বর্ষা
কাইরোতে বছরে ক’ইঞ্চি বৃষ্টি পড়ে এতদিন বাদে সে কথা আমার আর স্মরণ নেই। আধা হতে পারে সিকিও হতে পারে। দিনের পর দিন, মাসের পর মাস মেঘমুক্ত নীল আকাশ দেখে দেখে আমার তো প্রথমটায় মনে হয়েছিল, এদেশে বুঝি আদপেই বৃষ্টিপাত হয় না। আর গাছপালার কী দুরবস্থা, পাতাগুলোর কী অদ্ভূত চেহারা! সাহারার ধুলো উড়ে এসে চেপে বসেছে পাতাগুলোর গায়ে-সিন্দাবাদের কাঁধে যে রকম পাগলা বুড়ো চেপে বসেছিল-সে ধূলা সরানো দু-দশটা হৌজের কর্ম নয়। কাফেতে বসে বুলভারের গাছগুলোর দিকে তাকিয়ে তাকিয়ে প্রায়ই ভাবতুম, এদের কপালে কি কোন প্রকারের মুক্তিস্নান নেই?
সুদানের একটি ছেলের সঙ্গে আলাপ হল। সে বললে, তার দেশে নাকি ষাট বছরের পর একদিন হঠাৎ কয়েক ফোটা বৃষ্টি নেবেছিল। মেয়েরা, কাচ্চাব্বাচ্চারা, এমন কি গোটা কয়েক জোয়ান মদ্দরা পর্যন্ত হাউমাউ করে কান্নাকাটি জুড়েছিল, ‘আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে আমাদের ঘাড়ে ভেঙে পড়লো গো। আমরা যাব কোথায়? কিয়ামতের (মহাপ্রলয়ের) দিন এসে গেছে। সব পাপের তওবা (ক্ষমা-ভিক্ষা) মাঙবার সময় পেলুম না, সবাইকে যেতে হবে নরকে। গাঁও-বুড়োরা নাকি তখন সান্ত্বনা দিয়ে বলেছিলেন, ‘এতে ভয় পাবার কিছু নেই। আকাশ টুকরো টুকরো হয়ে ভেঙে পড়ছে না। এ যা নাবিছে সে জিনিস জল। এর নাম মৎর (অর্থাৎ বৃষ্টি)।’ সুদানী ছেলেটি আমায় বুঝিয়ে বললে, ‘আরবী ভাষায় মৎর (বৃষ্টি) শব্দ আছে; কারণ আরব দেশে মাঝে মাঝে বৃষ্টি হয়, কিন্তু সুদানে যে-আরবী ভাষা প্রচলিত সেভাষায় মৎর শব্দ কখনো ব্যবহৃত হয় নি বলে সে শব্দটি সুদানী মেয়েছেলেদের সম্পূর্ণ অজানা।’
সুদানে যাই হোক। কিন্তু একদিন যখন হঠাৎ কাইরোতে বৃষ্টি নাবল আমি তখন আনন্দে আত্মহারা হয়ে কাফে ছেড়ে রাস্তায় বেরিয়ে পড়লুম। বিরহী যক্ষ যেরকম দুই বাহু প্রসারিত করে উত্তরের বাতাস আলিঙ্গন করেছিল; আমি ঠিক সেইরকম ‘ঝড় নেমে আয়’ বেসুরা বেতালা করে গাইলুম আর আমার জোব্বাজাব্বা যে ভিজে কাঁই হল, সে কথা বলাই বাহুল্য।
বৃষ্টি না থামার পূর্বেই ফিরে এলুম পাড়ার কাফেতে। সবাইকে বোঝাবো, বাঙলা দেশে কি রকম অদ্ভুত বর্ষা নামে, তার কি অপূর্ব জৌলুস। দেখি, আড্ডার সদস্যরা কেউ আধভেজা, কেউ ছ’আনা, কেউ দু’আনা। আমাকে দেখা মাত্ৰ সবাই তো মারমার করে। তেড়ে এল। আরে, বুঝিয়েই বলে না, কি ব্যাপার, চটছে কেন?
সবাই এক সঙ্গে কথা কয়। কি মুশকিল: ভাবখানা অনেকটা;—এই ড্যাম নুইসেন্স বৃষ্টির প্রশংসা আমি রাস্কেল ইন্ডিয়ান কেন এতদিন ধরে করে আসছি? আর দ্যাটু পোয়েট টেগোর, যার নামে আমি অজ্ঞান, সেই বা এই বৃষ্টির নামে এত কবিতা লিখল কেন? সুট বরবাদ হয়ে গিয়েছে, হিম লেগে কেউ হাঁচ্ছে, কেউ কাঁদছে, কেউ বা পিছলে-পড়ে হাত ভেঙে ফেলেছে। আর সবচেয়ে মারাত্মক খবর, পাউলুসের বান্ধবী বৃষ্টির জন্য আসতে পারে নি বলে পাউলুস মর্মাহত হয়ে পটাশিয়াম সায়ানাইডের সন্ধানে বেরিয়ে গিয়েছে। মহা মুশকিলে পড়লুম। জুৎসই কি উত্তর দিই! মৃৎশকটিকায় বসন্তসেনা বৃষ্টিতে ভিজে যখন চারুদত্তের সামনে উপস্থিত হয়েছিলেন তখন যে কাব্য সৃষ্টি হয়েছিল, তার বর্ণনা এদের সামনে এই বেমক্কায় পেশ করলে এরা আমাকে খুন করবে; মেঘদূতের বয়ান, জয়দেবের ‘মেঘৈর্মেদুরস্বরং এদের সামনে গাইতে গেলে এরা আমাকে জ্যান্ত পুঁতে ফেলবে। তাই ভাবলুম, কার্ল মার্কসের স্মরণ নেওয়াই প্রশস্ত। অর্থনৈতিক কারণ দেখালে এরা হয়ত মোলায়েম হবে। বললুম, ‘বৃষ্টি না হলে গাছপালা, গম-ধান গজাবে কি প্রকারে?’
সবাই আমার দিকে এমন ভাবে তাকালে যেন আমি বেহেড মাতাল অথবা বদ্ধ উন্মাদ। মিশরে পাগলা উটের কামড় খেয়ে বহু লোক মতিচ্ছন্ন হয়ে যায় বলে এরা পাগলকে কি ভাবে সায়েস্তা করতে হয় সে কথা বিলক্ষণ জানে। রমজান বললে, ‘কাইরো শহরের ভিতর কি যবগম। ফলে যে এখানে বৃষ্টির প্রয়োজন? যবগম ফলে গ্রামাঞ্চলে। সেখানে বৃষ্টি হোক না, কে র্যারণ করছে। কিন্তু শহরের ভিতরে কেন?’
শরিফ মুহম্মদ বললো, ‘সেখানেই বা বৃষ্টি হবে কেন? আমাদের গম-ধান ফলে নাইলের জলে। এই যে বৃষ্টি কখন আসে কখন আসে না তার তো কিছু ঠিক-ঠিকানা নেই। এর উপর নির্ভর করলে মিশরীদের আর বাঁচতে হত না।’ আমি কি উত্তর দেব ভাবছি, এমন সময় গ্ৰীক সদস্য পাউলুস ফিরে এসে ঝুপ করে একটা চেয়ারে বসে টেবিলে মাথা রেখে নিঃশব্দে চোখের জল ফেলতে আরম্ভ করল। আমার সঙ্গে তর্কাতর্কির কথা সবাই ভুলে গিয়ে পাউলুসের চতুর্দিকে ঘিরে দাঁড়ালো।
কি হয়েছে, কি ব্যাপার?
অনেক ঝুলোকুলির পর পাউলুস মাথা না তুলেই ফুপিয়ে যা বললো তার অর্থ, মেঘ আর বৃষ্টিতে তার বান্ধবীর বিরহবেদনা তাকে কাবু করে ফেলেছে। এ যন্ত্রণা সে সইতে পারবে না। পটাসিয়াম সায়ানাইড রেশনড হয়ে গিয়েছে। মৃত্যুর অন্য কোনো প্রশস্ত পন্থা আড্ডা যদি থাকে না বাংলায়। তবে—ইত্যাদি।
আমাকে তখন আর পায় কে? হুঙ্কার দিয়ে বললুম, ‘ওরে মুখের দল, জীবনের সবচেয়ে বড় সত্য বিরহী। আর বিরহ করে কয়, সে-কথা কি করে জানবি মেঘ না জমলে, বৃষ্টি না ঝরলো? আর শেষ তত্ত্বকথা কবিতা কি করে ওৎরাবে বিরহবেদনা যদি মানুষকে পাগল করে না তোলে?’
আজও ভাবি, আমাদের পদাবলী, জয়দেব, কালিদাস, শূদ্ৰক যে বিরহ বর্ণনা রেখে গিয়েছেন তার সঙ্গে তো অন্য কোন সাহিত্যের বিরহ বর্ণনার তুলনা হয় না। তার একমাত্র কারণ আমাদের বর্ষা।
জিন্দাবাদ হিন্দুস্থানী বর্ষা!