রেডুকৎসিয়ো আড আবসু্ররডুম!
গিয়ে দেখলুম ক্লাবের প্রত্যন্ত প্রদেশে সেই নিমগাছের তলায় চীনা বন্ধু, গুণী অধ্যাপক উ বসে আছেন। নিমপাতা এখন বর্ষণ রসে টৈটস্কুর বলে টেবিলের উপর ঝরে পড়ে না। তাই উ বকুল ফুল দিয়ে আল্পনা আঁকছেন।
আমি চীনা কায়দায় ঝুঁকে ঝুঁকে দুলতে দুলতে বললুম, ‘জয় হিন্দ!’
অধ্যাপক মৃদু হাস্য করে মাথা নাড়িয়ে বললেন, ‘আলাইকুম সালাম, আজ তোমাদের ইদের পারব না?’
আমি বললুম, ‘ছুটির বাজার, তাই আপনার কাছ থেকে তত্ত্বকথা শুনতে এলুম।’
‘তৎপূর্বে বল, এ ফুলের নাম কি?’
মূল বক্তব্যের সঙ্গে এ প্রশ্নোত্তরের কোনো যোগ নেই। তবু বাঙালির মনে বিমলানন্দের সৃষ্টি হবে বলে নিবেদন করছি।‘
বললুম, ‘বাঙলা, মারাঠী, সংস্কৃতে ‘বকুল’, হেথাকার নেটিভ ভাষাতে ‘মোলশী’।*
অনেকক্ষণ ধরে মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললেন, ‘বকুল, মোলশী,-মোলশী বকুল। উহুঁ, বকুলটিই মিষ্টি।’ বাঙালির ছাতি তিন বিঘৎ ফুলে উঠল তো?’
আমি বললুম, ‘মিষ্টি নামই যদি রাখবেন তবে ‘প্ৰাণনাথ’ বলে ডাকলেই পারেন।’
ভুরু কুঁচকে বললেন, ‘সে আবার কি?’
‘প্ৰাণনাথ মানে, মাই ডার্লিং।’
‘আরো বুঝিয়ে বলো।’
আমি বললুম, ‘আমি বাঙাল। আমারই দেশের এক ‘চুকুমবুদাই’ অর্থাৎ এদিকে মুখচোরা ওদিক চটে যায় ক্ষণে ক্ষণে, এসেছে কলকাতায়। গেছে বেগুন কিনতে। দোকানীকে বললে, ‘দাও তো হে, এক সের বইগন।’ দোকানী পশ্চিম বাঙলার লোক।‘বেগুনে’র উচ্চারণ ‘বইগন’ শুনে একটুখানি গর্বের ঈষৎ মৌরী-হাসি হেসে শুধালো, ‘কি বললে হে জিনিসটার নাম?’ বাঙালি গেছে চটে, উচ্চারণ নিয়ে যত্রতত্র এরকম ঠাট্টা-মস্কার করার মানে?–চতুর্দিকে আবার বিস্তর ‘ঘটি’ দাঁড়িয়ে। তেড়েমেড়ে বলল, ‘বাইগন কইছি, তো বেশ কইছি হইছে কি?’
দোকানী আরেক দফা হাম্বড়াই আত্মম্ভরিতার মৃদু হাসি হেসে বললে, ‘ছোঃ, বইগন, বইগন। দেখো দিকিনি আমাদের শব্দটা কি রকম মিষ্টি—বেগুন, বেগুন।’
বাঙাল বলল, ‘মিষ্টি নামই যদি রাখবা, তবে ‘প্ৰাণনাথ’ ডাকলেই পারো। দাও। তবে এক সেরা প্ৰাণনাথ। প্ৰাণনাথের সেরা কত? ছ’ পয়সা না। সাত পয়সা?’
ঊ প্রাণভরে হাসলেন উচ্চস্বরে। তারপর চোখ বন্ধ করে মিটমিটিয়ে। সর্ব শেষে চেশায়ার বেড়ালের হাসিটার মত ‘আকাশে আকাশে রহিল ছড়ানো সে হাসির তুলনা।’
সুশীল পাঠক, তুমি রাগত হয়েছ, বিলক্ষণ বুঝতে পারছি। এ বাসি মাল আমি পরিবেশন করছি কেন? এ গল্প জানে না কোন মৰ্কট? পদ্মার এ-পারে কিংবা হে-পারে?
তিষ্ঠ, তিষ্ঠ। এ গল্পের খেই ধরে চীনা-গুণী সেদিন তত্ত্ব বিতরণ করেছিলেন বলেই এটাকে ‘এনকোর’ করতে হল।
***
হঠাৎ জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ গল্পে কি তত্ত্ব লুক্কায়িত আছে?’
খাইছে। আমি করজোড় বললুম, ‘আপনিই মেহেরবাণী করুন।’
বললেন, ‘রেডুকৃৎসিয়ে আড় আবসুভূমি’ কাকে বলে জানো?
আমার পেটের এলেম আপনারা বিলক্ষণ জানেন। কাজেই বলতে লজা নেই, অতিশয় মনোযোগের সহিত গ্ৰীবাকণ্ডুয়নে নিযুক্ত হলুম।
বললেন, ‘কেন! জানো না, যখন কোনো বিষয় টানাটানি করলে অসম্ভব বলে প্রতীয়মান হয় তখনই তাকে বলে ‘রেডুকৎসিয়ে আড আবসু-র্ডু-ম’।’
ততক্ষণে বুঝে গিয়েছি। সোৎসাহে বললুম, হ্যাঁ হাঁ, রিডাকশিও এ্যাড এ্যাবসার্ডাম।’ একটুখানি গর্বের হাসিও হেসে নিলুম।
বাঁকা নয়নে তাকিয়ে বললেন, ‘কথাটা যখন লাতিন তখন ইংরিজি উচ্চারণ করছে। কেন? ইংরেজের মুখ না হলে তোমরা কোনো ঝাল খেতে পারো না বুঝি?’
‘সে কথা থাক। শোনো।
‘আসল কথা হচ্ছে বাঙাল দেখিয়ে দিল, মিষ্টি নামই যদি রাখবে। তবে যাও একট্ৰিমে। রাখো নাম ‘প্ৰাণনাথ’। তৎক্ষণাৎ প্রমাণ হয়ে গেল, মিষ্টত্বের দোহাই কত অ্যাবসার্ড।
‘এ দেখো না, মার্কিন জাতটা কি রকম অ্যাবসার্ড। কোনো ক্রমে সুনিপুণ হতে পারাটা অতীব প্রশংসনীয়। এতে সন্দেহ করবে। কে? কিন্তু এরও তো একটা সীমা থাকা দরকার। গল্প দিয়ে জিনিসটে বোঝাচ্ছি।
‘ব্রুকলিন ব্রিজ যখন বানানো হয় তখন দু’পাড় থেকে দু’দল লোক পুল তৈরি করে। মাঝ গাঙের দিকে রওয়ানা হল। এমনি চৌকশ তাদের হিসেব, এমনি সুনিপুণ তাদের কলকব্জা যে মধ্যিখানে এসে যখন পুলের দুদিকে জোড়া লাগল। তখন দেখা গেল এক ইঞ্চির আঠারো ভাগের উঁচু-নীচুর ফেরফার হয়েছে। তারিফ করবার মত কেরদানী, কোনো সন্দ নেই।’
‘পক্ষান্তরে আমার স্বর্ণভূমি চীনদেশে কি হয়? দুদল লোককে এক পাহাড়ের দুদিকে দেওয়া হয়েছিল সুড়ঙ্গ বানানোর জন্য। এদিক থেকে এনারা যাবেন, ওদিক থেকে ওনারা আসবেন। মধ্যিখানে মিলে গিয়ে খাসা টানেল।
‘কিন্তু কাৰ্যত হল কি? দেখা গেল, ডবল সময় চলে গেল তবু মধ্যিখানে দু’দলের দেখা নেই। তারপর এক সুপ্ৰভাতে দু দল বেরিয়ে এলেন দুদিকে। মধ্যিখানে মেলামেলি, কোলাকুলি হয়নি।’
আমি চোখ টিপে ইসারায় জানালুম, এ কি রঙ্গ বুঝতে পেরেছি।
তিনি বললেন, ‘আদপেই না। মার্কিনীরা সুনিপুণ, সেই নৈপুণ্যের প্রসাদাৎ তারা পেল কুল্ল একখানা ব্রিজ। আর আমরা পেয়ে গেলুম, ‘দুখানা টানেল। লাভ করে বেশি হ’ল বল তো।
তাই বলি অত্যধিক নৈপুণ্য ভালো নয়।
‘রেডুকৎসিয়ো আড আবসু্ররডুম!’।