়ার চেয়ে বয়সে কত বড় হবে এই মানুষটি? নাদিয়া আন্দাজ করতে পারল না। তবে মানুষটা আশ্চর্য মমতাময় কণ্ঠে তাকে ডাকল, ‘ঠাণ্ডা লেগে যাবে কিন্তু নাদিয়া!

নাদিয়া জবাব দিতে পারল না। এই অচেনা অজানা মানুষটি তাকে চমকে দিয়ে এমন চেনা মানুষের মতো ডাকবে, এটা সে আশা করেনি। মানুষটি আবার বলল, ‘তোমার ঘর পছন্দ হয়েছে?’

নাদিয়া এবারও জবাব দিল না। তার আচমকা ভয় লাগতে লাগল। এই মানুষটাকে তার ভয় লাগার কথা না, বরং ভালো লাগার কথা। এমন মানুষকে কারো খারাপ লাগে না। কিন্তু কোনো এক রহস্যময় কারণে এই মানুষটিকে তার ভয় লাগছে। খুব ভয়!

মানুষটা আবারো ডাকল, ‘নাদিয়া?’

‘হুম।’

‘নাবিলা ঢাকায় নেই?’

নাদিয়ার মনে হলো এই প্রশ্নের উত্তরও তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মানুষটির অজানা নয়। তারপরও প্রশ্নটি সে কেন করল কে জানে!

‘তোমার মা এখন কেমন আছেন? ভালো?’

নাদিয়া এই প্রশ্নেরও জবাব দিল না। সে খোলা দরজা দিয়ে তার ঘরে ঢুকল। মানুষটি তখনো পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। নাদিয়া আড়চোখে একবার ফিরে তাকাল। আর তখুনি মানুষটা বলল, ‘তুমি সম্ভবত আমাকে চিনতে পারোনি। আমি আফসানা।‘

.

সেই রাতে আফসানার সাথে নাদিয়ার অনেক কথা হলো, গল্প হলো। এই মেয়ের কথা আড়ালে-আবডালে নানা সময়ে শুনেছে নাদিয়া। বাড়িতে মাঝেমাঝেই ফিসফাস হতো। কিন্তু তারপরও কেউ তাকে কখনো স্পষ্ট করে কিছু বলেনি। বরং সবসময়ই যেন বিষয়টা গোপন রাখতে চেয়েছিল সবাই। ফলে আফসানা তার কাছে এক প্রগাঢ় রহস্য হয়েই ছিল। কিন্তু আজ এভাবে আফসানার সাথে তার দেখা হয়ে যাবে, এটা সে ভাবেনি। তবে সন্ধ্যায় ভয় পেয়ে গিয়েছিল নাদিয়া। কেমন রহস্যময় জনবিচ্ছিন্ন এক বাড়ি! সেই বাড়িতে সন্ধ্যার অন্ধকারে অমন রহস্যময় এক নারী হঠাৎই একটা ভয় আগলে ধরেছিল তাকে। তবে সেই ভয়টা এখন মিলিয়ে গেছে। আফসানার সাথে কথা বলতে গিয়ে মনে হয়েছে সে খুবই সহজ, স্নেহময়ী এক মানুষ। কী অবলীলায়, কত সহজে সে নাদিয়াকে আপন করে নিলো, নাদিয়া যেন তা টেরই পেল না। বরং গত কয়েকদিনে তার বুকের ভেতর জমে থাকা থমথমে মেঘ সরে গিয়ে ধীরে ধীরে যেন রোদ ঝলমলে আকাশ উঁকি দিতে শুরু করল।

আফসানা বলল, ‘তোমার কবিতা ভালো লাগে?’

নাদিয়া ঠোঁট উল্টে বলল, ‘একদম না।’

আফসানা মন খারাপ করার ভঙ্গিতে বলল, ‘তাহলেতো আমাকেও ভালো

লাগবে না।

‘কেন?’

‘কারণ আমি যে কবিতা লিখি।’

নাদিয়া হাসল, ‘তাতে কী! আপনাকেতো ভালো লাগে।‘

আফসানা বলল, ‘তাহলে আরো বেশি ভালো লাগত। আমি কত কী প্ল্যান করে রেখেছিলাম, জানো?’

‘কী?’

‘কাল কিংবা পরশু পূর্ণিমা। এখানে পূর্ণিমা যে কী অদ্ভুত সুন্দর, তুমি ভাবতেও পারবে না। আমাদের ছাদে উঠে দাঁড়ালে চারপাশটাকে অন্য এক জগৎ বলে মনে হয়। আমার খুব ইচ্ছে ছিল, তোমাকে সারারাত কবিতা শোনাব।’

নাদিয়া মৃদু হেসে বলল, ‘কবিতা ভালো লাগেনা বলে যে কখনো শুনিনি, তা কিন্তু না। আর তা ছাড়া ও রকম একটা পরিবেশে হয়তো সবই ভালো লাগবে।’

‘আমাকে খুশি করার জন্য বলছো?’

‘একদম না। সত্যি সত্যি বলছি।’

আফসানা আলতো করে নাদিয়ার হাত ছুঁয়ে বলল, তুমি এত ভালো কেন নাদিয়া? আমার এ কদিন খুব মন খারাপ ছিল। কিন্তু তুমি আসার পর এইটুকু সময়েই আমার মন ভালো হয়ে গেছে।’

নাদিয়ার মনে হলো তার ক্ষেত্রেও ঘটনা একই। এই মেয়েটির সাথে তার বাবার কী সম্পর্ক সেটি নিয়ে সে খুব একটা চিন্তিত নয়। বরং তার মনে হয় একটা সময় পর প্রতিটি মানুষেরই হয়তো নিজের ভালো থাকার জন্য নিজেদের মতো আলাদা একটা জগৎ দরকার হয়। সেই জগৎ যদি অন্যের ক্ষতির কারণ না হয়, তাতে তার আপত্তি নেই। সে জানে বাবার সাথে মায়ের স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্কটা আর নেই বহুদিন। তারপরও আপাতদৃষ্টিতে বাবাকে যতটা দায়িত্বহীন মনে হয়, ততটা দায়িত্বহীন তিনি নন। বরং নাদিয়া টের পায় মায়ের অসুস্থতার চিকিৎসা, তাদের দুই বোনের পড়াশোনা, নাবিলার বিয়ে থেকে শুরু করে সবকিছুতেই বাবা তার সর্বোচ্চটা দিয়েই চেষ্টা করেছেন। কিন্তু তার সামর্থ্যের সীমাবদ্ধতা যেমন রয়েছে, তেমনি তিনি খুব অন্তর্মুখীও। ফলে নিজেকে যখন প্রকাশ করার দরকার হয়ে পড়ে, যখন নিজের কর্তৃত্ব জাহির করা অনিবার্য হয়ে ওঠে, তখনো তিনি সেটি করতে পারেন না। বরং নিশ্চুপ, নিষ্প্রভ হয়ে থাকেন। আর এ কারণেই তার চারপাশের মানুষের জন্য তিনি যা করেন তার বেশির ভাগই রয়ে যায় দৃষ্টির আড়ালে।

নাদিয়ার ধারণা বেশির ভাগ মানুষই তার বাবার বাইরের দিকটাই কেবল দেখে। তারা তার ভেতরের মানুষটাকে বোঝার চেষ্টা কখনো করে না। কিন্তু সে বাবাকে খুব কাছ থেকেই দেখার, বোঝার চেষ্টা করেছে। আর করেছে বলেই নাদিয়া জানে, তার বাবা দায়িত্বজ্ঞানহীন কোনো মানুষ নয়। বরং খুবই সংবেদনশীল একজন মানুষ। ফলে তার ভালো থাকা-মন্দ থাকায় অনর্থক হস্তক্ষেপ করতে চায়নি নাদিয়া। যদিও নাদিয়া এখনো পুরোপুরি স্পষ্ট নয় যে এই মেয়েটির সাথে তার বাবার প্রকৃত সম্পর্কটা আসলে কী? বাবাকে এটি জিজ্ঞেসও করতে পারবে না সে। এমনকি ফিরে গিয়ে এ নিয়ে কাউকে কিছু বলতেও চায় না নাদিয়া। মাত্র দুটো দিন সে এখানে কাটাবে বলে এসেছে। এই দুটো দিন যদি খানিক ভালো কাটে। যদি বুকের ভেতর জমে থাকা অসহনীয় যন্ত্রণার মেঘ খানিকটা হলেও উধাও হয়, তাতেই সে খুশি। তবে এখনো অবধি মেয়েটিকে তার দারুণ পছন্দ হয়েছে। এখানে এসে এত চমৎকার একজন মানুষের সঙ্গ পাবে এটা ভাবেনি আফসানা।

নাদিয়া বলল, ‘আমারও। আমি খুব মন খারাপ নিয়ে এখানে এসেছিলাম, কিন্তু আপনি আমার মন ভালো করে দিয়েছেন।’

সারাদিন ছোটাছুটি শেষে ক্লান্ত শরীরেও দীর্ঘ গল্প-আড্ডা হলো আফসানা আর নাদিয়ার। এই পুরোটা সময় অবশ্য আশফাক সেখানে থাকলেন না। তিনি চলে গেলেন তার কলেজ কোয়ার্টারের বাসায়। প্রায় শেষ রাতের দিকে ঘুমাতে গেল নাদিয়া। অনেকদিন পর যেন ভালো ঘুম হলে; তার। কিছুটা সময়ের জন্য হলেও বুকে জমা স্যাঁতসেঁতে আঁধারটা দূর হলো। সকালে বেলা করে ঘুম ভাঙল তার। গতকাল সারাদিনে হাফসা অসংখ্যবার ফোন করেছে তাকে। কিন্তু মায়ের সাথে বেশিক্ষণ কথা বলেনি সে। এখানে ভালো আছে, দুদিন বাদে ফিরে আসবে, এটুকু বলেই ফোন রেখে দিয়েছিল নাদিয়া। তারপর বন্ধই করে রেখেছিল ফোন। যদিও মা দুশ্চিন্তা করবে ভেবে মাঝখানে দুয়েকবার কথাও বলেছে। তবে সবচেয়ে বেশি যন্ত্রণা করেছে মুকিত। সে মেসেজের পর মেসেজ পাঠিয়ে গেছে। অসংখ্য প্ৰশ্ন তার। নাদিয়ার কাছে এখানকার ঠিকানাও চাইছে, যাতে চলে আসতে পারে সে।

নাদিয়া অবশ্য যতটা সম্ভব শান্ত থাকার চেষ্টা করল। ঘুম থেকে উঠে মাকে

ফোন করল। হাফসা বেগম কোনো এক অজানা আশঙ্কায় জড়সড় হয়ে আছেন। তিনি প্রায় কাঁদো কাঁদো স্বরে বললেন, ‘তুই এক্ষুনি চলে আয় মা। এক্ষুনি চলে আয়।’

‘আমিতো বললাম, দুটা দিন থেকে আমি চলে আসব মা। এত অস্থির হওয়ারতো কিছু নেই!‘

হাফসা প্রায় আকুতির স্বরে বললেন, ‘আমি জানি না কেন, আমার খুব অস্থির লাগছে, খুব ভয় হচ্ছে মা। তুই চলে আয়। তুই এক্ষুনি চলে আয়।’

‘এখন আমি কীভাবে আসব?’

‘আমি মুকিতকে পাঠাচ্ছি, মুকিত গিয়ে তোকে নিয়ে আসুক। সেও তোর জন্য খুব অস্থির হয়ে আছে। সকাল থেকে এসে বাসায় বসে আছে।’

নাদিয়া জানে না কেন, কথাটা শোনার সাথে সাথে তার প্রচণ্ড রাগ লেগে গেল। সে চাপা স্বরে বলল, ‘আমি এখন ফোন রাখছি মা। পরে আবার ফোন দেব। অযথা টেনশন করো না।’

সে মায়ের ফোন রেখে দেখে মুকিত এর মধ্যেই তাকে বারবার ফোন করেছে, শুধু ফোনই করেছে, তা-ই না। মেসেজও পাঠিয়েছে একের পর এক। সে মুকিতকে ফোন করল, ‘কী হয়েছে?’

মুকিত হড়বড় করে বলতে লাগল, ‘তুমি কোথায়? তোমার ফোন অফ কেন? আমি সারারাত একটুও ঘুমাতে পারিনি জানো? সকাল থেকে তোমাদের বাড়িতে এসে বসে আছি।’

নাদিয়া শান্ত গলায় বলল, ‘এত উত্তেজিত হওয়ার কিছু নেই। আপনি শান্ত হোন।’

শান্ত হবো মানে? তুমি কোথায় আছো, কীভাবে আছো, আমি কিছুই জানি না! ফোনও ধরছো না তুমি।’

নাদিয়া গম্ভীর ভঙ্গিতে বলল, ‘আমি এখানে আমার বাবার সাথে এসেছি। এটাই কি যথেষ্ট না?’

নাদিয়ার কথার ধরনে মুকিত দমে গেল। সে মিন মিন করে বলল, ‘আমার মা, বড় আপা তোমার সাথে খুব কথা বলতে চাইছিলেন।’

‘আমি কাল বা পরশু ঢাকায় আসবো। তারপর যে যত ইচ্ছা আমার সাথে কথা বলতে পারবে। এখন রাখি।’

নাদিয়া ফোন রাখার আগে মুকিত অবশ্য কাঁদো কাঁদো গলায় বলল, তুমি আমাকে ভালোবাসোতো নাদিয়া? আমাকে তোমার অপছন্দ নাতো?’

নাদিয়া থমথমে গলায় বলল, ‘কদিন পরেইতো আমি আপনাকে বিয়ে করছি, তাই না?’

‘হুম!’

‘তাহলে আবার কী!

‘নাহ, কিছু না। কিন্তু আমার কেন যেন মনে হচ্ছে কোনো একটা সমস্যা আছে।’

নাদিয়া বিরক্ত গলায় বলল, ‘কোনো সমস্যা নেই। সব ঠিক আছে। ঢাকায় ফিরলেই বিয়ে হবে। আমি কারো সাথে পালিয়ে যাচ্ছি না। আপনি শুধু শুধু দুশ্চিন্তা করবেন না, প্লিজ।’

‘ঠিক তো?’

‘হুম।’

‘তুমি তাড়াতাড়ি চলে আসো। তাড়াতাড়ি। আই ক্যান্ট ওয়েট অ্যানি মোর নাদিয়া।’

নাদিয়া আর কথা বাড়াল না। সে ফোন রেখে দিল। তার খুবই বিরক্ত লাগছে। তবে সেই বিরক্তিটা বেশিক্ষণ রইলো না। পুরো বিকেলটা অসাধরণ ভালো লাগায় আচ্ছন্ন হয়ে রইলো সে। তার বাবা, আফসানা আর সে মিলে খানিক দূরের নদীতে নৌকা করে ঘুরতে গেল। পায়ে হেঁটে হেঁটে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে আবার বাড়ি ফিরল। আফসানার সাথে কত কত গল্প যে হলো তার! নাদিয়ার হঠাৎ মনে হলো, যদি এখানের কোনো একটা স্কুলে সেও একটা চাকরি-বাকরি কিছু পেয়ে যেত, তাহলে এখানে থেকে যাওয়াটাও মন্দ কিছু নয়।

সন্ধ্যায় বাড়ি ফিরে অবশ্য দেখা গেল বাড়িতে লোকজন এসেছে। সবাই আফসানার সাথে দেখা করতেই এসেছে। হয়তো কলেজের কোনো বিষয়। পরদিন দুপুরে ঢাকায় চলে যাবে নাদিয়া। ফলে রাতে আফসানার সাথে দীর্ঘ আড্ডা হলো তার। সমস্যা হচ্ছে পরদিন দুপুরে নাদিয়া ঢাকায় যেতে পারল না। আশফাককে কী এক জরুরি কাজে যেতে হবে ময়মনসিংহ। সেদিন আর ফিরতে পারবেন না তিনি। তাকে ফিরতে হবে পরদিন। ফলে ঢাকায় ফেরার জন্য পরদিন পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে নাদিয়াকে। নাদিয়ার অবশ্য এতে ভালোই লাগল। আরো একটা দিন সে এখানে থেকে যেতে পারবে।

পরদিন দুপুর নাগাদ আশফাক চলে গেলেন ময়মনসিংহ। রাতে ভরা পূর্ণিমা। সেই পূর্ণিমার রাতে ধবল জোছনায় স্নান করা অন্য এক জগতের সৌন্দর্য দেখার অপেক্ষায় নাদিয়া। কিন্তু বিকেল থেকেই আকাশ কালো করে বৃষ্টি শুরু হলো। সাথে তুমুল ঝড়। নাদিয়ার অবশ্য সেই ঝড়ও ভালো লাগছে। ঝড়-বৃষ্টিও যে এমন অপরূপ হতে পারে, তা সে এখানে না এলে কখনোই বুঝতে পারত না। মুগ্ধ হয়ে জানালার সামনে দাঁড়িয়ে রইলো। মনে হচ্ছিল, এই ঝড়, এই বৃষ্টি আর না থামুক। কিন্তু নাদিয়া জানে না সন্ধ্যার আকাশ যে প্রবল মেঘে ঢেকে গেছে, যে পূর্ণিমার ঝলমলে চাঁদ লুকিয়ে গেছে কালো মেঘের দানবীয় চেহারার আড়ালে, সেই মেঘ নিয়ে আসছে এক ভয়াল কাল রাত্রিও। সেই ভয়াল রাত্রি অবর্ণনীয় এক নৃশংসতা নিয়ে আসছে তার জীবনে।

কে জানে সেই একই রাত্রি এখান থেকে বহু বহু দূরের এক পাহাড় চূড়ায় স্বপ্নাবিষ্ট হয়ে থাকা সুমি আর দিপুর জন্যও প্রলয়ঙ্করী এক ঝড় নিয়ে এলো কিনা!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *