ভাষাতত্ত্ব
প্যারিসে রেস্তরাঁয় বসে আছি। নিতান্ত একা; যাঁদের আসবার কথা ছিল তারা আসেন নি। এমন সময় একটি অতি সুপুরুষ এসে আমারই টেবিলের একখানা শূন্য চেয়ারে আসন গ্ৰহণ করলেন-অবশ্য প্রথমে ফরাসি কায়দায় বাও করে, আমার অনুমতি নিয়ে।
নিতান্ত মুখোমুখি তদুপরি কত্তিকের মত চেহারাখানা-বার বার আমার মুগ্ধ চোখ তাঁর চেহারার দিকে ধাওয়া করছিল। তিনিও নিশ্চয়ই এ রকম পরিস্থিতিতে জীবনে আরো বহুবার পড়েছেন। কি করতে হয় সেটা তাঁর রপ্ত আছে।
সিগারেট বাড়িয়ে দিয়ে বলছেন, ‘ইচ্ছে করুন।’
আমি ধন্যবাদ জানালুম।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘ফরাসিটা বলতে পারেন তো? আমি তো আর কোনো ভাষা জানি নে।’
আমি বললুম, ফরাসি ভাষাটা সব সময় ঠিক বুঝতে পারি কি না বলা একটু কঠিন। এই মনে করুন, কোনো সুন্দরী যখন প্রেমের আভাস দিয়ে কিছু বলেন, তখন ঠিক বুঝতে পারি। আবার যখন ল্যান্ডলেডি ভাড়ার জন্যে তাগাদা দেন তখন হঠাৎ আমার তাবৎ ফরাসি ভাষাজ্ঞান বিলকুল লোপ পায়।’
উচ্চাঙ্গের রসবিকাশ হল না সে কথা আমার সুরসিক পাঠকেরা বুঝতে পেরে নিশ্চয়ই একটুখানি স্মিতহাস্য করবেন। আমিও এ-কথা জানি, কিন্তু বিদেশে যখন মানুষ নিতান্ত একা পড়ে এবং রাম, শ্যাম যে-কোনো কারোর সঙ্গে বন্ধুত্ব জমাতে চায় তখন ঐ হল একমাত্র পন্থা, অর্থাৎ তখন কাঁচা, পাকা যে-কোনো প্রকারের রসিকতা করে বোঝাতে হয় যে, আমি তখন সঙ্গ-সুখলিপ্সু।
ফরাসি ভদ্রলোক হেসে বললেন, ‘দেশভ্রমণ বড় ভাল জিনিস। বিদেশে ভাষা নিয়ে এ ভানটা অনায়াসে করা যায়। আমি করি কি প্রকারে? আমি যে ফরাসি সে তো আর বেশিক্ষণ লুকিয়ে রাখতে পারি নে!’
দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘সে না হয় হল। কিন্তু বলুন তো, শব্দার্থ আপনি ঠিক ঠিক বুঝতে শিখেছেন? এই যদি আমি বলি যে, আমি ‘জার্নালিস্ট’ তাহলে তার মানে কি হল?’
একগাল হেসে বললুম, ‘তা আর জানি নে? তার মানে হল আপনি খবরের কাগজে লেখেন।’
‘উঁহু হল না। ঠিক তার উল্টো; আমি লিখি নে। সে কথা যাক। আরেকটি উদাহরণ দি। আমি যদি বলি, ‘আচ্ছা তা হলে আরেকদিন দেখা হবে’, তবে তার মানে কি?’
আমি এবারে আরেক গাল আর হাসলুম না; বললুম, ‘তার মানে আরেক দিন দেখা হবে, এতে আর অস্পষ্টতাটা কোথায়?’
বললেন, ‘ফেল!’ তার মানে হল, ‘আপনি এবারে দয়া করে গাত্রোৎপাটন করুন’।
আমি খুশি হয়ে বললুম, হ্যাঁ হ্যাঁ, আমরাও যখন বাঙলায় বলি, ‘এবার তুমি এসো।’ তখন তার অর্থ ‘তুমি এবারে কেটে পড়ো’।’
‘ঠিক ধরেছেন। তাই বলছিলুম, আমি জার্নালিস্ট; কিন্তু না-লেখার জন্য লোকে পয়সা দেয়। খুলে কই।
‘এই ধরুন কয়েক মাস আগে খবর পেলুম, আমাদের ডাকসাইটে রাজনৈতিক মসিয়ো অনুস্বার একটি রমণীর সঙ্গে ঢলাঢলি করছেন। ওদিকে বাজারে তার সুনাম আর খ্যাতি অতিশয় ধর্মভীরুরূপে–কোথায় জানি নে গির্জে মেরামত করে দিয়েছেন, কোন সেন্টের জন্মদিনে জাব্বাজোব্বা পরে পারবে পয়লা নম্বরী বনেছিলেন এইরকম ধারা কত কি? আমি খবরটা শুনে বললুম, ‘বটেরে স্যাঙাৎ, দাঁড়াও তোমাকে দেখাচ্ছি।’
‘করলুম কি, লাগলুম তত্ত্ব-তাবাশে। ডাক্তাররা নাকি এক্স-রে দিয়ে পেটের মধ্যিখানের ছবি তোলেন? স্রেফ গাঁজা; তার চেয়ে ঢের ঢের বেশি নাড়ীভূড়ির খবর মেলে কয়েক আউন্স রূপো ঢেলে, সোনা ঢাললে তার চেয়েও ভালো।
‘সেই নর্তকীর নামধাম সাকিন ঠিকানা হাড়হদের তাবৎ খবর পেয়ে গেলুম এক হগুপ্তার ভিতর।’
সিগারেট ধরাবার জন্য কথা বন্ধ করে একটুখানি ভেবে নিয়ে বললেন, কিন্তু এ কর্মে একটুখানি খাবসুরৎ হতে হয়। আমি—’ বলে থামলেন।
আমি বললুম, ‘আপনার চেহারা সম্বন্ধে কি আর বলব।–’
বাধা দিয়ে বললেন, ‘থ্যাঙ্ক ইউ, থ্যাঙ্ক ইউ। তারপর করলুম। কি জানেন, একপ্রস্ত উত্তম সুট পরে, গোঁফে আন্তর মেখে লেগে গেলুম নর্তকীর পিছনে। প্রেমের কবিতাগুলো ঝালিয়ে নিলুম। আচ্ছা করে, টাঙ্গো ওয়ালটিস নাচের নবীনতম ‘অবদানগুলা’ রপ্ত করে নিয়ে দিলুম হানা। জানতুম, রাজনৈতিক মসিয়ো অনুস্বারের টাকার জোয়ারের উপর আমি থাড্ডে কেলাস খোলামকুচি, কোথায় ভেসে যাব কেউ পাত্তাটি পাবে না, কিন্তু খোলামকুচি না হয়ে যদি পদ্মফুল হই-চেহারাটা বিবেচনা করুন—তা হলে নর্তকী কি একটুখানি মোলায়েম হবে না?
‘আমি অবিশ্যি নর্তকীকে প্রিয়ারূপে চিরকালের জন্য জিতে নিতে চাই নি। মসিয়ো অনুস্বার তাকে নিয়ে প্রেমসে প্রেমের ঢলাঢ়লি করুন আমার তাতে নাস্যি। আমি শুধু চাই একটুখানি খবর।
‘কিছুটা ভাবসাব হয়ে যাবার পর আমি আভাসে ইঙ্গিতে বুঝিয়ে দিলুম যে, তিনি যদি অন্য সূত্র থেকে অর্থাৎ অনুস্বারের কাছ থেকে টাকা মারেন তাতে আমার কোনো আপত্তি নেই। তিনি দু ঘোড়া না চড়ে আড়াইশটা চড়ুন আমি আপনাদের দেশের ফকিরের মত নির্বিকার। আমি একটুখানি প্রেমেই খুশি।
কাজেই আস্তে আস্তে প্রেমের নেশায় বানচাল হয়ে নর্তকী খবর দিয়ে ফেললেন, কোন হোটেলে কবে তাঁরা গোপনে স্বামী-স্ত্রী রূপে বাস করেছেন, কোন ইয়েটে কবে ক’দিন ক’রাত্তির কাটিয়েছেন। সেই খেই ধরে তাবৎ গোপনীয় খবর যোগাড় করে গেলুম,
তাতে অবশ্য নর্তকী সম্পৰ্কীয় কিঞ্চিৎ প্রমাণিক সংবাদও থাকবে। তবে কিনা, কিছু অর্থ পেলে আমি এসব ছাপবো না।’
অনুস্বার জউরি এবং ঘড়েল লোক। যেসব হোটেলে জল সই করেছেন তার ফোটোগ্রাফ দেখে বুঝলেন আমিও কাঁচা নাই।
তারপর বললেন, লিখি নি বলেই তো টাকা পেলুম, হাজার দশেক। যাকগে, এখন আমি চললুম।’
ব্যাপারটা বুঝতে আমার মিনিট খানেক লাগল। তখন ছুটে গিয়ে তাঁকে বললুম, ‘এটা কি তবে ব্ল্যাক-মেলিং হল না?’
হেসে বললেন, ‘অর্থাৎ ‘না-লিখিয়ে জার্নালিস্ট’। তাই তো বলছিলুম, ভাষা জিনিসটি অদ্ভুত।’
আমি স্বয়ং জার্নালিস্ট-আঁৎকে উঠলুম।