1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ৬

নাবিলার শ্বশুরবাড়িতে আসার তিন দিন হয়ে গেল নাদিয়ার। এর মধ্যেও সাজ্জাদের কোনো খবর নেই। তার ফোন বন্ধ। বন্ধুবান্ধব কারো কাছেই কোনো খোঁজ খবর নেই তার। নাদিয়া অবশ্য এতে অবাক হলো না। সে সাজ্জাদের বিষয়ে আগে থেকেই কম বেশি জানে। তবে সে অবাক হয়েছে নাবিলাকে দেখে। নাবিলার বাঁ চোখ ফুলে গেছে। কিন্তু ডান চোখের নিচে গর্তের মতো হয়ে আছে। তার কপালে কাটা দাগের চিহ্ন। গলার কাছে কণ্ঠার হাড় বেরিয়ে আছে। নাবিলাকে দেখে প্রথমেই যে কথাটি মনে হলো নাদিয়ার, তা হলো এই অবস্থায় ঢাকায় না গিয়ে সবচেয়ে ভালো কাজটা করেছে সে। তাকে এই অবস্থায় দেখলে হাফসা বেগম নিশ্চিত করেই আরো অসুস্থ হয়ে পড়তেন। বাড়িতে একটা তুলকালাম লাগিয়ে দিতেন।

নাদিয়া অবশ্য তার মনের এইসব ভাবনা কিছুই বুঝতে দিল না নাবিলাকে। সে বলল, ‘তুই অনেকটা শুকিয়েছিস, তাই না আপু?’

নাবিলা সন্ত্রস্ত ভঙ্গিতে আঁচল টেনে কাঁধটা ঢেকে ফেলল। নাদিয়া অবশ্য আশ্বস্ত করার ভঙ্গিতে মৃদু হাসল, ‘তোকে কিন্তু শুকানোতে সুন্দর লাগছে আপু।’

নাবিলা জবাব দিল না। সে নাদিয়ার কথার অর্থ বুঝতে পারছে না। তার আজকাল মনে হয় সে আর আগের মতো মানুষের কথাবার্তার অর্থও ঠিকঠাক বুঝতে পারে না। কোন কথাটায় কী ইঙ্গিত আছে, তা যেন ধরতে পারেনা সে।

নাদিয়া বলল, ‘আমি যদি তোর মতো একটু শুকাতে পারতাম! দেখছিস না, কেমন ভুঁড়ি হয়ে যাচ্ছে! তোকে দেখে মনে হচ্ছে আমিই তোর চেয়ে বয়সে বড়, আর তুই আমার ছোট। কেমন লাগে বলত!

নাবিলা লজ্জা পাওয়ার ভঙ্গিতে বলল, ‘যাহ! কীসব আজেবাজে কথা। তোর সামনে দাঁড়াতেতো আমার লজ্জাই করছে। দিন দিন কী সুন্দর হয়ে যাচ্ছিস তুই!’

‘সুন্দর না ছাই! দিন দিন বাচ্চা হাতি হয়ে যাচ্ছি।’

‘একদম না। এরচেয়ে কালেতো কঙ্কাল হয়ে যাবি।’

‘আজকাল কঙ্কালই ভালো বুঝলি? দেখিস না, সবাই কেবল জিরো ফিগার খোঁজে। হা হা হা।’

নাদিয়া পরের কয়েকটা দিন যতটা সম্ভব নাবিলাকে সুস্থ করে তুলতে চেষ্টা করল। সমস্যা হচ্ছে, নাবিলার ভেতরে ভেতরে ক্রমাগত তীব্র এক ভয়, একটা প্রবল আত্মবিশ্বাসহীনতা বাসা বেঁধেছে। আর সব কাটানো গেলেও এই মানসিক দুর্বলতাটা কী করে কাটাবে সে! তা ছাড়া খুব বেশিদিন নাবিলার কাছে থাকতেও পারবে না নাদিয়া। তার ইউনিভার্সিটি খোলা। ক্লাস চলছে। তারপরও সেসব বাদ দিয়েই সে এসেছে। কিন্তু কতদিন আর থাকতে পারবে সে!

শফিক ঢাকায় চলে গেলে নাদিয়ার পক্ষে একা ঢাকায় ফেরাটাও কষ্টকর হয়ে যাবে। এ কারণে শফিককেও আটকে রেখেছে সে। কিন্তু শফিকের পক্ষেও আর বেশি দেরি করা সম্ভব না। কিন্তু সেই কথাটা সে জোর দিয়ে বলতেও পারছে না।

নাদিয়া তাকে জিজ্ঞেস করেছিল, ‘আপনার ঢাকায় ফিরতে হবে কবে শফিক ভাই?’

শফিক বলেছিল, ‘আজ কালের মধ্যেইতো ফেরা দরকার।’

‘কিন্তু আপনি চলে গেলে আমি কীভাবে যাব?’

এই কথায় ভারি চিন্তিত হয়ে পড়ল শফিক। আসলেইতো, সে চলে গেলে নাদিয়া একা একা কী করে ঢাকায় ফিরবে! নাদিয়া বলল, ‘আপনি কি আর কটা দিন থেকে যেতে পারবেন না? খুব কি সমস্যা হবে?’

শফিক বিগলিত গলায় বলল, ‘না না। সমস্যা কেন হবে?’

শফিক না বললেও আসলে তার সমস্যা হবে। সে যেই এনার্জি বাল্ব কোম্পানিতে কাজ করে, সেখানে হয়তো বুঝিয়ে-সুঝিয়ে কিছু একটা বলে দেয়া যাবে। তা ছাড়া তার বেতন সেখানে কমিশন ভিত্তিক। অর্থাৎ যে পরিমাণ বাল্ব সে বিক্রি করতে পারবে, তার বিপরীতে কমিশন পাবে সে। ফলে, দুয়েকদিন দেরি করে গেলে তার রোজগারের পরিমাণ হয়তো কমে যাবে, কিন্তু চাকরির তাতে তেমন কোনো ক্ষতি হবে না। সমস্যা হচ্ছে তার টিউশন। যে দুজন ছাত্র সে পড়ায়, তাদের দুজনেরই সামনে পরীক্ষা। এই মুহূর্তে নিয়মিত পড়াতে না পারলে তার টিউশন থাকবে না। আর টিউশন না থাকলে আগামী কয়েক মাস খুব কষ্ট করেই কাটাতে হবে তাকে। শফিক অবশ্য এসবের কিছুই বলল না। সে হাসি হাসি মুখে বলল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমি থাকতে পারব, সমস্যা হবে না।’

‘কদিন থাকতে পারবেন?’

‘আপনি যে কদিন বলবেন।’

নাদিয়া মুখ টিপে হাসল, ‘যদি বলি বাকি জীবন থেকে যেতে হবে?’

‘সমস্যা নেই, আমি পারব’ বলতে গিয়েও শেষ মুহূর্তে নিজেকে সামলে নিলো শফিক। সে বুঝতে পারছে নাদিয়া কথাটা দুষ্টুমির ছলে বলেছে। এবং সে নাদিয়ার কথাটা পুরোপুরি না শুনেই উত্তর দিতে যাচ্ছিল। কিন্তু তারপরও ওই কথাটুকুই তার বুকের ভেতর তিরতির করে কাঁপন ধরিয়ে দিল। এমন কেন হয় তার? এই হওয়াটা কি ঠিক? সেই প্রথম যেদিন এই মেয়েটাকে সে দেখেছিল, সেদিনই কেমন দম বন্ধ লাগছিল শফিকের। বুকের ভেতর স্পষ্ট ধুকফুকানি টের পাচ্ছিল সে। সেই ধুকফুকানি এই এতদিনেও আর একটুও কমেনি। বরং বেড়েছে। সবচেয়ে বেশি বাড়ে নাদিয়ার সাথে দেখা হলে। এ কারণে সহসা সে নাদিয়াদের বাড়িতে যায় না। ঢাকায় থাকা সত্ত্বেও কখনো ভাইয়ের শ্বশুর বাড়ির পথ মাড়ায় না সে।

তার চারপাশের অন্য মানুষদের ঠিকঠাক বুঝতে না পারলেও নিজেকে খুব স্পষ্ট বুঝতে পারে শফিক। সে জানে, তার চারপাশে এত এত রংচঙা মানুষের ভিড়ে সে খুব সাধারণ, যোগ্যতাহীন এক মানুষ। সে দেখতে সাধারণ। পড়াশোনায় সাধারণ। ঠিকঠাক কথা বলতে পারে না। তার ধারণা সে বোধ-বুদ্ধিতে আরো বেশি সাধারণ। তাকে কারো আলাদা করে চোখে পড়ে না। সে মেধাবী নয়। জীবন নিয়ে খুব উচ্চাশাও নেই তার। অথচ সেই শফিকের বুকের ভেতর থাকা খুব সাধারণ হৃদয়টা যে গোপনে গোপনে কারো জন্য এমন তীব্র অপেক্ষা নিয়ে দিন গুনছিল, কে জানতো!

নাদিয়া হাসল, ‘কি ভয় পেয়ে গেলেন?’

শফিক কথা বলল না। মেঝের দিকে তাকিয়ে চুপচাপ বসে রইল। নাদিয়া বলল, ‘আপনাকে একটা কথা বলি শফিক ভাই?’

শফিক চোখ তুলে তাকাল। শেষ বিকেলের নরম আলোর এত মিষ্টি এক চিলতে হাসি ঝুলে আছে নাদিয়ার ঠোঁটে। শফিক চট করে চোখ ফিরিয়ে নিল। বুকের ভেতর কেমন চিনচিনে ব্যথার এত অনুভূতি। খুব সূক্ষ্ম অথচ তীব্র। তার উচিত এই মুহূর্তে নাদিয়ার সামনে থেকে চলে যাওয়া। কিন্তু সে তা পারছে না। একান্ত বাধ্যগত ছাত্রের মতো বসে আছে সে। নাদিয়া বলল, ‘আপনার সমস্যা হলে আপনি অবশ্যই ঢাকায় চলে যাবেন। কিন্তু তিন চারদিন পর কিন্তু আবার ফিরে আসতে হবে।’

‘কেন?’

‘কেন আবার! ফিরে এসে আমাকে নিয়ে যেতে হবে। আপনার যেহেতু ঢাকায় অনেক কাজ পড়ে আছে, সো আপনিতো আর এতদিন বাড়ি বসে থাকতে পারবেন না।’

শফিক বলল, ‘জি।’

নাদিয়া বলল, ‘আচ্ছা এক কাজ করলে কেমন হয়?’

শফিক প্রশ্নবোধক চোখে তাকাল, তবে কথা বলল না। নাদিয়া বলল, ‘আপনি বরং আজই চলে যান। গিয়ে কাজটাজ একটু গুছিয়ে ফেলুন। না হলে হয়তো আপনার কাজে আরো বেশি সমস্যা হবে। তাই না?

শফিক কী বলবে বুঝতে পারছে না। নাদিয়ার কথা ঠিক, তাকে যদি দিন চারেক পর আবার আসতে হয়, তবে আজই চলে যাওয়া ভালো। আগামী কয়েকদিন টিউশনটা করাতে পারবে সে। অফিসে নিজের উপস্থিতিটাও অন্তত দিন কয়েক দেখাতে পারবে। কিন্তু এই যে আজ এই মুহূর্তেই তাকে চলে যেতে হবে, এই ভাবনাটা শফিককে অস্থির করে তুলল। তার খুব বলতে ইচ্ছে করছে, আজ না, আগামীকাল যাবে। কিন্তু এই কথাটি সে কী করে বলবে নাদিয়াকে! নাদিয়া যদি তাতে অন্য কিছু মনে করে? সেই খটখটে দুপুরবেলা বুকভর্তি থমথমে মেঘলা আকাশ নিয়ে ঘর থেকে বের হলো শফিক। তার কেবল মনে হচ্ছিল, এই বুঝি নাদিয়া তাকে ডেকে বলবে, ‘আপনি কি পাগল শফিক ভাই? আমি বললাম আর অমনি আপনি ব্যাগ ট্যাগ গুছিয়ে রওয়ানা হয়ে গেলেন!’

শফিক বড় বড় চোখে তাকিয়ে অবাক গলায় বলবে, ‘তাহলে?’

নাদিয়া বলবে, ‘ধুর, এত বোকা আপনি! এমন কি হয় নাকি? আপনি এক কাজ করুন, ব্যাগ-ট্যাগ রাখুন, চলুন আমরা আশপাশে একটু ঘুরে দেখি। এখানে না নদী আছে? আজ আপনি আমাকে নৌকাতে চড়াবেন, পালতোলা নৌকায়। আপনি জানেন, আমি কখনো পালতোলা নৌকায় চড়িনি?’

নাদিয়া অবশ্য এমন কিছুই বলল না। শফিকের মনে হচ্ছিল, পথে যদি ছোটখাটো একটা দুর্ঘটনাও ঘটে যেত? যদি রাস্তা বন্ধ হয়ে যেত কিংবা ফেরি না চলত! কিংবা অন্যকিছু! মা যদি হঠাৎ বলতেন, আজ এখুনি কেন যেতে হবে, রাতটা থেকে কাল যাস।

কিন্তু তেমন কিছুই হলো না। আজ ঠিকঠিক ফেরি পেয়ে গেল শফিক। ফেরি থেকে নেমে ঢাকার বাস পেয়ে গেল। বাসে ভিড় নেই, সিট ফাঁকা। রাস্তায় কোনো জ্যাম লাগল না। সে সন্ধ্যা নাগাদ ঢাকায় পৌঁছে গেল। মেসে তার ঘরটাতে একটা কটকটে দুর্গন্ধ। অনেকদিন ধরে দরজা জানালা বন্ধ থাকার কারণে ভ্যাপসা দমবন্ধ পরিবেশ। তারপরও জানালাটা খুলতে ইচ্ছে হলো না তার। ধুলো জমা নোংরা ময়লা বিছানায় অন্ধকারে খানিক শুয়ে রইল সে। তারপর উঠে টিউশনে গেল। ঘণ্টাখানেক পড়ালোও সে। আরো কতকিছু যে হলো সেখানে, কিন্তু তার কিছুই শফিকের মাথায় ঢুকল না। তার কেবল মনে হলো বুকের ভেতর শূন্য এক তেপান্তরের মাঠ বয়ে বেড়াচ্ছে সে। সেই মাঠে কেউ নাই কেউ নাই মাতমে বয়ে যাচ্ছে হাহাকারের সুতীব্র হাওয়া। সেই হাওয়া তাকে অবশ করে দিচ্ছে।

পরের তিনটা দিন সে অফিসে গেল, টিউশন করাল, রোজকার আর সবকিছুই করল। কিন্তু একটা মুহূর্তও বুকের ভেতর থেকে হাহাকারে পরিপূর্ণ তেপান্তরের ওই মাঠটাকে সে তাড়াতে পারল না।

তৃতীয় দিন শেষে সবচেয়ে কষ্টকর মুহূর্তটা শুরু হলো শফিকের। সারাটাক্ষণ মোবাইল ফোন হাতে নিয়ে বসে রইল সে। এই বুঝি নাদিয়ার ফোন এলো। এই বুঝি সে বলবে, শফিক ভাই, কই, আপনি এখনো বাড়ির বাস ধরেননি! আমি কখন থেকে অপেক্ষা করে আছি!

আচ্ছা, সত্যি সত্যিই কি নাদিয়া তার জন্য অপেক্ষা করে আছে? হোক না প্রয়োজনে, তারপরও কি সে তাকে মনে করে? নিশ্চয়ই করে। ভালোবেসে না হোক, ঢাকায় ফেরার প্রয়োজনে হলেওতো করে। শফিকের আচমকা মনে হলো, সে নাদিয়ার প্রিয়জন হতে না পারুক, কেবল তার প্রয়োজন হয়েও একটা জীবন কাটিয়ে দিতে পারবে।

নাদিয়া তাকে ফোন করল পঞ্চম দিন সন্ধ্যায়। সে বলল, ‘শফিক ভাই, কাল চলে আসতে পারবেন?’

শফিক বলল, ‘পারব।’

‘সমস্যা হবে না?’

শফিকের খুব বলতে ইচ্ছে হচ্ছে, সমস্যাতো হবেই। কিন্তু তুমি ডাকলে এক পৃথিবীর সকল সমস্যাকে আমি অবলীলায় পায়ে মাড়িয়ে দিতে পারি।

কিন্তু এই কথা সে বলতে পারল না। নাদিয়া বলল, ‘সমস্যা থাকলে থাক। আমি একাই আসতে পারি। এটা এমন কঠিন কোনো কাজ না। জাস্ট ফেরি পার হয়ে বাসটা ধরতে হবে। ব্যাস। তারপরতো ঢাকায়ই পৌঁছে যাব।’

শফিকের বুকটা হঠাৎ ধক করে উঠল। মনে হলো বুকের ভেতর থেকে সব বাতাস যেন বেরিয়ে গেল। শ্বাস নিতে কষ্ট হচ্ছে তার। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে কিছু একটা বলতে, কিন্তু পারছে না। কথা গুছিয়ে আনতে পারছে না সে। কিন্তু বুক হাঁসফাঁস করছে তার। নাদিয়া বলল, ‘আচ্ছা, থাক তাহলে। আমি একা একাই আসতে পারব। এটুকুর জন্য শুধু শুধু আপনাকে ঝামেলায় ফেলতে চাই না।’

শফিক বারকয়েক চেষ্টার শেষে অবশেষে কথা বলতে পারল। কিন্তু এই কথাটা সে কোনোভাবেই বলতে চায়নি। সে মৃদু কণ্ঠে বলল, ‘আচ্ছা।’

নাদিয়া ফোন কেটে দেয়ার পরও শফিক ফোন কানে চেপে ধরে বসে রইল। তার মনে হচ্ছে ফোনের ভেতর থেকে একটা শো শো শব্দ এসে তার মাথার ভেতর ঢুকে পড়ছে। সেই শব্দ ক্রমশই বাড়তে থাকল। অনেক চেষ্টা করেও সেই শব্দ সে মাথা থেকে তাড়াতে পারছে না। তার কপাল, চুলের গোড়া বেয়ে দরদর করে ঘাম ছুটছে। তার চিৎকার করে কাঁদতে ইচ্ছে করছে। কাঁদতে কাঁদতে বুকের ভেতর জমা অভিমানের, অক্ষমতার কঠিন পাথরটাকে গলিয়ে ফেলতে ইচ্ছে করছে। কিন্তু এই মুহূর্তে কাঁদা সম্ভব না। তার রুমমেট চলে এসেছে। সে এসে বলল, ‘আমার শরীরটা খুব খারাপ লাগছে শফিক। তুমি কি আজ রাতের রান্নাটা রাঁধতে পারবে?’

এই মেসে তারা ছয়জন থাকে। সপ্তাহে ছয়দিন ছয়জন ভাগ করে বাজার ও রান্না করে। আজ তার রুমমেটের রান্না করার কথা। শফিক বিড়বিড় করে বলল, ‘বাজার করেছেন?’

‘বাজারতো করি নাই ভাই। শরীরটা ভালো না। তা ছাড়া আমার কাছে টাকাও নেই। তুমি আজকে চালাই নাও। আমি পরে দিয়ে দেব।’

শফিক বাজার করতে গেল। বাজার থেকে এসে রান্না করল। তারপর গোসল করে শুয়ে পড়ল। কিছু খেতে ইচ্ছে করছে না তার। মাঝরাতের দিকে শফিক বিছানা থেকে উঠে দাঁড়াল। তার শরীর থরথর করে কাঁপছে। মাথা ঘোরাচ্ছে। সে সন্তর্পণে দরজা খুলে বের হলো। এবড়োথেবড়ো রাস্তায় পা দিয়ে তার মনে হলো সে খালি পায়ে বের হয়েছে। এখন আর ঘরে ফিরে স্যান্ডেল পড়ে আসতে ইচ্ছে করছেনা। সে হাঁটতে হাঁটতে মহাখালী রেল ক্রসিং পেরিয়ে এলো। সুনসান ট্রেনলাইন। আশেপাশে কোথাও কেউ নেই। হলদে আলো ছড়িয়ে কেবল ল্যাম্পপোস্টগুলো দাঁড়িয়ে আছে। কতগুলো কুকুর চক্রাকারে ঘুরছে। শফিককে অবশ্য এসব কিছুই স্পর্শ করল না। সে হাঁটতে হাঁটতে একটা ল্যাম্পপোস্টের নিচে গিয়ে বসল। তারপর ল্যাম্পপোস্টে হেলান দিয়ে বসে আকাশের দিকে তাকিয়ে রইলো দীর্ঘসময়। নিষ্পলক। নির্নিমেষ। তারপর হঠাৎ হাউমাউ করে কাঁদতে লাগল। এমন কেন সে? কেন এমন? কেন নিজের বুকের ভেতর থাকা ইচ্ছেগুলো, কথাগুলো সে নাদিয়াকে স্পষ্ট করে বলতে পারে না! বুকের ভেতর এত তীব্র যন্ত্রণা লুকিয়ে কি কেউ বাঁচতে পারে!

শফিক জানে না। সে কাঁদতেই লাগল। কাঁদতেই লাগল। চক্রাকারে ঘোরা চুপচাপ কুকুরগুলো আচমকা থমকে দাঁড়ালো। তারপর হঠাৎই তীব্র স্বরে ঘেউ ঘেউ করতে লাগল। শফিকের কান্না অবশ্য তাতে থামল না। তার নিজের ওপর আজ খুব রাগ হচ্ছে। প্রবল অক্ষম আক্রোশে সবকিছু ভেঙেচুড়ে ফেলতে ইচ্ছে হচ্ছে। সে যেন সেই আক্রোশ মেটাতেই আরো জোরে চিৎকার করে কাঁদতে লাগল। কিন্তু তার সেই তীব্র কান্নার শব্দ ক্রমশই মিশে যেতে থাকল একদল কুকুরের সমবেত চিৎকারের সাথে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *