‘কালচর’
‘পরশুরামে’র কেদার চাটুজ্যেকে বাঘ তাড়া করেছে, ভূত ভয় দেখিয়েছে, হনুমান দাঁত খিচিয়েছে, পুলিশ কোর্টের উকিল জেরা করেছে, তবু তিনি ভয় পান নি। কিন্তু শেষটায় এক আমেরিকান মেমসায়েবের পাল্লায় পড়ে হিমসিম খেয়ে যান। কেদার চাটুজ্যের প্রতি আমার অগাধ ভক্তি কিন্তু তৎসত্ত্বেও আমাকে সবিনয় বলতে হবে তার তুলনায় আমি দেশভ্রমণ করেছি অনেক বেশি, কাজেই আমাকে ভয় দেখিয়েছে আরো অনেক বেশি ভূত, অদ্ভুত, নাৎসী, কম্যুনিস্ট, মিশনারী, কলাবৎ, সম্পাদক, দারোয়ান ইত্যাদি। কিন্তু তবু যদি তামাতুলসী-গঙ্গাজল নিয়ে শপথ কাটতে হয়, তবে বলব আমি বেশি ভয় পেয়েছি ‘কলচরে’র সামনে।
বাঙলা দেশে ‘কলচর’ আছে কিনা জানিনে; যদি বা থাকে। তবে আমি নিজে বাঙালি বলে সে জিনিস এড়িয়ে যাবার অন্ধিসন্ধি জানি। কিন্তু বিদেশ-বিভূইয়ে হঠাৎ বেমক্কা এ জিনিসের মুখোমুখি হয়ে পড়লে যে কী দারুণ নাভিশ্বাস ওঠে তার বর্ণনা দেবার মত ভাষা এবং শৈলী আমার পেটে নেই।
পশ্চিম ভারতে একবার এই কলচর।’ অথবা ‘কলচরড়া সমাজের পাল্লায় পড়েছিলুম। তার মর্মন্তব্দ কাহিনী নিবেদন করছি।
এক যুবতীর সঙ্গে কোনো এক চায়ের মজলিসে আলাপ হল। তিনি আমাকে তার বাড়িতে যাবার নিমন্ত্রণ করলেন। সুন্দরী রমণী। প্রত্যাখ্যান করি কি প্রকারে? তখন যদি জানতুম তিনি আমাকে বাঙালি অতএব ‘কলচরড়া’ ঠাউরে নিমন্ত্রণ করেছেন তাহলে ধর্ম সাক্ষী আমি কেটে পড়তুম। কারণ, আমি কলচরড়’ নই এবং পূর্বেই বলেছি। ও-জিনিসটাকে আমি বড্ড ডরাই।
সুন্দরী মোটর পাঠিয়ে দিয়েছিলেন। কাজেই বাড়ি খুঁজে বের করার মেহন্নত থেকে রেহাই পেলুম। গাড়ি এসে এক বিপুলায়তন বাড়ির সামনে দাঁড়াল। বাড়ি বলা হয়ত ভুল হল। সংস্কৃতে খুব সম্ভব এই বস্তুকেই ‘প্রাসাদ’ বলে।
কিন্তু সে কী অদ্ভুত বিভীষিকা। সঁচীর স্তুপ, অজন্তার প্রবেশদ্বার, অশোকের স্তম্ভ, মাদুরার মণ্ডপ, তাজের জালির কাজ, জামি মসজিদের আরাবেসক, ভারতবর্ষের তাবৎ সৌন্দর্য সেখানে যেন এক বিরাট তাণ্ডব নৃত্য লাগিয়েছে। যে ফিরিস্তিটা দিলুম সেটা পূর্ণাবয়ব কি না জানি নে এবং এসব স্থাপত্য কলার মর্ম এ অধম জানে না সেটাও সে সবিনয় স্বীকার করে নিচ্ছে। আমি সাহিত্য নিয়ে ঈষৎ নাড়াচাড়া করি, কারণ ঐ একমাত্র জিনিসই মাস্টার অধ্যাপকেরা আমাকে স্কুল-কলেজে ঠেঙিয়ে ঠেঙিয়ে কিছুটা শিখিয়েছেন। সাহিত্যের দৃষ্টিবিন্দু দিয়ে তাই যদি সে-প্রাসাদের বর্ণনা দিই। তবে বলতে হবে, আমি যেন এক কবিতার সামনে দাঁড়ালুম যার প্রথম লাইন চর্যাপদী, দ্বিতীয় লাইন চণ্ডীদাসী, তৃতীয় লাইন মাইকেলী, চতুর্থ লাইন রঙ্গলালী, পঞ্চম লাইন ঠাকুরী এবং শেষ লাইন নজরুলী। জানি, আজ যদি কেউ এই সব ক’জন মহাজনের শৈলী এবং ভাষা আয়ত্ত করে কাব্য সৃষ্টি করতে পারেন। তবে তিনি কি কালিদাস, কি সেক্সপীয়ার, কি গ্যেটে সর্ব যুগের সর্ব কবিরাজকে ছাড়িয়ে যেতে পারবেন। কিন্তু আমি যে বিভীষিকার সামনে দাঁড়ালুম সে তো তা নয়। এ যেন কেউ কঁচি দিয়ে নানান কবির লেখা নিয়ে হেথা থেকে দু’ছত্ৰ হোথা থেকে তিন পংক্তি কেটে গদ দিয়ে জুড়ে দিয়ে বলছে, পশ্য, পশ্য, কী অপূর্ব কবিতা; এ-কবিতা মাইকেল, রবীন্দ্রনাথ যে-কোনো কবির লেখাকে হার মানায় কারণ এ-কবিতা দুনিয়ার তাবৎ কবির বারোয়ারী চান্দা দিয়ে গড়া। বাঁদর হারালেও এখানে খুঁজে পাবে।’
তখনও পালাবার পথ ছিল, কিন্তু সুন্দরীর-যাকগে। না পালাবার জন্য আরেকটা কারণও মজুদ ছিল। এ বিভীষিকা দেখে গাঙ্গুলি মশাই অথবা ক্রামরিস বীবী পালাবেন, কিন্তু আমি তো ‘কলচরড়’ নই। আমি পালাব কেন?
ততক্ষণে এসে দাঁড়িয়েছি লিফটের সামনে। অপূর্ব সে খাঁচা। এতদিন বাদে আজ আর মনে নেই কোন কোন শৈলীর ঘুষোঘুষিতে (কোলাকুলিতে নয়) সে লিফটের চারখানা কাঠের পাট নির্মিত ছিল। প্রত্যেক পাটে অতি সূক্ষ্ম নাজুক, মোলায়েম দারুশিল্প। জয়পুরের মিনা যেন সূক্ষ্মতায় তার কাছে হার মানে।
ভিতরে ঢুকলুম। তখন লক্ষ্য করলুম। লিফটবয় দরজাখানা বন্ধ করল অতিশয় সন্তৰ্পণে—পাছে কাঠের চিকন কাজে কোনো জখম হয়। কিন্তু ফল হল এই যে লিফট আর উড্ডীয়মান হতে চায় না। বয় ধীরে ধীরে চাপ বাড়ায় কিন্তু লিফট নড়তে চায় না। তারপর হুস করে বলা নেই কওয়া নেই, লিফট উপরের দিকে চলল, পক্ষীরাজের বাচ্চা ঘোড়ার পিঠে হঠাৎ জিন লাগালে সে যে-রকম ধারা আচমকা লম্ফ দিয়ে ওঠে।
তারপর দোতলায় নামবার কথা—লিফট সেখান থামে না। থামলো গিয়ে আচম্বিতে দোতলা আর তেতলার মধ্যিখানে।
একে ত গাঁয়ের ছেলে, বয়স হওয়ার পর শহরে এসে প্রথম লিফট দেখেছি এবং তখনকার দিনে ধুতিকুর্তা পরা থাকলে লিফট চড়তে দিত না বলে এ ফাঁড়া থেকে প্রাণ বঁচাতে পেরেছি, তার উপর জানি দাড়াম করে দরজা বন্ধ না করলে ভালো লিফটও নড়তে চায় না এবং তার উপর দেখি এই ছোকরা চাকরি যাবার ভয়ে দরজার উপর জোর লাগাতেও রাজী হয় না। এই কলচরডু লিফটটাকে জখম চোটের হাত থেকে বাঁচাবার জন্য আমার প্রাণটা বলি দিতে হবে নাকি?
আমি তখন হন্যে হয়ে উঠেছি। ধমক দিয়ে বললুন, দরজা জোরে বন্ধ করো।’
সে করে না। এই মাগ্গীর বাজারে প্রেমের চেয়ে চাকরি বড়। প্রাণ জিনিসটা জন্মে জন্মে বিনা খরচে, বিনা মেহন্নতে পাওয়া যায়; কিন্তু চাকরির জন্য বিস্তর বেদরদ বেইজাতী সইতে হয়।
আমি আর কি করি? ধাক্কা দিয়ে ছোঁড়াটাকে পথ থেকে সরিয়ে দরজায় দিলুম বিপুল এক ধাক্কা। হুস করে লিফট উঠে গেল। তেতলায়। আমি দরজা খুলে নাবিতে যাচ্ছি, বয় চেচিয়ে বললে, ‘আপনি যাবেন দোতলায়, তেতলায় নয়।’ আমি বললুম, ‘তুমি যাও, চুলোয়।’ ছোকরা বাঙলা বোঝে না।
তেতলা থেকে সিঁড়ি ভেঙে নোমলুম দোতলায়।
ততক্ষণে লিফটের ধড়াধড় শব্দ শুনে সুন্দরীর ভাই-বেরাদর দু’একজন সিঁড়ির কাছে জমায়েত হয়ে গিয়েছেন। আমি ছোকরার চাকরি বাঁচাবার জন্য নিজের অপরাধ স্বীকার করলুম। ওঁরা যে-রকম ভাবে আমার দিকে তাকালেন তাতে মনে হল আমি যেন তাজমহলের উপর এটম বাম মেরেছি। অথবা ওস্তাদ ফৈয়াজ খানের গলা কেটে ফেলেছি।
‘কলচরড’ নই, তাই বলতে পারব না, ‘কলচর’ দেশ-কাল-পাত্র মেনে নিয়ে স্বতঃস্ফূর্ত হয় কি না। কিন্তু লিফটের ভিতরকার ‘কলচর’কে সম্মান দেখাতে গিয়ে আমি প্ৰাণটা দিতে রাজী নই। তাই বলছিলুম, আমি ‘কলচর’ জিনিসটাকে ডরাই।