1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ২২

২২

বেশ কিছুদিন হলো রাফির ঘুমের খুব সমস্যা হচ্ছে। রাতের পর রাত ঘুমের ওষুধ খেয়ে ঘুমানোর চেষ্টা করছে সে। কিন্তু সমস্যা হচ্ছে ঘুম খানিক গভীর হওয়া মাত্রই ভয়ানক দুঃস্বপ্ন দেখে তার ঘুম ভেঙে যায়। সেই দুঃস্বপ্নে কোনো এক ভয়াল দর্শন মানুষ তাকে মুগুর হাতে তাড়া করে। রাফি ঊর্ধ্বশ্বাসে দৌড়াতে থাকে। এই দৌড়ানোর সময়টুকুই সবচেয়ে ভয়ংকর। আতঙ্কে দম বন্ধ হয়ে আসে তার। পা চলে না। বুক ধুকফুক করে। মনে হয়, যেকোনো মুহূর্তে কলিজাটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসবে। ছুটতে ছুটতে আচমকা হোচট খেয়ে পড়ে যায় সে। উঠতে গিয়ে দেখে, একটা পুরনো আমলের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আছে। সেখানে ভয়াল দর্শন সেই লোকটা আর নেই। বরং তার সামনে হালকা গোলাপি রঙের শাড়ি পরে কেউ একজন দাঁড়িয়ে আছে। যদিও রাফি শুনেছে স্বপ্নে নাকি সবকিছুই সাদাকালো দেখায়। কিন্তু সে স্পষ্ট হালকা গোলাপি রং দেখতে পায়। সবচেয়ে অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, তার সামনে দাঁড়িয়ে থাকা মেয়েটা মুনিয়া। মুনিয়াকে দেখে তার ভয় কেটে যায়। স্বপ্নের মধ্যেই তার মনে হয় এতক্ষণ সে দুঃস্বপ্ন দেখছিল। আশপাশে কোথাও সেই ভয়াল মানুষটা আর নেই। কিন্তু মুনিয়ার দিকে হাত বাড়াতেই রাফির শরীর হিম হয়ে আসে। মুনিয়ার হাতে সেই ভয়াল দর্শন মানুষটার হাতে থাকা মুগুরটা। মুনিয়া নির্বিকার ভঙ্গিতে সেই মুগুরটা রাফির মাথায় নামিয়ে আনে। আতঙ্কে রাফির চোখজোড়া যেন কোটর ছেড়ে বেরিয়ে আসতে চায়। তারপর আর কিছু মনে থাকে না তার। তবে ঘুম ভেঙে যায়। সে ধড়ফড় করে বিছানায় উঠে বসে। তারপর মাথার পেছনে যে জায়গাটাতে মুনিয়া বাড়ি মেরেছে, সেখানে হাত দিয়ে দেখে। অদ্ভুত ব্যাপার হচ্ছে, রাফির মনে হয় জায়গাটা ফুলে আছে এবং ব্যথাও করছে।

এই কথা সে মুনিয়াকে বলেছেও। মুনিয়া স্বপ্নের কথা শুনে গম্ভীর হয়ে গেছে। সে বলেছে, ‘তুমি কি আমাকে ভয় পাও রাফি?’

রাফি বলেছে, ‘ভয় পাবো কেন?’

‘ভয় না পেলে আমাকে নিয়ে এমন স্বপ্ন তুমি দেখো কী করে?’

‘স্বপ্নের ওপর কি কারো নিয়ন্ত্রণ থাকে? স্বপ্নতো স্বপ্নই।’

‘উহু, স্বপ্ন কেবল স্বপ্ন না। মানুষ অবচেতন মনে যা ভাবে, তা-ই স্বপ্ন।’

‘আমি অবচেতন মনে ভাবি যে তুমি আমার মাথায় আঘাত করেছো?’

‘সেটা আমি কী করে বলব! তবে তুমি নিয়মিত যখন এই একই স্বপ্ন দেখছো, তখনতো তেমনই মনে হচ্ছে।’

এই নিয়ে মুনিয়া আর রাফির মধ্যে মাঝেমধ্যে একটু-আধটু সমস্যাও হয়েছে। মুনিয়া খুব মন খারাপও করেছে। কিন্তু রাফি জানে, জগতে এই একটা মাত্র গোপন কিংবা আপন জায়গা রয়েছে মুনিয়ার। যেখানে সে বাইরের খোলস ছেড়ে পুরোপুরি নিরাভরণ হতে পারে। অকপট, ভানহীন হতে পারে। রাগী মা, প্রচণ্ড ব্যক্তিত্ববান স্কুল শিক্ষক, দায়িত্বশীল গৃহকর্ত্রী থেকে এখানে এসে সে মুহূর্তেই হয়ে যেতে পারে অন্য এক মানুষ। এখানে সে চল্লিশোর্ধ্ব অভিজাত, গম্ভীর, সমীহ জাগানো প্রখর ব্যক্তিত্বের কোনো নারী নয়, বরং প্রবল অভিমানী, আহ্লাদি এক কিশোরী, খেয়ালি তরুণী, তুমুল তেষ্টায় কাতর ছটফটে এক প্রেমিকা। এ তাদের অদ্ভুত এক জগৎ। এখানে সে আর রাফি ছাড়া অন্য কারো কোনো প্রবেশাধিকার নেই। মুনিয়ার ভেতরকার একান্ত গোপন এই অন্য মানুষটাকে এই পৃথিবীতে শুধু একজন মাত্র মানুষই জানে। সেই মানুষটা রাফি। রাফির মাঝে মাঝে খুব অবাক লাগে। অবাক লাগে মুনিয়ারও। এমনও হয়?

তারা কেউই এই প্রশ্নের উত্তর ঠিকঠাক জানে না। তবুও এটি প্রবল রহস্যময় অনুদঘাটিত এক বর্তমান। এখানে মুনিয়া রোজ রোজ চমকে দেয় রাফিকে। রাফি সেসব চমক বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেয়। মুনিয়ার রাগ, ক্ষোভ, অভিমান, জেদ, খামখেয়ালিপনা সকলই হাওয়ায় মিলিয়ে দিতে জানে রাফি। সে একটু আদর করে কথা বললেই মুনিয়ার রাগ ভেঙে যায়। আবার আগের মতো হয়ে যায় সে। রাফি মাঝে মাঝে ভাবে, মানুষের বুকের ভেতর কত অসংখ্য রকমের তেষ্টা থাকে। কিন্তু সেসব তেষ্টার খবর কে রাখে?

না হলে এমন একটু আদুরে কথা, একটু মনোযোগ, একটু পাগলামি আর খানিক ক্ষ্যাপাটে ভালোবাসার জন্য মুনিয়ার মতো অমন একজন মানুষও যে ভেতরে ভেতরে এমন কাঙাল হয়ে ছিল, তা কে জানত!

সমস্যা হচ্ছে, বেশ কিছুদিন থেকে মুনিয়া কেমন অন্যরকম হয়ে যাচ্ছে। কী যেন একটা লুকানোর চেষ্টা করছে সে। কিন্তু সেটি লুকিয়েও মনে মনে স্বস্তি পাচ্ছে না। সারাক্ষণ একটা অস্থিরতা কাজ করছে তার মধ্যে। আগের মতো রাফির সাথে যোগাযোগটাও হচ্ছে না তার। এর মূল কারণ অবশ্য রফিকুল আলমের মৃত্যু। সেই রাতে ঠিক ওই জায়গাটাতেই ছিল রাফি। একটু এদিক-সেদিক হলেই যেকোনো ভাবে ফেঁসে যেতে পারত সে। ফলে আরো সতর্ক হয়ে গেছে মুনিয়া। তা ছাড়া বাড়িতেও একটা স্পষ্ট ফিসফিসানি টের পাচ্ছিল সে। এরমধ্যে রাফিকে যদি কারো সন্দেহজনকভাবে চোখে পড়ে যায়, তাহলে বিপদ।

রাফির ধারণা, এসব নানাবিধ কারণেই রাফিকে যতটা সম্ভব দূরে দূরেই থাকতে বলেছে মুনিয়া। এমনকি স্কুলে রথিকে আনতে যেতেও নিষেধ করেছে। বিষয়টা নিয়ে রাফি মনে মনে খুবই বিরক্ত। কিন্তু কিছু করার নেই তার। কারণ সে জানে, অপ্রয়োজনে মুনিয়া কিছুই করে না।

তবে এটা সত্যি, ক্রমাগত ওই বিদঘুটে দুঃস্বপ্নের কারণে হোক বা অন্য কোনো কারণেই হোক, মুনিয়ার প্রতি ইদানীং একটা ভয় কাজ করে রাফির। তার কেবল মনে হয়, মুনিয়া যেকোনো সময় যেকোনো কিছু করে ফেলতে পারে। বারবার ওই দুঃস্বপ্নটাই ঘুরেফিরে মনে পড়ে যায় তার। বহু চেষ্টা করেও মাথা থেকে তাড়াতে পারেনি সে। আজকাল মুনিয়ার সাথে যখনই দেখা হয়, তখনই চট করে বিষয়টা মাথায় চলে আসে রাফির। মনে হয়, এই বোধহয় মুনিয়ার হাতে কিছু একটা দেখতে পাবে সে। এবং সাথে সাথেই মুনিয়া তাকে আঘাত করবে। এ এক ভয়ানক অস্থিরতা। এই ভয়ানক অস্থিরতা ঢাকতেই মুনিয়ার সাথে খুব হাসিখুশি আচরণ করার চেষ্টা করে রাফি। যেন মুনিয়া কিছুতেই বুঝতে না পারে, তার মনে কী চলছে। মুনিয়া যদি ঘুণাক্ষরেও বুঝতে পারে যে রাফির মনে কী চলছে, তাহলে একটা তুলকালাম কাণ্ড ঘটে যাবে।

বহুদিন পরে আজ রাতে মুনিয়ার সাথে কথা হলো রাফির। মুনিয়ার একটা গোপন ফোন নম্বর আছে, সেই নম্বরে তাদের কথা হয়।

মুনিয়া বলল, ‘এতরাতে এখনো জেগে? ঘুমাওনি যে?’

‘ঘুম আসছে না।’

‘ঘুম আসছে না কেন?’

‘দুঃস্বপ্ন দেখছি বলে।’

‘তোমার একটা ভালো ডাক্তার দেখানো উচিত রাফি।’

‘ডাক্তার দেখিয়েই তো ঘুমের ওষুধ খাচ্ছি।’

‘উহু। আমার মনে হচ্ছে না এটা ঘুমের ওষুধের সমস্যা। এটা সাইকোলজিক্যাল প্রবলেম। ইউ শুভ কনসাল্ট আ সাইকিয়াট্রিস্ট।’

‘কিন্তু সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়ে আমি কী বলব?’

এই কথায় মুনিয়া চুপ করে রইলো। আসলেইতো সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে গিয়ে কী বলবে রাফি? সে দুঃস্বপ্নের কারণে ঘুমাতে পারে না, নাকি দুঃস্বপ্নের কারণে তার ঘুম ভেঙে যায়। আর যে কারণে সে দুঃস্বপ্ন দেখে তাই বা ডাক্তারকে কী করে বলবে রাফি? আজকাল রাফির জন্য দুশ্চিন্তা বোধ করে মুনিয়া। সেই দুশ্চিন্তা নানামুখী। তার কিছু রাফিকে বলা যায়, কিছু যায় না। বলতে না পারা সবচেয়ে বড় দুশ্চিন্তাটি হচ্ছে ঋদ্ধি। মুনিয়া স্পষ্ট বুঝতে পারছে ঋদ্ধির অবস্থা। খুবই বিপজ্জনক একটা বয়স পার করছে সে। এ সময় নিজের ভাবনা, নিজের অনুভূতি ছাড়া পৃথিবীর আর সবকিছুই ভুল মনে হয়। মনে হয় তার চিন্তায় বাধা দেয়া প্রতিটি মানুষই বোধহয় তার সবচেয়ে বড় শত্রু। অথচ, সেই মানুষটিই হয়তো তার সবচেয়ে বড় বন্ধু।

ঋদ্ধিকে এই অবস্থা থেকে ফিরিয়ে আনতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারত রাফি। কিন্তু রাফিকে লজ্জাজনক ওই কথাটা কী করে বলবে মুনিয়া? এটা সে কখনোই পারবে না। মরে গেলেও না। একজন নারীর জন্য এরচেয়ে বিব্রতকর, এরচেয়ে লজ্জাজনক কিছু আর হতে পারে না। আচ্ছা, রাফি বিষয়টা নিয়ে কী ভাবছে? সে কি বুঝতে পারছে যে ঋদ্ধি তাকে অন্যরকমভাবে পছন্দ করে? বিষয়টি নিয়ে মুনিয়া দ্বিধাগ্রস্ত। সেদিন ঋদ্ধির নোটবুকে রাফির ওই লেখাটা দেখার পর থেকে তার মাথায় উদ্ভট উদ্ভট সব চিন্তা ঘুরছে। কিন্তু তার কোনোটাতেই সে স্থির হতে পারছে না। দ্বিধাহীন হতে পারছে না। পাহাড় চাপা যন্ত্রণা নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে সে। কাউকে কিছু বলতেও পারছে না।

আচ্ছা, ঋদ্ধির ব্যাপারে রাফির ভাবনা কী? কেন হঠাৎ সে ঋদ্ধিকে অমন কবিতা লিখে দিতে গেল? এর আগেতো এমন করেনি। বরং এর আগে ছোট্ট একটা বাচ্চার মতোই তাকে দেখেছে রাফি। তাহলে হঠাৎ কী এমন হলো! ঋদ্ধি যে বড় হয়ে উঠছে, সেটা কি তবে রাফির মনোজগতেও কোনো প্রভাব ফেলছে? বিষয়টা নিয়ে স্পষ্ট হওয়ারও কোনো সুযোগ নেই।

মুনিয়া বলল, ‘আজকাল আর লিখছো না?’

‘উহু।’

‘কেন?’

‘মাথায় কোনো লেখা আসছে না। খুব অস্থির লাগছে।’

‘অস্থির লাগছে কেন?’

‘তুমি জানো কেন অস্থির লাগছে।’

‘কিন্তু অস্থিরতা পুষে রাখলেতো হবে না, স্থির হতে হবে।’

‘পারছি না তো।’

‘পারি না এমন অনেক কাজই কিন্তু আমাদের করতে হয় রাফি।’

‘তোমাকে একটা কথা জিজ্ঞেস করি?’ রাফি হঠাৎ প্রসঙ্গ পাল্টাল।

‘কী?’

‘এই যে আমাদের এই সম্পর্ক, এই সম্পর্কটা নিয়ে তুমি কী ভাবো?’

‘কী ভাববো?’

‘মানে, তুমি বিবাহিত বাট নট লয়্যাল টু ইওর হাজবেন্ড। তারপর আমি তোমার চেয়ে বয়সেও এত ছোট। ধরো অন্য কারো ক্ষেত্রে যদি এমন একটা সম্পর্কের কথা তুমি শুনতে, তখন কী করতে তুমি?

মুনিয়া কিছুক্ষণ চুপ করে রইলো। এই এতদিনে কখনোই এমন প্রশ্ন করেনি রাফি। আজ হঠাৎ কী এমন হলো তার? সে বলল, ‘আই ডোন্ট জাজ পিপল। যার যার জীবন তার তার সম্পর্ক। তার তার সিদ্ধান্ত। উই আর নোবডি টু জাজ।’

‘তা মানছি। কিন্তু তারপরও কিছু বিষয় থাকে না, আমরা যে মোরালিটিজ, যে ভ্যালুজ, যে এথিকসগুলো নিয়ে বেড়ে উঠি, সেগুলোর সাথেতো এই ধরনের সম্পর্কগুলো কনফ্লিক্ট করে। তাই না?’

মুনিয়া দীর্ঘশ্বাস ছেড়ে বলল, ‘হয়তো। কিন্তু আমার যন্ত্রণা, আমার একাকীত্ব, আমার ভালো থাকা-মন্দ থাকা এগুলোতো একান্তই আমার। আর সবকিছুই মানুষ নিজের প্রয়োজনেই বানিয়েছে। এমনকি এথিকস, মোরালিটিও।’

‘তা হয়তো বানিয়েছে। কিন্তু সমাজে সেগুলোর ইমপ্যাক্টতো পজেটিভ, তাই না?’

‘আমি সমাজবিজ্ঞানী না রাফি। আমি খুব সাধারণ একজন মানুষ। জীবনের দুই ভাগেরও বেশি সময় চলে যাওয়ার পর অবশেষে আমি বাঁচতে শিখেছি। আমি সমাজের জন্য না, এখন নিজের জন্য বাঁচতে চাই। নিজের ভালো থাকার জন্য, আনন্দের জন্য। সমাজের এথিকস, মোরালিটি আমাকে সেটা দেয়নি। বরং অনেক কিছু কেড়ে নিয়েছে।’

‘কিন্তু নিজেকে কখনো গিল্টি মনে হয় না এর জন্য? মনে হয় না অন্য কারো প্রতি অন্যায় করা হচ্ছে?’

মুনিয়া খানিক চুপ করে থেকে বলল, হয়তো হয়, হয়তো হয় না।’

‘তা কীভাবে?’

‘মানুষ যখন কোনো অপরাধ করে, তখন সে নানাভাবে নিজেকে নিজে বোঝানোর চেষ্টা করে যে, সে যা করছে তা অপরাধ নয়। বা হলেও স্বল্পমাত্রার অপরাধ। এমন অপরাধ আরো অনেকেই করছে। কিংবা সে নিজেই নিজের কাছে নানা যুক্তি দিয়ে তার অপরাধটাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে। এটা হিউম্যান ইন্সটিংকট। এটা সবাই করে।’

‘আসলেই কি তাই?’

‘হুম তাই। ধরো এই জীবনে যত মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয়েছে তারা সবাই কোনো না কোনোভাবে নির্যাতিত, বঞ্চিত, সৎ, লয়্যাল, প্রতারিত। প্রশ্ন হচ্ছে- তাহলে নির্যাতক, বঞ্চনাকারী, অসৎ, অবিশ্বস্ত, প্রতারক কিংবা খারাপ লোকের সাথে আমার কখনো দেখা হয়নি কেন বলোতো?’

‘আমি তোমার কথা বুঝতে পারিনি।’ রাফি কৌতূহলী গলায় বলল।

মুনিয়া বলল, ‘ধরো, স্কুলে-কলেজে বা কর্মক্ষেত্রে, যেখানেই কারো সাথে ভালো সম্পর্ক বা বন্ধুত্ব হয়েছে, কিছুদিন যেতে না যেতেই তাদের জীবনের ব্যক্তিগত নানা গল্প শোনার সুযোগ হয়েছে। সেই গল্পগুলো কেমন জানো?’

‘কেমন?’

‘কেউ তার বাবা, দাদা বা নানার কথা বলতে গিয়ে বলেছে, জানো আমার নানার মতো, বাবার মতো এমন সৎ মানুষ আমি আমার এই জীবনে আর কখনো দেখিনি। সারাজীবন অতবড় চাকরি করেছেন কিন্তু একটা টাকা কোনোদিন ঘুষ খাননি। অন্যসবাই এই চাকরি করেই ঢাকা শহরে চার-পাঁচটা বাড়ি করেছে অথচ আমার বাবা বা নানা সারা জীবনের সঞ্চয় আর ব্যাংক লোন নিয়ে ওই একটামাত্র ভাঙা বাড়ি, তাও শেষ করতে পারেনি। বা কিছুই করতে পারেননি।’

মুনিয়া সামান্য থেমে ঢোক গিলল। তারপর আবার বলল, ‘ধরো কারো ডিভোর্স হয়ে গেছে বা প্রেম ভেঙে গেছে, তার গল্পটা কেমন জানো?’

‘কেমন?’

সে বলবে, আমি এই সম্পর্কটা টিকিয়ে রাখার সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু পারলাম না। ও আমার প্রতি লয়্যাল ছিল না, তারপরও আমি চেষ্টা করেছি। ওকে বারবার সুযোগ দিয়েছি। কিন্তু সে বারবার আমার বিশ্বাস ভেঙেছে। শুধু আমি বলেই ওর মতো একটা মানুষের সাথে এতদিন ছিলাম। অন্য কারো পক্ষে এসব সহ্য করা সম্ভব হতো না। কী ভয়ংকর পজেসিভ, সন্দেহবাতিকগ্রস্ত আর হিপোক্রেট, তুমি চিন্তাও করতে পারবে না।’

‘আচ্ছা?’ রাফি খুব আগ্রহ নিয়ে শুনছে।

মুনিয়া বলল, ‘এমন সবাইই। ধরো কেউ বলছে তার মাকে তার দাদা-দাদি, ফুপু বা চাচিরা মিলে ভয়ানক যন্ত্রণা দিয়েছে, তার বাবাকে সহজ-সরল পেয়ে বাবার বন্ধুরা ব্যবসায় ঠকিয়েছে, চাচারা সম্পত্তির ভাগ দেয়নি, মেরে দিয়েছে। কিন্তু আমার প্রশ্ন হচ্ছে, জগতের এমন সব নির্যাতিত নিপীড়িত, প্রতারিত, সৎ, নিরীহ, ভালো মানুষদের সাথেই কী করে আমার পরিচয় হয়? কেন অসৎ, নিপীড়ক, প্রতারক, অবিশ্বস্ত কোনো খারাপ মানুষের সাথে আমার পরিচয় হয় না? কেন কেউ এসে কখনো বলে না, জানো আমার নানা বা বাবা এই বাড়িটা ঘুষের টাকা দিয়ে কিনেছে বা জোর করে তার বন্ধুর কাছ থেকে দখল করে নিয়েছে? বা কেউ কেন কখনো বলেনা যে আমার পার্টনারের প্রতি আমি লয়্যাল ছিলাম না, বাট সে আমার প্রতি শতভাগ লয়্যাল ছিল। তার সাথে সম্পর্ক থাকা অবস্থায়ও আমি আরো একাধিক সম্পর্কে জড়িয়ে পড়েছিলাম। সে আমাকে বারবার সুযোগ

দিয়েছে, বুঝিয়েছে, তারপরও আমি থাকিনি। সে একটা অসাধারণ মানুষ। কিন্তু আমার মতো বাজে একটা মানুষের সাথে যে সে কী করে এতদিন থাকল, আমি জানি না। কেন কেউ এমন করে কখনো বলে না? তাহলে এই অসৎ, অবিশ্বস্ত, নিপীড়ক, প্রতারক মানুষগুলো কি সব মঙ্গল গ্রহ থেকে এসেছে?’

মুনিয়া গ্লাস থেকে ঢকঢক করে পানি খেল। এক নাগাড়ে অনেকগুলো কথা বলে সামান্য হাঁপাচ্ছে সে। রাফি বলল, ‘হুম। মানুষ সবসময়ই নিজের কাজটাকে বৈধতা দেয়ার চেষ্টা করে। এ কারণেই সে সবসময় ভাবে অন্যজন ভুল। আর আমিই সঠিক।’

‘হুম। হয়তো আমিও তাদেরই দলে।’

রাফি কথা বলল না। চুপ করে রইলো। মুনিয়ার হঠাৎ কী হলো, সে বলল, ‘তোমার কী হয়েছে?’

‘কী হবে? রাফি অবাক হলো।

‘তাতো জানি না। তবে সবসময় কেমন অন্যরকম হয়ে থাকো। ভীত, সন্ত্রস্ত।’

‘সেটাইতো স্বাভাবিক, তাই না? তুমিইতো কতভাবে সতর্ক করে দিয়েছো। এটা করা যাবে না, ওটা করা যাবে না। তার একটা ইমপ্যাক্টতো আছেই। আছে না?’ মৃদু হাসল রাফি।

‘কী জানি, হয়তো।’ মুনিয়া সামান্য থেমে হঠাৎ মনে পড়েছে এমন ভঙ্গিতে বলল, ‘ওহ, তুমি সেদিন ঋদ্ধির নোটবুকে ওটা কী লিখে দিয়েছিলে?’

রাফি অনুসন্ধিৎসু কণ্ঠে বলল, ‘কী? কিছু একটা লিখে দিয়েছিলাম, কিন্তু কী লিখেছিলাম, তাতো মনে নেই।’

‘ওহ। চোখ নিয়ে কিছু একটা লিখেছিলে।’

রাফি খানিক ভেবে বলল, ‘ও হ্যাঁ, আমার আগের লেখা একটা কবিতার লাইন। ছোট মানুষতো, দেখা হলেই সারাক্ষণ এটা-সেটা আবদার করে। সেদিন বলল, চোখ নিয়ে কবিতা লিখে দিতে হবে। চট করে ওই লাইনটা মাথায় এলোতো, তাই দিয়ে দিলাম।’

‘হুম।’

‘কেন? কিছু হয়েছে?’

মুনিয়া তটস্থ ভঙ্গিতে বলল, ‘না না কী হবে! এমনিতেই, পড়াশোনাটা ঠিকঠাক করছে না। রেজাল্ট নিয়েও টেনশন হচ্ছে। তা ছাড়া স্কুলে নানাবিধ ঝামেলায় আমিও সময় দিতে পারছি না। এর মধ্যে এদিক-সেদিক থেকে নানারকম প্রশ্রয় পায়। ফলে একটু অমনোযোগীও হয়ে যাচ্ছে। আসলে বয়সটাইতো অমন। এই বয়সের ছেলে-মেয়েরা একটু প্রশ্রয় পেলেই বখে যাওয়ার সুযোগ থাকে।’

‘ঋদ্ধি কিন্তু মোটেই তেমন নয়। খুব শান্ত আর স্থির! বয়সের তুলনায় অনেক ধীর-স্থির সে। আর কী সুন্দর করে হাসে, দেখতে এত ইনোসেন্ট লাগে! তোমার মেয়ে বলে বলছি না কিন্তু, ও অনেক লক্ষ্মী একটা মেয়ে। পড়াশোনায়ও তো আমাদের রথির চেয়ে অনেক ভালো।’

মুনিয়া অস্ফুট শব্দ করল, ‘হুম।’

তারপর আর কথা বাড়াল না। ঋদ্ধি আসলেই শান্ত, ধীর, স্থির। এই বয়সের অন্য মেয়েদের তুলনায় খানিকটা অন্তর্মুখী আর মা ঘেঁষাও সে। কোনো কিছু নিয়ে খুব একটা অভিযোগও নেই তার। তার হাসিও মিষ্টি। সে দেখতেও সুন্দর। মুনিয়া এই বিষয়গুলো জানে, বোঝে, উপলব্ধিও করে। আর এসব কারণেই মা হিসেবে ঋদ্ধিকে নিয়ে তার আলাদা একটা ভালো লাগাও কাজ করে। বিশেষ এক ধরনের গর্বও অনুভূত হয়। কিন্তু সেই একই কথাগুলোই রাফির মুখে শুনে কেমন সূক্ষ্ম অথচ তীব্র এক অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে শুরু করল তার শরীরজুড়ে। সে প্রাণপণে চেষ্টা করছে এই অনুভূতিটাকে অগ্রাহ্য করতে। কিন্তু পারছে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *