মাদ্রাজ উপকণ্ঠের বেলাভূমি
এই যে সামনের বালুপাড়ের উপর জেলেপাড়া এর সঙ্গে মানব-সভ্যতার কোথায় যোগসূত্ৰ-এই পাড়ার বাইরে যে সংসার তার উপরে সে কথাটা নির্ভর করে, কি পরিমাণ সহযোগিতা পায়?
এদের ঘরে যা তৈজসপত্র তা বিক্রি করলে দুটাকার বেশি উঠবে না। যে সব বাসনকোসন সামনের রাস্তার কলতলায় ধুতে নিয়ে আসে তার অধিকাংশ মাটির। দৈন্য বোধ হয় এদের চরম, কারণ হাঁড়ি-কলসীগুলোও অত্যন্ত মামুলি-তাদের আকারপ্রকারে সামান্যতম সৌন্দর্যের সন্ধান নেই। এমনই এবড়ো-থেবড়ো যে কোনো গতিকে দাঁড় করানো যায় মাত্ৰ—ভার-কেন্দ্ৰ বলে কোনো জিনিস বেশির ভাগ হাঁড়ি-কলসীতে নেই।
পুরুষরা কাজকর্ম করে সুন্ধু একখানা কালো রঙের এক বিঘৎ চওড়া নেংটি আর ঘুনসি পরে। সন্ধ্যেবেলায় দেখেছি। কেউ কেউ ধুতি-শার্ট পরে –বেশীর ভাগ যে জামাকাপড় পরে সেগুলো দেখে মনে হয় যেন মাছের বদলে কুড়িয়ে নেওয়া পরিত্যক্ত বুশশার্ট, বোতামহীন শার্ট। ময়লা ঝোলাব্বালা শর্ট-শার্ট দেখে স্পষ্ট বোঝা যায়, নিতান্ত হিম বাতাসের কনকনানিতে বাধ্য হয়ে পরেছে।
মেয়েরা পরেছে উত্তর ভারতে তৈরি মিলের শাড়ি। দক্ষিণ ভারতের সুন্দর সবুজসোনালি, মেরুন-নীল রঙের মামুলি শাড়ি কেনার পয়সা এদের নেই। একরঙা জামা যা পড়েছে তা সে এমনি বিবৰ্ণ আর রুক্ষ যে সেটা পরার কোন অর্থ বোঝা যায় না-পরার কি প্রয়োজন? আমাদের জেলেনীরা তো পরে না। দু’একজনের পায়ে আংটি, হাতে বালা, নাকে ফুল-সবই রূপোর। 4.
এরা কেরোসিনের ডিবে জ্বালায় না, রেড়ির তেলের পিদিম এখনো বুঝে উঠতে পারে নি। আর সে জালানোই বা কতক্ষণের জন্য? সন্ধ্যে ভালো করে ঘনাতে-না-ঘনাতেই সাঁজের পিদিম দেখিয়ে এরা আলো নিভিয়ে ফেলে।
এদের মাছ-ধরার জাল, খানকয়েক এবড়ো-থেবড়ো তক্তায় জোড়া কাটা মারুন ভেলা, দড়াব্দড়ি সব কিছুই এদের নিজের হাতে তৈরি—সামান্য সীসের গুল আর লোহার পেরেক হয়ত সভ্য মানবের কাছ থেকে কিনে নেওয়া।
এদের ছেলেমেয়েরা ইস্কুল যায় না, ব্যামো শক্ত না হলে ডাক্তার হাসপাতালের সন্ধান করে না!
শহরের সভ্যতার কাছ থেকে এই নগণ্য,-প্রায় উদ্ধৃবৃত্তিলব্ধ—ন্যাকড়াটুকু গুলিপেরেকটার বদলে এরা সকাল সন্ধ্যা খাটে। যে মাছ ধরে তার অতি সামান্য অংশ খায়, বেশির ভাগ বিক্রি’ করে দিতে হয় ঐ ন্যাকড়টুকু, ঐ পেরেকটা আর দুমুঠো চালের জন্য। ‘বেচাকেনা’র নামে এই নগ্ন প্ৰবঞ্চনা চোখের সামনে যুগ যুগ ধরে চলে আসছে।
‘নগ্ন প্রবঞ্চনা?’ চক্ষুষ্মান লোকের সামনে এ নগ্নতা ধরা পড়ে। আর সবাই দেখছে সেই গল্পের রাজা যেন ফকিকারের জামা-কাপড় পরে শোভাযাত্রায় চলেছেন। সভ্যতা’র এই শোভাযাত্রার মাঝখানে সেই সরল বালকের চোঁচানো কেউ শুনতে পায় না-কিংবা চায় না।
***
সমুদ্রের গর্জন আর বাতাসের হাহাকারে যতক্ষণ বারান্দা মুখরিত থাকে, ততক্ষণ রাস্তার কলতলার শব্দ কানে আসে—না—শুধু দেখি সমুদ্রপরের জেলেরা আসছে পথের পাশের কলতলায় নাইতে অথবা কাপড় কাচতে; মেয়েরা আসছে জল নিতে, বাসন ধুতে, কাপড় কাচাতে, কাচ্চা-বাচ্চাদের নাওয়াতে, মাথা ঘষতে। কল থেকে জল বেরোয় অতি মন্দগতিতে- একটি কলসী ভারতে আধা ঘণ্টাটাক লাগে।
বেশী ভিড় না থাকলে দূর গায়ের মেয়েরা শহরে যাবার মুখে মাথা থেকে চুবড়ি নামিয়ে দুদণ্ড জিরিয়ে নেয়, কলে হাত পা ধোয়।
আপিস কিংবা কারখানা যাওয়ার তাড়া থাকলে নিশ্চয়ই কালতলায় ঝগড়াঝাঁটি বেধে যেত। এখানে সব কিছু ধীরে-সুস্থে এগোয়। ঐ যে জেলেটা আরাম করে কলতলায় গা এলিয়ে দিয়েছে তার জন্য কলসী হাতে মেয়েটার কোনো আপত্তি আছে বলে মনে হচ্ছে না। যে কথাবার্তা হচ্ছে তা সমুদ্রের গর্জনে আর বাতাসের শনশনানিতে শোনা যাচ্ছে না।
আজ বাদলার দিন। নাইবার চাড় নেই বলে কলতলায় ভিড় কম। কচ্চা-বাচ্চারা তো একদম আসে নি। কিন্তু কড়া গরম পড়লে এখানে রীতিমত হাট বসে যায়। কড়া গরম পড়ার মানে যে তখন হাওয়া বন্ধ, কাজেই তখন একটু আধটু চিৎকারও শোনা যায়— মেজাজও তখন কড়া হয়ে যায় বলে।
কলতলায় ভিড় কমে এসেছে। দুপুরবেলা খেয়েদেয়ে বারান্দায় দাঁড়িয়ে দেখি, একটি জেলেনী কলসী ভরে দাঁড়িয়ে আছে-কলতলায় আর কেউ নেই যে কলসীটা মাথায় তুলে দেবে।
এমন সময় এক রিক্সাওলা যাচ্ছিল। রিক্সা দাঁড় করিয়ে সে কলসীটা তুলে দিয়ে ফের রিক্সা টানতে টানতে চলে গেল।
মেয়েটা একবার কৃতজ্ঞ নয়নে তাকালো পর্যন্ত না। রিক্সাওলাও অত্যন্ত তাচ্ছিল্যের সঙ্গে সাহায্যটুকু করে গেল-যেন এরকম ধারা করাটা তার হামেশাই লেগে আছে!
একেই বলে খাঁটি ভদ্রতা।