ভক্তি

ভক্তি

ভক্তি ও ভালোবাসার ভিতর দিয়ে অনির্বচনীয় সত্তাকে পাবার চেষ্টা মানুষ সব যুগে আর সব দেশেই করেছে। এ-প্রচেষ্টার তুলনাত্মক ইতিহাস আজও লেখা হয় নি। কারণ শেষ পর্যন্ত এ-ইতিহাস লেখা হবে সর্বধর্মের উৎপত্তিস্থল প্রাচ্যেই এবং প্ৰাচী এখনো আপন ঘৃত-লবণ-তৈল-তণ্ডুল-বস্ত্ৰ ইন্ধন নিয়ে এতই উদ্ব্যস্ত যে তিন দেশের শাস্ত্রগ্রন্থ একত্র করে সেদিকে আপন শক্তি নিয়োজিত করবার অবসর পাচ্ছে না।

ভক্তিমার্গের প্রসার ও বিস্তার হয় প্রধানত হিন্দু, মুসলিম এবং খৃষ্টান ধর্মে। হিন্দুধর্মের শাস্ত্ররাশি এতই বিশাল এবং বিক্ষিপ্ত যে, তার ভিতর দিয়ে ভক্তির অভু্যুদয় পদে পদে অনুসরণ করা সহজ কর্ম নয়। তার তুলনায় খৃষ্টধর্মে ভক্তির অনুসন্ধান অনেক সহজ। একমাত্র বাইবেলখানা মন দিয়ে পড়লেই ভক্তির সূত্রপাত ও ক্রমবিকাশ বুঝতে বিশেষ অসুবিধা হয় না।

বাইবেলের প্রথম খণ্ডে (অর্থাৎ ওল্ড টেস্টামেন্ট) ঈশ্বরের যে রূপ পাওয়া যায় সেটি প্রধানত একচ্ছত্ৰাধিপতি, দুর্ধর্ষ, অকরুণ এমন কি বদরাগী এবং খামখেয়ালী রাজার রূপ। তাঁর সামনে পশুপক্ষী দাহ না করলে তিনি তৃপ্ত হন না, তার পদপ্রান্তে কুমারী কন্যাকে বিসর্জন না দিলে তিনি বন্যা, দুৰ্ভিক্ষ ও মহামারী দিয়ে দেশ লণ্ডভণ্ড করে দেন। তাই ওল্ড টেস্টামেন্টের দেবতাকে পূজারী আপন অর্ঘ্য দিচ্ছে অতি ভয়ে, সশঙ্ক চিত্তে।

খৃষ্ট এসে এই ভাবধারা সম্পূর্ণ বদলে দিলেন। তিনি বললেন, সৃষ্টিকর্তা রাজাধিরাজ, তাঁর ঐশ্বর্যের সীমা নেই, কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, তিনি আমাদের পিতা। ‘আওয়ার ফাদার উইথ আর্ট ইন হেভূন।’ এইখানেই ভক্তির সূত্রপাত। ভগবানকে ভয় করার কোনো প্রয়োজন নেই। তাঁর করুণা, তার স্নেহ পেতে হলে তাকে ভালবাসতে হবে পিতার মত।

কিন্তু মানুষ একবার ভালবাসার মন্ত্র পেলে সে আর মাটির মানুষ হয়ে থাকতে চায় না। মুক্তপক্ষ বিস্তার করে সে আকাশের সর্বোচ্চ স্তরে উড্ডীয়মান হতে চায়। পিতার প্রতি ভালবাসা মঙ্গলময় জিনিস কোনো সন্দেহ নেই, কিন্তু তার চেয়ে অনেক মধুর, বহু নিবিড় মাতার প্রতি পুত্রের ভালবাসা, পুত্রের প্রতি মাতার মমতা। তাই ক্যাথলিক জগৎ গেয়ে উঠলো, ‘ধন্য হে জননী মেরি, তুমি মা করুণাময়ী।’

ক্যাথলিক জগতে তাই ভগবানের পূজা প্রধানত মা-মেরি রূপে। এ পূজা ‘আভেমারিয়া’ মন্ত্র দিয়ে সমাধান হয় এবং সে মন্ত্র যে কত সঙ্গীত-স্রষ্টাকে অনুপ্রাণিত করেছে তার ইয়ত্তা নেই। খৃষ্টবৈরী ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রধান সঙ্গীতকার মেন্ডেলজোন এই আভেমারিয়া মন্ত্রের সুর দিয়ে লক্ষ লক্ষ ক্যাথলিক নরনারীর ধর্মপিপাসা সঙ্গীতসুধা দিয়ে তৃপ্ত করেছেন-সঙ্গীতজগতে আপন অক্ষয় আসন রেখে গিয়েছেন।

ঊর্ধ্বদিকে উচ্ছসিত উদ্বেলিত এই আভেমারিয়া সঙ্গীতের প্রতীক ঊর্ধ্বশির ক্যাথলিক গির্জা। আতুর মানুষের যে প্রার্থনা, যে বন্দনা অহরহ। মা-মেরির শুভ্ৰ কোলের সন্ধানে উর্ধ্বপানে ধায় তারই প্রতীক হয়ে গির্জাঘর তার মাথা তুলেছে ঊর্ধ্বদিকে। লক্ষ লক্ষ গির্জার লক্ষ লক্ষ শিখর মা-মেরির দিব্য সিংহাসনের পার্থিব স্তম্ভ।’

কিন্তু মানুষ এখানে এসেও থামল না। সত্য হোক, মিথ্যা হোক, মানুষের বিশ্বাস মাতার প্রেম, পুত্রের ভালবাসার চেয়েও শক্তিশালী যুবক-যুবতী, তরুণ-তরুণীর মধ্যে যে প্রেম উদ্ভাসিত হয়। বাইবেলে যখন বলা হয়েছে ‘For, love is stronger than death’ তখন মহাপুরুষ এই প্রেমের কথা ভেবেছিলেন। তাই মানুষ বিচার করল, ‘ভগবানকে যদি ভালবাসা দিয়েই পেতে হয়, তবে সে ভালবাসা তার নিবিড়তম রূপ নেবে না কেন? ভগবানকে তবে পিতা অথবা মাতা রাপে কল্পনা না করে তাকে হৃদয়ে বসাব বল্লভ রূপে, প্রেমিক রূপে।’

সমস্ত বৈষ্ণব রসসাধনা এই তত্ত্বের উপর সুপ্রতিষ্ঠিত—সে কথা পরে হবে। কিন্তু ক্যাথলিক রহস্যবাদী ভক্তেরা (Mystic saints)—ও যে এ-রকম রসস্বরূপে আরাধনা করছেন তার সন্ধান আমরা কমই রাখি,-কারণ আমাদের পরিচয় প্রধানত প্রটেস্টান্ট ধর্মের সঙ্গে। ঈষৎ দীর্ঘ হলেও নিচের কবিতাটি উদ্ধৃত করবার লোভ সম্বরণ করতে পারলুম না :–

O Night, that dids’t lead us thus,
O Night, more lovely that dawn
of light,
O Night that broughtest us
Lover to lover’s sight
Lover with loved in marriage
of delight!
Upon my flowery breast,
Wholly for him, and save himself
for none,
There did I give sweet rest
To my beloved one;
The fanning of the cedars
breathed thereon
When the first morning air
Blew from the bower, and waived
his locks aside,
His hand with gentle care,
Did Wound me in the side,
And in my body all my senses
died,
All things then forgot,
My cheek on him who for my
coming came;
All ceased and was not,
Leaving my cares and shame
Among the lilies and forgetting
them.

ক্যাথলিক জগতের বিখ্যাত সাধু সান খোয়ান দে লা ক্রুসের (San Juan de la Cruz)। কবিতা পড়ে কে বলবে–এ কবিতা অধ্যাত্ম জগতের ধর্মরস সৃষ্টি করবার জন্য রচিত হয়েছিল? এ কবিতা তো বৈষ্ণব পদাবলীর সুরে বাঁধা।

কিন্তু ভগবানকে রসস্বরূপে আরাধনা করার প্রচেষ্টাতে ক্যাথলিক জগতের এই চূড়ান্ত।

বৈষ্ণব ভক্ত সেই চুড়াস্ত ত্যাগ করে তারপর আকাশে উডতীয়মান হন। বৈষ্ণব প্রেমিক বলেন, ‘বৈধ প্ৰণয়ের নিবিড়তা বার বার হার মেনেছে অবৈধ প্রেমের সম্মুখে।’ আত্মীয়স্বজন, প্রচলিত ধর্মীরীতি যেখানে এসে প্রেমের পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়, দুর্বর প্রেম এসে সব কিছু ভাসিয়ে নিয়ে যায়। সেইখানেই। তাই আমাদের কদম্ববনবিহারিণী বিরাহিণী ব্রজসুন্দরী শ্ৰীীরাধা যে প্রেম পাগলিনী, সে প্রেমের সঙ্গে অন্য কোন প্রেমের তুলনা হয় না। বাঙালির রাধা বিবাহিতা,-সমাজ তার প্রেমের পথে অলঙঘ্য প্রাচীর গড়ে তুলেছে। শাশুড়ি-ননদী শঙ্খ-করাতের মত তাকে আসতে যেতে যেন খণ্ড খণ্ড করে কেটে ফেলছেন।

বহু যুগ পূর্বে উচ্চারিত মন্ত্র তাই তার সম্পূর্ণ অর্থ পেল কৃষ্ণরাধার মিলনে—

যদেৎ হৃদয়ং মম তদস্তু হৃদয়ং তব।
যদেৎ হৃদয়ং তব, তদস্তু হৃদয়ং মম।

ভারতের বাইরে একমাত্র ইরানে মাঝে মাঝে এই সর্বোচ্চ রসসাধনার সন্ধান মেলে। কারণ ভারত ও ইরানের আধ্যাত্মিক যোগাযোগ বহু শত শতাব্দীর। তাই ইরানী কবি সুর মিলিয়ে গেয়েছেন :

‘মন তু শুদমা তু মন শুদী, মন তন শুদম
তু জাঁ শুদী
তা কপী ন গোয়েদ বাদ আজ ঈ মন দিগরম
তু দিগরী।’
আমি তুমি হনু, তুমি আমি হলে, আমি দেহ
তুমি প্ৰাণ,
এর পরে যেন কেহ নাহি বলে তুমি আন
আমি আন।

***

এই বিশাল রসধারার কত স্রোত, কত শাখা-প্ৰশাখা। কত ধ্বনি, কত সঙ্গীত উচ্ছসিত হয়ে উঠেছে সান খোয়ান, শ্ৰীরাধা, রুমীর বিরহকাতর বক্ষ থেকে। কিন্তু হায়, এ শতাব্দীর যান্ত্রিক সভ্যতার উন্নতি মানুষকে কাছে এনেও কাছে আনতে পারল না। অর্থের সন্ধানে, স্বার্থের অন্বেষণে আজ পৃথিবীর এক কোণের মানুষ অপর কোণে গিয়ে মাথা কোটে, কিন্তু এ সব সাধক প্রেমিকদের বাণী এক করে দেখবার চেষ্টা কেউ যে করে না!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *