কিসের সন্ধানে

কিসের সন্ধানে

হটেনটট্‌দের কথা আলাদা। শিক্ষালাভের জন্য তারা যেখানে খুশি যেতে পারে। একথা তাদের ভাবতে হয় না, ‘যে-শিক্ষা লাভ করতে যাচ্ছি সেটা আবার দেশের ঐতিহ্যের সঙ্গে খাপ খাবে তো?’ কারণ কোনো প্রকারের ঐতিহ্যের কণামাত্র বালাই তাদের নেই।

ইংরেজ শাসনের ফলে আমরা প্রায় হটেনটটর পর্যায়ভুক্ত হয়ে পড়েছিলুম। আর কয়েকটি বৎসর মাত্র ইংরেজ এদেশে থাকলে আমরা একে অন্যকে কাঁচা খেয়ে ফেলতে আরম্ভ করতুম।

ইংরেজ গিয়েছে। তাই এখন প্রশ্ন উঠেছে আমরা বিদ্যালাভ করতে যাব কোন দেশে? এতদিন এ প্রশ্ন কেউ শুধতো না। টাকা থাকলেই ছোকরােরা ছুটতো হয় অক্সফোর্ডের দিকে নয় কেমব্রিজের পানে। সেখানে সীট না পেলে লন্ডন কিংবা এডিনবরা।

কিমাশ্চর্যমতঃপরম। এই ভারতবর্ষে একদিন বিদ্যা-শিক্ষার এমনি উৎকৃষ্ট ব্যবস্থা ছিল যে, গান্ধার, কম্বোজ, বলহীক, তিব্বত, শ্যাম, চীন থেকে বিদ্যার্থী শ্রমণ এদেশে আসত সত্যজ্ঞান লাভ করার জন্য। এবং বিংশ শতকে দেখলুম, এই ভারতবর্ষের লোকই ধেয়ে চলেছে ইংলন্ডের দিকে বিদ্যালাভে’র জন্য। ভারতীয় ঐতিহ্য তখন তার দুরবস্থার চরমে পৌঁছেছে।

রাধার দুরবস্থা যখন চরমে পৌঁছেছিল, তখন যমুনার জল উজানে বয়েছিল, একথা তাহলে মিথ্যা নয়।

কিন্তু আমাদের ছেলেরা যে ইংলন্ডের পানে উজান স্রোতের মতো বয়ে চলেছিল, সেটা তো রাতারাতি বন্ধ করে দেওয়া যায় না-পরাধীনতা-মুগীটার গলা কাটা যাওয়ার পরও সে খানিকদূর পর্যন্ত ছুটে যায় তারপর ধাপ করে মাটিতে পড়ে। তাই এই বেলা জমাখরচ নিয়ে নেওয়া ভালো, ভারতীয় ছেলে ইয়োরোপে পেত। কি, যেত কিসের আশায়?

রবীন্দ্রনাথ বিশ্বভারতী প্রতিষ্ঠা করার সময় বলেছিলেন, ইউরোপকে আমরা চিনলুম ইংলন্ডের ভিতর দিয়ে–তাই আমাদের প্রায় সকলেরই বিশ্বাস ইংলন্ড আর ইয়োরোপ একই জিনিস। ইংলন্ডের অনেক গুণ আছে সে কথা কেউ অস্বীকার করবে না, কিন্তু ইয়োরোপীয় বৈদগ্ধ্যভাণ্ডারে যে ইংলন্ড তেমন কিছু হীরে-মানিক জমা দিতে পারে নি, সে কথাও সত্য। ইয়োরোপীয় বৈগন্ধ্যের অপ্রতিদ্বন্দ্বী কুতুবমিনার বলতে যাদের নাম মনে আসে-মাইকেল এঞ্জেলো, রদ, রাফায়েল, সেজান, বেটোেফন, ভাগনার, গ্যেটে, টলস্টয়, দেকার্ত, কান্ট, পাসত্যোর, আইনস্টাইন ইংলন্ডে জন্মায় নি। তাই রবীন্দ্ৰনাথ চেয়েছিলেন বিশ্বভারতীতে যেন ফ্রান্স, জর্মনি, ইটালি, রুশ থেকে গুণীজ্ঞানীরা এসে এদেশে ছেলেমেয়েদের সামনে ইয়োরোপীয় সংস্কৃতির পূর্ণাঙ্গচিত্র তুলে ধরেন।

রবীন্দ্ৰনাথ যতদিন বেঁচেছিলেন ততদিন বহু গুণী শাস্তিনিকেতনে এসেছেন, বহু ছাত্র তাদের কাছ থেকে নানা প্রকারে বিদ্যা আহরণ করেছে, কিন্তু আজ শান্তিনিকেতনে সে-মেলা আর বসে না। তবু আমার বিশ্বাস, বাঙালি যদি আত্মবিশ্বাস না হারায় তবে এই শাস্তিনিকেতনেই।–দিল্লি, এলাহাবাদ, আমেদাবাদে নয়-এই শান্তিনিকেতনের পঞ্চবটীর তলায়ই একদিন পঞ্চমহাদেশ সম্মিলিত হবে। আমাদের দেখতে হবে, এই পঞ্চবটী যেন ততদিনে শুকিয়ে না যায়।

ভারতীয় ছেলে যে ইংলন্ডে পড়াশোনা করতে যেত তার কারণ এই নয় যে, তাদের সবাই ধরে নিয়েছিল ইংলন্ডই ইয়োরোপের প্রতীক-তারা ধরে নেয় নি যে, ইয়োরোপ থেকে যা কিছু শেখবার মত আছে তার তাবৎ সম্পদ অক্সফোর্ড কেমব্রিজেই পাওয়া যায়। এদের ভিতর অনেক ছেলেই জানতো, শিল্পকলার জন্য ফ্রান্সে, এবং বিজ্ঞানদর্শনের জন্য জর্মনিতেই গঙ্গোদক পাওয়া যায়-অভাব্যবশত তারা যে তখন কুপোদকের সন্ধানে যেতো। তাও নয়। তার একমাত্র কারণ চাকরি দেবার বেলা ইংরেজ এ জলেরই কদর দেখাতো বেশি। (এতে আশ্চর্য হবার মত কিছু নেই; আয়ানও চাইতেন না যে রাধা। যমুনার জল আনতে যান, পাছে কৃষ্ণের সঙ্গে সেখানে তাঁর দেখা হয়ে যায়-ইংরেজও চাইত না যে, ফ্রান্স জর্মনি গিয়ে আমরা সভ্য ইয়োরোপকে চিনে ফেলি। আয়ান ইংরেজ দু’জনেই তাই কুপোদক-সম্প্রদায়ের মুখপাত্র)।

জানি, আমার পাঠক মাত্ৰই টিপ্লনি কাটবেন। আমি বড় বেশি প্রাদেশিক কিন্তু তাই বলে তো আর ডাহা মিথ্যা কথা বলতে পারি নে। নিবেদন করতে বাধ্য হচ্ছি যে, ইংলন্ডে বর্জন করে। তবু যে কয়টি ছেলে প্যারিস, বার্লিন, মুনিক, ভিয়েনায় জ্ঞানের সন্ধানে যেত তাদের অধিকাংশই বাঙালি।

আশা করি একথা কেউ বলবেন না যে বাঙালির ট্যাকে এত বেশি কড়ি জমে গিয়েছিল যে, সেগুলো ওড়াবার তালে সে প্যারিস যেত, জর্মন ঘুরত। বরঞ্চ বাঙালির বদনাম সে চাকরির সন্ধানে প্ৰাণ পর্যন্ত বিসর্জন দিতে পারে। এক অখ্যাতনামা বাঙালি কবি চাকরি বাঁচানো সম্পর্কে আপিস ধাবমান বাঙালি কেরানীর মুখ দিয়ে বলিয়েছেন—

ভরা পেটে ছুটতে মানা? চিবিয়ে খাওয়া
স্বাস্থ্যকর?
চাকরি আগে বাঁচাই দাদা, প্ৰাণ বাঁচানো
সে তারপর।

যে অন্নের জন্য বাঙালি কেরানীগিরি করে সেই অন্ন পর্যন্ত বাঙালি কেরানী ধীরেসুস্থে খেয়ে আপিস যেতে পারে না। এত বড় প্যারাডক্স, এত বড় স্বাৰ্থত্যাগ বাঙলা দেশের বাইরে আপনি পাবেন না।

আমি বলি–আর আপনার কথায় কান দেব না-বাঙালিরই ঈষৎ রসবোধ ছিল, তাই সে প্যারিস যেত।

প্যারিসে একপ্রকারের হতভাগা চিত্রকারের দল আছে–এদের নাম পেভমেন্ট আর্টিস্ট। এরা আবার দুই সম্প্রদায়ে বিভক্ত। এদের ভিতর যারা কিঞ্চিৎ খানদানি তারা আপন ছবি ফুটপাথের রেলিঙের উপর ঝুলিয়ে রেখে একপাশে চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। আপনি যদি কোনো ছবি সম্বন্ধে কিছু জানতে চান তবে সে পরম উৎসাহে আপনাকে বাৎলে দেবে ছবিটার তাৎপর্য কি! আপনি যদি সঙ্গে সঙ্গে উৎসাহ দেখান তবে সে তার তাবৎ ছবির ঠিকুজি-কুলজি, নাড়ী-নক্ষত্ৰ সব কিছু গড় গড় করে বলে যাবে, আর যদিস্যাৎ আপনি একখানা ছবি কিনে ফেলেন-এ জাতীয় অলৌকিক ঘটনা অতিশয় রাঙা শুকুরবার ছাড়া কখনো দৃষ্টিগোচর হয় না।–তবে সে আপনাকে ও রিভোয়া’ জানাবার সময় কানে কানে বলে দেবে, ‘এ ছবি কিনে আপনি ভুল করেন নি, মসিয়ো—এ ছবি দেখবার জন্য তামাম পৃথিবী একদিন আপনার দোরের গোড়ায়। ধন্না দেবে।’

অবশ্য ততদিন সে উপোস করে। শেষটায় সে-দিন না দেখেই সে মরে-শীতে এবং ক্ষুধায়।

এদের চেয়েও হতভাগা চিত্রকর আছে। তাদের রঙ আর ক্যানভাস কেনবার পয়সা। পর্যন্ত নেই। তাই তারা রঙিন খড়ি দিয়ে ফুটপাথের এক পাশে ছবি এঁকে রাখে। প্যারিসের ফুটপাথে বারোমাস পুজোর ভিড়-তাই এদের ছবি আঁকতে হয় অপেক্ষাকৃত নির্জন ফুটপাথে। সেখানে পয়সা পাবার আশাও তাই কম।

এসব ছবি তো আর কেউ বাড়ি নিয়ে যেতে পারে না, তাই ছবি দেখে খুশি হয়ে কেউ যদি চিত্রকরের হ্যাটের ভিতর-বলতে ভুলে গিয়েছিলুম হ্যাটটা ছবির একপাশে চিৎ করে পাতা থাকে-দুটি পয়সা ফেলে দেয়। তবে সেটা ভিক্ষে দেওয়ার মতই হ’ল। এ শ্রেণীর চিত্রকররা অবিশ্যি বলে, ‘পয়সাটা ভিক্ষে নয়, পিকচার গ্যালারির দর্শনী। দর্শনী দিয়েছে বলে কি তোমাকে গ্যালারির ছবি বাড়ি নিয়ে যেতে দেয়?’ হক কথা।

এদের যদি বেশি পয়সা দিয়ে বলেন, ‘ঐ ছবিটা তুমি আমাকে ক্যানভাস আর রঙ কিনে ভালো করে একে দাও’, তবে সে পয়সাটা সীনের জলে ফেলারই সমান। এ শ্রেণীর চিত্রকরের সঙ্গে বোতলবাসিনীর বড় বেশি দহরম-মহরম।

আকাশ মেঘাচ্ছন্ন ছিল বলে মন উদাস হয়ে গিয়েছিল। তাই বেড়াতে বেরিয়েছি। আর দেশের কথা ভাবছি, এমন সময় হঠাৎ দেখি ফুটপাথের উপর অলৌকিক দৃশ্য। পদ্মানদীর গোটাকয়েক ছবি রঙিন খড়ি দিয়ে আঁকা। ছবিগুলো ভালো না মন্দ সেকথা আমি এক লহমার তরেও ভাবলুম না। বিদেশ-বিভূইয়ে দেশের লোক পেলে সে পকেটমার না। শঙ্করাচাৰ্য, সেকথা কেউ শুধায় না।

বৃষ্টি নামলেই ছবিগুলো ধুয়ে মুছে যাবে। আর্টিস্টের দিকে তাকালুম। শতচ্ছিন্ন কোট পাতলুন। হাতে বেয়ালা। বাঙালি।

আমাকে দেখে তার মুখের ভাব কণামাত্র বদলালো না। বেয়ালাখানা কনের কাছে তুলে ধরে ভাটিয়ালি বাজাতে আরম্ভ করল।

হাড্ডিসার মুখ, ঠোঁট দুটো অনবরত কাঁপছে, চোখ দুটিতে কোনো প্রকারের জ্যোতির বিন্দুমাত্র আভাস নেই, একমাথা উস্কো খুস্কো চুল, কিন্তু সব ছাড়িয়ে চোখে পড়ে তার কপালখানা। এবং সে কপাল দেখে স্বতই মনে প্রশ্ন জাগে, এরকম কপালী’ মানুষ বিদেশবিভুইয়ে ভিক্ষে মাঙছে, কেন?

তাকে পাশের কাফেতে টেনে নিয়ে যাবার জন্য আমাকে বিস্তর বেগ পেতে হয়েছিল। আমার কোনো কথার উত্তর দেয় না, আমার চেয়ে দেড় মাথা উঁচু বলে তার দৃষ্টি আমার মাথার উপর দিয়ে কোথায় কোন দূরান্তে গিয়ে ঠেকেছে তার সন্ধান নেই। একবার হাত ধরে বললুম, চলুন, এক কাপ কফি খাবেন’; ঝটিকা মেরে হাত সরিয়ে ফেলল।

আমি নিরাশ হয়ে চলে যাচ্ছি। দেখে হঠাৎ হ্যাটটা তুলে নিয়ে আমার সঙ্গে সঙ্গে চলল। পাশের কাফেতে বসে আমি শুধালুম, কফি? চা?’ মাথা নেড়ে অসম্মতি জানালো। আমি মনে মনে বুঝতে পেরেছিলুম। সে কি চায়; কিন্তু সে সম্বন্ধে সম্পূর্ণ নিঃসন্দেহ হবার জন্য চা কফির প্রস্তাব পেড়েছিলুম। শেষটায় শুধালুম, ‘তবে কি খাবেন?’

একটি কথা বললে, ‘আব্বসাঁৎ।’

দুনিয়ার সবচেয়ে মারাত্মক মাদক দ্রব্য! শতকরা আশিভাগ তাতে এলকহল। এ মদ মানুষ তিন চার বৎসরের বেশি খেতে পারে না। তারই ভিতরে হয় আত্মহত্যা করে, নয় পাগল হয়ে যায়, না হয় এলকহলিক বিভীষিকা দেখে দেখে এক মারাত্মক রোগে চিৎকার করে করে শেষটায় ভিরমি গিয়ে মারা যায়। ইঁদুরছানার নাকের ডগা এ মদে একবার চুবিয়ে নিয়ে ছেড়ে দিলে সে মিনিট তিনেকের ভিতর ছট্‌ফট্‌ করে মারা যায়।

কী বিকৃত মুখ করে যে আর্টিস্ট আবসঁৎটা খেল, তার বর্ণনা দেওয়া অসম্ভব। মনে হল, পানীয় যেন আগুন হয়ে পেটে ঢুকতে চায় বলে নাড়ী-ভুড়ি উল্টে গিয়ে বমি হয়ে বেরতে চায়, আর সমস্ত মুখে তখন ফুটে ওঠে অসহ্য যন্ত্রণার বিকৃততম বিভীষিকা। চোখ দুটো ফুলে উঠে যেন বাইরের দিকে ছিটকে পড়ে যেতে চায়, আর দরদরি করে দু’চোখ দিয়ে জল নেমে আসে।

আমি মাত্র একটা আবসাতের অর্ডার দিয়েছিলুম। সেটা শেষ হতেই আমার দিকে না। তাকিয়ে নিজেই গোটাতিনেক অর্ডার দিয়ে ঝাপঝাপ গিললো।

আমি চুপ করে আপনি কফি খেয়ে যাচ্ছিলুম।

গোটাচারেক আবসাঁৎ সে ততক্ষণে গিলেছে। তখন দেখি সে আমার দিকে তীক্ষা দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে। এ অস্বাভাবিক ঔজ্জ্বল্য এর চোখে এল কোত্থেকে?

হঠাৎ বললো, আর কেন ছোকরা, এইবার কেটে পড়ো, বীট ইট্, গে ভেক, ভিৎ ভিৎ।’ কটা ভাষায় যে সে আমায় পালাতে বললো তার হিসেবই আমি রাখতে পারলুম না।

আমি চুপ করে বসে রইলুম-নিট নড়ন-চড়ন-নট-কিছু।

একগাল হেসে বলল, ‘দেখলি? আমি ভিখিরি নই। এই ভাষা কটি ভাঙিয়েই আমি তোর চেয়ে দামী সুট পরতে পারবো, বুঝলি? আবািসাঁৎ দিয়ে প্যারিস শহর ভাসিয়ে দিতে পারবো, বুঝলি, কমপ্রাঁ, ফেরশটুহেস্ট ডু, পন্নিময়েশ?’ আবার চলল ভাষার তুবড়ি।

তারপর আমার দিকে তাকিয়ে মিটমিটিয়ে খানিকক্ষণ হাসলো। শুধালো, ছবি আঁকতে এসেছিস এ দেশে?-না হলে আর্টিস্টের উপর এ দরদ কেন, বাপু? তা তোর অজন্টার কি হল? না বাগ-গুহা? কিংবা মোগল? অথবা রাজপুত?’

তারপর হঠাৎ হো হো করে হেসে কুটি কুটি। অবনবাবু? নন্দলাল? যামিনী রায়? এনারা সব আর্টিস্ট! কচু!’

আমি তবু চুপ।

বললে, ‘অ-অ-অ! সেজান রেনোয়া গোগাঁ, আঁরি-মাতিস? বল না রে ছোকরা।’

আমি পূর্ববৎ।

‘তবে শোনা ছোকরা। এদের কাছ থেকে কিচছুটি শেখবার নেই, তোকে সাফ সাফ বলে দিচ্ছি। আমার কথা শোন। আর্ট জিনিসটা কি? আর্ট হচ্ছে—’

বলে সে আমায় প্রথম আর্ট সম্বন্ধে একখানা লেকচার শোনালে। সেই গ্ৰীকদের আমল থেকে নন্দনশাস্ত্রের ইতিহাস শুরু করে হঠাৎ চলে গেল ভরত দণ্ডিন মৰ্ম্মট ভট্টে। সেখান থেকে গোত্তা খেয়ে নাবিলো টলস্টয়ে-মধ্যিখানে গ্যেটেকে খুব একহাত নিল। তারপর বদলের, মালার্মে। শেষ করল জেমস জয়েসকে দিয়ে।

আরো বিস্তর কাব্য, নাট্য, চিত্রের সে উল্লেখ করে গেল, যার নাম আমি বাপের জন্মে শুনি নি।

তারপর ঝাঁপ করে আরেকটা আবসাঁৎ গিলে বললে, ‘উহঁ! তোর চোখ থেকে বুঝতে পারছি। ছবির তুই বুঝিস কচুপোড়া। একবার একটা সাড়া পর্যন্ত দিলি নে। তবে কি তোর শখ মূর্তি গড়াতে? অশোক স্তম্ভের সিংগি, গান্ধারের বুদ্ধ, মথুরার অমিতাভ, এলেফেন্টার ত্রিমূর্তি, মাইকেল এঞ্জেলোর মোজেস, নটরাজ? বল না?’

তারপর ছাড়লে আরেকখানা লেকচার। দুনিয়ার কোন যাদুঘরের কোন কোণে কোন মূর্তি লুকনো আছে, সব খবর নখাগ্ৰ-দৰ্পণে।

এই রকম করে লোকটা আর্টের যত শাখা-প্ৰশাখা আছে তার সম্বন্ধে আপন মনে কখনো মাথা নেড়ে, কখনো শব্দ ওজন করে করে, কখনো গড়গড়িয়ে মেল গাড়ির তেজে, কখনো বক্রোক্তি করে সন্দেহের দোদুল-দোলায় দুলে ব্যাখ্যান দিল। এদেশ সেদেশ সব দেশ মহাদেশের সর্বপ্রকারের আর্ট বস্তুর পাঁচমেশালি বানিয়ে।

এরকম পণ্ডিত আমি জীবনে আর কখনো দেখি নি।

কিন্তু শেষ পর্যন্ত আমাকে সে চুপ করে আর থাকতে দিল না।

বোধ হয় নেশা একটু কমে গিয়েছিল; তাই চাপ দিয়ে শুধালো, ‘বল, তুই এদেশে এসেছিস কি করতে?’

আমি না পেরে ক্ষীণ কণ্ঠে বললুম, ‘লেখাপড়া শিখতে।’

খুব লম্বা একখানা ‘অ-অ-অ’ টেনে বললো।

‘তা তো শিখবি। কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে ওয়াইন, শ্যাম্পেন, আবসাঁৎ? তার কি হবে? নানা প্রকারের ব্যামো? তার কি হবে? অদ্ভুত অদ্ভুত নয়া নয়া ইনকিলাবী মতবাদ? তার কি হবে?’

***

এই হল মুশকিল। আবসাঁৎ ব্যামোর চেয়েও ভয়ঙ্কর অৰ্ধসিদ্ধ অর্ধপক মতবাদ। শুধু ইনকোলাবী নয়, অন্য পাঁচ রকমেরও।

আজ পর্যন্ত যেটুকু এদেশে এসেছে তাকেই আমরা সামলে উঠতে পারছি নে। আমাদের ঐতিহ্য, আমাদের শিক্ষার সঙ্গে তাকে কি করে মিল খাওয়াবো, বুঝে উঠতে পারিনে। অথচ পশ্চিমের সঙ্গে লেন-দেনও তো বন্ধ করে দেওয়া যায় না। উপায় কি?

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *