1 of 2

অর্ধবৃত্ত – ১৩

১৩

ঋদ্ধির স্কুল ছুটি হয়েছে। কিন্তু সে ক্লাস থেকে বের হচ্ছে না। রথি বলল,

হলো, তুই যাবি না?’

‘হু, যাব।’

‘তাহলে বসে আছিস যে?’

‘আম্মুর জন্য বসে আছি।’

‘তাহলে এখানে বসে আছিস কেন? ম্যাডামের রুমে চলে যা।’

‘আম্মু রুমে নেই। কী একটা জরুরি মিটিং চলছে, আম্মু সেখানে।‘

‘তাহলে কতক্ষণ অপেক্ষা করবি?’

‘যতক্ষণ তুই আছিস, তারপর আম্মুর রুমে গিয়ে একা একা বসে থাকব।’

‘আমিতো ভাইয়া এলেই চলে যাব।’

‘আজ রাফি ভাইয়া তোকে নিতে আসবে?’ ঋদ্ধির গলায় চাপা উত্তেজনা।

‘হু। নানুর শরীরটা হঠাৎ খারাপ করেছে। আম্মু গেছে নানুকে দেখতে।’

‘ওহ, কখন আসবে রাফি ভাইয়া?’

‘তাতো জানি না। বললতো স্কুল ছুটির আগেই চলে আসবে।’

‘আচ্ছা, একটা কাজ করলে কেমন হয় বলতো?’

‘কী কাজ?’

‘আমিও তোদের সাথে গেলাম। তোরা যাওয়ার পথে বাসস্ট্যান্ডের ওখানে আমাকে নামিয়ে দিলেই হবে। আমি রিকশা করে চলে যেতে পারব।’

‘ম্যাডাম রাজি হবেন?’

‘আম্মুকে জানালেতো?’

‘না জানিয়েই যাবি?’

‘হুম।’

‘উহু ভাই, তা হবে না। ম্যাডাম যা রাগী। মনে নেই সেদিনের কথা? আজ আবার এই নিয়ে কী না কী কাণ্ড করে বসেন কে জানে!’

‘ধুর, কিচ্ছু হবে না।’

রথি কিছুতেই রাজি হলো না। রাফি এলো কাটায় কাটায় ত্রিশ মিনিট পর। সে ঋদ্ধিকে দেখেই বলল, ‘কী খবর পিচ্চি, কেমন আছো?

ওই একটা মাত্র শব্দ ‘পিচ্চি’ শুনেই মন খারাপ হয়ে গেল ঋদ্ধির। সে কোনোভাবেই চায় না কেউ তাকে পিচ্চি বলে ডাকুক। অন্তত রাফিতো নয়ই। সে মিনমিন করে বলল, ‘ভালো।’

‘পড়াশোনার খবর কী?’

‘ভালো।’

‘বাড়ির সবাই কেমন আছে?’

‘জি ভালো।

‘কী হলো? তুমি এভাবে কথা বলছো কেন? তোমার কি মন খারাপ? বার্থ ডে’র গিফট পছন্দ হয়নি?’

‘হু, হয়েছে।’ ঋদ্ধি ওপর নিচ মাথা নাড়ল।

‘তাহলে?’

ঋদ্ধি জবাব দিল না। রাফি তার বাঁ হাতের উল্টো পিঠে আলতো করে ঋদ্ধির মাথায় চাটি মেরে বলল, ‘এমন চোখ মুখ শক্ত করে কথা বলছো কেন? হাসো। তুমি হাসলে খুব ভালো দেখায় ঋদ্ধি।’

বাসায় ফিরতে ফিরতে সন্ধ্যা হয়ে গেল ঋদ্ধির। মুনিয়ার মিটিং শেষ হতে অনেক সময় লেগে গিয়েছিল। তাদের স্কুলে যে বড়োসড়ো একটা ঝামেলা চলছে তা ঋদ্ধি বুঝতে পারছে। সারাক্ষণ বড় বড় লোকজন আসা-যাওয়া করছে স্কুলে। মাঝে মাঝে নীল ভ্যানে করে পুলিশের লোকও আসে। একটার পর একটা মিটিং লেগেই থাকছে। কিন্তু সেসব নিয়ে মা কখনো তার সাথে কথা বলে না। আজকাল মায়ের সাথে তার কথা বলার বিষয় ওই একটিই, পড়াশোনা। যেন এর বাইরে তাদের আর কোনো কথা থাকতে নেই। অথচ একটা সময় মার সাথে তার কত কত বিষয়েই না কথা হতো!

আজকাল সেসব বিষয়ে কথা বলতে গেলেই মুনিয়া কঠিন গলায় তাকে থামিয়ে দেয়। মায়ের এমন বদলে যাওয়ার কারণটা পুরোপুরি বুঝতে পারে না ঋদ্ধি। মাঝে মাঝে মাকে খুব অচেনা লাগে তার। তবে আজ ঋদ্ধির মন ভালো। সে বাসায় ফিরেই তার ঘরের দরজা বন্ধ করে ফেলল। তারপর দীর্ঘ সময় চুপচাপ বসে রইলো আয়নার সামনে। একদৃষ্টিতে দেখতে লাগল আয়নায় নিজেকে। এমন করে এর আগে কখনো নিজেকে দেখেনি সে। এই বয়সটাই মেয়েদের তরতর করে বেড়ে ওঠার বয়স, শরীরে ও মনে। তবে মনের বেড়ে ওঠাটা কেউ তেমন করে না দেখলেও শরীরের বেড়ে ওঠাটা খুব করে চোখে পড়ে সবার। ফলে বেশির ভাগ মেয়েই এই সময়টায় খুব আড়ষ্ট হয়ে থাকে। মায়েরা খুব সাবধানে, সঙ্গোপনে তাদের বাড়ন্ত শরীর নিয়ে সতর্ক করতে থাকেন।

ঋদ্ধির ক্ষেত্রে অবশ্য তেমন কিছু ঘটেনি। কারণ মুনিয়া তাকে ওই আড়ষ্টতাটুকু শিখতে দেয়নি। মেয়েদের শরীরে যে আলাদা করে আড়াল করার, গোপন করার কোনো ব্যাপার আছে তা ঋদ্ধির মনে ঢুকিয়ে দিতে চায়নি সে। ফলে ওই আরোপিত তীব্র শারীরিক আড়ষ্টতাটুকু ঋদ্ধির নেই। যেটুকু আছে, সেটুকু সহজাত মেয়েলি সংবেদনশীলতা।

তবে আজ যেন নিজেকে নতুন করেই দেখছে ঋদ্ধি। ওই যে আয়নার ভেতর বসে থাকা মেয়েটি, তাকে কি বিশেষ কেউ একজন খুব গোপনে, খুব যত্ন করে খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখে? মুগ্ধ হয়? প্রবল ভালো লাগা নিয়ে ভাবে? ঋদ্ধির হঠাৎ কী যে লজ্জা লাগতে লাগল! তার শুভ্র গালে চকিতে লালচে এক চিলতে আভা খেলে গেল। মৃদু হাসল সে। আসলেই কি তার হাসিটা সুন্দর? সে তো নানাভাবেই হাসে। তার কোন হাসিটা সবচেয়ে বেশি সুন্দর?

সন্ধ্যা থেকে গভীর রাত অবধি একা একা ওই আয়নার সামনে বসে হাসল ঋদ্ধি। কত রকমের হাসি! তার কেবল মনে হতে লাগল, মাকে যদি একবার জিজ্ঞেস করা যেত? যদি মা বলে দিত ঠিক কেমন করে হাসলে তাকে সবচেয়ে বেশি সুন্দর লাগে? তাহলে সবসময় অমন করেই হাসত সে। সে জানে, এসব ব্যাপারে মা-ই সবচেয়ে সঠিক মানুষ। কিন্তু এই এত রাতে মাকে গিয়ে এই কথাটা জিজ্ঞেস করার সাহস ঋদ্ধির হলো না। অন্য সময় হলে হয়ত হতো। কিন্তু এই বদলে যাওয়া মাকে সে এতরাতে এই প্রশ্ন করতে পারবে না।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *