মোসাপাঁ-চেখফ্‌-রবীন্দ্রনাথ

মোসাপাঁ—চেখফ্‌–রবীন্দ্রনাথ

বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে অদ্ভুত যোগাযোগের ফলে অনেক তথ্য ও অনেক প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি আবিষ্কৃত হয়েছে। শুনেছি র্যোনটগেনের রঞ্জনরশ্মি আবিষ্কার, ফ্যারাডের বৈদ্যুতিক শক্তির আবিষ্কার এ রকম যোগাযোগের ফল। সাহিত্যে এ রকম ধারা বড় একটা হয় না। শুধু ছোট গল্পের বেলা তাই হয়েছে। কিন্তু একথাও স্মরণ রাখা উচিত যে, র্যোনাটুগেন ও ফ্যারাডে যদি বহু বৎসর ধরে আপনি আপন জ্ঞানচর্চায় নিবিষ্ট না থাকতেন, তাহলে যে-সব যোগাযোগের ফলে রঞ্জনরশ্মি ও বৈদ্যুতিক শক্তি আবিষ্কার হল সে সব.যোগাযোগ বন্ধ্যাই থেকে যেত। ছোট গল্পের বেলাও তাই—মোপাসঁ যদি সাহিত্য সাধনায় পূর্বের থেকেই নিযুক্ত না থাকতেন, তবে ফ্লবেরের সঙ্গে তার যোগাযোগ সম্পূর্ণ নিৰ্ম্মফল হত।

ফ্লবের যে কি অদ্ভুত সুন্দর ফরাসি লিখে গিয়েছেন, তার বর্ণনা দিতে পারেন। শুধু ফ্লবেরই ভলতেরের পরেই ফ্লবেরের নাম করতে হয় এবং এদের মাঝখানের যে-কোনো দ্বিতীয় শ্রেণীর লেখক পেলেও বাংলা ভাষা বর্তে যাবে। আর ফ্লবেরের আশা শিকেয় তুলে রাখাই ভালো, তাঁর মত লেখক জন্মাবার পূর্বে এদেশের গঙ্গায় বিস্তর চড়া পড়ে যাবে। তার কারণ এ নয় যে আমাদের দেশে শক্তিমান লেখকের অভাব, বেদনোটা সেখানে নয়, আসল বেদনা হচ্ছে আমাদের লেখকেরা খাটতে রাজী নন। ফ্লবেরের লেখা পড়ার সময় বোঝাই যায় না। তার পিছনে কি অসম্ভব পরিশ্রম রয়েছে, কারণ সে পরিশ্রমের উপরে ফ্লবেরকে আরো পরিশ্রম করতে হয়েছে গোড়ার পরিশ্রমটা ঢাকবার জন্য। ভলতেরের সরল স্বচ্ছ শৈলীর প্রশংসা করলে তিনি নাকি করুণ হাসি হেসে বলতেন, ফরাসি জাতটা কি আর জানে তাদের কষ্ট বাঁচাবার জন্য আমি নিজে কতটা কষ্ট স্বীকার করি?’ ফ্লবের এ কথাটা বললে মানাতো আরো বেশি-তিনি তো শেষটায় সে পরিশ্রম সইতে না পেরে লেখাই ছেড়ে দিলেন।

ধুয়ে মুছে কেচে ইন্ত্রি করে পাট না করা পর্যন্ত ফ্লবের ভাষাকে রেহাই দিতেন না। তাই যখন শাগরেদ। মোপাসীর ভিতর ফ্লবের গুণের সন্ধান পেলেন তখন মোপাসঁর লেখার উপর নির্মম র্যাদা চালাতে আরম্ভ করলেন। আর কী সব অদ্ভূত ফরমায়েশ-দশ লাইনে করুণ বৰ্ণনা লেখে, পনেরো লাইনে বীররস বাংলাও, এটা ছিড়ে ফেলে দাও, ওটা ছাপিয়ো না-অৰ্থাৎ ফ্লবের শাগরেদ। মোপাসাঁকে ধুয়ে মুছে কোচে তৈরি করে প্রায় পকেটস্থ করে ফেলেছেন, এমন সময় তাঁর ডাক পড়লো সেই লোক থেকে যেখানে রসসৃষ্টি করা যায় বিনা পরিশ্রমে-স্বৰ্গলোকে পরিশ্রম নেই বলেই মর্ত্যলোকের সৃষ্টি হয়েছিল। এ-কথা বাইবেলে লেখা আছে।

এই তালিমের ফলেই ছোট গল্পের সৃষ্টি? মোপাসঁর পূর্বের লেখকরা কি বৰ্ণনা, কি চরিত্র-বিশ্লেষণ, কি ঘটনার ঘাত-প্রতিঘাত সব কিছুই লিখতেন। ছড়িয়ে-ছিটিয়ে। ছোট গল্প লিখতে হলে যে বাকসংযম দরকার, বিস্তর কথা অল্প কথায় প্রকাশ করবার যে কেরামতির প্রয়োজন, প্রকাণ্ড আলোটার চতুর্দিক কালো কাপড়ে ঢেকে তার সামনের দিকে পুরু কঁচ লাগালে যে রশ্মির তীব্রতা বাড়ে সেই জ্ঞান মোপাসঁর পূর্বে কারো ছিল না, অথবা তাই নিয়ে মাথা ঘামাবার প্রয়োজন কেউ অনুভব করেন নি। সর্বাঙ্গ বেনারসীতে ঢেকে মুখ থেকে শুধু ঘোমটা সরিয়ে ফিক করে এক ঝলক হেসে সুন্দরী চলে গেল—মোপাসার পূর্বে ফরাসিরা যেন এ-অভিজ্ঞতার কল্পনাই করতে পারেন নি। তাদের কায়দাটা কি ছিল সে কথা ফেনিয়ে বলার সাহস আমার নেই-কলকাতা এ সব বাবদে প্যারিসের মত উদার’ নয়।

এ সব নিছক যোগাযোগের কথা। মোপাসার আপনি কৃতিত্ব। তবে কোনখানে? গল্পটাকে বিশেষ এক জায়গায় এনে অকস্মাৎ ছেড়ে দেওয়া, এবং সেই অকস্মাৎ ছেড়ে দেওয়াটাই গল্পের সম্পূর্ণতাকে প্রকাশ করল—ইংরিজিতে যাকে বলে ক্লাইমেক্স’— এইখানে মোপাসঁর বিশেষত্ব। মোপাসঁর পূর্বের ঔপন্যাসিকেরা তাবৎ নায়ক নায়িকাদের জন্য একটা পাকাপাকি বন্দোবস্ত না করে উপন্যাস বন্ধ করতেন না। নটে গাছটি তারা এমনি কায়দায় মুড়তেন যে, পাঠকের মনে আর কোনো সন্দেহ থাকত না যে এদের জীবনে আর কিছু ঘটতে পারে না, এরা এখন থেকে ‘পুত্র কন্যা লাভ করতঃ পরমানন্দে জীবন যাপন করিল’ অথবা অনুতাপের তুষানলে তিলে তিলে দগ্ধ হইতে লাগিল’।

ক্লাইমেকস আবিষ্কার মোপাসাঁর একান্ত নিজস্ব।

মোপাসার পর বিস্তর লেখক এস্তার ছোট গল্প লিখেছেন, কেউ কেউ মোপাসার চেয়েও ভালো লিখেছেন; কিন্তু অস্বীকার করবার উপায় নেই যে সব গল্পই মোপাসার ছাঁচে ঢেলে গড়া। মোপাসা যে কাঠামোটি গড়ে দিয়ে গিয়েছিলেন, সেই কাঠামোটিতে কোন ফেরফার করার সাহস কারোরই হল না।

চেখফই (Chekhov, Tschehoff ইত্যাদি নানা বানানে নামটি লেখা হয়, কিন্তু উচ্চারণ ‘চেখফ্‌’) প্রথম এ কাঠামোতে হাত দিয়ে দেখিয়ে দিলেন যে ক্লাইমেক্স বাদ দিয়েও সরেস ছোট গল্প লেখা যায়। শুধু তাই নয়, মানুষের দৈনন্দিন জীবনে খুব কম ঘটনাই এ রকম ধারা ‘বুমস-প্যাঙ’ করে সশব্দে ক্লাইমেকসে এসে অরকেস্ট্র শেষ করে। চেখফের অনেক গল্প ক্লাইমেকসে শেষ হয়। সত্য; কিন্তু সেটা গল্পের নিজস্ব প্রকৃতির উপর নির্ভর করে। সব গল্পেই যদি পাঠক ক্লাইমেকসের প্রত্যাশা করে করে পড়ে, তবে সেগুলো একঘেয়ে হয়ে যেতে বাধ্য, সব কবিতাই তো আর সনেট নয় যে শেষের দুই ছত্রে কবিতার সারাংশ জোর গলায় বলে দেওয়া হবে। তাই চেখফের বহু ক্লাইমেক্‌স-বৰ্জিত গল্পের ভরকেন্দ্র এমন ভাবে সমস্ত গল্পে ভাগ করে দেওয়া হয়েছে যে, পাঠক রসিয়ে রসিয়ে নিশ্চিন্ত মনে গল্পগুলো পড়তে পারে—ক্লাইমেক্‌সের আচমকা ইলেকট্রিক শকের জন্য নাক কান খাড়া করে থাকতে হয় না।

আর ভাষার দিক দিয়ে চেখফ মোপাসঁকেও ছাড়িয়ে যান। টলস্টয় ফ্লবেরের চেয়ে অনেক বড় স্রষ্টা এবং চেখফ যদিও টলস্টয়ের শিষ্য নন তবু তিনি বহু বৎসর ধরে টলস্টয়ের সাহচর্য ও উপদেশ পেয়েছিলেন। টলস্টয় স্বয়ং গর্কির চেয়ে চেখফকে পছন্দ করতেন বেশি-তিনি নাকি একবার গর্কিকে বলেছিলেন, চেখফ মেয়ে হলে তিনি তাঁর কাছে নিশ্চয়ই বিয়ের প্রস্তাব পাড়তেন।

রবীন্দ্রনাথের গোড়ার দিকের গল্পগুলি বড় ঢ়িলে। প্রমাণ করা কঠিন, কিন্তু আমার মনে হয়, এই ঢ়িলে ভাব তার প্রথম কাটল মোপাসঁর গল্পের সঙ্গে পরিচিত হওয়ার পর। তখন থেকে রবীন্দ্রনাথের গল্পে মোপাসঁরই মত ঠাস বুনুনি দেখতে পাওয়া যায়, আর কাঠামোটাও হরেন্দরে মোপাসার। কিন্তু রবীন্দ্রনাথের মত লেখক আপনি বৈশিষ্ট্য বর্জন করে লিখবেন-তা সে কাচা লেখাই হোক আর পাকা লেখাই হোক—সে কথা অনায়াসে অস্বীকার করা যায়। রবীন্দ্রনাথের গল্প মোপাসঁ, চেখফ দুজনের গল্পকেই হার মানায় তার গীতিরস দিয়ে। রবীন্দ্রনাথের সমস্ত গল্পটি কেমন যেন সঙ্গীতের কোনো এক রাগে বঁধা। এখানে সংস্কৃত নাটকের সঙ্গে রবীন্দ্রনাথের মিল রয়েছে। মৃৎশকটিকা, শকুন্তলা, রত্নাবলী নাটক গ্ৰীক কাঠামোতে ফেলা যায়। সত্য; কিন্তু এগুলিতে যে গীতিরস রয়েছে, গ্ৰীক নাটকে তো নেই-তই আমরা সংস্কৃত নাটকে যে আনন্দ পাই, গ্ৰীক নাটকে সেটি পাই নে।

রবীন্দ্ৰনাথ বিশেষ বয়সে শেলি, কীটসের প্রভাবে পড়েছিলেন সত্য, কিন্তু তার চেয়েও বড় সত্য, রবীন্দ্রনাথ সে প্রভাব একদিন সম্পূর্ণ কাটিয়ে উঠতে সক্ষম হয়েছিলেন। গল্পের বেলাতেও রবীন্দ্রনাথ একদিন মোপাসার প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দিতে সমর্থ হয়েছিলেন। রবীন্দ্ৰনাথ শেষের দিকের গল্পগুলিতে কি যেন এক অনির্বচনীয়ের প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। ‘মিস্টিক’ কথাটাতে সব কিছুই ঢাকা পড়ে যায় বলে শব্দটা ব্যবহার করতে বাধো বাধো ঠেকে; কিন্তু মানব-চরিত্রের আলো-অন্ধকারের আবছায়া আঁকুবীকু, মানব-চরিত্রের যে দিক দৈনন্দিন জীবনে আমাদের চোখে পড়ে না, মানুষকে যে সব সময় তার বাক্য আর আচরণ দিয়েই চেনা যায় না মানুষের সেই দুজ্ঞেয় অন্তঃস্তল রবীন্দ্রনাথ চেষ্টা করেছিলেন আধা-আলোরই ভাষা এবং ভঙ্গি দিয়ে প্রকাশ করতে। সেখানে রবীন্দ্ৰনাথ এক, মোপাসঁ, চেখফের সঙ্গে তাঁর যোগসূত্র সেখানে সম্পূর্ণ ছিন্ন হয়ে গিয়েছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *