বিদেশে
প্রায়ই প্রশ্ন শুনতে হয়, সব চেয়ে কোন দেশ ভাল?’
‘মই কনট্র রাইট অর রঙ, মই মাদার ড্রানক অর সোবার জাতীয় পাঁড় লোক হলে তো কথা নেই, চট করে বলবে, তার দেশই সবচেয়ে ভালো। কিন্তু আপনি যদি সে গোত্রের প্ৰাণী না হন তবে কি উত্তর দেবেন? কেউ যদি প্রশ্ন শুধায়, ‘সব চেয়ে খেতে ভালো কি?’ তা হলে যে রকম মুশকিলে পড়তে হয়।
তখন উল্টে শুধাতে হয়, ‘ভালো দেশ’ বলতে তুমি কি বোঝো? প্রাকৃতিক সৌন্দর্য, আবহাওয়া, আহারাদি, জ্ঞানবিজ্ঞানের চর্চা, সৌন্দর্যের পূজা, ধন দৌলত, আতিথেয়তা, তুমি চাও কোনটা?’ ‘সব কটা মিলিয়ে হয় না?’ ‘আজ্ঞে না।’
তবু যদি কেউ পিস্তল উচিয়ে বলে, ‘এখখুনি তোমায় এদেশ ছাড়তে হবে; কোথায় যাবে বলো!’ (যাদের ভ্ৰমণে শখ তারা অবশ্য উল্লসিত হয়ে বলবেন, ‘পিস্তল ওঁচাতে হবে না, একবার যাওয়ার ব্যবস্থা করে দিলেই হল’) তা হলে বোধ হয়। সুইটজারল্যান্ডের নামই করব।
ধরে নিচ্ছি খর্চাটা আপনিই দিচ্ছেন-কারণ খৰ্চা যদি না দেন। তবে তো সক্কলের পয়লাই ভাবতে হবে কোন দেশে গেলে দুমুঠো অন্ন জুটবে। তা হলে সাউথ সী আয়লেন্ড’ বা আফ্রিকার এমন কোন দেশের কথা ভাবতে হবে যেখানে এস্তার কলা-নারকেল রয়েছে, জীবনসংগ্রাম কঠোর নয়।–বেঘোরে প্রাণটা যাবার সম্ভাবনা কম। সেদিক দিয়ে অবিশ্যি মালদ্বীপ সবচেয়ে ভালো। ওদেশে কেউ কখনো শখ করে যায় নি। তাই ‘অতিথি’ শব্দটা মালদ্বীপের ভাষায় বঁটা চকচকে নূতন হয়ে পড়ে আছে, কখনো ব্যবহার হয় নি। মালদ্বীপের প্রত্যেকটি দ্বীপ। এত ছোট যে, যে-কেউ যে-কোনো মুহূর্তে আপনি বাড়ি ফিরে যেতে পারেঅতিথি হতে যাবে কে কার বাড়ি? এখানে অবশ্য পালা নেমস্তম্নের কথা উঠছে না। তাই কেউ যদি কখনো পাকে-চক্ৰে মালদ্বীপ পৌঁছয় তবে তাকে এর বাড়িতে ওর বাড়িতে এ দ্বীপে ও দ্বীপে দুদিন চারদিন থাকতে গিয়ে হেসেখেলে বছর তিনেক কেটে যায়। আমার জীবনে আমি মাত্র একটি মালদ্বীপবাসীর সঙ্গে কইরোতে পরিচিত হই। প্রতিবার দেখা হলেই ভদ্রলোক মালদ্বীপ যাবার আমন্ত্রণের কথাটি আমায় স্মরণ করিয়ে দিতেন।
তাই বলছিলুম, খৰ্চা যখন আপনিই দিচ্ছেন। তবে সুইটজারল্যান্ড সই। সুইটজারল্যান্ডের মত আক্রা দেশ ইউরোপে আর নেই—সেখানকার খর্চা যদি আপনি বরদাস্ত করতে পারেন তবে আর সর্বদেশ তো ফাউ। টুক করে প্যারিস, বার্লিন, ভিয়েনা ঘুরে আসতে পারবেন। খৰ্চা সুইটজারল্যান্ডে থাকলে যা বার্লিন ঘুরে এলেও তা।
স্বপ্নেই যখন খাচ্ছেন, তখন ভাত কেন পোলাওই খান (সিন্ধী প্রবাদে বলে, ‘স্বপ্নের পোলাওই যখন রাঁধছো তখন ঘি ঢালতে কঞ্জুসি করছে কেন?’), স্বপ্নেই যখন ভ্ৰমণ করছেন তখন থার্ড ক্লাস কেন, গোটা জাহাজ চার্টার করে ড্যা লুক্স কেবিনে কিম্বা প্রেসারাইজড্ প্লেনে করে জিনীভা চলে যান।
লেক অব জিনীভার পারে একটি ছোট, অতি ছোট কুটির (শালে) ভাড়া নেবেন আর একটি রাঁধুনী যোগাড় করে নেবেন।
শুনেই নাভিশ্বাস উঠলো তো? বিদেশ-বিভূই জায়গা, তার চুরি-চামারি ঠেকাবে কে? হিসেবে আলুর সের আড়াই টাকা দেখিয়ে বলবে না তো, ‘কত্তা, দাঁওয়ে মেরেছি, না হলে আসলে দাম তিন টাকা?’
এই হল সুইটজারল্যান্ডের প্রথম সুখ। ছুচোমো, ছাছড়ামো ওদেশ থেকে প্রায় উঠে গিয়েছে। সুইটজারল্যান্ডের হোটেলেও তাই। আক্রা বটে-বসবাস খাই-খরচের জন্য হয়ত দৈনিক কুড়ি টাকা নিল। কিন্তু তার পরও আপনাকে মাখনটাতে ফাঁকি, মুগীটাতে জুচ্চোরি এসব করে না। আপনার খাওয়া দেখে যদি তার সন্দেহ হয়। আপনি পেট ভরে খান নি। তবে এসে বলবে, ‘আপনি বিদেশী, এ রান্না আপনার হয়ত পছন্দ হয় নি। আপনি কি খেতে চান বাৎলে দিন, আমরা সে রকম রোধে দেব।’
আপনি নিশ্চিস্ত থাকুন; আপনার রাঁধুনী আপনাকে ফাঁকি দেবে না।
সকাল বেলা ঘুম ভাঙতেই বিছানার পাশের বোতামটি টিপবেন। পাঁচ মিনিটের ভিতর গরম কফি, মুরমুরে রুটি আর শিশির-ভেজা মাখনের গুলি। রাঁধুনী বলবে, ‘স্যার, চমৎকার ওয়েদার। আপনি বেরুচ্ছেন তো? আমি বাজার চললুম।’
লেকের পারে এসে একটা বেঞ্চিতে বসবেন। খবরের কাগজটি পাশে রেখে তার উপর হ্যাট চাপা দেবেন।
আহা, কী গভীর নীল জল জিনীভা লেকেরা! লেকের ওপারে যে আলপস সেও যেন নীল, আর তার মাথায় মাথায় সাদা সাদা বরফের টুপি। তার উপর চূড়োর কাটা-কটা সাদা ঝালরে সাজানো আকাশের ঘন নীল চন্দ্ৰাতপ। আর আকাশ-বাতাস, হ্রদের জল, পাহাড়ের গা, বরফের টুপি সব কিছু ভরে দিয়েছে। কঁচা হলুদের সোনালি রোদ। সকাল বেলায় বাতাস একটু ঠাণ্ডা; কিন্তু প্রতিক্ষণে আপনার গালে কানে আদর করে সে বাতাস কুসুম-কুসুম গরম হতে থাকবে। ওভারকেটের বোতামগুলো খুলে দিয়ে পাইপটা ঠাসতে আরম্ভ করবেন। হয়তো গুনগুন করতে আরম্ভ করবেন, ‘আমি চিনি, চিনি, চিনি তোমারে ওগো বিদেশিনী।’
নীল জলের উপর দিয়ে সাদা জাহাজের এ-পার ও—পার খেয়া। জলের উপর আলপসের কালো ছায়া পড়েছে, ফাঁকে ফাঁকে নীল জল, তার উপর সাদা জাহাজ। সেই আল্পনার উপর জাহাজের চাকার তাড়ায় ভেঙে পড়ছে লক্ষ লক্ষ ঢেউয়ের চুমুক। যেন কোন খেয়ালি বাদশা টাকশাল থেকে এইমাত্র বেরনো টাকা নিয়ে খোলামকুচির খেলা লাগিয়েছেন।
পাল তুলে দিয়ে চলেছে জেলের নৌকো। অতি ধীরে অতি মন্থরে। জাল টেনে তোলার সময় রোদ এসে পড়ছে ভেজা জালে। কালো জাল যাদুর ছোঁয়া লেগে রূপের জাল হয়ে গেল।
এই রকম রূপের জাল দিয়ে আপনার প্রিয়া তার খোঁপা জড়াতো না?
তৎক্ষণাৎ বুকটা চড়াচড় করে ইস-পার-উস-পার ফেটে যাবে। কোন মুর্থ বলে দেশভ্ৰমণে অবিমিশ্র আনন্দ?
রবিবারে জিনীভার লেকের পাড় আরও চমৎকার।
বিস্তর নরনারী জাহাজ চড়ে বেরিয়েছে ফুর্তি করতে। এসব জাহাজ ‘ইস্পিশাল’— লম্বালম্বি লেকের এপার ওপার হয়। সমস্ত দিন জাহাজে কাটিয়ে উত্তম আহারাদি করে (হে বাঙালি, লেকের মাছ খেতে চমৎকার
বাপ রে সে কি বিরাট মাছ উদরা আণ্ডাময়
মুখে দিলে মাখন যেন জঠর ঠাণ্ডা হয়),
জাহাজের ব্যান্ডের সঙ্গে টাঙ্গোর ধাগিনীতি নাকধিন আর ওয়ালটুসের ধা। ধিন না, ধা তিন না নোচে, কিংবা মাউথ-হারমনিয়ম বাজিয়ে, ছোঁড়াছড়িদের সঙ্গে দুদণ্ড রসালাপ করে, কিংবা জাহাজের এক কোণে আপন মনে বসে খুদাতালার আসমানপানি, পাহাড়-পর্বত দেখে দেখে সমস্ত দিনটা দিব্যি কেটে যায়।
সুইসরা ইংরেজের মত গেরেমভারী লোক নয়। যদি দেখে, আপনি বিদেশী, এক কোণে এক বসে আছেন। তবে কোনো একটু ছুতো ধরে আপনার সঙ্গে আলাপ করে নেবেই নেবে। অবশ্য আপনি যদি খেঁকিয়ে ওঠেন। তবে আলাদা কথা, কিন্তু আপনি তো বন্দরসিক নন-স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। আপনি ‘পঞ্চতন্ত্র’ পড়েন-আপনি খুশি হয়েই সাড়া দেবেন।
কিন্তু সুশীল পাঠক, এই বেলা তোমাকে বলে রাখি। দেশভ্রমণের ষোল আনা আনন্দই বরবাদ-পয়মাল যদি তুমি দেশের ভাষায় কথা কইতে না পারো। ভুল বললুম, বলা উচিত ছিল, যদি বুঝতে না পারো। কথা কইবার প্রয়োজন অত বেশি নয়, সুইস যদি দেখে যে তুমি তাঁর ভ্যাচর ভ্যাচর বুঝতে পারছে, মাঝে মাঝে মোকা-মাফিক ‘হুঁ’ ‘হুঁ’ করছে কিংবা বুড়া রাজা প্ৰতাপ রায়ের মত সমে সমে মাথা নাড়ছে তা হলেই সে খুশি।
সুইস কেন, পৃথিবীর প্রায় সব জাতের লোকই বিদেশী সম্বন্ধে কৌতূহলী। বিশেষ করে মেয়েদের উৎসাহ এ বাবদে পুরুষদের চেয়ে অনেক বেশি। অথচ মেয়েরা লাজুক তাই তারা পুরুষকে অগ্রদূত হিসাবে পাঠায় কলেকৌশলে আলাপ জমাবার জন্য। তার পর
‘দীন যথা যায় দূর, তীর্থ দরশনে
রাজেন্দ্ৰ সঙ্গমে-’
কিংবা কালিদাসের বাজমণি সমূৎকীর্ণ হওয়ার পর সূত্র যে রকম সুড়ৎ করে উৎরে যায় (সংস্কৃতটা আর ফলালুম না, ভুল হয়ে যাবার প্রচুর সম্ভাবনা), মেয়েটি আপনার সঙ্গে আলাপ জমিয়ে নেবে।
সাবধানী পথিক, ভয় পেয়ো না। যে মেয়েটি আপনার সঙ্গে আলাপ জমাবার জন্য ছোড়াটাকে পাঠিয়েছিলেন সে ফালতো। তার বোন ছোকরাটির ফিয়াসে। বোন সঙ্গে আছে, সে বেচারী একা এক কি করে?
চামড়া আর চুলের রঙ তাজ্জব জিনিস।
আমরা ফর্সা রঙের জন্য আকুল, যার চুল একটুখানি বাদামী তার তো দেমাকে মাটিতে পা পড়ে না। আর বেশির ভাগ উত্তর এবং মধ্য ইয়োরোপীয় বাদামী চামড়া আর কালো চুলের জন্য জান কোরবানী দিতে কবুল।
চট করে একটা ঘটনার উল্লেখ করে নেই। এ ঘটনা অধমের জীবনে একাধিকবার হয়েছে।
এরকম এক জাহাজে এক কোণে একা বসে আছি। আমার থেকে একটু দূরে একপােল ইস্কুলের মেয়ে মাস্টারনীর সঙ্গে ফুর্তি করতে জাহাজে চেপেছে। সবাই আপন আপন স্যান্ডউইচ বাড়ি থেকে সঙ্গে নিয়ে এসেছে। স্যান্ডউইচগুলো টেবিলের মধ্যিখানে বারোয়ারি করে রাখা হয়েছে, আর জাহাজ থেকে তারা অর্ডার করেছে লেমনেড।
কী চেচামেচি! ‘দেখ দেখ, ফ্রিডির মা কি রকম খাসা বেকনা-স্যান্ডউইচ পাঠিয়েছে, ফ্রিডি লজ্জায় টমাটো হয়ে বলছে, ‘না না, মাস্টার্ড ছিল না বলে স্যান্ডউইচ ভালো হয় নি’, ক্লারার মারা পাঠানো স্যালাডটা খা ভাই, জানিস ওঁর বাগানে যা লেটিস আর টমাটো হয়!’ আর টিচার শুধু বলছেন, ‘চুপ চুপ, অত করে চ্যাচাতে নেই। লোকে কি ভাববো?’
ধর্ম সাক্ষী লোকে কিছু ভাবে না। বরঞ্চ ওরা না চ্যাচালে পাঁচজন অস্বস্তি অনুভব করত; ভাবত কালা-বোবাদের ইস্কুল পিক্নিকে বেরিয়েছে।
সব কটা মেয়ে—ইস্তেক টিচার—আড়নয়নে ভদ্রতা বজায় রেখে আপনার কালো চুল আর বাদামী রঙের দিকে তাকাবে।
পরের স্টেশনে হুড়মুড় করে সবাই নেমে গেল। আমার মনটা উদাস হয়ে গেল।
তখন দেখি একটি আট ন’বছরের মেয়ে টেবিলের তলায় লুকিয়ে ছিল, গুড়ি গুড়ি আমার কাছে এসে কার্টসি করে (অর্থাৎ দু হাতে ফ্রক একটুখানি তুলে হাঁটু ভেঙে) বললে, ‘গুটেন টাখ (সুপ্রভাত)!’
আমি চিবুকে হাত দিয়ে আদর করে বললুম, ‘গুটেন টাখ, মাইন, জুথুসষেন (সুপ্রভাত, মিষ্টি মেয়ে)।’
লজ্জায় কঁচুমাচু হয়ে, চুলের ডগা পর্যন্ত লাল করে বললে, ‘আপনি রাগ করবেন না?’
আমি বললুম, ‘নিশ্চয় না।’
‘তবে বলুন তো, আপনি কি দিয়ে চুল কালো করেছেন! আমি কাউকে বলবো না, তিন সত্যি।’
আমি তখন তার সোনালি চুলের দিকে মুগ্ধ নয়নে তাকিয়ে বললুম, ‘ডার্লিং, তোমার কী সুন্দর সোনালি চুল!’
গাল ফুলিয়ে বললে, ‘রাবিশ, আমি কালোচুল চাই।’
কিছুতেই বোঝাতে পারি নে, আমি চুলে রঙ মাখাই নি!
শেষটায় হঠাৎ বুদ্ধি খেলল। কোটের আস্তিন সরিয়ে দেখলুম আমার লোমও কালো। বললুম, ‘ওগুলো তো আর বসে বসে কালো করি নি।’
বিশ্বাস তখন তার হল। মুখে গভীর বিষাদ মেখে, মাথা হোঁট করে আস্তে আস্তে জাহাজ থেকে নেমে গেল।
দুটাক জোর ন’সিকে দিয়ে টিকিট কেটে বসেছেন। এমন আর কি আক্রা হল? সমস্ত দিন কাটাতে গেলে বায়স্কোপেও তার চেয়ে বেশি খর্চা হত।
হুবহু গোয়ালন্দী জাহাজ। কেবিনের বালাই নেই-সব খোলা ডেকা! রেলিঙের গা ঘেষে ঘেঁষে চারজনের বসবার মত ছোট ছোট টেবিল সাজানো। নীল সাদায় ডোরাকাটা করকরে টেবিল ক্লথ। ক্লিপ দিয়ে টেবিলের সঙ্গে সাঁটা, পাছে হাওয়াতে ভর করে। পক্ষীরাজের মত ডানা মেলে লেকের ‘হে-পারে’ চলে যায়।
‘হে-পারে?’ চট করে মনটা পদ্মার দিকে ধাওয়া করলো তো?
আমারও মন পড়েছিল পদ্মার কথা। জীবনে কতবার প্রদোষের আধা-আলো-অন্ধকারে চাদপুর থেকে জাহাজে করে গোয়ালন্দের দিকে রওয়ানা হয়েছি। বিনিদ্র রজনীর ক্লাস্তিতে সর্বদেহ,মন অবসন্ন-বাড়ি ছাড়ার সময় মা অমঙ্গলের চোখের জল ঠেকিয়ে রাখতে পারেন নি, সে কথা বার বার বুকের ভিতর কাঁটার মত খোঁচা দিচ্ছে, বহু চেষ্টা করেও মন থেকে সেটাকে সরাতে পারছি নে।
পদ্মার সূর্যোদয় মনের অনেকখানি বেদনা প্রতিবারই কমিয়ে দিয়েছে। রেলিঙের পাশে বসে, তারই উপর মাথা কাৎ করে তাকিয়ে আছি আকাশের দিকে, যেখানে কালো-সাদার মাঝখানে আস্তে আস্তে গোলাপী আভা ফুটে উঠছে। পদ্মার জল রাঙা হয়ে গেল, মহাজনী নৌকের পাল ফুলে উঠে মাঝখানটায় গোলাপী মেখে নিয়েছে, দূরের পাখি আর এ-পৃথিবীর পাখি বলে মনে হচ্ছে না, কোন নন্দনকাননের মেহদি পাতার রস দিয়ে যেন ডানা দুটি লাল করে নিয়েছে।
ঐ তো সূৰ্য ঐ তো সবিতা!
জাহাজ জোর ফালতো স্টীম ছাড়ছে। তারই উপর ক্ষণে ক্ষণে রামধনুর রঙ খেলে যাচ্ছে। মাঝি-মাল্লাদের চোঁচামেচি কেমন যেন আর কর্কশ বলে মনে হচ্ছে না। পাশে মোল্লাজীর নামাজ পড়া শেষ হয়েছে। সুর করে কোরান পড়তে আরম্ভ করেছেন। হাওয়াতে তাঁর দাড়ি দুলছে, পাগড়ির ন্যাজ দুলছে। বরযাত্রীর দল যাচ্ছে, না কনে শ্বশুরবাড়ি যাচ্ছে, কে জানে—একমাথা সিঁদুর-মাখা একটি মেয়ে ঘন ঘন শাঁখ বাজাচ্ছে। হিন্দু বাড়িতে তো শাখ শুনেছি সন্ধ্যেবেলায়, ভোরেও বাজায় নাকি? কে জানে?
উত্তমাৰ্ধ নগ্ন, জাহাজের রাশির মত মোটা ধবধবে পৈতে-ঝোলানো এক ব্ৰাহ্মণ বললেন, ‘দেখো তো, মিয়া, ঠিক ঠিক রাজবাড়ির টিকিট দিয়েছে তো? যা ভিড় ছিল, কি দিতে কি দিয়ে বসছে কে জানে? চশমাটাও হারিয়ে গিয়েছে।’
রসভঙ্গ হল অস্বীকার করি নে, কিন্তু কাতর বৃদ্ধ ব্ৰাহ্মণ; অবহেলা অভিনয় করলে মশীদ-মুরুত্বীর মারাত্মক অভিসম্পাত লাগবে। বেশ করে দেখে নিয়ে বলুলম, ‘আজ্ঞে (আগে হলে একথা বলার প্রয়োজন হত না যে মুরুকীরা ছেলেবেলাই আমাদের পাই-পই করে শিখিয়েছিলেন, হিন্দু গুরুজনদের সঙ্গে কথা কইতে হরদম আজ্ঞে’—বাঙাল ভাষায় ‘আইগ’ বলতে হয়) ঠিকই দিয়েছে; আপনাকে ঠকাতে যাবে কোন পাষণ্ড?’
ব্রাহ্মণ ভারী খুশি। আমার পাতা বিছানাতে পরম পরিতৃপ্তিভরে গা এলিয়ে দিয়ে ঘুমিয়ে পড়লেন।
হঠাৎ একটা গল্প মনে পড়ে গেল।
তরকারি-বেচনে-ওলা গেছে জাহাজ ইস্টিশানে টিকিট কাটতে‘বাবু অ-আ-আ, অ—বাবু, নারানজোর (নারায়ণগঞ্জ) এ্যাখখান টিকস দিবাইন নি?’
বাবু বললেন, ‘ছ আনা।’
তরকারি-ওলা বললে, ‘বাবু অ-অ-অ, চারি আনায় অইব না?’
বাবু পশ্চিম বাঙলার লোক, ওনাদের মেজাজ আমাদের দ্যাশে এলে একটুখানি মিলিটারি হয়ে যায়। খেঁকিয়ে বললেন, দে ব্যাটা ‘দে, ছ’ আনা দে।’
গভীর বেদনা সহকারে তরকারি-ওলা বললে, ‘বাবু অ-অ-, তুমি আমার দোকানে রোজ রোজ আও। কলাড়া মুলাডা কিনো। দরদাম করো। আর আমি আইলাম তোমার দোকানে এগ দিন। দরদাম করতা গেলাম—তুমি আমন খাটাশের মতন মুখড়া করলা ক্যান?’
মনে আমার সন্দেহ জাগছে, চতুর পাঠক বিশ্বাস করতে চান না। জিনীভার জাহাজে বসে আমার এ নারানজী’ (নারায়ণগঞ্জ) গল্প সত্যই মনে পড়েছিল কি না।
কেন পড়েছিল বলছি।
ইয়োরোপের সব দেশের ভিতর সুইটজারল্যান্ডই সবচেয়ে ‘এক দরে বিক্রি’। সেখানে দরদস্তুর করতে গেলে (আমি বাঙাল, তাই করেছিলুম) সুইস এমনই বোকার মত তাকায়, কিংবা খেঁকিয়ে ওঠে যেন তাকে আমি ড্যাম মিথ্যেবাদী বলে সন্দা করছি।
অথচ দেখুন, ইয়োরোপীয়রা আমার দেশে হামেশাই দরদস্তুর করে। আমি যদি তরকারি-ওলার মত ওদেশে একবার গিয়ে দরদস্তুর করি, তবে ওরা ‘খাটাশের মত মুখ করবে ক্যান?’
ইতিমধ্যে মধ্য দিনের তপ্ত হাওয়া আমার মন উদাস করে দিয়েছে। মেঘের ডাকে, নব বরষণে বাঙালির মন কেমন যেন গভীর বেদনায় ভরে যায়, আর সে মনটা উদাস হয়ে যায়। দুপুর বেলায় আকাশের দিকে তাকিয়ে। হঠাৎ যেন বুকে বেজে ওঠে, আমি এ সংসারের নই, এখানকার সুখ-দুঃখের সঙ্গে আমার কোন সম্পর্ক নেই।
কিন্তু ওরকম ধারা মন খারাপের দাওয়াই জাহাজে মজুদ। হঠাৎ অর্কেস্ট্রা বেজে উঠলঃ ‘গোলাপবাগানে সানসুসির গোলাপবাগানে–’
কি হয়েছিল?
‘সেই গোলাপবাগানে আমি মেরিকে চুমো খেয়েছিলুম—
প্রথম চুম্বন তো মানুষ জীবনে কখনো ভুলতে পারে না।’
ট্রেনে বসে আছেন; চট করে আপনার সঙ্গে কেউ আলাপ জমাতে যাবে না-আপনি। হয়ত চুপ করে বসে থাকাটাই পছন্দ করেন। কিন্তু ফুর্তির জাহাজে যখন বসেছেন, তখন নিশ্চয়ই ফুর্তি করতে চান—বাঙলা কথা। একা বসে বসে ফুর্তি হয় না, তাই কেউ যদি আপনার সঙ্গে পরিচয় করে সুখ-দুঃখের গল্প জুড়তে চায়, তা হলে আপনার আপত্তি না থাকারই কথা এবং আশ্চর্য, মানুষ অনেক সময় পরদেশীর সঙ্গে যতখানি প্ৰাণ খুলে কথা কইতে পারে স্বদেশবাসীর সঙ্গে ততটা পারে না। প্ৰাণের কোণে বছরের পর বছরের জমানো কোনো এক গভীর বেদনা। আপনি লজ্জায় কখনো কাউকে স্বদেশে প্রকাশ করেন নি; হঠাৎ একদিন দেখতে পাবেন, অজানা-অচেনা বিদেশবিভূইয়ে এক ভিনদেশীর সামনে আপনি আপনার সব দুঃখকাহিনী উজাড় করে ঢেলে দিয়েছেন। তার সঙ্গে জীবনে আপনার আর কখনো দেখা হবে না-সেই কারণেই হয়ত আপনার হৃদয়ের আঁকবাঁকু তার বুকের উপর চেপে বসা জগদ্দল পাথর সরিয়ে ফেলে নিস্কৃতির গভীর আরাম পায়। ইয়োরোপের লোক তাই কোনো এক গোপন বেদনা নিয়ে যখন হন্যে হবার উপক্রম করে, তখন সাইকিয়াট্রিস্টের কাছে যায়—সেখানে বেদনার বোঝা নামিয়ে দিয়ে সে আবার সুস্থ মানুষ হয়ে সংসারের দুঃখ-কষ্টের সামনাসামনি হয়!
বোধ হয়, ঐ একই কারণে কখনো কখনো মানুষ বিদেশে স্বদেশবাসীর কাছেও তার বেদনার দ্বার খুলে দেয়।
একদা প্রাগ শহরে দেখি, এক ভারতীয় বৃদ্ধ—খুব সম্ভব দাক্ষিণাত্যের-রাস্তায় বেকুবের মতন দাঁড়িয়ে আছেন। মুখের ফ্যাল-ফ্যাল ভূবি দেখে অনুমান করলাম, হয়ত রাস্তা হারিয়ে ফেলেছেন, কিংবা হয়ত পার্সটাও গেছে। কাছে গিয়ে, শুধালুম ‘ব্যাপার কি?’
ভদ্রলোক তো আমাকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেলেন আর কি। শুধু যে হোটেল হারিয়ে বসেছেন তাই নয়, হোটেলের নামটা পর্যন্ত বেবাক ভুলে গিয়েছেন।
কি করে তাঁর হোটেল খুঁজে পেলুম সে এক নয়, পাঁচ-মহাভারত। দ্বিজেন্দ্রলাল তো আর মিছে বলেন নি, ‘একদা যাহার বিজয় সেনানী হেলায় লঙ্কা করিল জয়।‘ লঙ্কা রাক্ষসের দেশ, প্রাগে ভদ্রসন্তানের বসবাস। আমার মত লেখাপড়ায় পাঠা বঙ্গসন্তানের মাথায় এসব ফন্দিফিকির বিস্তর খেলে—সাক্ষাৎ শার্লক হোমস আর কি-সে কথা ‘দেশের পাঠককে হাইজাম্প লঙজাম্প দিয়ে বোঝাতে হবে না।
কিন্তু আমি মনে মনে পাঁচশবার তাজ্জব মানলুম, এই নিরীহ তামিল ব্ৰাহ্মাণের প্রাগে আসার কি প্রয়োজন? তখনকার দিনে প্রতি শহরে মেলা ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স বসত না যে, তিনি ভেটেরেনারির ‘রিন্ডারপেস্ট’ কিংবা ভারত বিদেশে ক’শ’ মণ গাঁজাগুলি চালান করতে পারবে, তাই নিয়ে পাণ্ডববিবর্জিত প্রাগে ভারতের প্রতিভূ হয়ে আলোচনা করতে আসবেন।
হোটেলে পৌঁছতে দেখি, সেখানেও আরেক কুরুক্ষেত্র। এরকম নিরীহ বিদেশী প্রাণী হোটেলের লোকও কখনো দেখে নি–প্ৰাগ তো প্যারিস নয়–তাই তারা ব্যাকুল হয়ে পড়েছে। দশটায় বেরিয়ে লোকটা আটটা অবধি ফেরে নি কেন? তাঁকে বাড়ি ফিরিয়ে আনার জন্য আমি সেখানে শার্লক হোমসেরই কদর পেলুম।
ভদ্রলোক চেপে ধরলেন, তাঁর সঙ্গে খানা খেতে যেতে হবে।
অপেরার টিকিট আমার কাটা ছিল-প্রাগের অপেরা ডাকসাইটে-কিন্তু আমার মনে হল, ‘প্ৰাগে তামিল ব্ৰাহ্মাণ’ যে-কোনো অপেরার টাইটলকে হার মানাতে পারে।
বললেন, ‘খানাটা কিন্তু আমার ঘরেই হবে-ডাইনিংরুমে না।’
আমি বললুম, ‘নিশ্চয়, নিশ্চয়।’
ঘরে ঢুকেই তড়িঘড়ি সুট খুলে ফেলে ধুতি বের করে মাদ্রাজি কায়দায় সেটাকে লুঙ্গি বানিয়ে পরলেন, গায়ে চাপালেন শার্ট, আর কাঁধে ঝোলালেন তোয়ালে।
চেয়ারে বসে খাটে দু-পা তুলে দিয়ে বললেন, ‘আঃ’!
এরকম দরাজ-দিল লোক আমি জীবনে আর কখনো দেখি নি। ওয়েটার ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে যখন বলে, এটা আনবো কি, সেটা আনবো কি, তিনি মাথা দুলিয়ে বলেন, ইয়েস, ইয়েস, ব্রিং, ব্রিং।’
বড় হোটেল। সেখানে ‘আ লা কার্তে’ অন্তত একশ’ পদ রান্না হয়, তিনশ’ রকমের মদ মজুদ আছে। আমি বাধা দিতে গেলে তিনি বলেন, কি জ্বালাতন, ভালো করে খেতে দেবে না কি?’
অথচ তিনি খেলেন, আলু-কপি-মটর-সেদ্ধ, রুটি-মাখন, স্যালাড আর চা। বললেন, ‘বুড়ো বয়সে আর মাছ-মাংসটা ধরে কি হবে?’
তবে তিনি নিশ্চয়ই এই প্রথম ইয়োরোপ এসেছেন। যে নিষ্ঠাবান ব্যক্তি বৃদ্ধ বয়সে অন্যকে মাংস খাওয়ায় সে যৌবনে এলে নিজেও চেখে নিত।
ক্ৰমে ক্ৰমে পরিচয় হল। আই সি এস থেকে পেন্সন নিয়েছেন। ওদিকে শাস্ত্রী ঘরের ছেলে—বিস্তর সংস্কৃত সুভাষিত মুখস্থ। একটানা নানা রকমের গল্প বলে যেতে লাগলেন— প্রধানত শঙ্কর রামানুজের জীবনের চুটকিলা ঘটনা নিয়ে। ইংরেজিতে যাকে বলে, ‘লাইটার সাইড’। আমি মুগ্ধ হয়ে শুনে যেতে লাগলুম।
তবে কি রাতের অন্ধকার যেমন যেমন ঘনাতে লাগে, মানুষের মনের অন্ধকার ঘর তার সমস্ত দরজা আস্তে আস্তে খুলে দেয়? আমরা আহারাদির পর বেলকনিতে ডেকচেয়ারে লম্বা হয়ে শুয়েছি, চোখ আকাশের দিকে। চতুর্দিকের ফ্ল্যাটের আলো আর রাস্তার বাতি নিভে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আকাশের তারা জ্বল-জ্বল করে ফুটে উঠছে। চেনা ঘরদোরের তুলনায় মানুষ তেমন কিছু ক্ষুদ্র জীব নয়, কিন্তু বিরাট গভীর আকাশের মূর্তি যখন তারায় তারায় ফুটে ওঠে, তখন তার ক্ষুদ্র হৃদয় আর তার ক্ষুদ্রতর লৌকিকতা, সঙ্কীর্ণতা কেমন যেন আস্তে আস্তে লোপ পেয়ে যায়।
কোনো ভূমিকা না দিয়ে বৃদ্ধ হঠাৎ বললেন, যার সঙ্গে আলাপচারি হয়; সেই ভাবে, এ-বুড়ো ইয়োরোপে এসেছে কি করতে? কি যে বলব, ভেবে পাই নে।’
এ তো তিনি আমাকে বলছেন না, আপন মনে ভাবছেন এবং হয়ত তার অজানাতেই গলা দিয়ে সে ভাবনা প্রকাশ পেয়ে যাচ্ছে। আমি যে শুধু চুপ করলুম। তাই নয়, নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসও প্রায় বন্ধ করে আনলুম, যাতে তাঁর চিন্তাধারা কোনো প্রকারের টক্কর না খায়।
না, ভুল বুঝেছি। তিনি আমার উপস্থিতি সম্বন্ধে সম্পূর্ণ সচেতন।
বললেন, ‘দেশের অনেকেই জানে কিন্তু কেউ আমাকে কখনো জিজ্ঞেস করে নি। এদেশে জিজ্ঞেস করলেও উত্তর দিই নে। কিন্তু তোমাকে বলি। এত অসাধারণ কিংবা কেলেঙ্কারির কিছুই নেই।–থাকলে মানুষ চুপ করে থাকে না, সব সময়ই ফলিয়ে বর্ণনা করে আপন সাফাই গায়।
‘আমি বড় সুখী ছিলুম। স্ত্রী, দুটি ছেলে আর একটি মেয়ে। দুটি ছেলেই ফাস্ট ক্লাস পেয়েছে এম, এ-তে, সংস্কৃতে আর ইকনমিক্সে। মেয়েটির বিয়ে ঠিক-জামাইয়ের চেহারা কন্দর্পের মত।
চাকরি-জীবনে মাদুরা, কাঞ্চী, তাঞ্জোর বহু জায়গায় ঘুরেছি, কিন্তু পৈতৃক ভদ্রাসনে যাবার কখনো সুযোগ হয় নি; আমিও গ্রাম ছেড়েছি, ষোল বছর বয়সে পিতার মৃত্যুর পরেই।
হঠাৎ গৃহিণী চেপে ধরলেন-আমি তখন সবেমাত্র পেন্সন নিয়েছি-তিনি তার শ্বশুরের ভিটে দেখতে যাবেন। ছেলেরাও বলে যাবে, মেয়েটার তো কথাই নেই। আমি অনেক করে বোঝালুম, সেখানে এটা নেই, ওটা নেই, সেটা নেই, সাপ আছে, খবরের কাগজ নেই, মশা আছে, পাইখানার ব্যবস্থা নেই, কিন্তু কাকস্য পরিবেদনা, তারা যাবেই যাবে। আমারও যে সামান্য দুর্বলতা হয় নি, সে কথা হলফ করে বলতে পারব না।
‘বিশ্বেস করবে না, বাবা, তারা গ্রাম দেখে মুগ্ধ। আমি তো ট্রেনে পই পাই করে গ্রামটাকে যতদূর সম্ভব কালো করে এঁকেছিলুম, তাদের শখটা যেন বড্ড বেশি কঠোর কঠিন না হয়। তা গাইলে উল্টো গান। ইঁদারা থেকে জল তুললো হৈ হৈ করে-মাদ্রাজে। কলের জল বন্ধ হলে এরাই ‘দি হিন্দু’ কাগজে কড়া কড়া চিঠি লিখিত— মেয়েটা দেখি, ছোট ছোট ইট নিয়ে বাস্তুভিটের গর্তগুলো বন্ধ করছে, গৃহিণী শুকনো তুলসীতলায় অনবরত জল ঢালছেন।
‘বড় আরাম পেলুম। গৃহিণীর কথা বাদ দাও, তিনি সতী-সাধ্বী, কিন্তু আমার মডার্ন’ ছেলেমেয়েরাও যে আমার চতুর্দশ পুরুষের ভিটেকে তাচ্ছিল্য করল না, তাই দেখে আমার চোখে জল ভরে এল।
‘আমার ছেলেবেলায় যারাই গ্রাম থেকে চলে যেত, তারা আর ফিরে আসত না। আমার বাবা তাই আমাকে কতবার বলেছেন তার ঠিক নেই, ‘‘বেণু-গোপালা, দেশের ভিটেমাটি অবহেলা করিস নি, আর যা কর কর!’’
‘চাকরির ধান্দায় আমি তার সে আদেশ পালন করতে পারি নি। এখন দেখি, আমার ছেলেমেয়েরা তার সে আদেশ পালন করছে; বসে বসে প্ল্যান কষছে, কোথায় রজনীগন্ধা ফোটাবে, কোথায় পাঁচিল তুলবে, কোথায় নাইট স্কুল খুলবে। আমার গৃহিণী সার্থক গৰ্ভধারিণী।’
বৃদ্ধ অনেকক্ষণ ধরে চুপ করে রইলেন। আমি আরো বেশি চুপ। বললেন, ‘এর পর আর বলার কিছু নেই, তাই সংক্ষেপে বলি। মাত্র দুদিন কেটেছে; তিন দিনের দিন সকালবেলা মেয়েটার কলেরা হল, ঘণ্টাখানেকের ভিতরে ছেলে দুটোরিও। লোক ছুটিয়ে মাদ্রাজে। তার করলুম। আরও লোক ছুটলো এখানে—সেখানে ডাক্তার-বদ্যির সন্ধান। দশ ঘণ্টার ভিতরে তিনজনই চলে গেল। গৃহিণীর চোখের সামনে।
তিনি গেলেন তার পরদিন। কলেরায় না অন্য কিছুতে বলতে পারি নে। আমি তখন সম্বিতে ছিলুম না।’।
আমি ক্ষীণকণ্ঠে বললুম, ‘থাক, আর না।’
আমার আপত্তি যেন শুনতে পান নি। বললেন, ‘মাদ্রাজে ফিরে আসার কয়েকদিন পরে আমার ব্যাঙ্কার আমার স্ত্রীর সঙ্গে ফোনে কথা কইতে চাইলে–সে জানতো আমাদের টাকা-পয়সার বিষয় আমি কিছুই জানি নে। তার কাছ থেকে শুনলুম, গৃহিণী ভালো ভালো শেয়ার কিনে লাখ তিনেকের মত জমিয়েছিলেন।
‘তাই বেরিয়ে পড়েছি। টমাস কুক যেখানে নিয়ে যায়, সেখানেই যাই।
‘ওদের ছবি দেখবে? চলো, ঘরের ভিতর যাই।’
মনোজ বসুর ভাষায় জাহাজে বসে কহাঁ কহাঁ মুম্বুকে চলে গিয়েছিলুম, হঠাৎ হাঁশি হল আমি পদ্মায় নাই, প্ৰাগে নই আমি বসে আছি জিনীভা লেকের জাহাজে।
জাহাজে অর্কেস্ট্রা গানের পর গান বাজিয়ে যাচ্ছে আর ডেকের মাঝখানে বিস্তর লোক টাঙ্গো, ওয়ালটিস, ফক্স ট্রট নাচছে। আর সে কত জাতবেজাতের লোক- বড় বড় চেক কাটা কোিট-পাতলুম-পরা মার্কিন (আমাদের মারোয়াড়ি ভাইয়ারা যে রকম ‘বড়া বড়া বুট্রাদার’ নক্সা পছন্দ করেন) নিখুঁত, নিপুণ, লিপস্টিক-রুজ-মাখা তষী ফরাসিনী, গাদা-গোদা হাব্দা-হোব্দ জর্মন আর ডাচু, গায়ে কালো নেটু আর লেসের ওড়না জড়ানো বিদ্যুৎনয়নী হিম্পানি রমণী, আপন হাম্বাইয়ের দম্ভে-ভরা একটুখানি আলগোছে-থাকা ইংরেজ আর তাদের উঁচু-নীচুর-টিক্করহীন হকির বাঘিনী, টেনিস-পাগলিনী স্পোর্টস রমণী।
এই হরতেন রুইতেন সায়েব বিবির তাসের দেশে নিরীহ ভারতসন্তান কল্কে পাবে কি?
তা পায়-আকসারই পায়।
তার প্রধান কারণ, আর পাঁচটা ইয়োরোপীয় এবং মার্কিন জাত সুইটজারল্যান্ডে এসেছে ফুর্তি করতে, এদেশের মেয়েদের সঙ্গে ভাবসাবী জমিয়ে ফষ্টিনষ্টি করতে। তার কলকৌশল—নাচের ভিতর দিয়ে, ভাষার অজ্ঞতার ভান করে, দামী দামী মদ খাইয়ে—এরা বিলক্ষণ জানে, এবং কাজে খাটাতে কিছুমাত্র কসুর করে না। এদের সম্বন্ধে তাই সুইস বাপ, ভাই, মা, দিদি এমন কি মেয়েরাও একটুখানি সাবধান।
ভারতীয় মাত্রই যে এদের তুলনায় ‘ধর্মপুত্তুর যুধিষ্ঠির’ এ-কথা আমি বলব না। কিন্তু ইয়োরোপ বাসের প্রথম অবস্থায় ভারতীয় মদ খেতে কিংবা খাওয়াতে জানে না, নাচতে পারে না এবং সবচেয়ে বড় কথা তার ভারতীয় ঐতিহ্য থেকে সে কণামাত্র তালিম পায় নি বিদেশিনীর সঙ্গে কি করে দোস্তী-ইয়ার্কি জমাতে হয়।
আমি ‘ৎসুরিশ সংবাদ’ পড়ছিলুম। পড়া শেষ হতে কাগজখানা টেবিলের উপর রাখামাত্রই আমার পাশের টেবিলের এক ছোকরা এসে আমাকে ‘বাও’ করে বললে, ‘আমার ‘বাজেল সংবাদে’র বদলে আপনার ‘ৎসুরিশ সংবাদ’খানা একমিনিটের জন্য পড়তে পারি কি?
‘নিশ্চয় নিশ্চয়।’-এ ছাড়া আপনি আর কি বলবেন?
কিন্তু স্পষ্ট বোঝা গেল আলাপ জমাবার জন্য সরকারি রাস্তা ধরেই সে যাত্রা শুরু করেছে। কারণ এতক্ষণ ধরে সে তার সঙ্গের দুটি মেয়ের সঙ্গেই গল্পগুজব বা নাচ-গান করছিল—কাগজ পড়ার ফুর্সৎ কই?
তবু কাগজখানা যখন নিয়ে গিয়েছে তখন দু’মিনিট পড়ার ভান করতে হয়। তাই করল। ফেরৎ দেবার সময় ধন্যবাদ জানিয়ে হেসে বলল, ‘আজকাল কিসসু নতুন খবর মেলে না।‘
আমি বললুম, ‘একদম না; সব যেন দাঁড়কচা মেরে গিয়েছে।’
মাথা দুলিয়ে দুলিয়ে বললে, ‘যা বলেছেন।’
এরপর আপনাকে অবশ্যই বলতে হয়, ‘দাঁড়িয়ে রইলেন কেন, বসুন।’
কিন্তু কিন্তু করে বসবে, তারপর আরো দু মিনিট না যেতেই বলবে, তার চেয়ে চলুন না আমাদের টেবিলে। আমার সঙ্গে দু’টি বান্ধবী রয়েছেন। তারা বড্ড একলা পড়ে গেলেন।’
আপনি বলবেন, ‘রাম রাম! বড্ড ভুল হয়ে গেল আপনাকে ঠেকিয়ে রেখে।’
ছোকরা বলবে, ‘সে কি কথা, সে কি কথা!’
এই হল প্রধান সরকারি পন্থা আলাপ-পরিচয় করার—অবশ্য আরো বহু গলিঘুচিও আছে!
বড়টির নাম গ্রেটে, ছোটটি ট্রুডে। ছেলেটার নাম পিট্। পিট্ বলবে, কিছু একটা পান করুন।’
আমি বললুম, ‘এইমাত্র কফি খেয়েছি; এখন আর থাক—অনেক ধন্যবাদ।’
এইবারে যে আলাপচারি আরম্ভ হবে তার চৌহদ্দি বাতানো সরল কর্ম নয়। সাধুসন্ন্যাসীরা সত্যি পেরেকের বিছানায় দিনের পর দিন কাটাতে পারেন কিনা, গোখরোর বিষ ওঝা নামাতে পারে কিনা, কিংবা যোগাভ্যাস করে মাটি থেকে তিন ইঞ্চি উঠে যেতে কাউকে কখনো আমি দেখেছি কিনা?
ছেলেটা যদি দর্শনের ছাত্র হয় তবে হয়ত ভারতীয় দর্শন সম্বন্ধেই প্রশ্ন জিজ্ঞেস করে বসবে, মেয়েটির যদি বাজনায় শখ থাকে তবে আপনাকে শুধিয়ে বসবে, ভারতীয় সঙ্গীতে ক’রকমের তাল হয়।
এসব তাবৎ প্রশ্নের সদুত্তর কে দেবো? ব্রজেন শীল, সুনীতি চাটুয্যে, বিশ্বকোষ, সুকুমার রায়ের ‘নোটবুক’, গুপ্তপ্রেস পঞ্জিকা সব মিলিয়ে ককটেল বানালেও ঐ প্রশ্নমেরু তাকে বেমালুম শুষে নেবে।
বিদেশী একথা বোঝে না যে, তার ঠিক যে জিনিসে কৌতূহল, আপনার তাতে মহব্বৎ নাও থাকতে পার। তার উপরে আরেকটা কথা ভুললে চলবে না, আমরা ইস্কুলকলেজে যে তালিম পাই তাতে ক্রুসেডের তারিখ মুখস্থ করানো হয়—অজন্তা, ধ্রুপদ শেখানো হয় না।
তবে অতি অবশ্য স্বীকার করবো, একটি প্ৰাতঃস্মরণীয় প্রতিষ্ঠান আমি চিনি যিনি এসব প্রশ্নের উত্তম উত্তম উত্তর দিতে পারেন।
হেদোর ওতর-পূব কোণের বসন্ত রেস্টটুরেন্ট’। সেখানে আমরা সুবো শাম রাজাউজীর কতল করি, হেন সমস্যা, হেন বখেড়া নেই। যার ফৈসালা আমরা পত্রপাঠ করে দিতে পারি নে।
‘বসস্ত রেস্টুরেন্টে’র আমি আদি ও অকৃত্রিম সভ্য। তস্য প্রসাদাৎ আমি হরমুলুকে হর-সওয়ালের জবাব দিতে পারি।
বিদেশীদের সম্বন্ধে ভারতীয়ের কৌতূহল কম। কলকাতায় বিস্তর চীনা থাকে; আমি আজ পর্যন্ত একজন বাঙালিকেও দেখি নি, যিনি উৎসাহী হয়ে চীনাদের সঙ্গে আলাপচারি করেছেন। মাত্র একটি বাঙালি চিনি যিনি ছেলেবেলা থেকে কাবুলিওয়ালাদের সঙ্গে ভাব করে দোন্তী জমিয়েছিলেন-কাবুলিরা এখন এদেশে দুর্লভ হয়ে যাওয়াতে তার আর শোকের অস্ত নেই।
ইয়োরোপীয়রা সংস্কৃত যে রকম পড়ে, আরবী চীনা ভাষারও তেমনি চর্চা করে। তাই আমার মনে সব সময়েই আশ্চর্য বোধ হয়েছে যে, ভারতীয় সম্বন্ধে তাদের কৌতূহল সবচেয়ে বেশি কেন?
পিটুকে জিজ্ঞেস করাতে সে বললে, ‘পণ্ডিতেরা কেন ভারতপ্ৰেমী হন, সে কথা আমরা বলতে পারবো না, তবু আমার মত পাঁচজন সাধারণ লোকের কথা কিছু বলতে পারি।
‘প্রাচ্যের তিন ভূখণ্ডের সঙ্গে আমাদের কিছুটা পরিচয় আছে। ভারত, আরবিভুমি আর চীন। তুর্কদেরও আমরা ছেলেবেলা থেকে দেখে আসছি, কিন্তু তারা অনেকখানি ইয়োরোপীয় হয়ে গিয়েছে, আর তিব্বত সম্বন্ধে কৌতূহল পুষে আর লাভ কি? তিব্বরীরা তো এদেশে আসে না।
‘আরবরা সেমিটি, চীনারা মঙ্গোলিয়। এদের ধরনধারণ এত বেশি আলাদা যে, এরা যেন অন্য লোকের প্রাণী বলে মনে হয়। অথচ ভারতীয়রা আর্য-তাই তারা চেনা হয়েও অচেনা। এই ধরুন না, যখন চীনা বা আরব ফরাসী-জার্মন বলে, তখন কেমন যেন মনে হয় ভিন্ন যন্ত্র বাজছে। অথচ ভারতীয়রা যখন ঐ ভাষাগুলোই বলে তখন মনে হয় একই যন্ত্র বাজছে, শুধু ঠিকমত বাঁধা হয় নি।
‘আরেকটা কারণ বোধ হয় খ্রীষ্টের পরই-সময়ের দিক দিয়ে নয়, মাহান্ত্র্যে— মহাপুরুষ বলতে আমরা বুদ্ধদেবের কথাই ভাবি। এখন অবশ্য অনেকখানি মন্দা পড়েছে, কিন্তু এককালে এখানে বুদ্ধদেব সম্বন্ধে প্রচুর বই বেরিয়েছিল। তার কারণ উনবিংশ শতাব্দীর লোক ভগবানে বিশ্বাস হারায়, অথচ একথা জানত না যে, ঈশ্বরকে বাদ দিয়েও শুধু যে ধাৰ্মিক জীবনযাপন করা যায় তাই নয়, ধর্মপত্তন করা চলে। তাই যখন বুদ্ধের বাণী, এদেশে প্রথম প্রথম প্রচার হল, তখন বহু লোক সে বাণীতে যেন হারানো-মাণিক ফিরে পেল। কেউ কেউ তো আদমশুমারীর সময় নিজেদের বৌদ্ধধর্মাবলম্বী বলে জাহির করল।
‘এযুগে গাঁধী পরম বিস্ময়ের বস্তু। অস্ত্ৰধারণ না করে বিদেশী ডাকুকে তাড়ানো যায় কিনা জানি না। কিন্তু গাঁধীর প্রচেষ্টাটাই বিশ্বজগৎকে একদম আহাম্মুক বানিয়ে দিয়েছে। আমি অনেক ধাৰ্মিক ক্ৰীশ্চানকে চিনি, যাঁরা গাঁধীর নাম শুনলেই ভক্তিতে গদগদ হন। একজন তো বলেন, খ্ৰীষ্টধর্ম প্রচার করেন খ্ৰীষ্ট এবং মাত্র একটি লোক সে ধর্ম স্বীকার করেছেন, তিনি গাঁধী।’
টুডে বললে, ‘টেগোরের নাম করলে না?’
পিট্ বললে, ‘টেগোরকে চেনে এদেশের শিক্ষিত লোক। তার কারণও রয়েছে। এ যুগে সাধারণ লোক পড়ে প্রধানত খবরের কাগজ। খবরের কাগজে গাঁধীর কথা দুদিন অন্তর অন্তর বেরয়, কিন্তু টেগোরের কথা বেরোয় তিনি যখন এদেশে আসেন।’
ট্রুডে বললে, ‘আর বুদ্ধদেবের কথা বুঝি খবরের কাগজে নিত্যি নিত্যি বেরয়, না তিনি প্রতি বৎসর এখানে স্কেট করতে আসেন?’
গ্রেটে বললে, ‘ছিঃ, বুদ্ধদেবকে নিয়ে ওরকম হাল্কা কথা কইলে বুদ্ধদেবের দেশের লোক হয়ত ক্ষুণ্ণ হবেন।’
আমি বললুম, ‘আদপেই না। আমাদের দেশে দেবতাদের নিয়ে মজার মজার গল্প আছে।’
পিট্ বললে, ‘বুদ্ধদেব যে একশ’ বছরের স্টার্ট পেয়ে বসে আছেন।’
ট্রুডে আমার দিকে তাকিয়ে বললে, ‘আপনাদের ঠাকুর-দেবতাদের নিয়ে যে সব মজার গল্প আছে, তারই একটা বলুন না।’
আমি শিব বেজায়গায় একবার বর দিয়ে যে কি বিপদে পড়েছিলেন, আর শেষটায় বিচক্ষণ নারদ তাকে কি কৌশলে বঁচিয়ে দিয়েছিলেন, সেই গল্পটি বললুম।
তিনজনেই হেসে কুটিকুটি।
ট্রুডে জিজ্ঞেস করলে, ‘শিব কি ডাঙর দেবতা?’
আমি বললুম, ‘নিশ্চয়। তবে কিনা তিনি শ্মশানে থাকেন, ভূতের নৃত্য দেখেন, কাপড়াচোপড়ও সব সময় ঠিক থাকে না। দেবতাদের পার্লিমেন্টে সচরাচর যান না।’
সবাই অবাক হয়ে শুধায়, ‘তবে তিনি ডাঙর হলেন কি করে?’
এখানেই আমি হামেশাই একটু বিপদে পড়ে যাই। নীলকণ্ঠের বৈরাগ্য যে এদেশের ঘোর সংসারী মনকেও মাঝে মাঝে ব্যাকুল করে তোলে, সেটা ইয়োরোপীয়রা ঠিক হৃদয়ঙ্গম করতে পারে না। ‘আরো চাই’, ‘আরো চাই’য়ের দেশে ‘কিছু না’, ‘কিছু না’র তত্ত বোঝাই কি প্রকারে? আমি যে বুঝেছি তা-ও নয়।
তবে ইয়োরোপের সর্বত্রই মেয়েরা হরপার্বতীর বিয়ের বর্ণনা শুনতে বড় ভালোবাসে। বিশেষ করে যখন বরযাত্রায় বলদের পিঠে শিবকে দেখে মেনকা চিৎকার করে তাঁকে খেদিয়ে দেবার জন্যে আদেশ দিলেন, আর যখন শুনলেন তিনিই বর এবং ভিরমি গেলেন–তখন মেয়েরা ভীষণ উত্তেজিত হয়ে ওঠে।
আমি তার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে উত্তেজনোটা বাড়ানোর জন্য ধীরে ধীরে একটি সিগারেট ধরাই।
‘তারপর, তারপর?’ সবাই চেঁচায়।
জানি অসম্ভব। তবু তখন এ-ক’টি ছত্র অনুবাদ করার চেষ্টা করি
ভৈরব সেদিন তব প্রেতিসঙ্গীদল রক্ত আঁখি দেখে,
তব শুভ্রতনু রক্তাংশুকে রহিয়াছে ঢাকি
প্ৰাতঃসূর্য রুচি।
অস্থিমালা গেছে খুলে মাধবীবল্লরী মূলে
ভালে মাখা পুষ্পরেণু-চিতাভস্ম কোথা
গেছে মুছি।
কৌতুকে হাসেন ঊমা কটাক্ষে লক্ষিয়া কবি পানে—
সে হাস্যে মন্দ্রিল বাঁশি সুন্দরের জয়ধ্বনি গানে
কবির পরাণে।
***
এ দৃশ্য আমি একমাত্র সুইটজারল্যান্ডেই দেখেছি।
পশ্চিমের সূর্য হেলে পড়েছে আর তার লাল আলো এসে পড়েছে পাহাড়ের গায়ের বাড়িগুলোর হাজার হাজার কাচের সাশীতে। সাশীগুলা লালে। লাল হয়ে গিয়ে একাকার—মনে হয় বাড়িগুলো বুঝি মিনিটখানেকের ভিতরই পুড়ে খাক হয়ে যাবে। আগুনের জিভের মত লালের আঁচ উঠেছে আকাশের দিকে, আর তারই রঙ গিয়ে লেগেছে দূর পাহাড়ের চূড়োয় সাদা বরফে। সেখানেও লেগে গেছে দাউ দাউ করে আগুন। পাহাড়ের কোলে বসা মেঘগুলোও সঙ্গে সঙ্গে পুড়ে যাচ্ছে; ওদিকে আকাশের এখানে ওখানে যে সব মেঘের টুকরো সমস্ত দিন সাদা ভেড়ার মত আকাশের নীল মাঠে শুয়ে ছিল তারা দেখি পূর্বপশ্চিমের আগুনে তেতে গিয়ে গোলাপী হয়ে উঠেছে। সেই লাল রঙের আওতায় পড়ে নীল পাহাড় আর হ্রদের নীল জল ঘন বেগুনী রঙ মেখে নিয়েছে।
চতুর্দিকে হুলস্থূল কাণ্ড, কিন্তু নিঃশব্দে। মেঘে মেঘে, আকাশে আকাশে, পাহাড়পর্বতে, ঘরবাড়িতে এমন কি জলে বাতাসে এই যে বিরাট অগ্নিকাণ্ডটা হয়ে যাচ্ছে তাকে নেভাবার জন্য চোঁচামেচি-চিৎকার হচ্ছে না, আগুনের তাপে কাঠ-বাঁশ ফেটে যাওয়ার ফট্-ফট্ দুদড়াম শব্দ হচ্ছে না, ঐ যে লেকের পাড়ে সোনালি বেঞ্চিতে বসে আছে মেয়েটি তার সাদা ফ্রকে আগুন লেগেছে, সেও তো চিৎকার করে কেঁদে উঠছে না। এ কী কাণ্ড!
এ আগুনের কি জ্বালা নেই, না। এদেশের জনমানব-পশুপক্ষীকে কোনো এক ভানুমতী ইন্দ্ৰজাল দিয়ে অসাড়-অচেতন করে দিয়েছেন? হাঁ, এ তো ইন্দ্ৰজালই বটে। এতখানি আগুন, লক্ষ লক্ষ কলসী থেকে উজাড় করে ঢেলে দেওয়া এতখানি গলানো সোনা, হাজার হাজার মণ গোলাপী পাপড়ির লোধু-রেণু, না জানি কত শত জালা আবির-গুলাল এরকম অকৃপণ হাতে ঢেলে দিলে, ছড়িয়ে ফেললে স্বৰ্গপুরীকেও লাল বাতি জ্বালাতে হবে।–হয়ত এই আগুন থেকেই পিদিম ধরিয়ে নিয়ে।
এ তো কনে-দেখার আলো নয়; এ তো সতীদাহের বহ্নিকুণ্ড।
গ্রেটে আর ট্রুডের ব্লন্ড্ চুল অদৃশ্য হেয়ার-ড্রেসারের হাতে সোনালি হয়ে গেল। পিট্ কথা বলবার সময় ঘন ঘন হাত নাড়ে; মনে হচ্ছে যেন সোনালি জলে হাত দুখানি সাঁতার কাটছে।
সূর্য পাহাড়ের পিছনে অতি ধীরে ধীরে অস্তাচলে নেমে গিয়েছেন। আবার সেই ভানুমতী এসেছে। অদৃশ্যে তিনি ঘন ঘন। এখানে ওখানে উড়ে গিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে মেঘের গা থেকে আবির তুলে নিয়ে কাজল মাখিয়ে দিচ্ছেন, ফুঁ দিয়ে এক এক সার সাশী থেকে আগুন নিবিয়ে দিচ্ছেন, কখনো বা দেখি লোকের এ-প্ৰান্ত থেকে ও-প্রান্ত অবধি জলের উপর হাত বুলিয়ে দিলেন-যেন গোবর দিয়ে আঙ্গিনা লেপে দেওয়া হল।
এ দৃশ্য সুইটজারল্যান্ডেও নিত্য নিত্য ঘটে না। জাহাজের ব্যান্ড তাই দুই নাচের মাঝখানে এখন অনেকখানি সময় নিচ্ছে। জাহাজের বহু নরনারী স্তব্ধ হয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। এরকম সূর্যস্ত কমই হয় যেখানে তুমি আমিও হিস্যেদার—স্পষ্ট দেখলুম। তোমার কাপড়ের আগুন লেগে গিয়েছিল আমার কাপড়েও। আপনি অজানাতে আমাদের দেহ, আমাদের বেশভুষা, এ রসের সায়রে ছোট ছোট দ’ সৃষ্টি করে তুলেছে।
টুডে জিজ্ঞেস করল, ‘আপনার দেশে এরকম সূর্যাস্ত হয়?’
আমি বললুম, কাশ্মীরে হয়; সেখানে বরফ আছে, পাহাড় আছে, লেক আছে। কিন্তু হাজার হাজার চকচকে ঝকঝকে জানলার সাশী নেই বলে হয়ত এতখানি আগুন ধরে না। তবে যদি হিমালয়কে ভারত বলে গোনা হয় তবে নিশ্চয়ই এর চেয়েও বেশি আগুন-জ্বালা সূর্যস্ত সেখানে হয়—সুইস পর্যটকদেরই লেখাতে পড়েছি।’
ভানুমতী দিকে দিকে কাজলধারা বইয়ে দিয়েছে। চতুর্দিক অন্ধকার।
শুধু ফুটে উঠেছে অন্ধকার ঘাসের উপর লক্ষ লক্ষ বিজলি-বাতির ফুল। আকাশের ফরাশেও দেবতারা জুলিয়ে দিয়েছেন। অগুণতি তারার মোমবাতি। ঠিক বোঝা যাচ্ছে না, পাহাড়ের উপরের দিকে যে আলোগুলো জুলছে সেগুলো মানুষের প্রদীপ না দেবতার তারা। মানুষ স্বর্গের দিকে ধাওয়া করে উঠেছে পাহাড়ে, আর দেবতারা নেমে এসেছেন। পৃথিবীর দিকে ঐ পাহাড়ের চুড়ো পর্যন্ত—একে অন্যকে অন্ধকারের এপার ওপার থেকে সাঁঝের পিদিম দেখাবার জন্য।
“মাটির প্রদীপখানি আছে মাটির ঘরের কোলে,
সন্ধ্যাতারা তাকায় তারি। আলো দেখবে বলে।
সেই আলোটি নিমেষহত প্রিয়ার ব্যাকুল চাওয়ার মতো,
সেই আলোটি মায়ের প্রাণের ভয়ের মত দোলে।।
সেই আলোটি নেবে জ্বলে শ্যামল ধারার হৃদয়তলে,
সেই আলোটি চপল হাওয়ায় ব্যথায় কঁপে পলে পলে।
নামল সন্ধ্যাতরার বাণী আকাশ হতে আশিস আনি,
অমরশিখা আকুল হল মর্তশিখায় উঠতে জ্বলে।।“
পিট্ বললে, ‘একটি প্রেমের গল্প বলুন।’
আমি বললুম, ‘ভারতবর্ষে সত্যকার প্রেমের গল্প আছে একটি, যার সঙ্গে অন্য কোনো দেশের গল্প পাল্লা দিতে পারে না। সে কাহিনীতে মাটির মানুষ তার আপনি বিরহবেদনার বর্ণনা শুনতে পায়, আবার ভগবদপ্রেমের জন্য ব্যাকুলজনও সেই কাহিনীতে আপন আকুলি-বিকুলির নিবিড়তম বর্ণনাও শুনতে পায়। কিন্তু রাধামাধবের সে কাহিনী বলবার মত ভাষা আমার নেই।’
ট্রুডে বললে, ‘আমি একখানি ছবি দেখেছি তাতে রাধা কৃষ্ণের গায়ে পিচকারি দিয়ে লাল রং মারছেন। চমৎকার ছবি!’
কিছুক্ষণ চুপ করে থাকার পর আমি পিট্কে বললুম, ‘তার চেয়ে বরঞ্চ আপনি আপনার প্রেমের কাহিনী বলুন না?’
পিট্ তো বেশ খানিকটা ঠা ঠা করে হাসল-দুপাত্রের পর মানুষ অল্পেতেই হাসে কাঁদে–তারপর বললে, ‘হ্যারগষ্ট হ্যারগষ্ট (রামচন্দর!), এ যুগে কি আর সে রকম প্রেম কারো জীবনে আসে যা নিয়ে রাসিয়ে গল্প জমানো যায়?’
ট্রুডে বললে, ‘বলেই ফেল না ছাই তোমার সাদা-মাটা গল্পটা।’
গ্রেটে দেখি চুপ করে আছে।
পিট্ বললে, ‘আমার প্রেমে পড়ার কাহিনীতে মাত্র সামান্য একটু বিশেষত্ব আছে। সেইটুকুই বুঝিয়ে বলি।
‘আমি তখন সবে কলেজে ঢুকেছি। ফাস্ট পিরিয়ডে ক্লাস থাকত না বলে আমি বাড়ি থেকে বেরতুম ন’টার সময়। একদিন ন’টার কয়েক মিনিট পরে কলেজের কাছেই একটি মেয়ে আমার পাশ দিয়ে উল্টো দিকে চলে গেল। হাবভাব দেখে মনে হল কলেজেরই ছাত্রী কিন্তু আসল কথা সেইটো নয়—আসল কথা হচ্ছে ওরকম সুন্দরী আমি আর কখনো দেখি নি।
‘আমার বুকের রক্ত দুম করে জমে গেল; আমার হার্টটা যেন লাফ দিয়ে গলার কাছে পৌঁছে গেল। আমি অনেকক্ষণ সেই রাস্তার উপর ঠায় দাঁড়িয়ে রইলুম। সেদিন আর ক্লাস করা হল না; কলেজের বাগানে বসে বসে সমস্ত সকলটা কাটল।
‘পরদিন ঠিক ঐ সময়ই মেয়েটি আমাকে রাস্তায় ক্রস করল। এবারে দুজনাতে চোখাচোখি হল–এক ঝলকের তরে। তারই ফলে আমাকে রাস্তার পাশের রেলিঙ ধরে সে নজরের ধাক্কা সামলাতে হল।
‘তারপর রোজই ঐ সময় রাস্তায় দেখা হয়, এক লহমার চোখাচোখি হয়। বুঝলুম মেয়েটির সেকেন্ড পিরিয়েড ফ্রী তাই বোধ হয় বাড়ি কিংবা অন্য কোথাও যায়।
‘আগেই বলেছি, মেয়েটি অপূর্ব সুন্দরী। রোজ সকালে নটার পর তার সেই এক ঝলকের তরে আমার দিকে তাকিয়ে দেখা যেন আমার গলায় এক পাত্র সোনালি মদ ঢেলে দিত আর বাদবাকি দিন আমার কাছে আসমানজমীন গোলাপী রঙে রাঙা বলে মনে হত।
‘করে করে তিন মাস কাটল।’
পিট্ মদের গেলাসে মুখ ঠেকাতে আমি শুধালুম, ‘পরিচয় করবার সুযোগ হল না, তিন মাসের ভিতর? কলেজ ডানসে, কলেজ রেস্তোরী-কোথাও?’
পিন্টু বলল, ‘ভয়, ভয়, ভয়। আমার মনে হত এরকম সুন্দরী কখনোই, কোন অবস্থাতেই আমার মত সাদা-মাটাকে ভালোবাসবে না, বাসতে পারে না, অসম্ভব, অসম্ভব, সম্পূর্ণ অসম্ভব। বিশ্বাস করবেন না, পাছে আলাপচারি হয়ে যায় আর সে আমায় অবহেলা করে সেই ভয়ে কোনো নাচের মজলিসে দেখা হলে আমি তৎক্ষণাৎ ঊর্ধ্বশ্বাসে সে স্থল পরিত্যাগ করতুম। তার চেয়ে পরিচয় না হওয়াটাই ঢের ঢের ভালো।’
আমি বললুম, ‘টেগোরেরও গান আছে—
‘সেই ভালো সেই ভালো আমারে না হয় না জানো
দূরে গিয়ে নয় দুঃখ দেবে কাছে কেন লাজে লাজানো?’
পিট্ বলল, ‘আশ্চর্য, টেগোর তো অতি সুপুরুষ ছিলেন। তিনি এরকম মর্মান্তিক অনুভূতিটা পেলেন কোথায়?’
আমি শুধালুম, ‘কিন্তু মেয়েটিও তো আপনার দিকে তাকাত!’
ঠিক বলেছেন, কিন্তু আমার মনে হত মেয়েটি শুধু দেখতে চায়, এই বেশিরম বাঁদরটা কত দিন ধরে এ তামাশা চালায়।’
আমি শুধালুম, ‘তার পর?’
‘তিন মাস হয়ে গিয়েছে। আমি প্রেমের পাখায় ভর করে চন্দ্ৰসূৰ্য ঘুরে বেড়াচ্ছি। প্রেমের এ পাখা দানা-পানি অর্থাৎ প্রতিদানের তোয়াক্কা করে না বলে এর কখনো ক্লান্তি হয় না; এ প্রেম আমার মনের বাগানে ফোটা জুই,-কারো অবহেলা-অনাদরের খরতাপে এ ফুল কখনো শুকোবে না।
‘কলেজের বাগানে বসে একদিন চোখ বন্ধ করে আমি আমার প্রিয়াকে দেখছি, এমন সময় কাঁধে হাত পড়ল। চোখ মেলে দেখি আমার গ্রামের একটি পরিচিত ছেলে আর তার পাশে দাঁড়িয়ে আমার স্বপ্নের ফুল। পালাবার পথ ছিল না, পরিচয় হয়ে গেল।’
‘তারপর?’
‘আমার একদম মনে নেই। যেটুকু মনে আছে বলছি, হঠাৎ দেখি ছেলেটি উধাও, আর আমার স্বপ্ন তখনো মূর্তি ধরে পাশে বসে আছে। কিন্তু আসল কথায় ফিরে যাই। সেই যে ভয়ের কথা বলেছিলুম। প্রথম আলাপেই আমি যে তার সঙ্গে পরিচয় করতে ডরাই সেকথা কি জানি কি করে বেরিয়ে গেল। মেয়েটি অবাক হয়ে শুধাল, ‘কিসের ভয়?’ আমি বললুম, ‘আপনি বড় বেশি সুন্দর।’ তখন যা শুনলুম সে আমি তখনো বিশ্বাস করি নি এখনো করি নে—তার বিশ্বাস, আমি একটা আস্ত এ্যাডনিস এবং তাই আমার সঙ্গে আলাপ-পরিচয় করতে সে ভয় পেয়েছিল। শুনুন কথা!’
আমি বললুম, ‘আপনারা দুজনাই দেখতে চমৎকার কিন্তু সেইটে আসল কথা নয়। আসল কথা আছে এক ফার্সী প্রবাদে, ‘লায়লীরা বায়দ্ ব্ চশ্মে মজনূন দীদ!’ লায়লীকে দেখতে হয় মজনুর চোখ দিয়ে।’
জাহাজ পাড়ে এসে ভিড়ল। সবাই নেমে পড়লুম। আবার দেখা হবে, বলে পিট্ গ্রেটে, ট্রুডে বিদায় নিল।
আপন মনে বাড়ির দিকে চলতে চলতে একটা কথা ভাবতে লাগলুম; এই যে ইয়োরোপীয়রা প্ৰাণ খুলে ফুর্তি করে, হৈ-হাল্লা করে, আমরা এ-রকম ধারা আপন দেশে করতে পারি নে কেন? সায়েবসুবোদের লেখাতে পড়েছি, আমরা নাকি বড্ড সিরিয়স, সংসারকে আমরা নাকি মায়াময় অনিত্য ঠাউরে নিয়ে মুখ গুমসো করে বসে আছি, ফুর্তিফার্তি করার দিকে আমাদের আদপেই মন নেই।
‘জাতক’ তো খ্ৰীষ্টের বহু পূর্বে লেখা। তাতে যে হরেক রকম পালা পরবের বর্ণনা পাই তার থেকে তো মনে হয় না, আমরা সে যুগে বড্ড রাশভরি মেজাজ নিয়ে আত্মচিস্তা আর তত্ত্বালাপে দিন কাটাতুম। স্পষ্ট মনে পড়ছে কোন এক পরবের দিনে এক নাগর তার প্রিয়ার মনস্তুষ্টির জন্য রাজবাগানে ফুল চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়ে শূলের উপর প্রাণ দেয়। মর্যার সময় সে আক্ষেপ করেছিল, প্রিয়া, আমি যে মরছি তাতে আমার কোনো ক্ষোভ নেই, কিন্তু তুমি যে পরবের দিনে ফুল পরে যেতে পারলে না সে দুঃখ আমার মরার সময়ও রইল।’
আমাদের কাব্যনাটক রাজরাজড়াদের নিয়ে—সেখানে হদিস মেলে না। আমাদের সাধারণ পাঁচজন আনন্দ উৎসব করত কি না এবং করলে কি ধরনের করত। শুধু মৃৎশকটিকা’ আর ‘মালতীমাধবে সাধারণ লোকের সবিস্তর বর্ণনা রয়েছে এবং এ দুটি পড়ে তো মনে হয় না। এ সময়ের সাধারণ পাঁচজন আজকের দিনের ইয়োরোপীয়দের তুলনায় কিছু কম আয়েস করত। মৃৎশকটিকায় রান্নাঘরের যে বর্ণনা পাই তার তুলনায় সুইটজারল্যান্ডের যেকোনো রেস্তরী নস্যাৎ। আর ‘মালতীমাধবের নাগর মাধববাবু তো জাহাজের পিট্ সাহেবকে প্রেমের লীলাখেলায় দু কলম তালিম দিতে পারে।
তবে কি নিতান্ত এ যুগে এসেই আমরা হঠাৎ বুড়িয়ে গিয়েছি? তাও তো নয়। হুতোমের কেতাবখানায় একবার চোখ বুলিয়ে নি-বাবুরা তো কিছুমাত্র কম ঢলঢলি করেন। নি। তবে কি একি বিংশ শতকে এসে হঠাৎ আমাদের ভীমরতি ধরল? তাও তো নয়। ফুটবল খেলা দেখতে এক কলকাতা শহরই যা পয়সা উড়োয় তার অর্ধেক বোধ হয় তামাম সুইটজারল্যান্ডও করে না।
ফুটবল সিনেমা লোকে দেখুক—আমার আপত্তি আছে কি নেই। সে প্রশ্ন উঠছে না। আমি শুধু ভাবি এসব আনন্দে উত্তেজনার ভাগটা এতই বেশি যে মানুষ যেন সেখানে স্থায়ী কোনো কিছু সন্ধান পায় না। আমার মনে হয়, স্টীমারে বা ট্রেনে, সত্যযুগে, যখন ভিড় বেশি হত না তখন ডেলিপ্যাসেঞ্জারি করাতেও আনন্দ ছিল অনেক বেশি। বহু বৎসর হয়ে গিয়েছে। তবু এখনো মনে পড়ছে দু’একজন যথার্থ সুরসিককে। এঁরা কামরায় উঠেই পাঞ্জাবির বোতাম খুলে দিয়ে কেঁচা দিয়ে হাওয়া খেতে খেতে যা গল্প জুড়তেন তার আর তুলনা হয় না। আমরা গুটিকয়েক প্রাণী রোজই এক কামরায় উঠতুমি আর এঁরা কামরা খানিকে গালগল্প দিয়ে প্রতিদিন রঙিন করে দিতেন। অসুখ করে আমাদের কেউ দুদিন কামাই দিলে এঁরা রীতিমত ব্যস্ত হয়ে উঠতেন, কোনো কৌশলে দুটো ডাব কিংবা চারটি ডালিম পাঠানো যায় কি না তার আন্দেশা করতেন, কিন্তু যাক, এ বাবতে রূপদশী’ আমার চেয়ে ঢের বেশি ওকীব-হাল।
আমি ভাবছি, সেই সব আনন্দের কথা যেখানে অজানা জনকে চেনবার সুযোগ হয়। উদয়াস্ত তো আমরা বসে আছি সাংসারিকতার মুখোশ পরে। আপিসে যারা আমার কাছে আসে তারা আসে স্বার্থের খাতিরে, বাড়িতে যাঁরা আসেন তাঁরা বন্ধুজন, তাঁদের আমি চিনি, তাঁরা আমায় চেনেন। কিন্তু নূতন পরিচয় হবে কি প্রকারে?
তাই ট্রেনের স্বল্পক্ষণের পরিচয় অনেক সময় গভীর বন্ধুত্বে পরিণত হয়। ট্রেনে তুমি আমাকে চেন না, আমি তোমাকে চিনি নে। আলাপচারিটা কোনো স্বার্থের খাতিরে আরম্ভ হয় না বলে শেষ পর্যন্ত সে যে কত অন্তরঙ্গতায় দুজনকে নিয়ে যেতে পারবে তার কোনো স্থিরতা নেই।
অবশ্য এখন আমরা সব মেকি সায়েব হয়ে গিয়েছি। আগের আমলের মত কেউ যদি সুধান, ‘বাবাজীর আসা হচ্ছে কোন থেকে’ কিংবা ‘বাবাজীরা—?’ অর্থাৎ ‘বাবাজী বামুন, কায়েত, না বদ্যি?’ তাহলে আমরা বিরক্ত হই। কেন হই, তা এখনো আমি বুঝে উঠতে পারি নে।
ইংরেজ শুনেছি হয়। আমি বলতে পারব না। কারণ আমি পারতপক্ষে কোনো ইংরেজের সঙ্গে আলাপ জমাতে চাই নে। অবশ্য কোনো ইংরেজ আলাপ করতে চাইলে আমি খেঁকিয়ে উঠে তাকে স্নাবও করি নে। কিন্তু ফরাসী জর্মন সুইস অন্য ধরনের। তারা অনেক বেশি মিশুকে। কাফে বা মদের দোকানে তারা যে রোজ সন্ধ্যায় আডডা জমায় সেখানে কোনো সদস্য যদি কোনো নূতন লোক নিয়ে উপস্থিত হয় তবে আর পাঁচজন আনন্দিত হয়। ইংরেজের ক্লাবে। যদি কোনো সদস্য আপন বন্ধুকে নিমন্ত্রণ করে তবে আর পাঁচজন তার দিকে আড়নয়নে তাকায়। কোনো কোনো ক্লাবে তো কড়া আইন, আপনি মাসে কদিন ক’জন অতিথিকে নিমন্ত্রণ করতে পারেন।
জর্মন, ফরাসী, সুইসদের ভিন্ন রীতি। ‘পাবে’, কাফেতে ইয়ারদোস্ত যোগাড় করার পরও তাদের প্রাণ ভরে ওঠে না বলে তারা যায় ফুর্তির জাহাজ চড়তে। সেখানে কত দেশের কত লোকের সঙ্গে আলাপ হবে–
কত অজানারে জানাইলে তুমি কত ঘরে দিলে ঠাঁই
দূরকে করিলে নিকট বন্ধু, পরকে করিলে ভাই।