1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৪২

৪২

দিপু প্রথম মাসের বেতন পেয়েছে দিন তিনেক হলো। সে বেতন পেয়েই আগ্রহ নিয়ে সুমিকে ফোন করেছিল। সুমি ফোন ধরে বলল, ‘কী হয়েছে?’

দিপু বলল, ‘আমি বেতন পেয়েছি।

‘তো?’

দিপু থতমত খাওয়া ভঙ্গিতে বলল, আগামী বৃহস্পতিবার পূর্ণিমা। পরের দুই দিন আমার অফিসও বন্ধ।’

‘তো?’

দিপু আর কথা বলল না। সে চুপচাপ ফোন কানে চেপে ধরে বসে রইলো। সুমি বলল, ‘কী হলো?’

দিপু বলল, ‘কিছু না।’

‘মন খারাপ হয়েছে?’

দিপু কথা বলল না। সুমি বলল, ‘আমার শরীরটা হঠাৎ খুব খারাপ করেছে। শ্বাসকষ্টটা প্রচণ্ড বেড়েছে। মনে হচ্ছে আমি দম বন্ধ হয়ে মারা যাব।’

সুমির কথা শুনে দিপুর উদ্বিগ্ন হওয়া উচিত। কিন্তু সে মোটেই উদ্বিগ্ন হলো না। তার বরং অভিমান হচ্ছে। যেন সুমি ইচ্ছে করেই অসুস্থতার কথা বলছে। এবারের পূর্ণিমাটাও সে কৌশলে এড়িয়ে যেতে চাইছে। সুমি অস্ফুটে বলল, ‘আমি তোমার সাথে রাতে কথা বলি?’

দিপু ম্লান গলায় বলল, ‘আচ্ছা।’ বলেই ফোনটা রেখে দিল সে। মনে মনে কত কত পরিকল্পনা করে রেখেছিল দিপু! প্রথম মাসের বেতনটা পেয়েই সে সুমিকে নিয়ে জোছনায় নীলগিরি দেখতে যাবে। সুমি তাকে কথাও দিয়েছিল, এবারের পূর্ণিমায় তারা নীলগিরি যাবে। সারারাত পাহাড়ের ওপর জোছনা দেখবে। পরদিন রাতের বাসে আবার ঢাকায় রওয়ানা করবে। ভোরবেলা এসে পৌঁছাবে ঢাকায়।

যদিও এই যাওয়া নিয়ে কম জল ঘোলা হয়নি। একগাদা শর্ত দিয়ে অবশেষে রাজি হয়েছিল সুমি। তার বেশির ভাগই পছন্দ হয়নি দিপুর। কিন্তু তারপরও সবই মেনে নিয়েছিল সে। অথচ আজ এসে সুমি বলছে তার শরীর খারাপ। দিপুর কেন যেনো মনে হচ্ছে সুমি আসলে যেতে চাইছে না। আর এ কারণেই এখন ইচ্ছে করেই শরীর খারাপের কথা বলছে। দিপুর ধারণা অবশ্য সত্য হলো না। সেদিন না হলেও পরদিন ফোন করল সুমি। তারপর গম্ভীর কণ্ঠে বলল, ‘আমরা না হয় পরের পূর্ণিমায় যাই?’

দিপু তার চেয়েও গম্ভীর গলায় বলল, ‘কোথায়?’

‘নীলগিরি।’

‘নীলগিরি কী দরকার?’

‘এতদিন পর এই কথা?’ সুমি মুখ টিপে হাসল। ‘তাহলে প্ল্যান বাদ?’

‘অবশ্যই বাদ।’

‘আমরা তাহলে যাচ্ছি না?’

‘নাহ।’

‘কেন?’

‘এমনি।’

‘আচ্ছা। তাহলে অবশ্য ভালোই হলো। সামনে আমার একটা লম্বা ছুটি। আমি বাবাকে বলি আমাকে এসে নিয়ে যেতে। কতদিন বাড়ি যাওয়া হয় না।’

দিপু মৃদু স্বরে বলল, ‘আচ্ছা।’ তারপর সুমিকে আর কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ফোনটা কেটে দিল সে। তারপর অন্ধকার ঘরে চুপচাপ বসে রইলো। ভয়ানক রাগ হচ্ছে তার। কিন্তু এই রাগটা সে প্রকাশও করতে পারছে না। সুমি যে এবারও এমন করবে, এটা দিপু ভাবেনি। তবে দিপুর ভাবনার বাইরের ঘটনা ঘটল খানিক বাদেই। সে তার ফেসবুক মেসেঞ্জার খুলে অবাক হয়ে গেল। সুমি তাকে মেসেজ করেছে। মেসেজে বান্দরবান যাওয়ার বাসের দুটো টিকিট। সেই টিকটের দিকে হতভম্ব চোখে তাকিয়ে রইলো দিপু। তারপর সুমিকে ফোন করল, ‘এটা কী?’

সুমি দুষ্টুমির ভঙ্গিতে বলল, ‘কী?’

‘এই যে বাসের টিকিট?’

‘হুম।’

‘টিকিট কেন?’

‘আমরা ভরা পূর্ণিমায় নীলগিরি দেখতে যাচ্ছি তাই।’

‘তুমি টিকিট পেলে কই?

সুমি হাসল, ‘আমাদের ব্যাচের আফরোজার কাজিনের ট্রাভেল এজেন্সি আছে। তোমাকে চমকে দেব বলে তাকে দিয়ে আগেই ম্যানেজ করে রেখেছিলাম।’

দিপুর অকস্মাৎ মন ভালো হয়ে গেল। খানিক আগের বুকভার কষ্ট, রাগ, অভিমান মুহূর্তেই যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেল। সে গাঢ় কণ্ঠে বলল, ‘তোমার যে শরীর খারাপ?’

সুমি বলল, ‘আশা করি এর মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। তা ছাড়া আমরাতো একটা মাত্র রাত থাকব। তারপরতো চলেই আসব।

দিপুর এখন সুমির জন্য অদ্ভুত এক ধরনের মায়া হচ্ছে। সে জানে, মেয়েটা তাকে কী অসম্ভব ভালোবাসে, কিন্তু তারপরও মাঝে মাঝে এমন সব কাণ্ডকারখানা করে যে দিপু ঠিক বুঝে উঠতে পারে না সুমিকে। আর না বুঝে তখন চোটপাট করলেও পরে ভীষণ অপরাধবোধ হয়। যেমন এই মুহূর্তে হচ্ছে। দিপুর এখন খুব ইচ্ছে হচ্ছে সুমিকে শক্ত করে জড়িয়ে ধরে কোথাও বসে থাকতে। যেখানে কোনো শব্দ নেই, কষ্ট নেই, কোলাহল নেই। কেবল পরস্পরের বুকের ভেতর পরস্পরের হৃৎপিণ্ডের শব্দ শুনতে ইচ্ছে হচ্ছে।

.

পরদিন সন্ধ্যায় জীবনের সবচেয়ে সুন্দরতম যাত্রা শুরু করল সুমি আর দিপু। দিপু বলল, ‘এত সুন্দর একটা দিনের জন্য এত দিন তুমি এমন কেন করলে?’

সুমি গম্ভীর গলায় বলল, ‘তোমাকে বোঝার জন্য।

দিপু যেন অবাক হলো, ‘আমাকে বোঝার জন্য?’

‘হুম।’

‘এখনো আমাকে বুঝতে তোমার বাকি আছে?’

‘আছে।’

‘মানে?’

সুমি হাসল, ‘মানে হচ্ছে, মানুষকে বুঝতে হলে সময় দিতে হয়।

‘এতদিনেও আমাকে বুঝতে পারোনি?’

‘পুরোটা হয়তো পারিনি। মানুষ কেমন জানো?’

‘কেমন?’

‘গ্লাসে ঢালা কোকের মতো।’

‘মানে কী!’ দিপু অবাক গলায় বলল।

সুমি শান্ত কণ্ঠে বলল, ‘দেখবে গ্লাসে ঢালার সাথে সাথে কোক গ্লাস উপচে পড়ে। পড়ে না?’

হুম।’

‘কিন্তু ওই গ্লাস উপচে পড়া পুরোটাই কিন্তু সত্যিকারের কোক নয়। ওর বেশির ভাগই বুদবুদ, ফেনা। একটু সময় দাও। অপেক্ষা করো। দেখবে ওই গ্লাস উপচে পড়া ফেনাটুকু মিইয়ে গিয়ে আসল কোকটুকু গ্লাসের তলায় থেকে যাবে।’

‘মানুষের সাথে এর কী সম্পর্ক?’

‘আমাদের চারপাশের বেশির ভাগ মানুষও অমনই। প্রথমেই তাদের দেখে বোঝা যায় না তারা কেমন, কতটুকু তাদের আসল আর কতটুকু ওই বুদবুদ। তারাও তখন তাদের আরোপিত নানা আচরণ, মন ভোলানো নানা কথায় ওই গ্লাস উপচে পড়া কোকের ফেনার মতোই উপচে পড়ে। কিন্তু একটু সময় দিতেই তাদেরও ভেতরকার সত্যিকারের চেহারাটা বের হয়ে আসে। ওটুকুই শেষ পর্যন্ত আসল।’

সুমির কথা শুনে দিপু হকচকিয়ে গেল। সে বিভ্রান্ত গলায় বলল, ‘এতদিন তুমি আমাকে পরীক্ষা করেছো?’

‘হুম।’

কথাটা শুনে দিপুর খুব মন খারাপ হয়ে গেল। সে বলল, ‘কেন?’

‘কারণ আমি এমন কারো সাথে নীলগিরির মতো কোথাও যেতে চাইনি, যেখানে গিয়ে তাকে ভালোবাসা সত্ত্বেও আমাকে সারাক্ষণ ভেতরে ভেতরে সন্ত্রস্ত থাকতে হবে। ভয়ে থাকতে হবে। আমি তাকে অন্ধের মতো বিশ্বাস করতে চেয়েছি।’

দিপু থমথমে গলায় বলল, ‘এখন পেরেছো?’

সুমি দিপুর কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলল, ‘না পারলে এভাবে আসতাম? তাও এই আমি? তুমি সুমিকে চেন না?’

দিপু কোনো জবাব দিল না। সে বুক ভরে সুমির চুলের সুবাস টেনে নিতে থাকল।

.

মাঝরাতে সুমির ঘুম ভেঙে গেল। দিপু তার কাঁধে মাথা রেখে ঘুমাচ্ছে। বাইরে ধবল জোছনায় ভেসে যাচ্ছে বিস্তীর্ণ মাঠ, মাঠের ওপারে পাহাড়, পাহাড়ের বুকের ওপর ছায়াবৃক্ষের সারি। কী আশ্চর্য মায়াময় এক আলোছায়া। সেই আলোছায়ার যেন সম্মোহনী এক শক্তি আছে। সেই শক্তিতে সুমিরও ভেসে যেতে ইচ্ছে করছে। সে আলতো হাতের স্পর্শে দিপুকে ডেকে তুলল। দিপু ঘুম ঘুম চোখে বলল, ‘কী?’

‘বাইরে তাকাও।’

‘বাইরে কী?’

‘তাকিয়েই দেখনা?’

দিপু অনেক কষ্টে চোখ মেলে খানিক দেখল। তারপর আবার সুমির কাঁধে মাথা রাখতে রাখতে বলল, ‘কাল রাতেতো দেখবই। এখন একটু ঘুমাই?’

‘উহু।’

‘কেন?’ দিপু ঘুমজড়ানো গলায় বলল। সুমি জলের বোতল থেকে খানিকটা জল হাতে নিয়ে দিপুর মুখে ছিটিয়ে দিল হঠাৎ। দিপু ছিটকে গিয়ে ধড়ফড় করে উঠে গেল। সুমি হাসতে হাসতে বলল, ‘কাল যদি জোছনা না থাকে?’

দিপু বলল, ‘থাকতেই হবে।’

‘কেন থাকতে হবে?’

‘বাহ! এই যে এত দীর্ঘ অপেক্ষা, আর তারপর এই আসা। আর এতকিছু যার জন্য সেই জোছনাই থাকবে না?’

নাওতো থাকতে পারে। জীবনে কোনোকিছুই কি সুনিশ্চিত?’

দিপু এই প্রশ্নের উত্তর দিল না। সে এখনো ঘুম ঘুম চোখে তাকিয়ে আছে বাইরে। সুমি বলল, ‘সবাই বলে জীবন একটা বৃত্তের মতো। সার্কেল কিংবা চক্র। আসলে জীবন কিন্তু তা না।’

‘দিপু বলল, ‘জীবন তাহলে কী?’

সুমি বলল, ‘জীবন যেখানেই থামুক, সে কখনো পরিপূর্ণ হতে পারে না। সে সবসময় অপরিপূর্ণ অবস্থায় থামে। এই জন্য জীবন কখনো বৃত্ত নয়। জীবন মূলত অর্ধবৃত্ত।’

এই মাঝরাতে দিপু এমন ভারী ভারী কথা নিতে পারছিল না। বিষয়টা বুঝতে পারছিল সুমি। সে হাসল, ‘তুমি ঘুমাও।’

সাথে সাথেই চট করে ঘুমিয়ে পড়ল দিপু। সুমি দিপুর ঘুমন্ত মুখের দিকে তাকিয়ে রইলো। চলন্ত বাসের জানালার কাঁচের নকশার ফাঁক গলে যেন স্রোতের মতো বিভ্রমাত্মক এক আশ্চর্য জাদুকরি আলো এসে দিপুর মুখখানা ধুইয়ে দিচ্ছে। সেই মুখের দিকে তাকিয়ে সুমির এত মায়া হলো! সে আলতো করে ঠোঁট ছোঁয়াল দিপুর কপালে। কাল রাতে সে কিছুতেই ঘুমাতে দেবে না দিপুকে। সারারাত জাগিয়ে রাখবে। এমন অদ্ভুত মায়াময় চাঁদের আলোয় কেউ ঘুমায়? কাল রাত যে করেই হোক দিপুকে জেগে থাকতে হবে। এমন স্বপ্নাবিষ্ট চাঁদের আলোয় পাহাড়চূড়ায় বসে থাকবে তারা। আহা জীবন, আহা স্বপ্ন!

কিন্তু সুমি কি আসলেই জানে, জীবন সত্যি সত্যিই এক অর্ধবৃত্ত? এই জীবন কখনোই পরিপূর্ণ এক বৃত্ত হয়ে উঠতে পারে না। সে সবসময়ই হয়ে থাকে অনন্ত এক আক্ষেপের নাম। সে কি জানে, নীলগিরির স্বপ্নময় পূর্ণিমার ওই জোছনায় কী ভয়াল এক কালো রাত অপেক্ষা করছে তার জন্য?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *