আমার ভাণ্ডার আছে ভরে

আমার ভাণ্ডার আছে ভরে

শব্দপ্রাচুর্যের উপর ভাষার শক্তি নির্ভর করে। ইংরেজি এবং বাংলা এই উভয় ভাষা নিয়ে যাদের একটুখানি ঘাঁটাঘাঁটি করতে হয়, তারাই জানেন বাঙলার শব্দ-সম্পদ কত সীমাবদ্ধ। ডাক্তারি কিংবা ইঞ্জিনীয়ারিং টেকনিকেল শব্দের কথা তুলছি নে—সে সব শব্দ তৈরি হতে দেরি—উপস্থিত সে শব্দের কথাই তুলছি যেগুলো সাহিত্য ক্ষেত্রেই সর্বদা দরকার হয়।

ইংরেজির উদাহরণই নিন। ইংরেজি যে নানা দিক দিয়ে ইয়োরোপীয় সর্বভাষার অগ্রগণ্য তার অন্যতম প্রধান কারণ ইংরেজির শব্দ-সম্পদ। এবং ইংরেজি সে সম্পদ আহরণ করেছে অত্যন্ত নির্লজের’র মত পূর্ব-পশ্চিম সর্ব দেশ মহাদেশ থেকে। গ্ৰীক, লাতিনের মত দুটো জোরালো ভাষা থেকে তার শব্দ নেবার হক তো সে উত্তরাধিকারসূত্রে পেয়েইছে, তার উপর ফরাসির উপরও ওয়ারিশন বলে তার ষোল আনা অধিকার। তৎসত্ত্বেও-সুকুমার রায়ের ভাষায় বলি—

এতো খেয়ে তবু যদি নাহি ওঠে মনটা
খাও তবে কচু-পোড়া খাও তবে ঘণ্টা!

ইংরেজ উত্তরে বেশিরমের মত বলে, ‘ঠিক বলেছে, আমার মনে ওঠে নি, আমি কচুপোড়া এবং ঘণ্টা খেতেও রাজী!’

তাই দেখুন ইংরেজ, আরবী, ফার্সী, তামিল, হিন্দি, মালয়—কত বলবো?-দুনিয়ায় তাবৎ ভাষা থেকে কচু-পোড়া ঘণ্টা সব কিছু নিয়েছে, এবং হজমও করে ফেলেছে। ‘এডমিরাল নিয়েছে আরবী, ‘আমীর-উল-বহর’ থেকে, ‘চেক’ (কিস্তিমতের) নিয়েছে পাসী। ‘শাহ’ থেকে, ‘চুরুট’ নিয়েছে তামিল ‘শুরুট্টু’ থেকে, ‘চৌকি’ নিয়েছে হিন্দি থেকে, ‘এমাক’ নিয়েছে মালয় থেকে।

(কিন্তু আশ্চর্য, ইংরেজের এই বিদঘুটে গরুড়ের ক্ষুধা শব্দ বাবদেই; আহারাদির ব্যাপারে ইংরেজ নকিষ্যি কুলীনের মত উন্নাসিক, কট্টর স্বপাকে খায়, এদেশে এত কাল কাটানোর পরও ইংরেজ মাস্টার্ড (অর্থাৎ সর্ষেবাটা বা কাসুন্দি) এবং মাছে মিলিয়ে খেতে শেখে নি, অথচ কে না জানে সর্ষেবাটায় ইলিশ মাছ খাদ্য-জগতে অন্যতম কুতুব-মিনার? ইংরেজ এখনো বিস্বাদ ফ্রাইড ফিশ খায়, মাছ বাছতে শিখলো না; আমরা তাকে খুশি করার জন্য পাস্তুয়ার নাম দিলুম লেডিকিনি (লেডি ক্যানিং) তবু সে তাকে জাতে তুললো না, ছানার কদর বুঝলো না। তাই ইংরেজের রান্না এতই রসকষ-বর্জিত, বিস্বাদ এবং একঘেয়ে যে তারই ভয়ে কন্টিনেন্টাল মাত্ৰই বিলেত যাবার নামে আঁৎকে ওঠে-যদি নিতান্তই লন্ডন যায়। তবে খুঁজে খুঁজে সোহো মহল্লায় গিয়ে ফরাসি রেস্তোরায় ঢুকে আপন প্রাণ বাঁচায়। আমার কথা বাদ দিন, আমার পেটে এটম বোম মারলেও আমি ইংরিজি খানা দিয়ে আমার পেট ভরাতে রাজী হবে না।)

শব্দের জন্য ইংরেজ দুনিয়ার সর্বত্র ছোঁক ছোক করে বেড়ায় সে না হয়ে বুঝলুম; কিন্তু ইংরেজের মত দন্তী জাত যে দুশমনের কাছ থেকেও শব্দ ধার নেয়। সেইটেই বড় তাজবীকী বাৎ{ এই লড়াইয়ের ডামাডোলে সবাই যখন আপনি আপন প্রাণ বাঁচাতে ব্যস্ত তখনো ইংরেজ গোটা কয়েক শব্দ দুশমনের কাছ থেকে ধার নিয়ে দাঁত দেখিয়ে হোসেছে। লুফট-ভাফফের মার খেয়ে খেয়ে ইংরেজ যখন মর-মর তখনো সে মনে মনে জপছে, লুফট-ভাফফে, লুফট-ভাফফে, শব্দটা ভুললে চলবে না’, ক্লিৎসক্রীগের ঠেলায় ইংরেজ যখন ডানকার্কে ডুবু ডুবু তখনো ইষ্টনাম না জপে সে জপেছে, ‘ব্লিৎস-ক্রীগ, ক্লিৎস-ক্রীগ।’

আর বেতামিজীটা দেখুন। গালাগাল দেবার বেলা যখন আপন শব্দে কুলোয় না— মা লক্ষ্মী জানেন সে ভাণ্ডারেও ইংরেজের ছয়লাব-তখনো সে চক্ষুলজার ধার ধারে না। এই তো সেদিন শুনলুম কাকে যেন স্বাধিকার প্রমত্ত’ বলতে গিয়ে কোনো এক ইংরেজ বড় কর্তা শত্রুপক্ষকে শাসিয়েছেন, ‘আমাদের উপর ফ্যুরার-গিরার ফাপরদালালি করো না।’

পাছে এত সব শব্দের গন্ধমাদন ইংরেজকে জগন্নাথের জগদ্দল পাথরে চেপে মারে তাই তার ব্যবস্থাও সে করে রেখেছে। ‘জগন্নাথ’ কথাটা ব্যবহার করেই সে বলেছে, ‘ভেবে চিন্তে শব্দভাণ্ডার ব্যবহার করবে-পাগলের মত ডোন্ট থ্রো ইয়োরসেলভস আন্ডার দি হুইল অব Juggernaut (জগন্নাথ) ‘

ব্যাটারা আমাদের জগন্নাথকে পর্যন্ত সমুদ্রযাত্ৰা করিয়ে দেশে নিয়ে ছেড়েছে। পারলে তাজমহল আর হিমালয়ও আগেভাগেই নিয়ে বসে থাকত-কেন পারে নি। তার কারণ বুঝতে বেগ পেতে হয় না।

ফরাসি জাতটা ঠিক তার উল্টো। শব্দ গ্রহণ বাবদ সে যে কত মারাত্মক ছুঁৎবাইগ্ৰস্ত তা বোঝা যায় তার অভিধান থেকে। পাতার পর পাতা পড়ে যান, বিদেশী শব্দের সন্ধান পাবেন না। মনে পড়ছে, আমার তরুণ বয়সে শান্তিনিকেতনের ফরাসি অধ্যাপক বেনওয়া সায়েবের সঙ্গে যোগাযোগ হয়। রোমা রলাঁর পঞ্চাশ না ষাট বছর পূর্ণ হওয়াতে পৃথিবীর বড় বড় রল-ভক্তেরা তখন তাকে একখানা রিল-প্রশস্তি উপহার দেন। এ-দেশ থেকে গাঁধী, জগদীশ বসু ওঁরা সব লিখেছিলেন-রবীন্দ্রনাথ লিখেছিলেন কি না ঠিক মনে পড়ছে না। বেনওয়া সায়েবও সে-কেতবে একখানা প্ৰবন্ধ লিখেছিলেন–বিষয়বস্তু শান্তিনিকেতনের আশ্রম’। ‘আশ্রম’ শব্দে এসে বেনওয়া সায়েবের ফরাসি নৌকা বানচাল হয়ে গেল। ‘আশ্রম’ শব্দটা ফরাসিতে লিখবেন কি প্রকারে, অথচ ফরাসি ভাষায় আশ্রম’ জাতীয় কোনো শব্দ নেই। আমি বললুম, ‘প্যারিস শহর আর ব্ৰহ্মচর্যাশ্রম যে বিশ্বব্ৰহ্মাণ্ডের দুই প্রান্তে অবস্থিতঅন্তত ভাবলোকে-সে কথা সবাই জানে, তবু-ইত্যাদি।’ বেনওয়া সায়েব ফরাসি কায়দায় শোলডার শ্রাগ করে বললেন, ‘উঁহু, বদহজম হবে।’ সায়েব শেষটায় কি করে জাতিরক্ষণ আর পেট ভরানোর দ্বন্দ্ৰ সমাধান করেছিলেন সে কথাটা এতদিন বাদে আজ আমার আর মনে নেই।

অর্থাভাববশত একদা আমাকে কিছুদিনের জন্য এক ইংরেজ ব্যবসায়ীর ফ্রান্সাগত ফরাসি চিঠি-পত্রের অনুবাদ করে দিতে হয়েছিল। মনে পড়ছে, কারবারে ফরাসি পক্ষ হামেশাই ইংরেজ পক্ষকে দোষারোপ করতো যে ইংরেজ অনেক সময় আপন অভিসন্ধি সাফ সাফ বলে না। ইংরেজি ভাষায় শব্দসম্পদ প্রচুর বলে ইচ্ছে করলেই আপনি বক্তব্য ঘোলাটে, আবছা আবছা করে লেখা যায়। ফরাসিতে সেটি হবার জো নেই। যা বলার সেটা পরিষ্কার হয়ে বেরবেই বেরবে। (লক্ষ্য করে থাকবেন কাচাবাচ্চার শব্দ-সম্পদ সীমাবদ্ধ বলে তাদের কথায় সব জিনিসই হয় কালো নয়। ধলা, সব কিছুই পরিষ্কার, কোনো প্রকারের হাফটোন নেই)। তাই ফরাসি এই চিঠিপত্র লেনদেনের ব্যাপারে পড়লো বিপদে।

কিন্তু ফরাসিরাও গম যব দিয়ে দিয়ে লেখাপড়া শেখে না। তাই শেষটায় ফরাসি কারবারি হুমকি দিল, সে ইংরেজ রেখে চিঠি-পত্ৰ ইংরিজিতে লেখাবে। ইংরেজ হস্তদন্ত হয়ে চিঠি লিখল, ‘সে কি কথা, আপনাদের বহুৎ তকলিফ হবে, বড় বেশি বাজে খৰ্চা হবে, এমন কৰ্ম্ম করতে নেই।’

তখন একটা সমঝাওতা হল।

***

Gepaeckaufbewahrungstelle!

শব্দটা শুনে মূৰ্ছা যাই আর কি! প্রথমবার বার্লিন যাচ্ছি, জর্মন ভাষার জানি শুধু ব্যাকরণ, আর কণ্ঠস্থ আছে হাইনরিশ হাইনের গুটিকয়েক মোলায়েম প্রেমের কবিতা। সে-রেস্ত দিয়ে তো বার্লিন শহরে বেসাতি করা যায় না। তাই একজন ফরাসি সহযাত্রীকে ট্রেনে বার্লিন পৌঁছবার কিছু আগে জিজ্ঞেস করলুম, ‘ক্লোক-রুম’’ বা ‘লেফট-লগেজ-অফিসের’ জর্মন প্রতিশব্দ কি? বললেন–

Gepaeckaufbewahrungstelle!

প্রথম ধাক্কায়ই এ-রকম আড়াইগজী শব্দ মুখস্থ করতে পারবো, সে দুরাশা আমি করি নি। মসিয়োও আঁচতে পারলেন বেদনোটা—একখানা কাগজে টুকে দিলেন শব্দটা। তাই দেখলুম। বার্লিন স্টেশনের এক পোর্টারকে। মাল সেখানে রেখে একদা হোটেল খুঁজে নিলুম। ভাগ্যিস ‘’হোটেল’ কথাটা আন্তর্জাতিক-না হলে ক্লোক-রুমের তুলনায় হোটেলের সাইজ যখন পঞ্চাশগুণ বড় তখন শব্দটা পঞ্চাশগুণ লম্বা হত বই কি।

জর্মন ভাষার এই হল বৈশিষ্ট্য। জর্মন ইংরিজির মত দিল-দরিয়া হয়ে যত্রতত্র শব্দ কুড়োতে পারে না, আবার ফরাসির মত শব্দতাত্ত্বিক বাত-ব্যামোও তার এমন ভয়ঙ্কর মারাত্মক নয় যে উবু হয়ে দু’একটা নিত্যপ্রয়োজনীয় শব্দ কুড়োতে না পারে। শব্দ সঞ্চয় বাবদে জর্মন ইংরেজি ও ফরাসির মাঝখানে। তার সম্প্রসারণক্ষমতা বেশ খানিকটা আছে; কিন্তু ইংরিজি রবারের মত তাকে যত খুশি টেনে লম্বা করা যায় না।

জর্মন ভাষার আসল জোর তার সমাস বানাবার কৌশলে আর সেখানে জর্মনের মত উদার ভাষা উপস্থিত পৃথিবীতে কমই আছে।

এই যে উপরের শব্দটা শুনে বিদগ্ধ পাঠক পর্যন্ত কাতর হয়ে পড়েছিলেন সেইটেই নিন! Gepaeck অর্থ যা প্যাক করা যায়, অর্থাৎ লাগেজ, aufibewahrung অর্থ তদারকি করা (ইংরিজি beware কথা থেকে bewahrung); আর stelle কথার অর্থ জায়গা। একুনে হল লাগেজ তদারকির জায়গা’। জর্মন সবকটা শব্দকে আলাদা আলাদা রূপে বিলক্ষ চেনে বলেই সমাসটার দৈর্ঘ্য তাকে কিঞ্চিৎমাত্র বিচলিত করে না।

তুলনা দিয়ে বক্তব্যটা খোলসা করি।

‘কিংকর্তব্যবিমূঢ়’ কথাটার সামনে আমরা মোটেই কিংকর্তব্যবিমূঢ় হই নে। তার কারণ, কর্তব্য আর বিমূঢ় আমরাই হামেশাই ব্যবহার করি আর কিং কথাটার সঙ্গেও আমাদের ঈষৎ মুখ চেনাচেনি আছে। কাজেই সমাসটা ব্যবহার করার জন্য আমাদের বড্ড বেশি ‘প্রত্যুৎপন্নমতিত্বের প্রয়োজন হয় না। যারা সামান্যতম বাঙলা জানে না তাদের কথা হচ্ছে না, তারা নিত্যসা ফতেনা দিয়ামা’ করে এবং ঘৃত-তৈল-লবণ-তণ্ডুল-বস্ত্ৰ ইন্ধনের সামনে ঘরপোড়া গোরুর মত সিঁদুরে মেঘ দেখে ডরায়।

বড্ড বেশি লম্বা সমাস অবিশ্যি কাজের সুবিধে করে দেয় না। তাই যারা সমাস বানাবার জন্যই সমাস বানায় তাদের কচকচানি নিয়ে আমরা ঠাট্টা-মস্করা করি। জর্মনরাও করে। রাজনৈতিক বিসমার্ক পর্যন্ত সমাস বানাবার বাই নিয়ে ঠাট্টা করতে কসুর করেন নি। ‘ড্রগিস্ট’ শব্দটা জর্মনে চলে, কিন্তু তার একটা উৎকট জর্মন সমাস স্বয়ং বিসমার্ক বানিয়ে দিয়ে গিয়েছেন।

Gesundheitswiederherstellungsmittelzusammen mischungverhaeltnisskundiger.

টুকরো টুকরো করলে অর্থ হয়; ‘স্বাস্থ্যু’, ‘পুনরায় দান’, ‘সর্বভেষজ’, ‘একসঙ্গে মেশানোর তত্ত্বজ্ঞান’। একুনে হবে ‘স্বাস্থ্যপুনরাদানসৰ্বভৈষজসংমিশ্রণশাস্ত্ৰজ্ঞ’।

(সমাসটায় কোনো ভুল থেকে গেলে বিদগ্ধ পাঠক বিরক্ত হবেন না–আমার সংস্কৃতজ্ঞান ‘নিত্যসা ফতেন’ জাতীয়)।

সংস্কৃত ভাষা সমাস বানানোতে সুপটু, সে-কথা আমরা সবাই জানি এবং প্রয়োজনমতো আমরা সংস্কৃত থেকে সমাস নিই, কিন্তু নতুন সমাস যদি বা আমরা বানাই তবু কেমন যেন আধুনিক বাংলায় চালু হতে চায় না। আলোকচিত্র’, ‘যাদুঘর’, ‘হাওয়াগাড়ি’ কিছুতেই চললো না।-ইংরিজি কথাগুলোই শেষপর্যন্ত ঠেলে ধাক্কা দিয়ে ঘরে ঢুকে আসন জাঁকিয়ে বসলো। দ্বিজেন্দ্ৰনাথ নির্মিত automobile কথার স্বতশ্চলশকট’ সমাসটা চালানোর ভরসা আমরা অবশ্য কোনো কালেই করি নি।

বিশেষ করে এই দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্যই এ প্রস্তাবটি আমি উত্থাপন করেছি—এবং এতক্ষণ ধরে তারই পটভূমিকা নির্মাণ করলুম।

ভাষাকে জোরালো করার জন্য যে অকাতরে বিদেশী শব্দ গ্ৰহণ করতে হয়, সেকথা অনেকেই মেনে নেন, কিন্তু আপন ভাষারই দুটো কিংবা তারও বেশি শব্দ একসঙ্গে জুড়ে দিয়ে যে তৃতীয় শব্দ নির্মাণ করে ভাষার শব্দভাণ্ডার বাড়ানো যায় সে দিকে সচরাচর কারো খেয়াল যায় না।

এই সমাস বাড়ানোর প্রবৃত্তি এবং ক্ষমতা কোনো কোনো ভাষার নেই। ইংরিজি ফরাসি কেঁদে-কুকিয়ে দৈবাৎ দু’একটা সমাস বানাতে পারে–যথা হাইব্রাও’, ‘রাব্দেভু’। এ প্রবৃত্তি যে ভাষার নেই, তার ঘাড়ে এটা জোর করে চাপানো যায় না।

বাংলার আছে, কিন্তু মরমর। এখানে শুদ্ধ সংস্কৃত সমাসের কথা হচ্ছে না-সে তো আমরা নিইই—আমি খাঁটি বাংলা সমাসের কথা ভাবছি। হুতোমের আমলেও অশিক্ষিত বাঙালি খাঁটি বাঙলা শব্দ দিয়ে খাস সমাস বানাতো। মেছুনি ডাকছে, ‘ও-’গামছা-কেঁধে’, দাঁড়া, ঐ হোথায় খ্যাংরা-গোপো’ তোর সঙ্গে কথা কইতে চায়।’

একেই বলে সমাস! চট করে ছবিটা চোখের সামনে ভেসে ওঠে।

কিন্তু আজকালকার লেখকেরা এরকম সমাসের দিকে নজর দেন না, নতুন সমাস গড়বার তকলিফ বরদাস্ত করতে তো তারা বিলকুল নারাজ বটেনই। সমাস বানাবার প্রবৃত্তিটা অনাদরে ক্রমেই লোপ পেয়ে যাচ্ছে, কারণ লব্ধপ্রতিষ্ঠ লেখকেরা যদি দিশী সমাসকে আপন লেখনে স্থান না দেন, তবে ক্ৰমে ক্ৰমে গোটা প্রবৃত্তিটা বেমালুম লোপ পায়-যে–রকম। বাউল-ভাটিয়ালী সাহিত্যিকদের কাছে সম্মান পাচ্ছে না বলে ক্ৰমেই উপে যাচ্ছেপরে যখন কুঁশ হয় ততদিনে ভাষায় লড়াইয়ের একখানা উমদা-সে উমদ হাতিয়ার অবহেলায় মর্চে ধরে শেষ হয়ে গেছে। তখন শুধু মাথা-চাপড়ানো আর কান্নাকাটি।

রবীন্দ্রনাথ এ তত্ত্বটা শেষ বয়সে বিলক্ষণ বুঝতে পেরেছিলেন এবং সেই শেষ রাতেই ওস্তাদের মারা দেখিয়ে গিয়েছেন :—

‘ডাকছে থাকি থাকি
ঘুমহারা কোন ‘নাম-না-জানা’ পাখি,
দক্ষিণের ‘দোলা-লাগা’, ‘পাখি-জাগা’
বসন্ত প্ৰভাতে’

তাই বলি বাঙলা ভাষা লক্ষ্মীছাড়া’, ‘হতভাগা’ নয়! শুধু হাতির মত আমরা নিজেদের তাগাদ জানি নে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *