দাম্পত্য জীবন
যাঁদের ঝড়তি-পড়তি মালা কুড়িয়ে নিয়ে ভাঙিয়ে খাচ্ছি।–অর্থাৎ ‘পঞ্চতন্ত্ৰ’ তৈরি করছি তাঁদের সঙ্গে ‘দেশের পাঠক-পাঠিকার যোগসূত্র স্থাপন করার বাসনা এ-অধমের প্রায়ই হয়। তাঁদেরই একজন আমার এক চীনা-বন্ধু। সত্যকারী জহুরী লোক-লাওৎসে, কন-ফুৎসিয়ে টৈ-টম্বর হয়ে আছেন। তত্ত্বালোচনা আরম্ভ হলেই শাস্ত্রবচন ওষ্ঠাগ্রে। আমি যে পদে পদে হার মানি সে-কথা আর রঙ ফুলিয়ে, তুলি-বুলিয়ে বলতে হবে না।
ক্লাবের সুদূরতম প্রত্যন্ত প্রদেশে একটি নিমগাছের তলায় বসে তিনি আপিস ফাঁকি দিয়ে চা পান করেন। তাঁর কাছ থেকে আমি এস্তার এলেম হাঁসিল করেছি—তারই একটা আপিস ফাঁকি দেওয়া। কাছে পৌঁছতেই একগাল হেসে নিলেন–অর্থ সুস্পষ্ট-ছোকরা কাবেল হয়ে উঠছে। আর কদিন বাদেই আপিস-যাওয়া বিলকুল বন্ধ করে পুরো তনখা টানবে।
ইতিমধ্যে এক ইংরেজও এসে উপস্থিত।
রসালাপ আরম্ভ হল। কথায় কথায় বিবাহিত জীবন নিয়ে আলোচনা। সাহেব বললে, লন্ডনে একবার স্বামীদের এক আড়াই মাইল লম্বা প্রসেশন হয়েছিল, স্ত্রীদের অত্যাচারের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ জানাবার জন্য। প্রসেশনের মাথায় ছিল এক পাঁচ ফুট লম্বা টিঙটিঙে হাড়ি-সার ছোকরা। হঠাৎ বলা নেই, কওয়া নেই, ছ’ফুট লম্বা ইয়া লাশ এক ঔরৎ দুমদুম করে তার দিকে এগিয়ে গিয়ে তার হাত ধরে এক হাঁাচক টান দিয়ে বললে, তুমি এখানে কেন, তুমি তো আমাকে ডরাও না! চলো বাড়ি। সুড়সুড়ি করে ছোকরা চলে গেল সেই খাণ্ডার বউয়ের পিছনে পিছে।’
আমার চীনা বন্ধুটি আদিত-মাফিক মিষ্টি মৌরী হাসি হাসলেন। সায়েব খুশি হয়ে চলে গেল।
গুটিকয়েক শুকনো নিমপাতা টেবিলের উপর ঝরে পড়ল। বন্ধু তাই দিয়ে টেবিলক্লথের উপর আল্পনা সাজাতে সাজাতে বললেন, কী গল্প! শুনে হাসির চেয়ে কান্না পায় বেশি।’ তারপর চোখ বন্ধ করে বললেন,
চীনা গুণী আচার্য সূ তাঁর প্রমাণিক শাস্ত্রগ্রন্থে লিখেছেন, একদা চীন দেশের পেপিং শহরে অত্যাচার-জর্জিরিত স্বামীরা এক মহতী সভার আহ্বান করেন। সভার উদ্দেশ্য, কি প্রকারে নিপীড়িত স্বামীকুলকে তাঁদের খাণ্ডার গৃহিণীদের হাত থেকে উদ্ধার করা যায়?
‘সভাপতির সম্মানিত আসনে বসানো হল সবচেয়ে জাঁদরেল দাড়িওয়ালা অধ্যাপক মাওলীকে। ঝাড়া ষাটটি বছর তিনি তার দাজ্জাল গিন্নির হাতে অশেষ অত্যাচার ভুঞ্জেছেন। সে কথা সকলেরই জানা ছিল।
‘ওজস্বিনী ভাষায় গভীর কণ্ঠে বজনির্ঘোষে বক্তার পর বক্তা ঘণ্টার পর ঘণ্টা আপন আপন অভিজ্ঞতা বলে যেতে লাগলেন। স্ত্রীলোকের অত্যাচারে দেশ গেল, ঐতিহ্য গেল, ধর্ম গেল, সব গেল, চীন দেশ হটেনটটের মুলুকে পরিণত হতে চলল, এর একটা প্রতিকার করতেই হবে! ধন-প্ৰাণ, সর্বস্ব দিয়ে এ অত্যাচার ঠেকাতে হবে। এস ভাই, এক জোট
হয়ে–
‘এমন সময় বাড়ির দারোয়ান হস্তদন্ত হয়ে ছুটে এসে বলল, ‘হুজুররা একবার আসুন। আপনাদের গিন্নিরা কি করে এ সভার খবর পেয়ে বঁটা, ছেঁড়া জুতো, ভাঙা ছাতা ইত্যাদি যাবতীয় মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এদিকে ধাওয়া করে আসছেন।’
‘যেই না শোনা, আর যাবে কোথায়? জানলা দিয়ে, পেছনের দরজা দিয়ে, এমন কি ছাত ফুটো করে, দেয়াল কাণা করে দে ছুটী! দে ছুটী! তিন সেকেন্ডে মিটিঙ সাফ-বিলকুল ঠাণ্ডা!
‘কেবলমাত্র সভাপতি বসে আছেন সেই শান্ত গভীর মুখ নিয়ে-তিনি-বিন্দুমাত্র বিচলিত হন নি। দারোয়ান তার কাছে ছুটে গিয়ে বার বার প্রণাম করে বলল, ‘হুজুর যে সাহস দেখাচ্ছেন তার সামনে চেঙ্গিস খানও তসলীম ঠুকতেন, কিন্তু এ তো সাহস নয়, এ হচ্ছে আত্মহত্যার সামিল। গৃহিণীদের প্রসেশনের সক্কলের পয়লা রয়েছেন আপনারই স্ত্রী। এখনো সময় আছে। আমি আপনাকে নিরাপদ জায়গায় নিয়ে যাচ্ছি।’ সভাপতি তবু চুপ। তখন দারোয়ান তাকে তুলে ধরতে গিয়ে দেখে তাঁর সর্বাঙ্গ ঠাণ্ডা। হার্ট ফেল করে মারা গিয়েছেন।’
আচার্য উ থামলেন। আমি উচ্ছসিত হয়ে ‘সাধু সাধু’, ‘শাবাস, শাবাসা’ বললুম। করতালি দিতে দিতে নিবেদন করলুম, ‘এ একটা গল্পের মত গল্প বটে।’
আচাৰ্য উ বললেন, ‘এ বিষয়ে ভারতীয় আপ্তবাক্য কি?’
চোখ বন্ধ করে আল্লা রসূলকে স্মরণ করলুম, পীর দরবেশ গুরু ধর্ম কেউই বাদ পড়লেন না। শেষটায় মৌলা আলীর দয়া হল!
হাত জোড় করে বরজলালের মত ক্ষীণ কণ্ঠে ইমন কল্যাণ ধরলুম।
শ্রীমন্মহারাজ রাজাধিরাজ দেবেন্দ্রবিজয় মুখ কালি করে একদিন বসে আছেন ঘরের অন্ধকার কোণে। খবর পেয়ে প্রধানমন্ত্রী এসে শুধালেন, ‘মহারাজের কুশল তো?’ মহারাজ রা। কাড়েন না। মন্ত্রী বিস্তর পীড়াপীড়ি করাতে হঠাৎ খ্যাক খ্যাক করে উঠলেন, ‘ঐ রাণীটা–কি দাজ্জাল, কি খাণ্ডার: বাপরে বাপ! দেখলেই আমার বুকের রক্ত হিম হয়ে আসে।’
মন্ত্রীর যেন বুক থেকে হিমালয় নেমে গেল। বললেন ‘ওঃ! আমি ভাবি আর কিছু। তাতে অতো বিচলিত হচ্ছেন কেন মহারাজ! বউকে তো সব্বাই ডরায়-আম্মো ডরাই। তাই বলে তো আর কেউ এরকমধারা গুম হয়ে বসে থাকে না।’
রাজা বললেন, ‘ঐ তুমি ফের আরেকখানা গুল ছাড়ােল।’ মন্ত্রী বললেন, ‘আমি প্রমাণ করতে পারি।’ রাজা বললেন, ‘ধরো বাজি।’ ‘কত-মহারাজ! দশ লাখ?’ ‘দশ লাখ।’
পরদিন সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত শহরে ঢোল পেটানোর সঙ্গে সঙ্গে হুকুমজারি হল—বিষ্যদবার বেলা পাঁচটায় শহরের তাবৎ বিবাহিত পুরুষ যেন শহরের দেয়ালের বাইরে জমায়েৎ হয়; মহারাজ তাদের কাছ থেকে একটি বিষয় জানতে চান।
লোকে লোকরণ্য। মধ্যিখানে মাচাঙ—তার উপরে মহারাজ আর মন্ত্রী। মন্ত্রী চেচিয়ে বললেন, ‘মহারাজ জানতে চান তোমরা তোমাদের বউকে ডরাও কি না। তাই তার হয়ে আমি হুকুম দিচ্ছি। যারা বউকে ডরাও তারা পাহাড়ের দিকে সরে যাও আর যারা ডরাও না তারা যাও নদীর দিকে।’
যেই না বলা আমনি হুড়মুড় করে, বাঘের সামনে পড়লে গোরুর পালের মত, কালবৈশাখীর সামনে শুকনো পলাশ পাতার মত সবাই ধাওয়া করলে পাহাড়ের দিকে, একে অন্যকে পিষ, দলে, থেঁৎলে-তিন সেকেন্ডের ভিতর পাহাড়ের গা ভর্তি।
বউকে না-ডরানোর দিক বিলকুল ফর্সা। না, ভুল বললুম। মাত্র একটি রোগা টিঙটিঙে লোক সেই বিরাট মাঠের মধ্যিখানে লিক্লিক করছে।
রাজা তো অবাক। ব্যাপারটা যে এরকম দাঁড়াবে তিনি তার কল্পনাও করতে পারেন নি। মন্ত্রীকে বললেন, ‘তুমিই বাজি জিতলে। এই নাও দশ লখা হার।’ মন্ত্রী বললেন, ‘দাঁড়ান, মহারাজ। ঐ যে একটা লোক রয়ে গেছে।’ মন্ত্রী তাকে হাতছানি দিয়ে ডাকলেন। কাছে এলে বললেন, ‘তুমি যে বড় ওদিকে দাঁড়িয়ে? বউকে ডরাও না বুঝি?’
লোকটা কাঁপিতে কাঁপিতে কঁদো কঁদো হয়ে বললে, ‘অতশত বুঝিনে, হুজুর। এখানে আসবার সময় বউ আমাকে ধমক দিয়ে বলেছিল, ‘যেদিকে ভিড় সেখানে যেয়ো না।’ তাই আমি ওদিকে যাই নি।’
আচাৰ্য উ আমাকে আলিঙ্গন করে বললেন, ‘ভারতবর্ষেরই জিৎ। তোমার গল্প যেন বাঘিনী-বউ। আমার গল্প ভয়ে পালালো।’
তবু আমার মনে সন্দ রয়ে গিয়েছে। রসিক পাঠক, তুমি বলতে পারো কোন গল্পটাকে শিরোপা দি??